সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয় : যেসব দিকে নজর দিতে হবে

দেশের ৬৯১টি সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয় এবং মাধ্যমিক শিক্ষা প্রশাসনে স্থবিরতা এবং অস্থিরতা নিরসন প্রয়োজন। তাতে দেশের ২০,৩৫৩টি মাধ্যমিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান উপকৃত হবে।

মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের দুটি শাখা। যথা, কলেজ শাখা এবং বিদ্যালয় ও পরিদর্শন শাখা। কলেজশাসিত মাউশির কলেজ শাখার আন্তঃক্যাডার বৈষম্য ছাড়া তেমন একটা বঞ্চনা না থাকলেও বিদ্যালয় ও পরিদর্শন শাখায় কর্মরত শিক্ষক/কর্মকর্তাদের ইতিহাস শোষণ-বঞ্চনার।

এ যেন স্বাধীন দেশেরই আরেক উপনিবেশবাদের গল্প। সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয় থেকে সদ্য বিদায়ী একজন শিক্ষক বিষয়টিকে এভাবে বলেছেন, ‘মাধ্যমিক যেন কলেজ শাখার কলোনীতে পরিণত হয়েছে।’ 

এখানে কর্মরত শিক্ষক-কর্মকর্তাগণ অপ্রাপ্তির নানা ধরনের হতাশায় নিমজ্জিত। ব্যানবেইজ পরিসংখ্যান ২০২২ অনুযায়ী দেশে বর্তমানে ২০৩৫৩টি মাধ্যমিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান রয়েছে এবং ৪৭৪৭টি কলেজ রয়েছে। তবে কলেজ শাখার সাধারণ শিক্ষা ক্যাডার সংখ্যায় কম হলেও মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের ৯৫ ভাগের বেশি পদে কলেজ শিক্ষকগণ (শিক্ষা ক্যাডার) বসে আছেন।

সঙ্গত কারণে দীর্ঘদিন ধরে প্রায় ৮১ শতাংশ (মাউশির অধীনে মোট প্রতিষ্ঠানের) মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে মানব সম্পদ ব্যবস্থাপনা কার্যক্রমের গতি মন্থর হয়ে আছে। তাছাড়া মাউশিতে কর্মরত প্রায় সকল কর্মকর্তা (প্রকৃত অর্থে তিনটি পদ ব্যতীত) কলেজ শিক্ষক হওয়ায় মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষকগণ অধিদপ্তরে তাঁদের দাপ্তরিক কাজের ক্ষেত্রে তেমন কোনো সুবিধা পান না, উল্টো অনেকক্ষেত্রেই নানা ধরনের ভোগান্তির শিকার হন।

এ শাখায় কর্মরত শিক্ষক/কর্মকর্তাদের চাকুরী শুরু হয় দশম গ্রেডে সহকারী শিক্ষক হিসেবে এবং এ পদের শিক্ষাগত যোগ্যতা বিসিএস সাধারণ শিক্ষা ক্যাডারের প্রবেশ পদের প্রাথমিক যোগ্যতার সমান। অতিরিক্ত যোগ্যতা হিসেবে বাধ্যতামূলকভাবে শিক্ষায় ব্যাচেলর ডিগ্রি, যা তাদের জন্য অতিরিক্ত কোনো সুবিধা তো নয়ই, বরং বঞ্চনাই যেন বাড়িয়ে দিয়েছে বলে সরকারি মাধ্যমিকের শিক্ষকগণ মনে করেন।

সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয় বা উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসারের কার্যালয়ে সহকারী শিক্ষক বা শিক্ষিকা/সহকারী মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসার নন ক্যাডার দশমগ্রেডভুক্ত পদটি বিষয় ভিত্তিক চার বছর মেয়াদি স্নাতক বা তিন বছর মেয়াদি স্নাতক পাসসহ স্নাতকোত্তর ডিগ্রি থাকার সাপেক্ষে নিয়োগযোগ্য।

এ ছাড়াও শিক্ষায় এক বছর মেয়াদী ব্যাচেলর ডিগ্রি (বিএড) থাকা বাধ্যতামূলকভাবে প্রয়োজন। সাত বছর চাকরি করার পর পরবর্তী ধাপে পদোন্নতিযোগ্য। তবে সহকারী উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসার পদটি বর্তমানে মাউশিতে কর্মরত কর্মচারীদের থেকে পদোন্নতি দিয়ে পূরণ করা হয়।

সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়/উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসারের কার্যালয়ে সিনিয়র শিক্ষক/উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসার নন-ক্যাডার ৯ম গ্রেডভুক্ত পদটি ২০১৫ সালে সৃষ্ট, তবে ১/১২/২০০৩ সালে পদটি ক্যাডার পদ হিসেবে সৃষ্টির উদ্যোগ ছিলো শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের। সহকারী শিক্ষক বা শিক্ষিকা/সমমান পদোন্নতি দিয়ে এ পদ পূরণ করা হয়। স্বপ্ন দেখানো হয় পরবর্তী ধাপে পদোন্নতি হবে।

কিন্তু জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের ১৫/১০/২০১৯ তারিখে জারিকৃত স্মারক নং সম/সওবা/প-২২/০৩( সি. স্কে. গে.) /অংশ( ১৮)১-২৫৮ এর ক্রমিক ‘গ’-এ পরিপত্র অনুযায়ী সমগ্রেডে পদোন্নতি বিধিসম্মত নয়। তাই সিনিয়র শিক্ষক/সমমান (নন ক্যাডার ৯ম গ্রেড) এবং সহকারী প্রধান শিক্ষক/সমমান (বিসিএস সাধারন শিক্ষা ক্যাডার ৯ম গ্রেড) দুটি পদই নবম গ্রেডে হবার কারণে পরবর্তী ধাপে পদোন্নতি দেয়া সম্ভব হচ্ছে না এবং এই বিধিমালা সংশোধনেরও কোনো উদ্যোগ নেই। ফলে মাধ্যমিকের বন্ধ্যাকরণ প্রক্রিয়া কার্যত এখান থেকেই শুরু হয়েছে বলে অনেকেরই বিশ্বাস।

সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয় বা জেলা শিক্ষা অফিসার কার্যালয়ে সহকারী প্রধান শিক্ষক বা শিক্ষিকা/সহকারী জেলা শিক্ষা অফিসার বিসিএস সাধারণ শিক্ষা ক্যাডার ৯ম গ্রেডভুক্ত একটি পদ। ২০১৩ সালে বাংলাদেশ সরকারি কর্ম কমিশন ‘বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিস (বয়স, যোগ্যতা ও সরাসরি নিয়োগের জন্য পরিক্ষা) বিধিমালা ২০১৪’ প্রণয়নের পূর্বে  বিসিএস (সাধারণ শিক্ষা) ক্যাডারভুক্ত নবম গ্রেডের সহকারী প্রধান শিক্ষক/সহকারী প্রধান শিক্ষিকা/সহকারী জেলা শিক্ষা অফিসার পদে নিয়োগের জন্য এই তিনটি পদের নাম বিসিএস পরীক্ষা বিধিমালায় সংযোজনের জন্য শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কাছে পত্র মারফত জানতে চায়।

শিক্ষা মন্ত্রণালয় কোনো ধরনের সদুত্তর না দেওয়ায় বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিস (বয়স, যোগ্যতা ও সরাসরি নিয়োগের জন্য পরীক্ষা) বিধিমালা ২০১৪ এর তফসিল-১ এর ১৩নং ক্রমে কলেজ শাখার দুটি প্রবেশ পদের পর (গ) সহকারী জেলা শিক্ষা অফিসার (ঘ) সহকারী প্রধান শিক্ষক (ঙ) সহকারী প্রধান শিক্ষিকা নামের পদগুলো সংযোজন করা সম্ভব হয়নি।

শিক্ষা মন্ত্রণালয় স্মারকের চিঠির কোনো জবাব না দেওয়ায় বিসিএস নিয়োগ বিধিতে পদটি যুক্ত করা হয়নি। ফলে উন্মুক্ত বিজ্ঞপ্তি দিয়ে নিয়োগ প্রক্রিয়া বন্ধ আছে। এই ধাপ থেকে পরবর্তী উচ্চতর ধাপ ষষ্ঠ গ্রেড প্রধান শিক্ষক/ জেলা শিক্ষা অফিসার পদে পদোন্নতির কোনো বাধা নেই। কিন্তু বিধিগত জটিলতার কারণে নিচের দিক থেকে পদোন্নতি দিয়ে এই ধাপে কাউকে আনা যাচ্ছে না বা নতুন করে কাউকে নিয়োগ করা যাচ্ছে না। ফলে উপরের দিকে শূন্যতা তৈরি হচ্ছে।

উপ-পরিচালকের কার্যালয়ে সহকারী বিদ্যালয় পরিদর্শক/পরিদর্শিকা বিসিএস-সাধারণ শিক্ষা ক্যাডারে নবম গ্রেডভুক্ত একটি পদ। পদটি ক্যারিয়ার পাথ বহির্ভূত সহকারী প্রধান শিক্ষক/সমমান পদ হিসেবে দুই বছর চাকরি করার পর এখানে পদায়ন করা হতো। কিন্তু নবম গ্রেড থেকে পরবর্তী ধাপে পদোন্নতিযোগ্য অষ্টম গ্রেডে কোনো পদ নেই।

পূর্বের পদসোপানে পদটি ছিলো কিন্তু বারবার পদটিকে আপডেট করার কথা বলা হলেও কর্তৃপক্ষ কোনো কথাই কানে তোলেননি। ফলে শিক্ষা প্রশাসনের নজরদারির অন্যতম পদটি কার্যত অকার্যকর হয়ে পড়েছে।

এ পদের গুরুত্ব বিবেচনায় নিয়ে জাতীয় শিক্ষানীতি-২০১০-এ শিক্ষা কার্যক্রম পরিদর্শনের জন্য প্রধান শিক্ষা পরিদর্শকের কার্যালয় স্থাপনের কথা বলা হয়েছে। এছাড়াও শিক্ষাক্রম বাস্তবায়নে তদারকের দায়িত্ব এই পদটির উপরে।

সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয় বা জেলা শিক্ষা অফিসারের কার্যালয়/উপপরিচালকের কার্যালয়/মাউশি প্রধান কার্যালয়ে প্রধান শিক্ষক/জেলা শিক্ষা অফিসার/সহকারি পরিচালক/বিদ্যালয় পরিদর্শক/পরিদর্শিকা বিসিএস সাধারণ শিক্ষা ক্যাডারে ষষ্ঠ গ্রেডভুক্ত একটি পদ। এই ধাপ থেকে পরবর্তী ধাপে পদোন্নতি প্রক্রিয়া দীর্ঘদিন যাবত বন্ধ আছে। ফলে মাউশি প্রধান কার্যালয়সহ অন্যান্য আঞ্চলিক কার্যালয় এর উপরের পদটি ভারপ্রাপ্ত দিয়ে দীর্ঘদিন ধরে চালানো হচ্ছে।

উপ-পরিচালকের কার্যালয়/মাউশি প্রধান কার্যালয়ে উপ-পরিচালক বিসিএস সাধারণ শিক্ষা ক্যাডারে ৫ম গ্রেডভুক্ত একটি পদ। পূববর্তী ধাপ থেকে এই ধাপে পদোন্নতি প্রক্রিয়া দীর্ঘদিন যাবত বন্ধ আছে। ফলে মাউশি প্রধান কার্যালয়সহ অন্যান্য আঞ্চলিক কার্যালয় পদটি ভারপ্রাপ্ত দিয়ে চালানো হচ্ছে।

মাউশি প্রধান কার্যালয়ে পরিচালক বিসিএস সাধারণ শিক্ষা ক্যাডারে চতুর্থ গ্রেডভুক্ত একটি পদ। Bangladesh civil service Recruitment, 1981 মোতাবেক পরিদর্শক/পরিদর্শিকা পদ হতে পদোন্নতি পেয়ে উপপরিচালক হওয়ার সুযোগ থাকলেও ১৯৮৯ সালের সংশোধনীতে উপপরিচালক পদ হতে পদোন্নতির ক্ষেত্রে ফিডার পদ হিসেব বিদ্যালয় পরিদর্শক/ পরিদর্শিকা পদের সাথে কলেজ শাখার সহযোগী অধ্যাপক ও টিটি কলেজের উপাধ্যক্ষ্যের একটি সমন্বিত গ্রেডেশন লিস্ট তৈরি করে পদোন্নতি বিধান চালু করা হয়। ফলে মাধ্যমিক থেকে এ পদে পদোন্নতির পথ প্রায় বন্ধ হয়ে যায়। এখন পদটি শিক্ষা ক্যাডার থেকে পূরণ করা হচেছ। 

এগুলোর বাইরে কিছু পরিসংখ্যানগত বৈষম্য এখানে আলোচনা করা হলো।

সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয় ও মাধ্যমিক শিক্ষা প্রশাসনের বর্তমানে কোনো সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয় সহকারী প্রধান শিক্ষক বা সহকারী জেলা শিক্ষা অফিসার পদে কেউ কর্মরত নেই। ৫০০টি সহকারী প্রধান/শিক্ষিকা সমমান ও ৬৪টি সহকারী জেলা শিক্ষা অফিসার পদ শূন্য রয়েছে। উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসারের প্রায় দুইশত পদ শূন্য রয়েছে। আরও অনেকগুলো শূন্য হওয়ার পথে।

এ বছরেই প্রায় সকল পুরনো সরকারি হাইস্কুলে প্রধান শিক্ষক ও প্রায় সকল জেলা শিক্ষা অফিসারের পদে শূন্য হয়ে যাবে। দেশে মোট সরকারি হাইস্কুল রয়েছে ৬৯১টি, যার মধ্যে ৩১৯টি পুরনো।

শিক্ষা প্রশাসনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ পদ উপ-পরিচালক আঞ্চলিক কার্যালয় এবং বিদ্যালয় পরিদর্শক পদগুলো দীর্ঘদিন যাবত শূন্য রয়েছে। উপ-পরিচালক পদগুলো জেলা শিক্ষা অফিসার/প্রধান শিক্ষকদের দিয়ে ভারপ্রাপ্ত করে কোনোমতে কাজ চালানো হচ্ছে। কিন্তু সহকারী বিদ্যালয় পরিদর্শক ও বিদ্যালয় পরিদর্শক পদগুলো ভারপ্রাপ্ত হয়েও বর্তমানে কর্মরত কেউ নেই। ফলে ১০ অঞ্চলে সহকারী বিদ্যালয় পরিদর্শক ১০ জন এবং বিদ্যালয় পরিদর্শক ১০ জন সম্পূর্ণরূপে শূন্য রয়েছে।

সহকারী প্রধান শিক্ষক বা সহকারী জেলা শিক্ষা অফিসার পদে পদোন্নতি না হওয়ার কারণে প্রধান শিক্ষক বা জেলা শিক্ষা অফিসার পদ এবং এর পরবর্তী উচ্চতর ধাপের পদসহ শিক্ষা প্রশাসনের সব গুরুত্বপূর্ণ পদ আগামী কয়েক বছর যাবত শূন্য থাকবে এবং বিধি সংশোধন না হলে এটা যুগ যুগ এরকমই চলতে থাকবে। এছাড়া প্রায় ১৯ বছর চাকরি করেও টাইম স্কেল বা সিলেকশন গ্রেড পাননি প্রায় ছয় হাজার শিক্ষক।

ডিজিটাল তথা স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্যে সরকার মাধ্যমিক পর্যায়ে ষষ্ঠ শ্রেণি থেকে আইসিটি বিষয়টি বাধ্যতামূলকভাবে  চালু করেছে। এরই ধারাবাহিকতায় সকল এমপিওভুক্ত বিদ্যালয়গুলোর জন্য ১৯৯৪ সাল থেকেই আইসিটি বিষয়ে শিক্ষকের পদ সৃজন ও নিয়োগ করা হলেও সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে এ বিষয়ে কোনো পদ সৃজনই এখন পর্যন্ত হয়নি।

এ ছাড়াও লিডিং প্রতিষ্ঠান হিসেবে সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে কম্পিউটার ল্যাব স্থাপন করা হলেও এখানে কোনো ল্যাব সহকারী নিয়োগ করা হয়নি। ফলে সরকারের কোটি কোটি টাকা ব্যয়ে স্থাপিত ল্যাবগুলো কার্যত অচল হয়ে পরে আছে।

অন্যদিকে এমপিওভুক্ত স্কুলগুলোতে ল্যাব সহকারী নিয়োগ করা হচ্ছে। এটি ভালো পদক্ষেপ, কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে সরকারি বিদ্যালয়গুলোতে ল্যাব সহকারী নিয়োগ হবে না কেন?

সরকারি মাধ্যমিকে ১৯৯৮ সালে প্রধান শিক্ষক (বিসিএস সাধারণ শিক্ষা ক্যাডার) হিসেবে নিয়োগপ্রাপ্ত হয়ে পরবর্তী উচ্চতর ধাপে পদোন্নতি না পেয়ে এ বছরে (২০২৪) প্রায় সকল প্রধান শিক্ষকই অবসরে চলে যাচ্ছেন বা ইতোমধ্যে অনেকেই চলে গেছেন।

সহকারী শিক্ষক ও সিনিয়র শিক্ষক পদকে ক্যাডার মর্যাদা প্রদানসহ সরকারি মাধ্যমিক শিক্ষক/শিক্ষিকাদের পদ-সোপানে ক্যাডার মর্যাদার নতুন একাডেমিক ধাপ সংযোজন করে তাদের পদোন্নতির সুযোগ না বাড়ালে শিক্ষক/শিক্ষিকাদের অনেকে আগামী তিন থেকে চার বছরের মধ্যে তাদের স্ব স্ব ভোগরত স্কেলের সর্বোচ্চ ধাপে পৌঁছে যাবেন।

ফলে আগামী তিন-চার বছরের মধ্যে তাদের বার্ষিক বেতন বৃদ্ধি বন্ধ হয়ে যাবে। এ-কারণে শিক্ষক/শিক্ষিকাগণ আগামী দুই/তিন বছরের মধ্যে বড় ধরনের আর্থিক ক্ষতির মধ্যে পড়তে যাচ্ছেন। ফলে এ খাতে কর্মরত শিক্ষক/কর্মকর্তাদের মধ্যে হতাশা বিরাজ করছে এবং এখানে বড় ধরনের বিশৃংখলা তৈরি হতে পারে বলে মাধ্যমিক নিয়ে কাজ করা বিদগ্ধজন মনে করেন।

উপরে বর্ণিত বিদ্যমান সোপানে উপযুক্ত সংস্কারের অভাবে সৃষ্ট বৈষম্য শিরোনাম অংশে বিদ্যালয় ও পরিদর্শন শাখা কর্মরত শিক্ষক/কর্মকর্তাদের বর্তমান পদ ও পরবর্তী ধাপে পদোন্নতিতে বিধিবিধানগত জটিলতা থাকার কারণে মাধ্যমিক শিক্ষা প্রশাসনের প্রায় সকল পদ ভারপ্রাপ্ত বা অনেক জায়গায় পদশূন্য অবস্থায় চলছে।

এতে দেশের মাধ্যমিক শিক্ষা প্রশাসন এবং মাধ্যমিক শিক্ষার আইডল খ্যাত জিলা স্কুলগুলোসহ অন্যান্য নামী সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের মতো প্রতিষ্ঠানগুলোর গুরুত্ব ও ঐতিহ্য ম্লান হতে চলেছে।

এছাড়াও দীর্ঘদিন পদোন্নতি বঞ্চিত হয়ে একই পদে অবস্থান করে শিক্ষক/কর্মকর্তাগণ হতাশার মধ্যদিয়ে অবসরে চলে যাচ্ছেন এবং নতুন মেধাবীরাও এখানে চাকরি নিয়ে এসে বেশিদিন থাকছেন না বা অনেকেই এ শাখায় চাকরি নিতে চান না। ফলে দেশের শিক্ষার জন্য অপূরণীয় ক্ষতি সাধিত হচ্ছে এবং আর্থিকভাবেও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে সরকার।

তাছাড়া ২০২৩ সাল থেকে চালু হওয়া নতুন শিক্ষাক্রম বাস্তবায়ন ও হুমকিতে পড়বে শিক্ষা প্রশাসনের এই অবস্থার কারণে। কারণ বিদ্যালয় ও পরিদর্শন শাখাকে দুর্বল করে এ শিক্ষাক্রম সঠিকভাবে বাস্তবায়ন কঠিন হয়ে পড়বে। হতাশায় নিমজ্জিত কোনো জনশক্তি দিয়ে ভালো ফলাফল আশা করা কতটা সমীচীন, সেটি আর একটি প্রশ্ন।

এ থেকে মুক্তির উপায় কী? পদোন্নতি প্রক্রিয়া শুরু করতে হলে একটি সুসামঞ্জস্য পদ সোপান প্রণয়ন করা অতীব জরুরি। সরকারের অন্যান্য দপ্তরের পদ সোপানের সাথে তুলনা করলে যে বিষয়টি চলে আসে সেটি হলো সরকারি মাধ্যমিকের প্রবেশ পদ এবং পরবর্তী ধাপ সিনিয়র শিক্ষক পদ মিলিয়ে নিচের এই দুটি পদকে ক্যাডারভুক্ত করলে খুব সহজেই এই জটিলতা নিরসন করা সম্ভব।

অন্যথায় বিদ্যমান পদ সোপানে ধাপগত যে জটিলতা রয়েছে তা সহজে নিরসন করে একটি সুসমাঞ্জস্য পদ সোপান প্রণয়ন বেশ দুরূহ। অনেক ক্ষেত্রেই তা সম্ভব নয় বলে মাধ্যমিক নিয়ে কাজ করা বিদগ্ধজন মনে করেন। মাধ্যমিকের সমস্যা সমাধানের জন্য একটি সুসামঞ্জস্য পদ সোপান প্রণয়ন করতে হবে। আর সেটি সুষ্ঠুভাবে করা সম্ভব স্বতন্ত্র মাধ্যমিক শিক্ষা অধিদপ্তর গঠনের মাধ্যমে।

লেখক পরিচিতি

মাছুম বিল্লাহ

মাছুম বিল্লাহ বাংলাদেশে ইংলিশ টিচার্স অ্যাসেসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ইট্যাব)-এর সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। তিনি পূর্বে ক্যাডেট কলেজ ও রাজউক কলেজের শিক্ষক হিসেবে কাজ করেছেন। কাজ করেছেন ব্র্যাকের শিক্ষা কর্মসূচিতে বিশেষজ্ঞ হিসেবে। তিনি ভাব বাংলাদেশের কান্ট্রি ডিরেক্টর হিসেবেও কর্মরত রয়েছেন। তিনি নিয়মিত শিক্ষাবিষয়ে নানা প্রবন্ধ লিখছেন।

জনপ্রিয় নিবন্ধ

প্রাথমিক স্তরে ভাষা শেখা : বিষয় – বাংলা

ভাষার দক্ষতা চারটি— শোনা, বলা, পড়া, লেখা। আর ভাষা...

আগে ইংরেজি গ্রামার শিখবো, নাকি ভাষা শিখবো?

কোন ভাষার গ্রামার হলো ঐ ভাষার গঠন প্রকৃতি যার...

শিক্ষাব্যবস্থার হালচাল

অর্থনীতিবিদদের মতে, শিক্ষা খাতে বিনিয়োগ সবচেয়ে লাভজনক এবং নিরাপদ রাষ্ট্রীয় বিনিয়োগ। অর্থনীতিবিদ এডাম স্মিথ, ডেভিড রিকার্ডো এবং মার্শালের মতে, শিক্ষা এমন একটি খাত যার কাজ হলো দক্ষ জনশক্তি গড়ে তুলে পুঁজির সঞ্চালন ঘটানো। শিক্ষার অর্থনীতি নিয়ে মৌলিক গবেষণায় অর্থনীতিবদ আর্থার শুল্জ ও রবার্ট সলো দেখিয়েছেন যে, প্রাথমিক শিক্ষায় বিনিয়োগ করলে সম্পদের সুফল ফেরত আসে ৩৫ শতাংশ, মাধ্যমিক শিক্ষায় ২০ শতাংশ, এবং উচ্চ শিক্ষায় ১১ শতাংশ।

আমেরিকায় উচ্চশিক্ষা : পিএইচডির পর কী?

আমেরিকায় উচ্চশিক্ষা নিয়ে প্রচুর লেখালেখি হয়, আমি নিজেও এ-নিয়ে...

ক্যাডেট কলেজে ভর্তি পরীক্ষা নিয়ে কিছু কথা

ক্যাডেটসমূহ বাংলাদেশের শিক্ষাঙ্গনে এক গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে আছে।...

আরও কিছু লেখা

অধিক

    যোগাযোগ বৈকল্য: যোগাযোগে অক্ষম করা এক ব্যাধি – পর্ব ৩

    যোগাযোগ বৈকল্য বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে তেমন পরিচিত রোগ না হলেও...

    ইংরেজি মাধ্যম এবং আন্তর্জাতিক ইংরেজি মাধ্যম স্কুলের লেখাপড়া

    ইংরেজি মাধ্যমের ছাত্রছাত্রীরা জাস্টিন বুইবেন বা অ্যাকর্ন-এর গান শোনে, তারা রুনালায়লা, সাবিনা ইয়াসমিন এবং লালনগীতি জানে না, জানে না মমতাজ কে। ইংরেজি মাধ্যমের একটি ছেলে বা মেয়েকে শুধুমাত্র ইংরেজি বলতে পারা এবং উপস্থাপন দক্ষতা ছাড়া প্রশংসা করার মতো তেমন আর কিছু নেই। তারপরও তারা যে শুদ্ধ ইংরেজি বলছে তা কিন্তু নয়। তারা আমাদের নিজস্ব কালচার সম্পর্কে অজ্ঞ, আমাদের সংস্কৃতিতে বিশ্বাস করে না বা শ্রদ্ধা দেখায় না। শিক্ষার যে মূল উদ্দেশ্য তা কিন্ত এখানে হচ্ছে না।

    দ্য আর্ট অফ টিচিং সাইন্স

    বিজ্ঞান শিক্ষণের ক্ষেত্রে প্রেষণা প্রদান না করলে বিজ্ঞান শিখনের প্রতি আগ্রহ তৈরি হবে না। এই সমস্যার সমাধান হলো, বিজ্ঞান শিক্ষণের কৌশল সম্পর্কে জানা অর্থাৎ আর্ট অফ সাইন্স টিচিং সম্পর্কে ধারণা লাভ করা।

    বিনামূল্যে বই বিতরণ এবং শিক্ষার গুণগত মান

    আমাদের দেশ সমাজতান্ত্রিক দেশ নয় যে সরকারকে সব বই বিনামূলে বিতরণ করতে হবে। তাছাড়া সরকারের সে ক্ষমতাও ভালোভাবে নেই। শিক্ষাখাতে রয়েছে প্রচুর সমস্যা, বোর্ডের বই কেনা খুব একটা সমস্যা নয় অনেকের জন্যই। এমনটি নয় যে, বোর্ডের বইয়ের অভাবে ছাত্রছাত্রীরা পড়াশুনা করতে পারছে না।

    শিক্ষা বনাম জ্ঞান: একটি মৌলিক বিবেচনা

    মুহাম্মাদ মিজানুর রশীদ শুব্র লিখেছেন শিক্ষা ও জ্ঞান প্রসঙ্গে শিক্ষা...

    বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা ও গবেষণা: পর্ব ৩

    সম্ভবত আমরা অধিকাংশই বুঝতেই পারি না, এটি আমাদের কতো...

    বাংলাদেশে শিক্ষাব্যবস্থায় বিদ্যমান সমস্যা সমাধানে প্রস্তাবনা

    আদর্শ শ্রেণিকক্ষে দক্ষ ও যোগ্য শিক্ষক যদি সময়ের চাহিদা পূরণে সক্ষম এমন বিষয়বস্তু সম্বলিত পাঠ্যপুস্তক অনুসরণ করে আধুনিক শিখন-শেখানো পদ্ধতিতে শিক্ষার্থীকে শিক্ষালাভে সহায়তা করেন এবং যথাযথভাবে মূল্যায়ন করেন তবেই সম্ভব হবে আকাঙ্ক্ষিত মাত্রায় শিখনফল অর্জন। সার্থক হবে শিক্ষাব্যবস্থা, অর্জন করা সম্ভব হবে শিক্ষার প্রকৃত লক্ষ্য

    মানসম্মত শিক্ষা ও বাংলাদেশ

    একুশ শতকে পৃথিবীজুড়েই শিক্ষা, বিশেষত মানসম্মত শিক্ষা, একটি কৌশলগত...

    প্রাসঙ্গিক নিবন্ধসমূহ

    নতুন লেখার খবর পান ইমেইলে
    বাংলাদেশের শিক্ষা প্রসঙ্গে নতুন লেখা প্রকাশিত হলে সেই খবর পৌঁছে যাবে আপনার ইমেইলে।