কবি বলেছেন, “গ্রন্থগত বিদ্যা আর পরহস্তে ধন, নহে বিদ্যা নহে ধন, হলে প্রয়োজন”। অর্থাৎ, যে শিক্ষা শুধু বইয়ে সীমিত থাকে, যে শিক্ষার কোনো বাস্তব প্রয়োগ নেই, সেই শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা যুগে যুগে বারবার প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। শিক্ষার অনেকগুলো লক্ষ্য-উদ্দেশ্যের মধ্যে অন্যতম হলো— শিক্ষার্থী যাতে তার অর্জিত জ্ঞান বাস্তব জীবনে প্রয়োগ করে জীবনের উন্নতি করতে পারে। কিন্তু বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে, গ্রন্থগত বিদ্যা বা মুখস্থ বিদ্যা দিয়ে বাস্তব জীবনে সেই শিক্ষার প্রয়োগ খুব কমই হয়।
মুখস্থ করা বলতে এখানে বোঝানো হচ্ছে, কোনো বিষয়ের প্রেক্ষাপট, ইতিহাস, ব্যাখ্যা না জেনে কোনো উদ্দেশ্য পূরণের জন্য শুধু পড়ে পড়ে মনে রাখা। কাগজে যা ছাপা থাকে তাই-ই অনর্গল পড়ে পড়ে মুখস্থ করা। শিক্ষার্থীরা যখন মুখস্থ করে তখন বেশিরভাগ সময়ে সেই বিষয়ের ব্যাখ্যা না জেনেই মুখস্থ করে। আর এক্ষেত্রে উদ্দেশ্য হয় পরীক্ষার খাতায় প্রশ্নের উত্তর দিয়ে ভালো নম্বর পাওয়া।
মুখস্থ করা বলতে এখানে বোঝানো হচ্ছে, কোনো বিষয়ের প্রেক্ষাপট, ইতিহাস, ব্যাখ্যা না জেনে কোনো উদ্দেশ্য পূরণের জন্য শুধু পড়ে পড়ে মনে রাখা। কাগজে যা ছাপা থাকে তাই-ই অনর্গল পড়ে পড়ে মুখস্থ করা।
ভালো নম্বর পেয়ে ভালো ফল করা সব শিক্ষার্থীরই উদ্দেশ্য। কিন্তু এই উদ্দেশ্য পূরণের জন্য না বুঝে মুখস্থ করা অবশ্যই একটি নেতিবাচক ঘটনা। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, বীজগণিতের অংক করার জন্য সূত্র জানা ও মনে রাখা খুব জরুরি। তাই শিক্ষার্থী ব্যাখ্যা না জেনেই অংক করার জন্য প্রয়োজনীয় সূত্রগুলো মুখস্থ করে নিল। কিন্তু এই সূত্রগুলোও কীভাবে খুব সাধারণ অংক করে করেই বের করা যায় সেটি শিক্ষার্থী শিখতে পারলো না এই মুখস্থ করার কারণে।
আবার সময় স্বল্পতা বা বিভিন্ন কারণে শিক্ষকও অনেক সময়ে একদম গোড়া থেকে অংক করে শিক্ষার্থীদের এসব সূত্র ব্যাখ্যা করে বুঝিয়ে দেন না। অংকের মতো যুক্তি ও ব্যাখ্যায় ভরপুর মজাদার একটি বিষয় যে সকল কারণে বেশিরভাগ শিক্ষার্থীর কাছে দুঃস্বপ্নের, মুখস্থ করে পড়া ও পড়ানোর প্রবণতা তার মধ্যে অন্যতম। এমনটি শুধু গণিতের ক্ষেত্রেই নয়, দীর্ঘদিন ধরে প্রায় প্রতিটি বিষয়েই এমন হয়ে আসছে ।
মুখস্থ করার প্রবণতা শিক্ষার্থীর উদ্ভাবনী ও সৃজনশীল ক্ষমতাকে নষ্ট করে দেয়। কারণ মুখস্থ করার জন্য শিক্ষার্থীকে নিজে থেকে তার মস্তিষ্ককে কাজে লাগিয়ে কোনো কিছু করতে হচ্ছে না। ফলে আগে থেকে নির্ধারিত কোনো বিষয়ের বাইরে গিয়ে একই বিষয় নিয়ে শিক্ষার্থী নিজের মতো বিভিন্ন প্রেক্ষাপট কল্পনা করে সৃজনশীল চিন্তা করতে পারে না।
এবার ইতিহাস দিয়ে বিষয়টি ব্যাখ্যা করা যাক। ইতিহাস পড়ার সময়ে শিক্ষার্থীরা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দেখা যায় সাল, ঘটনা, নাম এসব মুখস্থ করছে। ইতিহাস সম্পর্কে বইয়ে যা ছাপা আছে, শিক্ষক মোটামুটি সেগুলোই শিক্ষার্থীদের পড়ে শোনান, ব্যাখা করে বুঝিয়ে দেন। অথচ এই বিষয়ের প্রতিটি অংশই দারুণভাবে অন্যান্য বিভিন্ন ঘটনার সাথে মিলিয়ে, তুলনা করে শিক্ষার্থীদের বোঝানো যায়। ঘটনাগুলোর ওপর নাটক বা অভিনয় করেও উপস্থাপন করা যায়। আবার অতীতের সাথে বর্তমান প্রেক্ষাপটের মিল করে শিক্ষার্থীদের মাঝে বিতর্কেরও আয়োজন করা যায়। ফলে সেই নাম, সাল বা ঘটনা মুখস্থ করার ওপরে নয়, তখন শিক্ষার্থীর মনযোগ থাকবে ইতিহাসের ঘটনাগুলোকে বিভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি থেকে ব্যাখ্যা ও তুলনা করার ওপর।
আবার খুব সাবলীলভাবেই মুখস্থ না করেও এসব তথ্য শিক্ষার্থীদের মনে থাকবে। বরং এভাবে শিখে তাদের আরও বেশিদিন মনে থাকবে। এভাবেই শিক্ষার্থীরা মুখস্থ না করে জ্ঞান আত্মস্থ করবে। আমাদের শিক্ষকরাও যথেষ্ট চেষ্টা করেন বিভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি থেকে ব্যাখ্যা করে শিক্ষার্থীদের পড়াতে। কিন্তু শুধু শ্রেণিকক্ষে পড়ানোর মধ্যে সীমিত থাকলে হবে না। শিক্ষণ-শিখন কার্যক্রম থেকে শুরু করে পরীক্ষা-মূল্যায়নেও পরিবর্তন আনতে হবে।
এই মুখস্থ করার প্রবণতাকে আমরা আত্মস্থ করার ধারণা দিয়ে প্রতিস্থাপন করতে পারি। এক নজরে হয়তো একই মনে হবে, কিন্তু সুক্ষ্ম পার্থক্য রয়েছে। আত্মস্থ ব্যাখ্যা করে আগে যেমনটা বলা হলো, অর্থাৎ শিক্ষার্থী যখন কোনো বিষয় আত্মস্থ করবে তখন সেই বিষয়ের বিভিন্ন প্রেক্ষাপট, ব্যাখ্যা, বিশ্লেষণও জানবে। ফলে খুব সাবলীলভাবেই বিষয়গুলো শিক্ষার্থীর মনে থাকবে।
আবার যেহেতু একটি বিষয় বিভিন্ন বিষয়ের সাথে মিলিয়ে খুব গভীরভাবে জেনে পড়ছে, সেহেতু সেই জ্ঞানটি তার জন্য দীর্ঘমেয়াদী হবে। যেমন, সেই বীজগণিতের সূত্রগুলো প্রথমে অংক করে বুঝানো যে সেগুলো কীভাবে এসেছে। অর্থাতৎ সূত্রগুলো যে শুধু মুখস্থ করেই শেখা যায় না, অংক করেও শেখা যায় তা শিক্ষার্থী বুঝতে পারবে। ফলে সে পরবর্তীতে যেকোনো বিষয়ে যতো সূত্র দেখবে তার শিখন ও কৌতুহল থেকে সে সেই সূত্রগুলোর ব্যাখ্যা খুঁজে বের করার চেষ্টা করবে। আর এই ব্যাখ্যা খুঁজে সূত্র বের করতে করতে শিক্ষার্থীর পূর্বজ্ঞানেরও ঝালাই হয়ে যাবে। তারপর এক-একটা সূত্র দিয়ে একসাথে বেশকিছু অংক করে সেগুলোর প্রয়োগ শেখানো হবে।
এই মুখস্থ করার প্রবণতাকে আমরা আত্মস্থ করার ধারণা দিয়ে প্রতিস্থাপন করতে পারি। এক নজরে হয়তো একই মনে হবে, কিন্তু সুক্ষ্ম পার্থক্য রয়েছে।
এভাবে শিখলে শিক্ষার্থী যেমন তার পূর্বজ্ঞানের সাথে নতুন জ্ঞানের সম্পর্ক স্থাপন করতে পারবে, তেমনি একটি বিষয়কে বিভিন্নভাবে ব্যাখ্যা করে প্রয়োগ করতে পারবে, জ্ঞানটিও হবে দীর্ঘমেয়াদী। অর্থাৎ শিক্ষার্থী পুরো বিষয়টি আত্মস্থ করে নিজের মধ্যে ধারণ করবে। এক্ষেত্রেও বলা যায়, এমনটি শুধু গণিতের ক্ষেত্রেই নয়, বরং সকল বিষয়ের ক্ষেত্রেই করা যায়।
অনেক শিক্ষক আপ্রাণ চেষ্টার পরও মন খারাপ করে বলতে পারেন, তাঁরা যথাসম্ভব চেষ্টা করেন শিক্ষার্থীদের মধ্যে থেকে মুখস্থের প্রবণতা দূর করার। তারপরও শিক্ষার্থীরা মুখস্থ করে। শিক্ষক তাঁর পক্ষে সম্ভাব্য সকল পদক্ষেপ নেওয়ার পরও অনেক সময়ে দেখা যায় শিক্ষার্থীরা মুখস্থ করার অভ্যাস ছাড়তে পারে না। সেক্ষেত্রে বলা যায়, সেসব শিক্ষার্থী হয়তো পূর্বে মুখস্থ করেই শিখে এসেছে।
পড়ালেখার একদম শুরু থেকে যদি কোনো শিক্ষার্থী মুখস্থ করে শেখার অভ্যাস গড়ে তোলে, তাহলে পরবর্তী জীবনে সেই অভ্যাস ত্যাগ করে উদ্ভাবনী, সৃজনশীল ও নতুন নতুন পদ্ধতিতে মানিয়ে নিতে একটু সময় লাগবেই। এক্ষেত্রে শিক্ষক যা করতে পারেন তা হলো তাঁর গতানুগতিক পড়ানো ও মূল্যায়নের ধরন পরিবর্তন করা। শ্রেণিতে যখন কোনো বিষয় পড়াচ্ছেন, তখন চেষ্টা করতে হবে শিক্ষার্থীদের বেশি বেশি প্রশ্ন করতে উতৎসাহিত করা, আবার সেসব প্রশ্নের উত্তর শিক্ষার্থীদের মাঝ থেকেই আদায় করে নেয়া।
কখনও শিক্ষার্থীরা ঠিক বলবে, কখনও ভুল বলবে। তারা ভুল করলে তা সংশোধন করে দিয়ে শিক্ষক তাদের জ্ঞানকে আরও সংগঠিত করে দেবেন। এরপর যখন তাদের মূল্যায়নের সময়ে আসবে তখন শিক্ষক শিক্ষার্থীদের বলে দেবেন তিনি আসলে কোন ধরনের জ্ঞান ও দক্ষতার মূল্যায়ন করবেন। প্রশ্ন করার সময়ে খেয়াল রাখতে হবে প্রশ্নের মাধ্যমে যেন প্রায়োগিক ও তুলনামূলক দক্ষতার যাচাই করা সম্ভব হয়। অর্থাৎ শুধু যেন শিক্ষার্থীর মুখস্থ করার ক্ষমতারই যাচাই না হয় তা খেয়াল রাখতে হবে।
তবুও এমন অনেক অনেক বিষয় আছে যেগুলো আসলে হুবহুই মনে রাখা প্রয়োজন। তবে তা শুধু খুব প্রাথমিক পর্যায়ের জন্য। সেগুলো মনে রেখে, সেগুলোর প্রয়োগ করে নিশ্চয়ই আরও উচ্চতর দক্ষতা অর্জন করা সম্ভব। অর্থাৎ এক্ষেত্রেও মনে রাখার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ হলো সেগুলোর প্রয়োগ করতে পারা, আরও বিভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি থেকে সেগুলোর ব্যাখ্যা ও তুলনা করতে পারা।
মুখস্থনির্ভর শিখন-শিক্ষণ ও শিক্ষাকার্যক্রম বহুকাল ধরেই চলে আসছে। আর এ-কারণেই প্রাথমিক থেকে উচ্চশিক্ষা পর্যন্ত শিক্ষার প্রায় প্রতিটি স্তরেই এমন শিক্ষার্থীর দেখা মিলবে যে মুখস্থের ওপর অনেকাংশে নির্ভরশীল। হঠাৎ করে তাদের শেখার ধরনে পরিবর্তন আনা কঠিন হবে।
মুখস্থনির্ভর শিখন-শিক্ষণ ও শিক্ষাকার্যক্রম বহুকাল ধরেই চলে আসছে। আর এ-কারণেই প্রাথমিক থেকে উচ্চশিক্ষা পর্যন্ত শিক্ষার প্রায় প্রতিটি স্তরেই এমন শিক্ষার্থীর দেখা মিলবে যে মুখস্থের ওপর অনেকাংশে নির্ভরশীল। হঠাৎ করে তাদের শেখার ধরনে পরিবর্তন আনা কঠিন হবে। তাই শিক্ষকদের প্রতিনিয়ত শিক্ষার্থীদের উৎসাহিত করতে হবে যেন তারা মুখস্থ করার অভ্যাস থেকে বেরিয়ে আসতে পারে। শিক্ষার্থীদের সামনে নতুন নতুন পদ্ধতি তুলে ধরতে হবে, তাদের মূল্যায়নের সময়ে স্পষ্ট করে বলে দিতে হবে মুখস্থ ছাড়া শিক্ষার্থীর কোন কোন দিক কোন মাপকাঠিতে কীভাবে মূল্যায়ন করা হবে।
শিক্ষক, শিক্ষার্থী এমনকি অভিভাবকসহ প্রত্যেকে আমরা নিজ নিজ জায়গা থেকে যদি ক্ষুদ্র স্বার্থ ভুলে বৃহৎ স্বার্থে একযোগে চেষ্টা করি, তাহলে শিক্ষা ও মূল্যায়ন ব্যবস্থা থেকে মুখস্থ করার প্রবণতাকে বিতাড়িত করা সম্ভব। মুখস্থ করার পরিবর্তে শিক্ষার্থীদের মাঝে আত্মস্থ করার অভ্যাস গড়ে তুলে তাদেরকে ভবিষ্যতের জন্য টেকসই জ্ঞানলাভে দক্ষ করে তুলতে হবে।
লেখক পরিচিতি
হিয়া মুবাশ্বিরা রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের শিক্ষার্থী।