অভিনন্দন আহ্‌মদ ইকরাম আনাম। আমরা আশা করবো, ভবিষ্যতে আপনার শক্তিশালী লেখনীর মাধ্যমে বাংলাদেশের শিক্ষাক্ষেত্রের এ ধরনের অনুচ্চারিত বিষয়গুলো তুলে আনবেন, পাশাপাশি সেগুলো কীভাবে সমাধান করা যায় তারও দিকনির্দেশনা আমরা আপনার কাছ থেকে আশা করি।

প্রিয় পাঠক, আপনারা জানেন যে, ২০১২ সালের জুন মাস থেকে ‘শুদ্ধস্বর-বাংলাদেশের শিক্ষা’ সেরা লেখা পুরস্কারের আয়োজন করা হয়েছে। পুরস্কারের নিয়মানুযায়ী, প্রতি তিন মাসে প্রকাশিত লেখাগুলো থেকে নির্ধারিত বিচারক একটি লেখা সেরা লেখা হিসেবে ঘোষণা দিবেন। পাশাপাশি কেন লেখাটি তাঁর কাছে সেরা বলে মনে হয়েছে, তারও একটি ব্যাখ্যা থাকবে বিচারকের পক্ষ থেকে। এই পুরস্কার-প্রক্রিয়ায় ‘বাংলাদেশের শিক্ষা’ ওয়েব সাইটের সঙ্গে যুক্ত রয়েছে প্রকাশনা সংস্থা ‘শুদ্ধস্বর’। সেরা লেখার লেখককে শুদ্ধস্বর থেকে প্রকাশিত ৫০০ টাকা মূল্যমানের বই প্রদান করা হবে।

আমরা আনন্দের সঙ্গে জানাচ্ছি যে, ২০১২ সালের জুলাই-সেপ্টেম্বর পর্যন্ত যেসব লেখা ‘বাংলাদেশের শিক্ষা’ ওয়েব সাইটে প্রকাশিত হয়েছে, সেগুলোর মধ্যে ‘স্বপ্ন ও বাস্তবতা: টানাপোড়েনে শিক্ষকতা’ লেখাটি বিচারকের কাছে শুদ্ধস্বর-বাংলাদেশের শিক্ষা সেরা লেখা হিসেবে নির্বাচিত হয়েছে। লেখাটি তৈরি করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের শিক্ষার্থী আহ্‌মদ ইকরাম আনাম। আর জুলাই-সেপ্টেম্বর ২০১২ প্রান্তিকের বিচারক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন ব্র্যাক শিক্ষা কর্মসূচির প্রোগ্রাম ম্যানেজার ও বাংলাদেশ ইংলিশ ল্যাঙ্গুয়েজ টিচার্স অ্যাসোসিয়েশন (বেল্টা)-এর ভাইস প্রেসিডেন্ট মাছুম বিল্লাহ

লেখাটি মূল্যায়ন করতে গিয়ে মাছুম বিল্লাহ বলেছেন:

কোনো লেখা বিচার করা একটি দুরুহ কাজ। এ সিরিজে (জুলাই-সেপ্টেম্বর ২০১২) মোট ১২টি লেখা ছিল। প্রতিটি লেখাই মূল্যবান তথ্যাদি দিয়ে সমৃদ্ধ। ১১টি লেখার মধ্যেই নতুন নতুন ধারণা ও উপাদান পেয়েছি। তিন-চারটি লেখা একেবারে একই মানের। তাই বিচার করার জন্য চুলচেরা পার্থক্য করতে খুবই কষ্ট হচ্ছিল। আমার বিচারে ‘স্বপ্ন ও বাস্তবতা: টানাপোড়েনে শিক্ষকতা’ লেখাটি বেশ কিছু কারণে শুদ্ধস্বর-বাংলাদেশের শিক্ষা পুরস্কারের জন্য শ্রেষ্ঠ মনে হয়েছে। এটি আমার নিজস্ব মতামত। পাঠকদের এ ব্যাপারে পরিবর্তিত মত থাকতে পারে।

লেখক আহ্‌মদ ইকরাম আনাম বলেছেন, “শিক্ষাবিজ্ঞানের নতুন নতুন তত্ত্ব ও কলাকৌশল যখন জানতে লাগলাম, তখন মনে মনে নিজের বিদ্যালয় জীবনের শিক্ষকদের প্রতি এক ধরনের ক্ষোভ জন্মাতে লাগল। আহা! আধুনিক শিক্ষাবিজ্ঞানের কত তত্ত্ব, কত নিয়মনীতি। এগুলো শ্রেণীকক্ষে প্রয়োগ করে কতোই না কার্যকরভাবে পড়ানো যায়। একেকজন শিক্ষার্থীকে পণ্ডিত না বানিয়ে এবারে আর ক্ষান্ত হচ্ছি না। আসন্ন শিক্ষকতার জন্য মহাপরিকল্পনা হাতে নিলাম। শ্রেণীকক্ষে এমন শিক্ষণ, পদ্ধতি প্রয়োগ করব যে সবাই টাশকি খেয়ে যাবে। আমরা আইইআরের শিক্ষার্থীরা এবার না জানি কী করে দেখাব। শ্রেণীকক্ষে বিপ্লব এনে দেব”।

তার পরক্ষণেই লেখক সত্যিকারভাবে উপলব্ধি করতে পেরেছেন শিক্ষকতা পেশা কতটা চ্যালেঞ্জিং, কতোট কষ্টের, কতটা ধৈর্য্যের। লেখকের নিজের কথায়- “যেদিন থেকে নিয়মিত ক্লাস নিতে শুরু করলাম, সেদিন থেকে বাস্তবতা অনুধাবন করতে পারলাম। নিজের বিদ্যালয় জীবনের শিক্ষকদের প্রতি সকল ক্ষোভ দূর হয়ে তার পরিবর্তে ভক্তি স্থান করে নিল। কীভাবে আমাদের শিক্ষকগণ আমাদের পড়াতেন? শ্রেণীকক্ষ যে এতটা চ্যালেঞ্জিং তা বিদ্যালয়ে ক্লাস না নিলে কোনোদিনও অনুধারন করা সম্ভব নয়। শিক্ষাবিজ্ঞানের তাত্ত্বিক বুলি বোধহয় গবেষণা প্রতিবেদন আর পাঠ্যবইয়েই সীমাবদ্ধ। বাস্তবতার সাথে তার বিস্তর ফারাক”। লেখক তাঁর বাস্তব অভিজ্ঞতা দিয়ে অনুধাবন করেছেন তত্ত্ব ও বাস্তব যে কত তফাৎ! শ্রেণীকক্ষের বাস্তবতা গবেষণার ফর্মুলা দিয়ে নিয়ন্ত্রণ করা যায় না। এটি একটি সর্বৈব সত্যি কথা। আমাদের  দেশে এখনও ধরে নেওয়া হয় যে, একজন শিক্ষক/কর্মকর্তা বা শিক্ষাপ্রশাসক যদি পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন, তাহলে তিনি সবকিছুই জানেন, সবসমস্যার সমাধান দিতে পারেন। আসলে ব্যাপারটি তা নয়। ব্যতিক্রম সব জায়গাতেই আছে, তবে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দেখা যায় একজন পিএইডি ডিগ্রিধারী যে বিষয়টি নিয়ে গবেষণা করেছেন, তিনি বিভিন্ন রেফারেন্স বই এবং মাঝেমধ্যে হয়ত কিছু বাস্তব অভিজ্ঞতা থেকেই তাঁর থিসিস লিখেছেন। ওই পর্যন্তই। তারপরে আর কোনো গবেষণা নেই, কাজ নেই, লেখা নেই। আর ওই থিসিস বাস্তবে মেলে না।

লেখক অনেক জায়গাতেই চমৎকার চমৎকার বাস্তব কথা বলেছেন। যেমন, “শ্রেণীকক্ষ ব্যবস্থাপনার জন্য অভিজ্ঞতার বিকল্প নেই। যতই প্রস্তুতি নিয়ে যাই না কেন, ক্লাসে এমন একেকটা ঘটনা বা পরিস্থিতির সম্মুখীন নিত্যদিন হতে হয় যে, সকল প্রস্তুতি মাঠে মারা যায়”। চমৎকার অভিজ্ঞতা! দীর্ঘ চৌদ্দ বছরের শিক্ষকতা জীবনে এই বাস্তব কথাটিই প্রত্যক্ষ করেছি আমি নিজেও বহুবার। অনেকে শুধু শিক্ষদেরই দোষ দিয়ে থাকেন শিক্ষা ব্যবস্থায় পরিবর্তন না আসার জন্য, শিক্ষার্থীরদের সঠিক শিক্ষা না দেওয়ার জন্য। অধিকাংশ মানুষই শিক্ষকদের সীমাবদ্ধতার কথা, অবহেলার কথা চিন্তা করেন না। লেখক শিক্ষকদের সম্পর্কে পাঠকদের জানিয়ে দিয়েছেন যে, শিক্ষাদান আসলেই কতটা চ্যালেঞ্জিং। তিনি একটি মহৎ কাজ করেছেন।

প্রশিক্ষণে শিক্ষার্থীর সংখ্যা নির্দিষ্ট থাকে বিধায় অনেক কাজই সেখানে করানো সম্ভব হয়; অথচ আমাদের শ্রেণীকক্ষ শতাধিক শিক্ষার্থী নিয়েও গঠিত হয়। সেখানে প্রশিক্ষণের আনেক বিষয়ই খাটে না। শিক্ষাকদের, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অনেক বাস্তবতার কথা, সীমাবদ্ধতার কথা লেখক চমৎকারভাবে তুলে ধরেছেন যেগুলোর সমাধান করার জন্য বাস্তবমুখী কোনো পদক্ষেপ নেই, আছে শুধু গবেষণা আর প্রতিবেদন। এর পরিবর্তন দরকার, দরকার আসল বাস্তবমুখী পদক্ষেপ।

এ সকল বিষয় বিচার-বিশ্লেষণ করে আমার কাছে এ লেখাই শ্রেষ্ঠ মনে হয়েছে।

বিচারক মাছুম বিল্লাহর নির্বাচন অনুসারে প্রথমবারের মতো শুদ্ধস্বর-বাংলাদেশের শিক্ষা পুরস্কারের দাবিদার হলেন আহ্‌মদ ইকরাম আনাম। অভিনন্দন আহ্‌মদ ইকরাম আনাম। আমরা আশা করবো, ভবিষ্যতে আপনার শক্তিশালী লেখনীর মাধ্যমে বাংলাদেশের শিক্ষাক্ষেত্রের এ ধরনের অনুচ্চারিত বিষয়গুলো তুলে আনবেন, পাশাপাশি সেগুলো কীভাবে সমাধান করা যায় তারও দিকনির্দেশনা আমরা আপনার কাছ থেকে আশা করি। খুব শিগগিরই আপনার ঠিকানায় পৌঁছে যাবে শুদ্ধস্বর থেকে প্রকাশিত ও আমাদের নির্বাচিত ৫০০ টাকা সমমানের অমূল্য উপহার- বই।

আমরা একইসঙ্গে শুদ্ধস্বর-বাংলাদেশের শিক্ষার পক্ষ থেকে ধন্যবাদ জানাতে চাই বিচারক মাছুম বিল্লাহকেও যিনি তাঁর মূল্যবনা সময় বের করে প্রতিটি লেখা পড়েছেন এবং সেরা লেখা নির্বাচন করেছেন। পাশাপাশি তিনি সেরা লেখা নির্বাচনের যে চমৎকার ব্যাখ্যা দিয়েছেন, সেটি থেকেও আমরা উপলব্ধি করতে পারি যে, লেখক আহ্‌মদ ইকরাম আনাম যে ভাবনার সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন আমাদের পাঠকদের, বিচারক সেটিকে তাঁর নিজ অভিজ্ঞতা থেকে মিলিয়ে পুরো বক্তব্যটিকে আরও শক্তিশালী করে তুলেছেন। বিচারকের প্রতি রইলো আমাদের কৃতজ্ঞতা।

নিচে পাঠকদের সুবিধার জন্য লেখক আহ্‌মদ ইকরাম আনামের বিস্তারিত পরিচয় তুলে ধরা হলো।

'শুদ্ধস্বর-বাংলাদেশের শিক্ষা" সেরা লেখা পুরস্কারের সেরা লেখক আহ্‌মদ ইকরাম আনাম
‘শুদ্ধস্বর-বাংলাদেশের শিক্ষা” সেরা লেখা পুরস্কারের সেরা লেখক আহ্‌মদ ইকরাম আনাম

আহ্‌মদ ইকরাম আনাম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউট থেকে ব্যাচেলর অব এডুকেশন (সম্মান) সমাপ্ত করে বর্তমানে সেখানেই শিক্ষা প্রশাসন বিষয়ে মাস্টার্স করছেন। স্নাতক পর্যায়ে লেখাপড়ার অংশ হিসেবে তিনি সাড়ে চার মাস ইউনিভার্সিটি ল্যাবরেটরি স্কুল অ্যান্ড কলেজে পূর্ণকালীন প্রশিক্ষণার্থী শিক্ষক হিসেবে কাজ করেন। শিক্ষকতা করতে গিয়ে ক্লাস নেয়া, প্রশ্ন করা, পরীক্ষা গ্রহণ, খাতা দেখা প্রভৃতি দায়িত্ব পালন করে তাত্ত্বিক শিক্ষার পাশাপাশি শিক্ষার প্রায়োগিক দিকসমূহও ভালোভাবে উপলব্ধি করেন। পাশাপাশি তিনি মোহাম্মদপুরে অবস্থিত টিচার ডেভেলপমেন্ট ইনস্টিটিউট থেকে প্রাকশৈশব শিক্ষার ওপরে সার্টিফিকেট কোর্স করেছেন। তিনি শিক্ষা বিষয়ে লেখালেখি করেন আইইআর জীবনের শুরু থেকেই। শিক্ষা-বিষয়ে তাঁর বিভিন্ন লেখা বাংলা ব্লগ সাইট সামহোয়ার ইন ও নিজস্ব ব্লগসাইটে প্রকাশিত হয়েছে। শিক্ষা-বিষয়ক প্রবন্ধের ওয়েবসাইট ‘বাংলাদেশের শিক্ষা’তেও তিনি শিক্ষার নানা বিষয় নিয়ে লিখেছেন। দেশের প্রথম বাণিজ্য-বিষয়ক বাংলা পত্রিকা বণিক বার্তায় কন্ট্রিবিউটর হিসেবে কিছুদিন লেখালেখি করেছেন। সেখানেও তাঁর লেখার মূল বিষয় ছিল শিক্ষা। উচ্চশিক্ষা-প্রশাসন বিষয়ে উচ্চতর পর্যায়ে পড়াশুনা করতে তিনি আগ্রহী। ভবিষ্যতে শিক্ষা-বিষয়ে কাজ করতে চান। উচ্চশিক্ষায় শিক্ষার্থী ব্যবস্থাপনা নিয়ে তাঁর বিশেষ আগ্রহ রয়েছে।

আমাদের এই উদ্যোগ বা শুদ্ধস্বর পুরস্কার সম্পর্কে আপনাদের কোনো প্রশ্ন, মতামত বা পরামর্শ থাকলে এখানে জানাতে পারেন। আশা করছি, এই উদ্যোগের প্রতিটি পর্যায়ে আপনাদেরকে আমরা সাথে পাবো। ধন্যবাদ।

Sending
User Review
0 (0 votes)

লেখক সম্পর্কে

সম্পাদক বাংলাদেশের শিক্ষা

এই লেখাটি সম্পাদক কর্তৃক প্রকাশিত। মূল লেখার পরিচিত লেখার নিচে দেওয়া হয়েছে।

মন্তব্য লিখুন

একটি মন্তব্য