বাংলাদেশের প্রাথমিক শিক্ষার মান নিয়ে বর্তমান সময়ের শিক্ষার্থী, অভিভাবক এমনকি শিক্ষাসংশ্লিষ্টগণও সন্তুষ্ট নন। এর প্রধান কারণ হচ্ছে, প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পাঠদানের যথাযথ পরিবেশ না থাকা। প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের বদলি কি এখন সময়ের দাবি? কারণ এর সঙ্গে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মানের একটি সম্পর্ক রয়েছে।
প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার মান নিয়ে নানা প্রশ্ন রয়েছে, রয়েছে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের অভিভাবকদের নানাবিধ প্রশ্ন। যদিও প্রাথমিক শিক্ষার মান নিয়ে এসব প্রশ্নের নানা ধরন রয়েছে, কিন্তু অধিকাংশ প্রশ্নই মূলত শিক্ষককে কেন্দ্র করে। এসব প্রশ্নের উত্তর কে দেবেন?
অভিভাবকদের মতে, “যদি পঞ্চম শ্রেণির শিক্ষার্থীরা বাংলা পড়তে না পারে তাহলে অন্য কোনো বিষয়ে ভালো পারার সুযোগ কোথায়? শিক্ষকের একমাত্র কাজ হচ্ছে শিশুদের শিখন নিশ্চিত করা, আসলে ওনারা কি করছেন? শিক্ষকগণ দাবি করেন করোনার কারণে শিশুদের শিখন ঘাটতি তৈরি হয়েছে, কিন্তু বিদ্যালয় তো ২০২১ সালের সেপ্টেম্বর মাসে খুলেছে যা প্রায় দু’বছর হতে চললো; তবে প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির শিক্ষার্থীরা দেখে পড়তে পারে না কেন? শিক্ষকদের এত বেতন তবুও তারা বাসায় প্রাইভেট পড়ায় কেন? সরকার এত টাকা খরচ করছে বিদ্যালয়ে, বিনামূল্যে লেখাপড়ার ব্যবস্থা নিয়েছে, উপবৃত্তি দিচ্ছে তবুও শিশুদের কাছ থেকে টাকা নেওয়া হয় কেন?”
অভিভাবকদের উপর্যুক্ত মৌলিক প্রশ্নগুলোর উত্তর খোঁজার জন্য আমরা যাই বিদ্যালয়ের সহকারি শিক্ষক থেকে শুরু করে সর্বোচ্চ কর্তৃপক্ষের কাছে। তাঁদের কাছে শিক্ষার পরিবর্তন বলতে যেসব বিষয় প্রাধান্য পাচ্ছে, সেগুলোর মধ্যে এখন বিদ্যালয়ে সহকারী শিক্ষক হিসেবে উচ্চ শিক্ষিতরা নিয়োগ পাচ্ছেন, অবকাঠামোগত নানাবিধ পরিবর্তনের কথাও শিক্ষার উন্নয়নের মাপকাঠি হিসেবে তাঁরা দেখাতে চাচ্ছেন।
প্রশ্ন হলো, প্রাথমিক শিক্ষায় উচ্চশিক্ষিতদের নিয়োগ কতোটা জরুরি? কে ভালো পড়াচ্ছেন? উচ্চশিক্ষিতরা না-কি তুলনামূলকভাবে কম শিক্ষিতরা? এ বিষয়ে কোথাও কি নির্দিষ্ট তথ্য রয়েছে? বর্তমানে একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে কমপক্ষে পাঁচজন শিক্ষক রয়েছেন। পাঁচ শিক্ষকবিশিষ্ট বিদ্যালয়ের গড় শিক্ষার্থী সংখ্যা একশত এর বেশি নয়। যদি উক্ত বিদ্যালয়ে সরকারের মাসিক খরচ দুই লক্ষ টাকা হয়, তবে প্রতি মাসে শিক্ষার্থী প্রতি খরচ প্রায় দুই হাজার টাকা এবং বছরে প্রায় চব্বিশ হাজার টাকা। প্রশ্ন হলো, এত বিনিয়োগের ফলে শিক্ষার্থীর শিখনের অগ্রগতি কতটুকু হচ্ছে?
শিক্ষার মান বাড়াতে যুগে যুগে শিক্ষা কমিশন গঠন করা হচ্ছে, শিক্ষাক্রম পরিমার্জন করা হচ্ছে, শিক্ষাক্রম সংশোধন করা হচ্ছে, শিক্ষক এবং কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষিত করা হচ্ছে। সময়ে সময়ে এরকম নানা উদ্যেগ গ্রহণ করা হচ্ছে। তারপরও শিক্ষার মান প্রতিনিয়ত নিচের দিকেই যাচ্ছে কেন? এ প্রশ্নের উত্তরে শিক্ষক এবং কর্মকর্তাগণ নানাবিধ সমস্যার কথা উল্লেখ করে থাকেন; যেখানে নিজে ব্যতীত অন্য সবাই যার যার দায়বদ্ধতার জায়গা থেকে সঠিক কাজটি করছেন না তেমনটিই উঠে এসেছে। অর্থাৎ, উদোর পিণ্ডি বুদোর ঘাড়ে দিয়েই সবাই দায়মুক্ত হতে চাচ্ছেন।
রাজনৈতিক চাপ, অভিভাবকের অসচেতনতা, বিদ্যালয় ব্যবস্থাপনা কমিটির উদাসীনতা এসব গৎবাধা সমস্যার কথা বলে নিজের দায় এড়িয়ে যাচ্ছেন সকলে। প্রত্যেকে মনে করছেন, তাঁরা তাঁদের নিজের কাজটি করে যাচ্ছেন। আমাদের সরল মন বুঝতে পারছে না, কে শিশুর সবচেয়ে নিকটে থাকেন? অবশ্যই বাড়িতে মা-বাবা এবং বিদ্যালয়ে শিক্ষক। অতএব শিক্ষক যদি সঠিক কাজটি না করেন তাহলে প্রাথমিক শিক্ষা সচিব মহোদয় যতোই যোগ্য এবং আন্তরিক হন না কেন, শিশুকে শেখানো কি আদৌ সম্ভব?
এছাড়াও বড় প্রশ্ন হচ্ছে, শিক্ষকগণ কি আসলেই সঠিক দায়িত্বটি পালন করছেন না? নাকি দায়িত্ব পালনের যথাযথ পরিবেশ পাচ্ছেন না? বর্তমান সময়ে শিক্ষকদের একটা বড় অংশই উচ্চতর ডিগ্রিসম্পন্ন, প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত এবং বেশিরভাগই নিজের সুবিধাজনক স্থানে পোস্টিং নিয়ে রয়েছেন। তারপরও শিশুর শেখার অগ্রগতি আমাদেরকে তৃপ্ত করতে পারছে না কেন? সমস্যাটি কোথায়?
শিক্ষাসংশ্লিষ্ট নানারকম অংশীজনের সাথে মতবিনিময় করে একটি বিষয় স্পষ্ট যে, প্রাথমিক বিদ্যালয়ে যেসব শিক্ষক দীর্ঘদিন ধরে একই বিদ্যালয়ে চাকুরি করে আসছেন, তাদের তুলনায় নতুন নিয়োগপ্রাপ্ত বা বদলি হয়ে আসা শিক্ষকগণ পাঠদানে অনেক বেশি আন্তরিক। দীর্ঘদিন ধরে একই বিদ্যালয়ে চাকুরি করার ফলে শিক্ষকগণ কর্মস্পৃহা হারিয়ে ফেলেন এবং সাথে সাথে স্থানীয়ভাবে নানারকম দায়বদ্ধতায় জড়িয়ে পড়েন।
ফলে তাঁদের সাথে শিশু এবং অভিভাবকদের সম্পর্কটা অনেকটা ফেলনা হয়ে ওঠে এবং ক্ষমতার একটি বলয় তৈরি হয়, যা শিখন পরিবেশ তৈরিতে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে থাকে। পুরাতন শিক্ষকগণ শিক্ষার্থীদের দিয়ে ব্যক্তিগত কাজ করানো, অভিভাবকদের থেকে বাড়তি সুবিধে নেয়া, গ্রুপিং এবং অর্থনৈতিক কেলেঙ্কারি পর্যন্ত ঘটাতে পারেন। এসবের একটি বড় প্রভাব হচ্ছে, তা শিশুদের শিক্ষায় বড় প্রভাব ফেলে।
কর্তৃপক্ষ চাইলে খুব সহজেই শিক্ষার পরিবেশ সৃষ্টি করতে পারেন। সব সমস্যা দূর হয়ে যাবে যদি শিক্ষকদেরকে একটি নির্দিষ্ট সময় পর পর বদলি করা হয়। তবে এটিই একমাত্র সমাধান নয়; উত্তম কাজের জন্য পুরস্কৃত করা, দায়িত্বে অবহেলার জন্য শাস্তির ব্যবস্থা, এসবও থাকতে হবে।
প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের বদলির ব্যবস্থা চালু করতে পারলে শিক্ষায় একটি যুগান্তকারী পরিবর্তন আসবে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন। বিভিন্ন শিক্ষকের বিভিন্নরকম সক্ষমতা এবং অভিজ্ঞতা থাকে, নির্দিষ্ট মেয়াদে শিক্ষকদের বদলি হলে সেই সক্ষমতা এবং অভিজ্ঞতাসমূহ সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ছড়াতে থাকবে যা সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে একটি কাছাকাছি মানের মধ্যে রাখবে।
শিক্ষকদের বদলি নিশ্চিত করা গেলে শিক্ষকগণ পাবেন নিত্য নতুন সহকর্মী, শিক্ষার্থী এবং অভিভাবক; যাদের সাথে ওনারা নব উদ্যমে চমৎকার চমৎকার উদ্যোগ নেবেন। অন্যদিকে নতুন নতুন শিক্ষককে পেয়ে শিক্ষার্থী এবং অভিভাবকও খুশি থাকবে। শিক্ষকদের মধ্যে মনোমালিন্য থাকলে তারা ঠিকমতো পাঠ পরিচালনা করতে পারে না। সেই পাঠ শিশুদের কাছেও ভালো লাগে না।
শিক্ষকদের বদলি এখন সময়ের দাবি। তবে, প্রথমেই শিক্ষকদের বদলির বর্তমান নীতিমালা সংশোধন করতে হবে। এক বিদ্যালয়ে যাদের পনেরো বছর হয়ে গিয়েছে তাদের তালিকা করতে হবে। সেই পদগুলো শূন্য দেখিয়ে সার্ভার খুলে দেওয়া দরকার যেখানে একই বিদ্যালয়ে যারা পনের বছরের বেশি সময় ধরে রয়েছেন তাঁরাই কেবল আবেদন করতে পারবেন । তাঁদের বদলি হয়ে গেলে দশ বছর ধরতে হবে, এরপরে পাঁচ বছর।
দূরত্বের ভিত্তিতে বদলি নয়, বদলি হবে জ্যেষ্ঠতার ভিত্তিতে। জ্যেষ্ঠতার তালিকার প্রথম দিকে থাকবেন স্থানীয় শিক্ষক। তার পরে থাকবেন সেসব শিক্ষক যারা ইতোপূর্বে অন্য উপজেলা থেকে বদলি হয়ে এসেছেন। শিক্ষকদের বদলি প্রক্রিয়ায় শিক্ষকদের মানের একটি গ্রেডিং থাকা উচিত। সেটি হলে মিশ্র প্রেডের ভিত্তিতে একটি বিদ্যালয়ে শিক্ষক বণ্টন করা যাবে।
তাহলে কোনো একটি বিদ্যালয়ে সকল শিক্ষক দক্ষতাসম্পন্ন বা কোনো বিদ্যালয়ে সকল শিক্ষক কম দক্ষতাসম্পন্ন হবার সুযোগ থাকবে না। শিক্ষকদের বদলি দীর্ঘদিন যাবৎ বন্ধ থাকার অন্যতম কারণ হচ্ছে ঘুষ বাণিজ্য, যা বদলিতে বৈষম্য তৈরি করে থাকে; অতএব ঘুষ বাণিজ্য বন্ধ করার জন্য কঠোর আইনও এবং পরিবীক্ষণ থাকতে হবে।
প্রশ্ন থাকে যে, অন্যান্য দেশে কি বাধ্যতামূলক শিক্ষকদের বদলির ব্যবস্থা রয়েছে কিংবা শিক্ষার সকল স্তরে কি শিক্ষকদের বদলি বাধ্যতামূলক করা উচিত?
আমার প্রস্তাব হচ্ছে, অন্যান্য দেশের আর্থসামাজিক অবস্থা, শিক্ষকের সুযোগ-সুবিধা, সম্মান, বিদ্যালয় মনিটরিং ব্যবস্থা, স্বচ্ছতা এবং জবাবদিহিতা ব্যবস্থার সাথে যেহেতু বাংলাদেশের ব্যবস্থা মিলবে না, তাই অন্য দেশে কী আছে বা কী নেই সেটি মূখ্য হওয়া উচিত নয়। তবে এটি শিক্ষার সকল স্তরে চালু করা গেলে অবশ্যই শিক্ষায় ভালো ফলাফল আশা করা যাবে।
যেহেতু বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি বরাদ্দ প্রাথমিক শিক্ষায় এবং একটি বড় সংখ্যক প্রাথমিক বিদ্যালয় জাতীয়করণ করা হয়েছে, তাই পরীক্ষামূলকভাবে এটি প্রাথমিক স্তর থেকেই শুরু করা যেতে পারে। একটা বিদ্যালয়ে দীর্ঘ সময় চাকরি করে যে প্রচ্ছন্ন পরিবেশ তারা সৃষ্টি করেছেন এই পরিবেশ পরিবর্তন করতেই হবে।
লেখক পরিচিতি
মো: সাইদুল হক বাংলাদেশে একটি বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থায় শিক্ষাবিশেষজ্ঞ হিসেবে কর্মরত রয়েছেন।