একুশ শতকে পৃথিবীজুড়েই শিক্ষা, বিশেষত মানসম্মত শিক্ষা, একটি কৌশলগত ইস্যু। অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি অর্জন করতে যেকোনো রাষ্ট্রকে শিক্ষানীতি, শিক্ষায় জেন্ডার সমতা, শিক্ষার বাজেট, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীদের উপস্থিতি ও মানসম্মত শিক্ষায় নিশ্চিতভাবেই গুরুত্ব দিতে হয়।
ইউনেস্কো তাদের বিভিন্ন কর্মকাণ্ড ও দলিলপত্রে টেকসই উন্নয়নের পরিপ্রেক্ষিতে মানসম্মত শিক্ষার ধারণা ও গুরুত্বকে বিশেষভাবে তুলে ধরেছে। ২০০৫ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত দশ বছর সময়কে জাতিসংঘ শিক্ষা দশক হিসেবে গণ্য করে ইউনেস্কো গুণগত শিক্ষার লক্ষ্য-উদ্দেশ্য, উপাদান ও কর্মপরিকল্পনা নির্ধারণ করেছে। ‘সবার জন্য শিক্ষা’ তাদের প্রধানতম লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে ‘সবার জন্য মানসম্মত শিক্ষা’।
বাংলাদেশ প্রায় তিন কোটি শিক্ষার্থীর শিক্ষার অধিকার বাস্তবায়নসহ নানা পর্যায়ের বৃত্তি, দরিদ্রদের বিদ্যালয়মুখী করার বিভিন্ন কার্যক্রম, শিক্ষার সঙ্গে খাদ্য, নারীশিক্ষা, শিক্ষাক্ষেত্রে বিনিয়োগ, সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন উদ্যোগের মাধ্যমে সর্বজনীন প্রাথমিক শিক্ষার লক্ষ্য ছুঁতে প্রায় সক্ষম হয়েছে।
উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে প্রাথমিক এবং মাধ্যমিক স্তরে ভর্তির হার। প্রাথমিক স্তর সম্পন্ন করা শিক্ষার্থীর হারও এখন শতভাগ ছুঁইছুঁই।
মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করতে সরকার কর্তৃক গৃহীত পদক্ষেপগুলোর মধ্যে রয়েছে পিইডিপি ৩ (প্রাথমিক স্তর), সেকেন্ডারি এডুকেশন কোয়ালিটি অ্যান্ড অ্যাকসেস এনহান্সমেন্ট প্রজেক্ট (সেকায়েপ), শিক্ষকদের মানোন্নয়নে টিকিউআই, উচ্চশিক্ষার মানোন্নয়ন প্রকল্প, ইংরেজি বিষয়ে দক্ষতা বৃদ্ধি করতে ইংলিশ ইন অ্যাকশন ইত্যাদি।
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অর্জন হলো, বর্তমান সরকার প্রতি বছর প্রায় ১১ কোটি নতুন রঙিন পাঠ্যপুস্তক শিশুদের হাতে তুলে দিচ্ছে বছরের একেবারে প্রথম দিনটিতে।
উৎসাহব্যঞ্জক এতসব সফলতার পরও বলতে হবে বাংলাদেশ কাঙ্ক্ষিত মানসম্মত শিক্ষা অর্জন করতে পারেনি। বিভিন্ন সময়ের সরকারগুলোর শিক্ষানীতির দুর্বলতা, ত্রুটিপূর্ণ কর্মপরিকল্পনা, অগ্রাধিকার ভিত্তিতে কার্যপরিধি নির্বাচনের অদক্ষতা এবং শিক্ষকদের নিম্নমান প্রাথমিকভাবে মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করতে না পারার পেছনে দায়ী।
মানসম্মত শিক্ষার অপরিহার্য উপাদান হলো আধুনিক ও যুগোপযোগী শিক্ষাক্রম, পর্যাপ্ত সংখ্যক যোগ্য শিক্ষক, প্রয়োজনীয় শিক্ষাদান সামগ্রী ও ভৌত কাঠামো, যথার্থ শিক্ষণ-শিখন পদ্ধতি, কার্যকর বিদ্যালয় ব্যবস্থাপনা ও তত্ত্বাবধান, ধারাবাহিক পরিবীক্ষণ, উপযুক্ত মূল্যায়ন পদ্ধতি, ভারসাম্যপূর্ণ শিক্ষক-শিক্ষার্থী অনুপাত, শিক্ষার্থীদের শিখন দক্ষতা অর্জন, পাঠদান ব্যাপ্তি ইত্যাদি। বাংলাদেশে প্রাথমিক স্তর অতিক্রম করা শিক্ষার্থীদের মধ্যে মাত্র এক-তৃতীয়াংশ ভাষা ও গণিতে দক্ষতা অর্জন করে (বাংলাদেশ এডুকেশন সেক্টর রিভিউ, ২০১৩)।
একজন শিক্ষক এই অপর্যাপ্ত বেতনভাতা দিয়ে আত্মমর্যাদা নিয়ে সমাজে চলতে পারেন না। এ-কারণে যারা শিক্ষকতাকে পেশা হিসেবে নিয়েছেন, তারা চাকুরি পাল্টাতে সদাতৎপর অথবা বিদ্যালয়ে শিক্ষকতার পাশাপাশি অর্থ-উপার্জনের নানা কাজের সাথে জড়িত।
বিভিন্ন গবেষণায় বলা হচ্ছে, প্রাথমিক স্তর পেরুনো শিশুদের প্রায় অর্ধেক ইংরেজিতে শুদ্ধ করে একটি সরল বাক্য লিখতে পারে না। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক স্তরে সর্বোচ্চ জিপিএ-প্রাপ্ত শিক্ষার্থীরা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষাগুলোতে পাশই করতে পারছে না। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা প্রায়শই বলে থাকেন, গত দশ-পনের বছরে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ভর্তি হওয়া শিক্ষার্থীদের মান নিম্নগামী।
শিক্ষাব্যবস্থার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হচ্ছে শিক্ষক, যিনি পাঠদান করেন। অথচ আমাদের দেশে শিক্ষকের নিদারুণ সঙ্কট থাকা সত্ত্বেও বিদ্যমান শিক্ষকদের আমরা ভালোভাবে কাজে লাগাতে পারছি না। একটি দেশে শিক্ষক নিয়োগের যোগ্যতা, শিক্ষকদের বেতনভাতা, শিক্ষকদের সামাজিক মর্যাদা সেই দেশের শিক্ষার মান সম্পর্কে এক ধরনের ধারণা তৈরি করে।
শিক্ষক নিয়োগে যোগ্যতা ন্যূনতম হওয়া সত্ত্বেও এখনো বাংলাদেশে শিক্ষক নিয়োগে দুর্নীতি চলছে। তাছাড়া বিদ্যমান ব্যবস্থায় যোগ্য শিক্ষার্থীদের শিক্ষকতা পেশায় নিয়ে আসা প্রায় অসাধ্য। এখানে শিক্ষকদের বেতনভাতা, সামাজিক সুবিধা-মর্যাদা এত কম যে, কেউই শিক্ষকতাকে পেশা হিসেবে বেছে নিতে আগ্রহ পান না। যারা আছেন তারা খুবই হতাশাগ্রস্থ।
আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষক বলছিলেন, “পিতার অগাধ সম্পত্তি না থাকলে ভালো শিক্ষার্থীদের শিক্ষকতায় আসা বোকামি।” কেউ কি ভাবতে পারেন বাংলাদেশে একজন শ্রমিকের ন্যূনতম মজুরি এবং একজন প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকের বেতন প্রায় সমান?
একজন শিক্ষক এই অপর্যাপ্ত বেতনভাতা দিয়ে আত্মমর্যাদা নিয়ে সমাজে চলতে পারেন না। এ-কারণে যারা শিক্ষকতাকে পেশা হিসেবে নিয়েছেন, তারা চাকুরি পাল্টাতে সদাতৎপর অথবা বিদ্যালয়ে শিক্ষকতার পাশাপাশি অর্থ-উপার্জনের নানা কাজের সাথে জড়িত।
এসব কিছুর চূড়ান্ত ভুক্তভোগী আমাদের কোমলমতি শিক্ষার্থীরা। ঊনচল্লিশটি দেশে গবেষণায় দেখা গেছে, শিক্ষকদের ১৫% বেতন বৃদ্ধির কারণে শিক্ষার্থীদের শিখন দক্ষতা ৬%-৮% বৃদ্ধি পেয়েছে (সবার জন্য শিক্ষা, ২০১৪)।
শিক্ষকদের দুর্বল বিষয় দক্ষতা এবং প্রশিক্ষণের অভাব মানসম্মত শিক্ষার পথে অন্যতম অন্তরায়। বাংলাদেশে ৭৩% সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক এবং ৭০% রেজিস্টার্ড বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের বিষয়ভিত্তিক প্রশিক্ষণ নেই।
শিক্ষক প্রশিক্ষণের প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো অত্যন্ত দুর্বল এবং এর শিক্ষাক্রম বহুলাংশে তাত্ত্বিক। তাছাড়া শিক্ষক স্বল্পতার কারণে কোনো ধরনের পূর্বজ্ঞান বা প্রশিক্ষণ না থাকা সত্ত্বেও তাঁদের একের অধিক বিষয়ে পাঠদান করতে হয়।
শিক্ষাখাতে বাজেট অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। একটি দেশের জিএনপির অন্তত ৬% শিক্ষার জন্য ব্যয় করা উচিত। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, শিক্ষাখাতে জাতীয় বাজেটের কমপক্ষে ২০% বরাদ্দ প্রদান করা দরকার।
প্রত্যন্ত অঞ্চলগুলোতে একজন শিক্ষক একাধিক ক্লাসে পাঠদান করছেন একই সময়ে। ফলে বিষয়ভিত্তিক জ্ঞান-দক্ষতা বৃদ্ধি এবং বিভিন্ন স্তর ও বয়সভেদে পাঠদান পদ্ধতি সম্পর্কে সকল শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ নিশ্চিত করা প্রয়োজন। প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত শিক্ষকদের ওপর ক্লাসের চাপ বেশি পড়ছে এবং যার কোনো আর্থিক সুবিধাও তাঁরা পান না।
ফলে সেসব শিক্ষকদের যতটুকু মান রয়েছে, সে অনুসারেও তাঁরা পাঠদানে ব্যর্থ হচ্ছেন। আমাদের শিক্ষাক্রমের দুর্বলতার কারণে শিক্ষকরা কার্যকর প্রশিক্ষণ গ্রহণে আগ্রহী হন না। শিক্ষাক্রমে জীবনঘনিষ্ঠ উপাদানের অভাব এখনও রয়েছে।
শিক্ষকরা ভালো করে জানেন না যে শিক্ষাক্রমে কী বলা আছে, শিক্ষককে কী কী বিষয় জানতে হবে, শিক্ষার্থীরা কী জানবে, কতটুকু জানবে এবং কীভাবে জানবে। বিভিন্ন স্তরের শিক্ষাক্রম এখনো বহুলাংশে মুখস্থবিদ্যার ওপর নির্ভরশীল।
যদিও সৃজনশীল পদ্ধতি একটি নির্দিষ্ট মাত্রায় চালু করা হয়েছে; কিন্তু শিক্ষকের তুলনায় অতিরিক্ত শিক্ষার্থী, সৃজনশীল প্রশ্নপত্র রচনায় পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণের অভাব, বাজারের সৃজনশীল গাইডের ওপর নির্ভরশীলতা— এসব কারণে সৃজনশীল পদ্ধতিকে নতুন করে সাজানোর বিষয়টি নিয়ে অনেকে ভাবছেন।
এছাড়া শিক্ষকদের বছরব্যাপি সরকারি বিভিন্ন প্রয়োজনে ব্যস্ততা, জাতীয়-আন্তর্জাতিক ছুটি এবং দেশের রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার কারণে বিদ্যালয়ে পাঠদানের বার্ষিক সময় কমে যাচ্ছে যা মানসম্মত শিক্ষার স্বীকৃত পাঠদানকালের চেয়ে বেশ কম।
শিক্ষাখাতে বাজেট অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। একটি দেশের জিএনপির অন্তত ৬% শিক্ষার জন্য ব্যয় করা উচিত। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, শিক্ষাখাতে জাতীয় বাজেটের কমপক্ষে ২০% বরাদ্দ প্রদান করা দরকার।
সারাবিশ্বের নিম্ন বা নিম্ন-মধ্যআয়ের দেশগুলো যেখানে শিক্ষাখাতে বাজেট বরাদ্দ ক্রমাগতহারে বাড়াচ্ছে, বাংলাদেশে সেখানে ২০১৩-২০১৪ অর্থবছরে শিক্ষাখাতে বরাদ্দ মাত্র ১২%। শিক্ষাখাতে অধিক বরাদ্দ দিতে প্রয়োজনে অনুৎপাদনশীল খাত থেকে কর্তন করে শিক্ষার জন্য বাজেট বৃদ্ধি করতে হবে।
২০০২ সাল থেকে ২০১০ পর্যন্ত ধারাবাহিকভাবে দাতাগোষ্ঠীগুলো আর্থিক সহায়তা বাড়তে থাকলেও ২০১০-২০১১ অর্থবছরে আর্থিক সহায়তার হার প্রায় ৭% কমেছে। এখুনি যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ না করলে হয়তো সবার জন্য মানসম্মত শিক্ষার অধিকার বাস্তবায়নের দৌড়ে আমরা পিছিয়ে পড়ব।
শিক্ষাখাতের বরাদ্দ ঠিকমতো মনিটরিং করাও দরকার। অভিযোগ আছে, যে কাজে বরাদ্দ প্রদান করা হয়েছে, সে কাজে তা ব্যয় করা হচ্ছে না। দাতাগোষ্ঠীগুলো অন্যদিকে তাদের বহুমাত্রিক সহায়তার দ্বার সাম্প্রতিক সময়ে সংকুচিত করে আনছে।
২০০২ সাল থেকে ২০১০ পর্যন্ত ধারাবাহিকভাবে দাতাগোষ্ঠীগুলো আর্থিক সহায়তা বাড়তে থাকলেও ২০১০-২০১১ অর্থবছরে আর্থিক সহায়তার হার প্রায় ৭% কমেছে। এখুনি যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ না করলে হয়তো সবার জন্য মানসম্মত শিক্ষার অধিকার বাস্তবায়নের দৌড়ে আমরা পিছিয়ে পড়ব।
বাংলাদেশ অত্যন্ত সম্ভাবনাময় একটি দেশ। ইউরোপ-আমেরিকায় যখন অর্থনীতির মন্দা পরিস্থিতি বিরাজ করছে, তখনও বাংলাদেশের অর্থনীতি গতি হারায় নি। বিভিন্ন সঙ্কট মোকাবিলা করেও বাংলাদেশের জিডিপি ৬%-এর বেশি। এটি সম্ভব হয়েছে আমাদের দারুণ প্রতিশ্রুতিশীল জনশক্তির জন্য।
- শিক্ষার মান ও শিক্ষাধ্বংসের কালপঞ্জী : ১৯৭২—২০২২
- প্রশ্নফাঁস ও শতভাগ পাশ: কাঠামোগত, সংগঠনগত ও ব্যবস্থাপনাগত ভিত্তি
- প্রয়োজন সুস্থির, সুনির্দিষ্ট ও পরিকল্পনামাফিক শিক্ষাউন্নয়নের রূপরেখা
- ওমর শেহাবের ‘নতুন শিক্ষাক্রমে দুটি বড় ভুল’ : একটি ‘ব্যক্তিগত’ প্রতিক্রিয়া
- ভাষাশিক্ষা ও সাহিত্যের মধ্যে সম্পর্ক : নতুন শিক্ষাক্রমে ইংরেজি শেখাতে সাহিত্য কতোটা ব্যবহারযোগ্য?
বাংলাদেশ বর্তমান সময়ে এমন একটি পর্যায়ে রয়েছে যখন দেশে উপার্জনক্ষম মানুষের সংখ্যা গত এক শতকে সবচেয়ে বেশি। এই জনশক্তিকে মানবসম্পদে রূপান্তরিত করতে পারলেই বাংলাদেশের টেকসই উন্নয়ন সম্ভব। টেকসই উন্নয়নের সাথে টেকসই সাক্ষরতার সংযোগ অত্যন্ত নিবিড়। আর টেকসই সাক্ষরতা একমাত্র মানসম্মত শিক্ষার মাধ্যমেই নিশ্চিত করা সম্ভব। সরকারের ‘ভিশন ২০২১’ বাস্তবায়নে তাই মানসম্মত শিক্ষার বিকল্প নেই।
লেখক পরিচিতি
হাসান তৌফিক ইমাম চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটে শিক্ষকতা করছেন।