শিক্ষার মানের সঙ্কটকে, বিশেষ করে প্রাথমিক শিক্ষার, আমরা কোনোদিনই গুরুত্বের সাথে নিইনি। স্বাধীন বাংলাদেশ পঞ্চাশে পা দিতে চললো, তবুও এটুকু দূরদৃষ্টি অর্জিত না হওয়া আমাকে হতাশ করে। জনবহুল বাংলাদেশ কৃষিতে পূর্ণতা অর্জনের পথে, কেননা তার বিপুল জনগোষ্ঠির খাদ্যাভাব তাকে ভাবিয়েছে ঢের। অথচ খাদ্যের যোগানের পাশাপাশি এই জনগোষ্ঠিকে জনসম্পদে পরিণত করার যে তাড়না, তা তাকে তাড়িত করতে পারেনি। হয়তো সেজন্যই কৃষিতে আমরা যা পেয়েছি শিক্ষায় তা অধরা রয়ে গেছে।
কৃষিতে সাফল্যের পেছনের কারণ অনুসন্ধান করলে দেখা যাবে, কৃষক, কৃষিবিদ ও কৃষিবিজ্ঞানীর মেলবন্ধনে অনুকুল কর্মপরিবেশ সৃষ্টি, কৃষি গবেষণা ও উন্নয়নে সরকারের বিনিয়োগ, কৃষি বিষয়ে উচ্চশিক্ষার সুযোগ প্রসারিত করার মাধ্যমে দক্ষ কৃষিবিদ তৈরি ও দক্ষ কৃষিবিদের হাতেই কৃষির সকল ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে।
শিক্ষার ক্ষেত্রে তা কিন্তু হয়নি। বিশেষ করে প্রাথমিক শিক্ষা, যা শিক্ষার ভিত্তিভূমি রচনা করে। প্রাথমিক শিক্ষার মানোন্নয়নে বিগত দুই দশকের বেশি সময় ধরে চলমান ‘প্রাথমিক শিক্ষা উন্নয়ন কর্মসূচি’র নানা উদ্যোগ যেমন ব্যাপকভাবে শিক্ষক-প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা, বিদেশে উচ্চশিক্ষা ও প্রশিক্ষণ গ্রহণের সুযোগ বৃদ্ধি, সি-ইন-এড প্রশিক্ষণের মানোন্নয়ন ঘটিয়ে ডিপিএড প্রবর্তন ও এর সাথে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটকে যুক্ত করা, শিক্ষার জন্য উপবৃত্তি প্রদান, শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যসূচির পরিমার্জন, সময়মতো সকল শিশুর হাতে পাঠ্যপুস্তক তুলে দেওয়া, বিদ্যালয়ের ভৌত সুবিধার সম্প্রসারণসহ অনেক ক্ষেত্রে ইতিবাচক পরিবর্তন সূচিত হয়েছে।
প্রাথমিক শিক্ষার মতো একটি গুরুত্বপূর্ণ খাতকে পরিচালনার জন্য দক্ষ জনশক্তি তৈরির কার্যকর উদ্যোগ এখনও নেওয়া হয়নি। তাই প্রাথমিক শিক্ষা দক্ষ জনশক্তির সঙ্কটে পথ হারিয়েছে।
পাশাপাশি সরকারের নীতিনির্ধারণী পর্যায়েও নেওয়া হয়েছে উদ্যোগ। জাতীয় শিক্ষানীতি প্রণয়ন ও বাস্তবায়নে চেষ্টা সরকারের সদিচ্ছার প্রকাশ। ১৯৭৩ সালে জাতির জনকের এক ঘোষণায় ৩৬১৬৫টি প্রাথমিক বিদ্যালয়কে জাতীয়করণ করা হয়। সেই পথ অনুসরণ করে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী ২০১৩ সালে একযোগে ২৬১৯৬টি রেজিস্টার্ড বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়কে জাতীয়করণ করেন যা প্রাথমিক শিক্ষার প্রতি সরকারের অগ্রাধিকারকে তুলে ধরে। কিন্তু প্রাথমিক শিক্ষার মতো একটি গুরুত্বপূর্ণ খাতকে পরিচালনার জন্য দক্ষ জনশক্তি তৈরির কার্যকর উদ্যোগ এখনও নেওয়া হয়নি। তাই প্রাথমিক শিক্ষা দক্ষ জনশক্তির সঙ্কটে পথ হারিয়েছে।
শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষা বিষয়ে উচ্চশিক্ষা ও গবেষণার প্রাচীনতম প্রতিষ্ঠান হিসেবে ১৯৯৪ সাল থেকে শিক্ষায় সম্মানসহ স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রির প্রচলন করেছে। প্রতিষ্ঠানটি এখন পর্যন্ত প্রায় দু’হাজারের বেশি শিক্ষা-বিশেষজ্ঞ তৈরি করলেও দেশের শিক্ষা বিভাগ তাদের দক্ষতাকে কাজে লাগানোর প্রয়োজনবোধ করেনি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশাপাশি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় ও নোয়াখালি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়েও শিক্ষা বিষয়ে পাঠদান প্রক্রিয়া চলছে।
এসব শিক্ষা-বিশেষজ্ঞের অনেকে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থায় শিক্ষা-বিষয়ক কর্মসূচির উচ্চপদে দক্ষতার সাক্ষর রাখা সত্ত্বেও দেশীয় শিক্ষাব্যবস্থার সঙ্কট উত্তরণে এদের ডাক পড়েনি, ডাকা হয় বিদেশি বিশেষজ্ঞদের। আগেই বলা হয়েছে, দেশের অন্তত ছয়টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষা-বিষয়ে সম্মানসহ স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি প্রদানের ব্যবস্থা রয়েছে। দেশের শিক্ষাখাতে দক্ষ জনশক্তি যোগান দেওয়ার জন্য এটি শুভ উদ্যোগ। এই উচ্চশিক্ষার সুযোগকে দেশের শিক্ষাব্যবস্থার মূলস্রোতে যুক্ত করা এখন সময়ের দাবি।
দেশের প্রাথমিক শিক্ষার উন্নয়নের জন্য উচ্চতর গবেষণায় যেমন বিনিয়োগ দরকার, তেমনি বিদ্যমান সুবিধাকে কাজে লাগিয়ে কর্মকেন্দ্রিক গবেষণারও (অ্যাকশন রিসার্চ) প্রসার ঘটানো জরুরি। প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় গঠিত হবার পর আশা করা হয়েছিলো যে, প্রাথমিক শিক্ষার হাল ধরার মতো দক্ষ জনশক্তি তৈরির উদ্যোগ নেওয়া হবে। কৃষি, চিকিৎসা, প্রকৌশল কিংবা ব্যবসায় ব্যবস্থাপনার মতো প্রাথমিক শিক্ষা ব্যবস্থাপনায়ও যে দক্ষ শিক্ষক কিংবা শিক্ষাবিশেষজ্ঞের আবশ্যকতা রয়েছে, তা আমরা স্বীকার করিনি।
প্রাথমিক শিক্ষকেরা এখনও আত্মপরিচয়ের সঙ্কটে। কেননা শিক্ষকতা পেশার জন্য কোনো পূর্বপ্রস্তুতি ছাড়াই শিক্ষকরা এই পেশায় নিয়োগ লাভ করেছেন। শুধু তাই নয়, শিক্ষকদের পেশাগত কাজে সহায়তা দেওয়ার নিমিত্তে যে শিক্ষা প্রশাসন বা প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠানসমূহ গড়ে তোলা হয়েছে, সেখানেও শিক্ষকতা পেশায় অভিজ্ঞদের স্থান নেই।
আমি দীর্ঘ ১৫ বছর ধরে প্রাথমিক শিক্ষক প্রশিক্ষক (ইন্সট্রাক্টর) হিসেবে কাজ করছি। প্রথম যখন চাকুরিতে আসি, একধরনের উচ্চাশা নিয়েই এসেছিলাম। শিক্ষা-বিষয়ে দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ থেকে সম্মানসহ স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি নিয়ে নিজেকে শিক্ষাবিদ মনে করার স্পর্ধা আমাকে পেয়ে বসেছিল। সেই সাথে আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকগণের অনুপ্রেরণা এবং দেশের শিক্ষার মূলধারায় একজন তরুণ শিক্ষাবিদের অবদান রাখার আকাঙ্ক্ষাও কম তাড়িত করেনি।
আন্তর্জাতিক সংস্থার চকচকে ক্যারিয়ারকে ছেড়ে এসেছিলাম সম্ভবত সে-কারণেই। সেই ভাবনার ঘোর এখনও কাটেনি আমার। তা না হলে জাপান সরকারের বৃত্তি নিয়ে সেদেশে শিশুশিক্ষা নিয়ে পড়ালেখা ও কাজের অভিজ্ঞতাকে পুঁজি করে আবারও আন্তর্জাতিক সংস্থায় কাজের ডাককে উপেক্ষা করলাম কেন? অতঃপর যুক্তরাজ্যে শিক্ষা-বিষয়ে আরও একটি স্নাতকোত্তর ডিগ্রি নেওয়া এবং সেসব অভিজ্ঞতাকে প্রাথমিক শিক্ষায় কাজে লাগাবার মতো উন্মাদনা আমার হলো কেন?
বাংলাদেশের সরকারই আমাকে এবং আমার মতো আরও অনেককে শিক্ষা-বিষয়ে উচ্চতর ডিগ্রি নিতে যুক্তরাজ্যে পাঠিয়েছে প্রাথমিক শিক্ষা উন্নয়ন কর্মসূচির আওতায়। এখন দেখছি আমাকে এখানে কোনো প্রয়োজনই নেই। আমরা যে শিক্ষা নিয়ে ফিরে আসছি, তা কাজে লাগাবার মতো একটি সুযোগ তো থাকতে হবে বিদ্যমান ব্যবস্থায়! আমি আমার কর্মস্থলে ফিরে কর্তৃপক্ষের নির্দেশনার আলোকে সব কাজই করছি আগের নিয়মে। এখানে আমার নিজস্ব জ্ঞানের প্রয়োগাধিকার খুবই সীমিত।
বাংলাদেশের সরকারই আমাকে এবং আমার মতো আরও অনেককে শিক্ষা-বিষয়ে উচ্চতর ডিগ্রি নিতে যুক্তরাজ্যে পাঠিয়েছে প্রাথমিক শিক্ষা উন্নয়ন কর্মসূচির আওতায়। এখন দেখছি আমাকে এখানে কোনো প্রয়োজনই নেই। আমরা যে শিক্ষা নিয়ে ফিরে আসছি, তা কাজে লাগাবার মতো একটি সুযোগ তো থাকতে হবে বিদ্যমান ব্যবস্থায়! আমি আমার কর্মস্থলে ফিরে কর্তৃপক্ষের নির্দেশনার আলোকে সব কাজই করছি আগের নিয়মে। এখানে আমার নিজস্ব জ্ঞানের প্রয়োগাধিকার খুবই সীমিত। উপরন্তু, একটি উপজেলার প্রাথমিক শিক্ষার মানোন্নয়নে এবং প্রশিক্ষণের মাধ্যমে শিক্ষকগণের মানোন্নয়নে যে প্রতিষ্ঠানটি কাজ করবে বলে জন্ম নিয়েছিলো, সেই উপজেলা রিসোর্স সেন্টারও কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারেনি উপযুক্ত ব্যবস্থাপনার অভাবে।
জাতীয় প্রাথমিক শিক্ষা সপ্তাহ ২০১৯ (১৩-১৯ মার্চ)-এর প্রতিপাদ্য হলো, “প্রাথমিক শিক্ষার দীপ্তি, উন্নত জীবনের ভিত্তি”। এই প্রতিপাদ্যটিকে আমি সর্বান্তঃকরণে বিশ্বাস করি এবং লালন করি। তাই এরকম একটি প্রতিপাদ্যকে সামনে রেখে সাড়ম্বরে যে প্রাথমিক শিক্ষা সপ্তাহ উদযাপিত হচ্ছে, সেই উদযাপনকে ঘিরে আমার কিছু প্রত্যাশার কথা বলার চেষ্টা করেছি। উন্নত জীবনের ভিত্তি যে প্রাথমিক শিক্ষা, সেই শিক্ষাস্তরের একজন কর্মী হিসেবে আমার উপলব্ধিজাত এই লেখার অন্তরালে আমার পেশাগত বঞ্চনা কিংবা অব্যবস্থার কিছু অনিবার্য ব্যথার সুর হয়তো নেপথ্য সঙ্গীতের মত বেজেছে; কিন্তু সেটিও তো প্রাথমিক শিক্ষার অবিচ্ছেদ্য বাস্তবতা।
প্রাথমিক শিক্ষা নিয়ে আরও কিছু প্রাসঙ্গিক লেখা
- নতুন শিক্ষাক্রম : জাপানের সাথে তুলনা কতোটুকু প্রাসঙ্গিক?
- প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের বদলি এখন সময়ের দাবি
- কোভিড-১৯ পরিস্থিতি : বাংলাদেশের শিক্ষার আদ্যোপান্ত ও কিছু প্রস্তাব
- প্রাথমিকে প্যানেল শিক্ষক নিয়োগ: উত্তীর্ণদের কী হবে?
- শিক্ষা উদ্যান: অনন্য এক বিদ্যালয় মডেল
লেখক পরিচিতি
জগজ্জীবন বিশ্বাস খুলনা সদর থানা রিসোর্স সেন্টারে ইনস্ট্রাক্টর হিসেবে কর্মরত। জাপান থেকে পিজিডি ইন টিচার ট্রেনিং ও ইউকে থেকে এমএ ইন এডুকেশন সম্পন্ন করেছেন।