আমরা কি জানি, পৃথিবীর প্রায় কোনো বিখ্যাত মানুষই তাঁদের মা-বাবার প্রত্যাশিত উপায়ে বড় হননি? তাঁরা প্রায় সবাই তাঁদের মা-বাবার প্রত্যাশার চাপ এড়িয়ে, মতের বাইরে গিয়ে, এমনকি তাঁদের মতের সাথে বিদ্রোহ করে ভিন্ন কিছু করে বিখ্যাত হয়েছেন।
একটি ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা দিয়ে শুরু করি। বেশ আগের কথা। তখন আমি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। থাকি জগন্নাথ হলে। পাশেই উদয়ন স্কুল। স্কুলের পাশ দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিলাম নীলক্ষেতের দিকে।
দেখলাম, আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন স্বনামধন্য শিক্ষক তাঁর মেয়েকে ভীষণভাবে বকাবকি করছেন। মেয়েটির অপরাধ, সে পরীক্ষায় একটু কম নম্বর পেয়েছে। বকুনির ধরনটা ছিলো এরকম, “তোমার লজ্জা হওয়া উচিৎ! এই রেজাল্ট করে তোমার মুখ দেখাতে লজ্জা করে না? আমার ভাবতে লজ্জা লাগছে যে, তুমি আমার মেয়ে। কিচ্ছু হবে না তোমাকে দিয়ে। তোমার মতো একটা গাধা মেয়ে জীবনে কিচ্ছু করতে পারবে না। আগে বাসায় চলো, তারপর দেখছি!”
অসহায় মেয়েটি বাবার পাশ দিয়ে হাঁটছে আর এসব অখাদ্য হজম করছে। ভীষণ খারাপ লাগলো দেখে। ওর অসহায়ত্ব দেখে আমিও অসহায় বোধ করছিলাম ওর জন্যে কিছু না করতে পেরে। আবার খুব ভালো লাগলো এই ভেবে যে, আমার কৃষক বাবা আমার পরীক্ষার ফলাফলের কোনো খবরই রাখতেন না। খবর যে রাখা দরকার, সেটাও তিনি মনে করতেন না। তখন খারাপ লাগতো। এখন ভাবি, সে যে কতো বড় এক স্বাধীনতা ছিলো!
প্রায় সবার মা-বাবাই তাদের সন্তানদের সত্যিকারের যোগ্যতা মূলায়ন করতে ব্যর্থ হন। প্রত্যাশার চাপ তৈরি করেন নিজের মতো, কোনো ঝুঁকি নিতে চান না কোনো মা-বাবাই। তাঁরা কী চান? তাঁদের সীমাবদ্ধ ধারণা থেকে বিশেষ ঝুঁকি নেই এবং বাজার দরে লোকে ভালো বলে এমন একটি পেশাই তারা পছন্দ করেন। অনেক ক্ষেত্রে বিয়ের বাজারে কদর আছে, এমন পেশার দিকে তাঁদের পছন্দ ঝুঁকে যায়। আমার বাবাও চেয়েছিলেন আমি বাজারে একটা দোকান-টোকান করি। একসময় স্বর্ণকারের দোকানে ভর্তি করে দেওয়ার কথাও বলেছিলেন। আর আমি ছিলাম চিরকালই তাঁদের অবাধ্য সন্তান। গ্রাম থেকে আমার ঢাকায় আসা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া, সবই ছিল তাঁদের মতের বিরুদ্ধে গিয়ে। এ কারণে আবার তাঁদেরকে দায়ী করা চলে না। কারণ তাঁরা তাঁদের বাস্তবতায় দাঁড়িয়ে তাঁদের মতো করে ভেবেছিলেন।
একবার ভাবুন তো, পৃথিবীর বিখ্যাত মানুষেরা যদি তাঁদের মা-বাবার কথা পুরোপুরি শুনতেন, তাহলে পৃথিবীর আজ কী অবস্থা হতো? বড় বড় ব্যবসায়ী নয়, পৃথিবী ছেয়ে যেতো মুদি দোকানীতে। বড় বড় লেখক নয়, তাঁরা তৈরি হতেন ছোট-বড় কেরানি হিসেবে। বাবার পছন্দমতো রবীন্দ্রনাথ ব্যারিস্টারি পাস করে ওকালতি করলে আমাদের কী ক্ষতিটাই না হয়ে যেতো! অথবা বাবার তুলে দেওয়া দায়িত্ব, মানে জমিদারী করেই যদি কাটিয়ে দিতেন? রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর বাবার কথা পুরোপুরি না শুনে বিরাট বাঁচা বাঁচিয়ে দিয়েছেন বাঙালিকে, তথা সমগ্র বিশ্ববাসীকে।
স্বামী বিবেকানন্দ জীবন শুরু করেছিলেন স্কুল শিক্ষক হিসেবে। সংসারে চরম অভাব তখন। যদি কেবল সেই সংসার চালানোর কথা ভেবে থেকে যেতেন স্কুল শিক্ষক হিসেবেই? কী হতো আমাদের? কত বড় এক সম্পদ আমরা হারিয়ে ফেলতাম!
অত্যন্ত মেধাবী ছাত্র নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বসুকে তাঁর উকিল বাবা তৈরি করছিলেন তৎকালীন ইন্ডিয়ান সিভিল সার্ভিসে যোগদানের উপযুক্ত করে। সেই মোতাবেক তাঁকে ইংলিশ মিডিয়ামে পড়ানো হয়েছিল প্রথমে, শেষে ইংল্যান্ডেও পাঠানো হয়েছিল। তিনি সেই সিভিল সার্ভিসে পরীক্ষায় বসলেন এবং চাকরিটা পেয়েও গেলেন। যদি তাঁর বিবেকের সায় না আসতো এবং বাবার নির্দেশমতো সিভিল সার্ভিসে যোগ দিতেনই, তাহলে ভারত থেকে ইংরেজদেরকে তাড়ানোয় কে অগ্রণী ভূমিকা পালন করতেন?
কলম্বাসকে কম বেগ পেতে হয়নি সমুদ্র অভিযানে নামতে। পড়াশোনায় অতি সাধারণ আইনস্টাইনের মা-বাবা হয়তো আশাও করেননি তাঁদের ছেলে এতো বড় হবে। তাঁদের কী যেন যন্ত্রপাতি তৈরির দোকান ছিলো। ভাগ্যিস সেই দোকানে সকাল সকাল ভর্তি করে দেননি তাঁরা।
অস্তিত্ববাদের প্রবক্তা ফরাসি দার্শনিক জাঁ পল সার্ত্রে তাঁর বাবাকে হারান আট বছর বয়সে; আর বারো বছর বয়সের সময় তাঁর মা আবার বিয়ে করেন। পরিণত বয়সে তিনি যখন যথেষ্ট নাম করেছেন, তখন সাংবাদিকের এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেছিলেন, “আমার জীবনের এক মস্তবড় সুযোগ যে, ছোটবেলাতেই আমি মা ও বাবা উভয়কেই হারিয়েছি। কারণ তাঁরা থাকলে আমি আমার মতো হতে পারতাম না। হয়তো তাঁদের ইচ্ছে মতো কিছু একটা হতাম”।
আমাদের মা-বাবা, পরিবার, সমাজ তাদের সাধারণ ধারণা থেকে আমাদের শিশুদের গায়ে তারা কে কেমন তার একধরনের লেভেল লাগিয়ে দেন। প্রত্যাশার চাপ তারা এড়াতে পারেন না। ধরুন, একজন শিক্ষার্থী আশা করছে সে একজন সফ্টওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার হবে, কিন্তু পরিবার থেকে বলা হলো তারা তাকে ডাক্তার বানাতে চায়। তাদের যুক্তি, আমাদের পরিবারে সবই আছে, এখন একজন ডাক্তার দরকার। অত্যন্ত খোঁড়া যুক্তি! নয়তো ভাবতে পারেন, ডাক্তার হওয়া কত ভালো! গর্ব করে বলা যায়। বিয়ের বাজারের চাহিদার কথা তো বাদই দিলাম। সন্তান কী করবে, কোনো দিকে গেলে ভালো হয়, সে নিজে কী চায়, সে কীসে ভালো— এগুলো সব গৌণ হয়ে যায় এসব ক্ষেত্রে।
তার মানে, মা-বাবা কি কোনো কিছুই করতে পারবেন না? কোনোরকম কর্তৃত্বই ফলাতে পারবেন না নিজের সন্তানের উপরে? প্রত্যাশার চাপ কি থাকবে না তাদের পক্ষ থেকে? এখানেই কবি খলিল জিব্রান বলছেন তাঁর বিখ্যাত কবিতা On Chilldren এ,
“Your children are not your children.
They are the sons and daughters of Life’s longing for itself.
They come through you but not from you,
And though they are with you yet they belong not to you.”
On Children, Kahlil Gibran
এবার দেখে আসি বিখ্যাত মানুষেরা কে কী বলেছেন আমাদের আজকের আলোচনার এই বিষয় নিয়ে। ইংরেজি সাহিত্যের বিখ্যাত নাট্যকার জর্জ বার্নার্ড শ বলেছেন, “Parentage is a very important profession, but no test of fitness for it is ever imposed in the interest of the children.”
তিনি আরও বলেছেন, “The best bought-up children are those who have seen their parents as they are. Hypocrisy is not the first duty of a parent.”
শিশু-শিক্ষার এক বৈপ্লবিক নাম মারিয়া মন্তেসরি। তিনি বলেছেন, “The child’s parents are not his makers but his guardians.”
আরেকটি কথা। আমরা কেউ কি ভেবেছি, আমাদের সবার সন্তান যদি হুবহু আমাদের মনের মতো হয় এবং আমাদের দেখানো পথ অক্ষরে অক্ষরে অনুসরণ করে, তাহলে পৃথিবীর উন্নতিই থেমে যাবে? আমাদের সন্তানেরা আমাদের থেকে এক প্রজন্ম এগিয়ে। তাদেরকে যদি আমাদের ধারণার আলোকে আমাদের মতো করে তৈরি করতে চেয়ে এভাবে এক প্রজন্ম পিছিয়ে রাখি, তাহলে তো তাই হবে।
তাহলে কী করবো আমরা মা-বাবারা? আবার শরণাপন্ন হতে হয় স্বামী বিবেকানন্দের। তিনি চারাগাছের বেড়ে ওঠার উদাহরণ দিয়ে বলেছেন, “মাটিটা একটু খুঁড়িয়া দিন, যাহাতে অঙ্কুর সহজে বাহির হইতে পারে। চারিদিকে বেড়া দিয়া দিতে পারেন, যাহাতে কোনো জীবজন্তু চারাটি না খাইয়া ফেলে; এইটুকু দেখিতে পারেন যে, অতিরিক্ত হিমে বা বর্ষায় যেন তাহা একেবারে নষ্ট হইয়া না যায়- ব্যাস, আপনার কাজ ঐখানেই শেষ!”
তাই বলি, আমরা যেন আমাদের প্রিয় সন্তানকে প্রত্যাশার চাপ দিয়ে পিষে না ফেলি। নিজে যা করতে পারিনি, তা সন্তানের মাধ্যমে দেখতে চেয়ে ওদের স্বাভাবিক বিকাশকে ক্ষতিগ্রস্ত যেন না করি। পরীক্ষায় কতো নম্বর পেলো; তার চেয়ে ঢের বেশি জরুরি কতোটা চিন্তা করতে শিখলো, কতোটা প্রশ্ন তৈরি করতে শিখলো।
আসুন, ওদের মানুষের কাছে নিয়ে যাই, প্রকৃতির কাছে নিয়ে যাই। গাছ-নদী-পাহাড়ের সাথে বন্ধুত্ব করাই। যতোটা সম্ভব, বাস্তব অভিজ্ঞতার মুখোমুখি করাই। ওদেরকে নিজের সিদ্ধান্ত নিজেদেরকেই নিতে দিই। প্রত্যাশার চাপ তৈরি না করে বা সুরক্ষার নামে বেড়া তৈরি করে আলোবাতাস প্রবেশ করা বন্ধ করে না দিই যেনো। ওরা অপার সম্ভাবনাময় শিশু, রেসের ঘোড়া নয়।
বাঁচতে হলে নিঃশ্বাস নেওয়া চাই। আসুন আমার আপনার শিশুকে খোলা হাওয়ায় বুক ভরে নিঃশ্বাস নিতে দিই।
লেখক পরিচিতি
সুদেব কুমার বিশ্বাস বাংলাদেশে একটি আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানে শিক্ষাবিষয়ক কর্মকর্তা হিসেবে কর্মরত রয়েছেন। তিনি বাংলাদেশের শিক্ষার নানা বিষয় নিয়ে নিয়মিত লেখালেখি করছেন।