স্বাধীনতার পর থেকে এখন পর্যন্ত বাংলাদেশের শিক্ষার মান উন্নয়নে গৃহীত সিদ্ধান্ত এবং তার ফলাফলগুলো পর্যবেক্ষণ করলে প্রত্যক্ষ ইতিবাচক যুক্তি ও প্রচারণার আড়ালে একটা পরোক্ষ ও গভীর নেতিবাচক ফলাফল পাওয়া যায়। এই ফলাফলগুলোর সম্মিলিত যোগফল নিয়ে গত অর্ধশতাব্দীকাল ধরে বাংলাদেশের শিক্ষার মানের ক্রমাগত পতনের কথা নানা সামাজিক মতামতে যেমন পাওয়া যায়, তেমনি নানা তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণেও এর চিত্র ফুটে ওঠে।
কিছু সরকারী-বেসরকারী গবেষণা-প্রতিবেদনে তার সাক্ষ্যও মেলে। আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে, প্রতিটি পদক্ষেপ গ্রহণের আগে আশ্বাসবাণী যতোখানি জোরের সাথে শোনানো হয়, বাস্তবায়নের পর দেখা যায় ঠিক ততোখানিই হতাশা চারপাশে ছড়িয়ে পড়েছে। এবং তখন আশ্বাস প্রদানকারী সেই একই কর্তৃপক্ষ আগেকার ব্যর্থতার কোনো ব্যাখ্যা না দিয়েই নবতর দাওয়াই-সহ আরো প্রবলতর আশ্বাসবাণী নিয়ে হাজির হন।
এই সব পোশাকী দাওয়াই এবং তাদের দ্বারা সৃষ্ট ফলাফলগুলো পর্যবেক্ষণ করলে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের আর্থসামাজিক ও রাজনৈতিক বিকাশপথ বা ডিরেকশনের সাথে শিক্ষা-উন্নয়নে গৃহীত এসব সিদ্ধান্তের একটা গভীর যোগসূত্র পাওয়া যায়। এই আলোচনার লক্ষ্য সেই সূত্রগুলোর প্রাথমিক অনুসন্ধান। আর এই অনুসন্ধান সীমাবদ্ধ থাকবে শুধু শিক্ষার সাধারণ ধারার মধ্যে।
আলোচনার সুবিধার্থে পুরো সময়টাকে দশকওয়ারী ভাগ করে সে-সময়ে গৃহীত পদক্ষেপগুলোকে কিছু প্রশ্ন আকারে এনে তার কর্তৃপক্ষীয় মহৎ উত্তর খোঁজার পাশাপাশি ফলাফল হিসাবে যা ঘটেছে তার এক ধরণের পর্যবেক্ষণ উপস্থাপনের চেষ্টা করা হয়েছে। পাশাপাশি এসব উন্নয়নাকাঙ্ক্ষী পদক্ষেপ বা সিদ্ধান্তের কিছু কার্যকারণ খোঁজারও চেষ্টা করা হয়েছে।
এক. মুক্তিযুদ্ধের পর প্রথম দশক (১৯৭২—১৯৮০)
প্রশ্ন ১ : ১৯৭২ সালের এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষা কেন শর্ট সিলেবাসে হয়েছিল? কেনই-বা অন্যান্য শ্রেণীতে অটোপাশ দেওয়া হয়েছিল?
মহৎ উত্তর : মুক্তিযুদ্ধের কারণে সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান একটানা প্রায় ৩৪০ দিন বন্ধ ছিল। ফলে শিক্ষার্থীরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল, অনেকে মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছিল। তাদেরকে স্বাভাবিক শিক্ষাজীবনে ফিরে আসার জন্য প্রথম থেকে দ্বাদশ শ্রেণীর সকল শিক্ষার্থীকে অটোপাশ দেওয়া উচিত। আর এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষার্থীরা যেহেতু যথাযথ ক্লাস ও প্রস্তুতি নিতে পারেনি, অনেকেই মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছেন, সেকারণে পুরো সিলেবাসে পরীক্ষা নেওয়া হলে অধিকাংশ শিক্ষার্থী অকৃতকার্য হবে।
এটা শিক্ষাক্ষেত্রে বিপর্যয় সৃষ্টি করবে। তাই এসএসসিতে সিলেবাস ১০০০ থেকে কমিয়ে ৩০০ করা উচিত। উচ্চতর গণিত এবং বিজ্ঞানের ব্যবহারিক ও মৌখিক পরীক্ষা—এগুলো না নেওয়া উচিত। আর এইচএসসিতে যেহেতু ১ম পার্ট ৫০০ নাম্বারের পরীক্ষা মুক্তিযুদ্ধের আগেই হয়ে গিয়েছিল, সেহেতু এখন ২য় পার্ট পরীক্ষার ৫০০ নাম্বারের সিলেবাস ২৫০ করা উচিত, এবং একইভাবে ব্যবহারিক ও মৌখিক পরীক্ষা না নেওয়া উচিত।
ফলাফল : মুক্তিযুদ্ধ এবং তার মাধ্যমে অর্জিত স্বাধীনতা একটি জাতির জীবনে সবচেয়ে গৌরবময় প্রাপ্তি। সেই প্রাপ্তি অর্জনে আত্মত্যাগের যে মহিমা তাকে শুরুতেই এ ধরণের অন্যায্য প্রাপ্তি দিয়ে কালিমালিপ্ত করে বিকৃত করে দেওয়া হলো। বাহাত্তর সালে শিক্ষা বিষয়ে পরিকল্পনা কমিশনের কাজের সাথে যুক্ত বুদ্ধিজীবী-শিক্ষাবিদগণ এ বিষয়ে যে কিছু ভিন্ন সুপারিশ করেছিলেন তা শোনা হলো না।
তাঁদের কথা না শুনে তৎকালীন সরকার অটোপাশ, শর্ট সিলেবাস ইত্যাদি বিষয়ে সিদ্ধান্ত ঘোষণা করলেন। সংক্ষিপ্ত সিলেবাসের কারণে ইতিপূর্বে অকৃতকার্য হওয়া শিক্ষার্থীরাও ব্যাপকভাবে অংশগ্রহণ করলো এবং ব্যাপক নকলের মাধ্যমে পাশের হারে রেকর্ড সৃষ্টি হলো। অন্যান্য শ্রেণীতেও অটোপাশ দেওয়ায় সকল শিক্ষার্থীর মধ্যে না-পড়েই উপরের ক্লাসে ওঠার একটা চাহিদা সৃষ্টি হলো। পরবর্তীতে পূর্ণ সিলেবাসে পরীক্ষা হলেও নকল প্রবণতা সারাদেশে কমবেশী বাড়তে লাগলো।
এমনকি পাবলিক পরীক্ষায়ও ক্ষেত্রবিশেষে অটোপাশের দাবী উঠতে থাকলো। কিন্তু এটা বারবার দেওয়া সম্ভব না হওয়ায় মুক্তিযুদ্ধে ত্যাগ স্বীকারের পরোক্ষ প্রাপ্তি হিসাবে পরীক্ষায় কিছু সুযোগ-সুবিধার দাবীও উচ্চারিত হতে লাগলো। এভাবে পরাধীন আমলে যেটা ভাবাও যেতো না, স্বাধীন আমলে এসে সর্বস্তরে নকল ক্রমশ স্বাভাবিকীকরণের দিকে যেতে লাগলো। ফলে পরাধীন আমলে শিক্ষার মান যা ছিল তা স্বাধীন আমলে এসে ক্ষতিগ্রস্তই শুধু হলো না, নৈতিকভাবে দুর্বল প্রজন্ম তৈরী হলো এবং মানবসম্পদ উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত হয়ে জাতিগঠন কাজ পিছিয়ে যেতে লাগলো।
পরবর্তীতে ক্ষমতাকেন্দ্রের কাছাকাছি মানুষের সন্তানকে রক্ষায় কয়েক বছর পর কৌশলে কিছুটা পরিবর্তন আনা হলো। রাজধানী ও জেলা শহরের কিছু স্কুল-কলেজকে নকলমুক্ত রেখে প্রান্তের সাধারণের সন্তানের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নকল অব্যাহত রাখা হলো। ফলে কোনো কেন্দ্রে নকল হবে কি হবে না, হলে কতটুকু হবে বা কিভাবে হবে—তা ক্রমশ বাণিজ্যিক ভিত্তিতে নির্ধারণের দিকে যাওয়ার সম্ভাবনা সৃষ্টি হলো।
দুই. মুক্তিযুদ্ধের পর দ্বিতীয় দশক (১৯৮০—১৯৯০)
প্রশ্ন ১ : কেন মাধ্যমিক স্তরে ল্যাবনির্ভর ও অভিজ্ঞতা ভিত্তিক বিজ্ঞান বই প্রচলন করা হয়েছিল?
মহৎ উত্তর : বিজ্ঞান হাতেকলমে শেখার বিষয়, আর ল্যাব ছাড়া বিজ্ঞান শিক্ষা সম্পূর্ণ হয় না। শুধু তত্ত্ব মুখস্থ করার মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা পরীক্ষায় ভালো করলেও প্রকৃতপক্ষে বিজ্ঞানের ব্যবহারিক বিষয়ে অদক্ষ থেকে যায়। বিজ্ঞান পড়েও তাদের মানসিক পরিবর্তন সেভাবে হয় না। তাই শিক্ষার্থীরা যদি মাধ্যমিক স্তরের শুরু থেকেই ল্যাবে পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে বিজ্ঞান শিখতে পারে বা ফিল্ডে গিয়ে অভিজ্ঞতার মাধ্যমে শিখতে পারে তবে বিজ্ঞান হয়ে উঠবে আনন্দের বিষয়। এতে সারাদেশে বিজ্ঞানভিত্তিক চিন্তা ও চর্চার যেমন প্রসার ঘটবে, তেমনি শিক্ষার্থীরা উচ্চশিক্ষায় গিয়েও ভালো করবে; সর্বোপরি দেশ এগিয়ে যাবে।
ফলাফল : রাজধানী ও বৃহত্তর জেলা শহরের গুটিকয় স্কুলের বাইরে দেশের অধিকাংশ স্কুলেই যেহেতু ল্যাব ছিল না, থাকলেও পর্যাপ্ত উপকরণ বা তা ব্যবহার করার মতো শিক্ষক ছিল না এবং সুযোগও ছিল না; এবং একইসাথে বিদ্যালয় ব্যবস্থাপনা, পরিবেশ-পরিস্থিতি ইত্যাদিও ফিল্ডে গিয়ে হাতেকলমে করার উপযোগী ছিল না, সেহেতু শিক্ষার্থীরা আগে বিজ্ঞানের তত্ত্বনির্ভর বই ও অনুশীলন থেকে যতোটুকু বিজ্ঞান শিখতে পারতো এ ধরণের বইয়ের ফলে সেটাও আর সম্ভব হলো না।
এতে করে ব্যাপক সংখ্যক শিক্ষার্থীর কাছে বিজ্ঞান আরো অনাগ্রহের বিষয় হয়ে উঠতে লাগলো। এবং নবম শ্রেণীতে গিয়ে যখন শাখা ও বিষয় বেছে নেওয়ার সুযোগ এলো তখন ব্যাপক সংখ্যক শিক্ষার্থী মানবিক, বিশেষ করে বাণিজ্য শাখার দিকে যেতে লাগলো। এর ফলে আশির দশকের শুরুতে এসএসসিতে বিজ্ঞান শাখায় মোট শিক্ষার্থীর যতো শতাংশ পড়তো নব্বই দশকের শুরুতেই তা প্রায় অর্ধেকে নেমে এলো। এরপর আবার সেই বই পরিমার্জনা করে এবং পরবর্তীতে ইভ্যালুয়েশন করে বাতিল করলেও বিজ্ঞানের শিক্ষার্থী আর আগের সংখ্যায় ফিরে এলো না, ক্রমাগত কমতেই থাকলো।
প্রশ্ন ২ : কেন থানা বা উপজেলার বাইরে পরীক্ষা কেন্দ্র স্থাপনের অনুমতি দেওয়া হয়েছিল?
মহৎ উত্তর : গ্রাম এলাকায় পরীক্ষাকেন্দ্র থেকে শিক্ষার্থীদের বাসস্থান অনেক দূরে। যোগাযোগ-ব্যবস্থার প্রতিকূলতার কারণে তাদের বাড়ি থেকে প্রতিদিন কেন্দ্রে যেতে অনেক কষ্ট হয়। অনেকেই বিলম্বে আসে, পরীক্ষায় খারাপ করে, অনেকে পরীক্ষা দিতেও ব্যর্থ হয়। তাছাড়া উপজেলা বা থানা পর্যায়ে স্বল্পমেয়াদে প্রয়োজনীয় থাকার জায়গারও সংকট রয়েছে। আর্থিক কারণেও অনেকে বাসা ভাড়া করে থাকতে পারে না। সে-কারণে রেলষ্টেশন বা গুরুত্বপূর্ণ বাজার-বন্দর ইত্যাদি রয়েছে এবং যেখানে উপজেলা বা থানা থেকে দ্রুত গিয়ে তদারকি করা সম্ভব এমন স্কুল-কলেজে কেন্দ্র স্থাপনের অনুমতি দিলে শিক্ষার্থীদের উপকার হবে। আর এটা শিক্ষার প্রতি আগ্রহ বাড়াতেও সহায়ক হবে।
ফলাফল : নতুন কেন্দ্র অনুমোদনে অসাধু পথ তৈরী হলো, কতখানি নকল হবে বা হবে-না তা দরদামের বিষয় হয়ে পড়লো। উন্মুক্তভাবে নকল চলতে দিয়েও মূল্যায়নে শিথিলতা না থাকায় পাশের হার খুব একটা বাড়লো না, কিন্তু কেন্দ্র হিসাবে নির্বাচিত স্কুলগুলোতে কয়েক গুণ শিক্ষার্থী পরীক্ষার্থী হিসাবে নিবন্ধন করতে লাগলো। ফলে সেসব স্কুলের আয় বৃদ্ধি পেল এবং এতে করে শিক্ষকদের বেতনভাতা বৃদ্ধির তীব্র দাবী খানিকটা স্তিমিত করা সম্ভব হলো। কিন্তু প্রান্তের অপেক্ষাকৃত ভালো স্কুলগুলো এর নেতিবাচক প্রভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হলো। প্রান্তের শিক্ষার্থীদের না পড়ে পাশ করার প্রবণতা ও শিক্ষকদের না-পড়িয়ে পাশ করিয়ে দেওয়ার অসাধু তৎপরতার মাধ্যমে শিক্ষাক্ষেত্রে নৈরাজ্য ছড়িয়ে পড়লো। পরোক্ষভাবে রাজধানী ও জেলা শহর, অর্থাৎ ক্ষমতাকেন্দ্রের কাছাকাছি থাকা শিক্ষার্থীর সাথে প্রান্তের শিক্ষার্থীর ব্যবধান আরো বেড়ে গেল।
তিন. মুক্তিযুদ্ধের তৃতীয় দশক (১৯৯০—২০০০)
প্রশ্ন ১ : এমসিকিউ প্রশ্ন কেন প্রবর্তন করা হয়েছিল?
মহৎ উত্তর : রচনামূলক প্রশ্নগুলো সুনির্দিষ্ট থাকে না—কি বোঝো, ব্যাখ্যা করো, পার্থক্য লেখো, বর্ণনা করো, যাহা জানো লেখো—ইত্যাদি ধরনের। তাই এটা থেকে সুনির্দিষ্টভাবে কি এবং কতখানি চাওয়া হচ্ছে তা স্পষ্ট করা সম্ভব নয়। একজন শিক্ষার্থী বেশীও লিখতে পারে, আবার কমও লিখতে পারে। সেক্ষেত্রে কাকে কত নাম্বার দেওয়া হবে তার মানদণ্ড নির্ধারণ করা যায় না।
তাছাড়া পরীক্ষকের মানসিক অবস্থা বা পছন্দ-অপছন্দের উপরও নাম্বার কম-বেশী হওয়া স্বাভাবিক। এতে করে হয়তো কোনো শিক্ষার্থী ১ বা ২ নাম্বারের জন্য ডিভিশন বা ষ্টার বা ষ্ট্যাণ্ড করা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে, এমনকি ফেলও করছে। সেই সম্ভাবনা এমসিকিউ প্রশ্নে একেবারেই নেই—উত্তর সঠিক বা ভুল হবে। সঠিক হলে পূর্ণ নাম্বার, না হলে শূন্য। ফলে রচনামূলক প্রশ্ন ৫০% রেখে বাকী ৫০% এমসিকিউ করে দিলে শিক্ষার্থীর উপর ইনজাষ্টিস বা অবিচার হওয়ার মাত্রা অনেক কমে যাবে।
তাছাড়া রচনামূলক প্রশ্নগুলো এমন যে, তা না বুঝে মুখস্থ করা যায়, কিন্তু এমসিকিউ তা নয়। এটা না জানলে আন্দাজে উত্তর দিলেও সঠিক হওয়ার সম্ভাবনা খুবই কম। সুতরাং এটার মাধ্যমে মুখস্থ করার প্রবণতাও কমবে। শিক্ষার মান উন্নয়নও ঘটবে।
ফলাফল : বছরের পর বছর ধরে ব্যাপক নকলের সুযোগও পাশের হার বাড়ানোর ক্ষেত্রে ব্যর্থ পদক্ষেপ হিসাবে প্রমাণিত হচ্ছিল, কারণ খাতা মূল্যায়নের ক্ষেত্রে পরীক্ষকদের শিথিলতা প্রদর্শনের আদেশ সে-সময় সরকারের পক্ষ থেকে দেওয়া সম্ভব হচ্ছিল না। অথচ বিশ্বব্যাংক-আইএমএফ পরিচালিত ষ্ট্রাকচারাল অ্যাডজাষ্টমেণ্ট পলিসি, লেইসেফেয়ার ইকনোমি ইত্যাদি গালভরা ব্যবস্থার বাস্তবায়নে শিক্ষার বাণিজিকীকরণ, বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা ইত্যাদির কাঁচামাল হিসাবে প্রচুর পাশ-করা শিক্ষার্থীর প্রবাহ জরুরী ছিল।
কিন্তু এই জরুরত্ব বহু চেষ্টা করেও মেটানো যাচ্ছিল না। অন্যদিকে একই কারণে অভিভাবকেরাও তাদের বাচ্চাদের অবস্থা বুঝে আগেই কৃষিকাজ, দোকান, ব্যবসা বা স্থানীয় কোনো পেশায় নিয়োজিত করছিল। এর ফলে দ্রুত বিকাশমান গার্মেণ্ট শিল্পের শ্রমিক সরবরাহের প্রবাহ যেমন চাঙ্গা করা যাচ্ছিল না, তেমনি বেসরকারী স্কুল-কলেজে ছাত্রবেতন আদায় পর্যাপ্ত না হওয়ায় শিক্ষকদের বেতনভাতা বাড়ানোর আন্দোলনও নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছিল।
সে-কারণে ৫০ নাম্বার এমসিকিউ শুধু না, তার জন্য যদি ৫০০ নম্বরের একটা প্রশ্নব্যাংক তৈরী করে দেওয়া যায় এবং সেখান থেকেই ৫০টি প্রশ্ন করা হয়, এবং একইসাথে লিখিততে ফেল করলেও এমসিকিউতে পাশ করলেই যদি কৃতকার্য ধরা হয়, তবে পাশের হার যেমন বাড়ানো যাবে, তেমনি এর ফলে শিক্ষার্থীদের ঝরে যাওয়ার হারও কমে আসবে; বিদ্যালয়ের ছাত্রবেতন আদায়সহ অন্যান্য আয়ও বাড়বে। এবং সেটাই ঘটলো। শিক্ষার মান উন্নয়নের কোনো শর্ত একটুও অনুকূল না করেও পাশের হার রাতারাতি দ্বিগুণ হয়ে গেল এবং শিক্ষাক্ষেত্রে যোগ্যতার তুলনায় অতিমূল্যায়ন পর্বের শুরু হলো।
প্রশ্ন ২ : সহজ, শিশুবান্ধব ও আনন্দদায়কভাবে বাংলা ভাষা শেখানোর শুরু কেন হয়েছিল?
মহৎ উত্তর : শিশুদেরকে সহজ থেকে কঠিনের জগতে নিয়ে যেতে হয়। সাবেকী বাংলা বইগুলোতে, এমনকি বিখ্যাত লেখকের জনপ্রিয় প্রাইমারগুলোতেও এটা অনুসরণ করা হয়নি। সেখানে এমনকিছু বিষয় ছিল যা শিশুমনস্তত্ত্ব-বিরোধী, আজগুবি বা ভয়ের। তাছাড়া এসব বইয়ের শুরুতেই এতো এতো যুক্তবর্ণ আর কঠিন শব্দ রয়েছে যে শিশুরা তা দেখলেই ঘাবড়ে যায়।
শোনা, বলা, পড়া ও লেখা¾ভাষা শিক্ষার এই ৪টি দক্ষতার বিকাশ সমানভাবে ঘটানোর জন্য এখানে যথাযথভাবে টেক্সট নির্মাণ করা হয়নি। এগুলো বুঝে এবং সেসময় প্রণীত নতুন কারিকুলাম অনুযায়ী শ্রেণীভিত্তিক ও প্রান্তিক যোগ্যতা অনুসরণ করে বাংলা বই নির্মাণ করলে শিশুরা স্বাভাবিক ও আনন্দদায়কভাবে ভাষা শিখবে ও দক্ষ হয়ে উঠবে।
ফলাফল : বাংলা শুধু একটি বিষয় নয়, এটা শিক্ষার মাধ্যমও। তাই প্রাথমিক স্তরে বাংলা শিক্ষা দুর্বল হলে অনিবার্যভাবে শিক্ষার্থীর গণিত, বিজ্ঞান ও অন্যান্য বিষয়ের শিক্ষাও ক্ষতিগ্রস্ত হয়। সে-কারণে সহজ থেকে কঠিনের যুক্তি প্রয়োগ করে বর্ণমালার ক্রম উল্টোপাল্টা করে শেখানোর ফলে শুরুতে শিশুর বর্ণমালা শেখার কাজই পিছিয়ে যায়। এই ক্ষতি তারা কখনো আর কাটিয়ে উঠতে পারে না।
আর বাংলা ভাষার বৈশিষ্ট্যের মধ্যে যুক্তবর্ণ অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ। নিজের নাম, বাবা-মার নাম, স্কুলের নাম, বাসস্থান বা ঠিকানার সাথে যুক্তবর্ণ রয়েছে প্রায় সবার। সুতরাং কঠিনের কথা বলে এগুলো যথাসম্ভব সরিয়ে রাখলে খুব অল্প টেক্সটই নির্মাণ করা যায়। যেটুকু নির্মাণ করা যায়, সেটাও হয়ে ওঠে একধরণের রসকষ-শূন্য ও আনন্দহীন। আনন্দময় শিক্ষার নামে আনন্দহীন এসব টেক্সট অধিকাংশ শিশুর ভাষা শিক্ষার ভিত্তি শুরুতেই ব্যাপকভাবে দুর্বল করে দেয়। নিরক্ষর অভিভাবক, এমনকি সাক্ষর অভিভাবকের পরিবারেও শিশুতোষ বই পাঠের অভ্যাস না থাকায় সেই ক্ষতি তারা কখনো আর কাটিয়ে উঠতে পারে না। ফলে যথাযথ ভাষা দক্ষতা অর্জন না করে শিশু যতো উপরে উঠতে থাকে ততো তার শিক্ষাগ্রহণ বাধাগ্রস্ত হতে থাকে।
প্রশ্ন ৩ : প্রাথমিক স্তরে কেন আশি ভাগ নারী শিক্ষক নিয়োগের বিধান করা হলো?
মহৎ উত্তর : জাতিকে আগাতে হলে নারী-পুরুষ উভয়কেই শিক্ষিত হতে হবে, কারণ শিক্ষিত মা মানেই শিক্ষিত সন্তান, শিক্ষিত জাতি। পৃথিবী জুড়ে দেখা গেছে প্রাথমিক শিক্ষার মতো পেশায় নারীরা খুবই ভালো করেন। তারা শিশুর প্রয়োজনটা ছেলেদের চেয়ে অনেক দ্রুত বুঝতে পারেন এবং করণীয়ও যথাযথভাবে করতে পারেন। তাই প্রাথমিক শিক্ষার মানের উন্নয়নে শতভাগ না হলেও অন্তত ধাপে ধাপে নিয়োগ আশি ভাগে উন্নীত করা উচিত।
ফলাফল : আমাদের মতো দেশে নারীশিক্ষা, নারীর কর্মসংস্থান, ক্ষমতায়ন ইত্যাদি বিষয় দাতাসংস্থাসহ নানা বিদেশী শক্তির দান-অনুদান ও ঋণ পাওয়ার পূর্বশর্ত হিসাবে কাজ করে। সেইসব প্রাপ্তির শর্ত পূরণে শিক্ষাখাত সবচেয়ে সুবিধাজনক। কিন্তু নব্বইয়ের দশকে শিক্ষক হওয়ার যোগ্যতাসম্পন্ন নারী কম ছিল। ফলে নারী কোটা পূরণের জন্য মেয়েদের ক্ষেত্রে যোগ্যতা শিথিল করে এসএসসি করা হয়। সে-সময়েই এমসিকিউ প্রশ্ন ও মূল্যায়ন পদ্ধতির মাধ্যমে এসএসসি-তে পাশের হার রাতারাতি দ্বিগুণ করা হয়। এটা নারী প্রার্থী পাওয়ার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
পাশাপাশি ছাত্রী উপবৃত্তি এবং তাদের পাশ না করলেও উপরের ক্লাসে ওঠার সুযোগ সৃষ্টির মাধ্যমে নারীশিক্ষার হার দ্রুত বাড়তে থাকে। এভাবে পরীক্ষা ও পাশ সহজীকরণ এবং শিক্ষক নিয়োগ প্রক্রিয়ায় দুর্নীতি ও অসাধু প্রক্রিয়ার সুযোগ রেখে ব্যাপক সংখ্যক অযোগ্য শিক্ষককে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে নিয়োগ দেওয়া সম্ভব হয়। রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক দুর্বৃত্তায়ন ও নানাবিধ কারণে নারী শিক্ষকের ক্ষেত্রে প্রশাসনিক ব্যবস্থা গ্রহণ, এমনকি কর্মস্থল পরিবর্তন করাও অপেক্ষাকৃত জটিল হয়। ধারাবাহিকভাবে এই প্রক্রিয়া অব্যাহত থাকায় প্রাথমিক শিক্ষার মানের ব্যাপক অবনমন ঘটে।
প্রশ্ন ৪ : জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার প্রয়োজন কেন হয়েছিল?
মহৎ উত্তর : মাত্র তিন-চারটি স্বায়ত্তশাসিত বিশ্ববিদ্যালয় সারাদেশের কয়েকশো ডিগ্রী ও মাষ্টার্স কলেজ এবং একইসাথে মেডিকেল কলেজের ভার বহন করতে গিয়ে তারা নিজেরা যেমন সেশনজ্যামে পড়ছে, তেমনি কলেজগুলোকেও জ্যামে ফেলছে। এতে তাদের নিজেদের শিক্ষার মানের যেমন অবনমন ঘটছে, তেমনি কলেজের প্রতি মনযোগ দিতে না পারায় সেগুলোর মানেরও অবনমন ঘটাচ্ছে। তাই উচ্চশিক্ষার বিকাশ ও তার মান উন্নয়নে স্বায়ত্তশাসিত বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে যেমন অবমুক্ত করা প্রয়োজন, তেমনি কলেজগুলোর জন্যও শ্রেণী কার্যক্রমমুক্ত এমন একটা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ প্রতিষ্ঠা করা দরকার যেটা তাদের তদারকি করবে ও মান নিয়ন্ত্রণ করবে।
ফলাফল : পতিত স্বায়ত্তশাসিত বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক ও প্রশাসনিক মানের তুলনায়ও নিম্ন মানের একটা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ প্রথমে প্রতিষ্ঠা করা হয়। অনেকটা শিক্ষাবোর্ডের মতো করে বানানো এই জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তার কাজের পরিধি, সুবিধা ও প্রভাব বাড়াতে পুরনো কলেজগুলোতে গাদা গাদা অনার্স-মাষ্টার্স খুলতে দেয়।
একইসময়ে এসএসসি ও এইচএসসিতে পাশের হারের কৃত্রিম উল্লম্ফনের ফলে নতুন নতুন কলেজ প্রতিষ্ঠা ও সেখানে যেনতেনভাবে অনার্স-মাষ্টার্স খোলার প্রতিযোগিতা শুরু হয়। ফলে খুব অল্প সময়ের মধ্যেই জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশের শুধু নয়, প্রায় মিলিয়ন শিক্ষার্থী নিয়ে পৃথিবীর মধ্যে অন্যতম বৃহৎ বিশ্ববিদ্যালয় রূপে আবির্ভূত হয়। এখান থেকে নিম্নমানের উচ্চশিক্ষা পাওয়া শিক্ষার্থীর ব্যাপক প্রবৃদ্ধি ঘটে। এই সব শিক্ষার্থীরা দেশে-বিদেশে ভালো-মন্দ যা কিছু করতে প্রস্তুত হয়ে ওঠে। এদের বেকারত্বকে পুঁজি করে নানা রাজনৈতিক প্রয়োজনে হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহার করাও সহজ হয়।
অন্যদিকে উচ্চশিক্ষা প্রদানের চাপ ও প্রতিযোগিতায় চলতে চলতে বনেদী বিখ্যাত কলেজ থেকে উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষা উঠে যেতে থাকে এবং যেগুলোতে থাকে তার মানেরও ভয়াবহ অবনমন ঘটে। ফলে অতীতে এইসব কলেজ থেকে স্বায়ত্তশাসিত বিশ্ববিদ্যালয়গুলো যে-মানের শিক্ষার্থী পেতো তার প্রবাহে সংকট সৃষ্টি হয়। এভাবে ঐতিহ্যবাহী বিশ্ববিদ্যালয় এবং তার চেয়েও ঐতিহ্যবাহী কলেজ উভয়েই সব হারিয়ে নিঃস্ব হতে থাকে।
প্রশ্ন ৫ : উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার প্রয়োজন কেন হয়েছিল?
মহৎ উত্তর : দেশের অধিকাংশ শিক্ষার্থী আর্থিক অস্বচ্ছলতা, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের দূরত্ব, পরীক্ষায় অকৃতকার্য হওয়া, অনাগ্রহ ইত্যাদি বহু কারণে আনুষ্ঠানিক শিক্ষা থেকে ঝরে পড়ে এবং একসময় কর্মক্ষেত্রে প্রবেশ করে। অনেকেই নামমাত্র বেতনে দেশে-বিদেশে কাজ করে। কিন্তু শিক্ষিত না হওয়ায় তারা যথাযথ প্রশিক্ষণও গ্রহণ করতে পারে না। এমনকি উচ্চশিক্ষা গ্রহণে সক্ষম বহু শিক্ষার্থীও নানা কারণে নিরবচ্ছিন্নভাবে শিক্ষা নিতে পারে না। তাদের সম্ভাবনার বিকাশ শুধুমাত্র প্রচলিত স্কুলিং সিষ্টেমের কারণে বাধাগ্রস্ত হয়।
তাছাড়া বাংলাদেশে শিক্ষার হার খুব কম এবং এর প্রবৃদ্ধিও আশাব্যঞ্জক নয়। সুতরাং শিক্ষার হার বৃদ্ধিসহ দক্ষ ও শিক্ষিত জনশক্তি গড়ে তোলার ক্ষেত্রে দূরশিক্ষণের বিকল্প নেই। পৃথিবীর বহু দেশেই এ ধরণের অনানুষ্ঠানিক শিক্ষা চালু আছে। এটা ব্যয়সাশ্রয়ীও। কারণ এখানে ক্লাসরুম, ক্যাম্পাস, ছাত্র-শিক্ষক অনুপাত, শিক্ষার্থীর বয়স এগুলোর কোনোকিছুই সেভাবে গুরুত্বপূর্ণ নয়।
ফলাফল : শিক্ষার সাধারণ ধারায় পাশের হারের কৃত্রিম উল্লম্ফন সত্ত্বেও যারা ব্যর্থ হয়, বা বহু আগে ব্যর্থ হয়েছিল বা আগামীতে হতে পারে¾এমন শিক্ষার্থীরাই মূলত উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের এসএসসি-এইচএসসি-বিএড সহ নানা প্রোগ্রামে যুক্ত হয়। খুব শীঘ্রই উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় হয়ে ওঠে অনেকটা উন্মুক্ত পরীক্ষাকেন্দ্র। এটা বুঝে এবং একবার না পারিলে দেখো শতবারের মতো এক একটি বিষয়ের পরীক্ষার অবারিত সুযোগ থাকায় লক্ষ লক্ষ শিক্ষার্থী এই রেসের মধ্যে ঢুকে পড়ে।
কিন্তু নামের সাথে যেহেতু বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে তাই সংশ্লিষ্টজনেরা এর মানমর্যাদা বাড়াতে প্রচলিত বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজের চেয়েও এগিয়ে থাকতে উদ্গ্রীব হয়ে ওঠেন। তারা সারা দেশে আঞ্চলিক কেন্দ্র, সমন্বয় কেন্দ্র, ক্লাসব্যবস্থাপনা ইত্যাদি গড়ে তোলেন। দূরশিক্ষণের ধারণাও ক্রমশ সরে যেতে থাকে। এমনকি এমফিল-পিএইচডি প্রোগ্রামও চালু হয়ে যায়। গড়ে ওঠে বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহৎ এবং পৃথিবীর অন্যতম বৃহৎ বিশ্ববিদ্যালয়, যেখান থেকে গাদা গাদা নিম্নশিক্ষা ও উচ্চশিক্ষা পাওয়া সার্টিফিকেটধারী শিক্ষার্থী বের হয়ে মিশে যেতে থাকে অন্যান্য স্রোতে।
প্রশ্ন ৬ : বিশ্ববিদ্যালয়ে কোর্স সিষ্টেম থেকে কেন সেমিষ্টার সিষ্টেম চালু করা হয়েছিল?
মহৎ উত্তর : রাজনৈতিক হানাহানির কারণে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো মাঝে মাঝেই দীর্ঘদিন ধরে বন্ধ থাকে। ক্লাস-পরীক্ষা ঠিকভাবে নেওয়া যায় না। ফলে কোর্স সিষ্টেমে একবারে বছর শেষে পরীক্ষা নেওয়ায় অনেক শিক্ষার্থীই খারাপ করে। অনেকে পরীক্ষাই দিতে পারে না। কিন্তু সেমিষ্টার সিষ্টেমে বছরে ২ বা ৩টা সেমিষ্টার হলে শিক্ষার্থী এক সেমিষ্টারে খারাপ করলেও আরেক সেমিষ্টারে পুষিয়ে নিতে পারে, বা তার সুযোগ থাকে।
এখানে সুনির্দিষ্ট টপিকে কিছুদিন পরপর ফাইনাল পরীক্ষা হওয়ায় শিক্ষার্থীরা যেমন লেখাপড়ার প্রতি সতর্ক থাকে, শিক্ষকরাও তেমন সচেতন থাকেন। ফলে বিভাগে বা ক্যাম্পাসে শিক্ষার পরিবেশের উন্নতি হয়, এলোমেলো কর্মকাণ্ড কম হয়, শিক্ষার মান বাড়ে। তাছাড়া পৃথিবীর বহু নামকরা বিশ্ববিদ্যালয়ের বহু বিভাগে সেমিষ্টার পদ্ধতি চালু আছে।
ফলাফল : বিশ্ববিদ্যালয়ে খুনোখুনির দায় রাজনীতির, এবং ছাত্র শুধু নয় শিক্ষকরাও কমবেশী সেই অপ-রাজনীতির চর্চা করেন। সেমিষ্টারে-সেমিষ্টারে ৩-৪ মাস পর টপিক বণ্টন হলে পরীক্ষা বাড়ে, ক্লাসের সংখ্যা কমে, এবং রাজনীতিও থেকে যায়, বরং তার আরো অবনমন ঘটে। ফলে যতোটা সময় ও ব্যাপ্তি নিয়ে কোনো বিষয় আলোচনা ও গবেষণা করার প্রয়োজন তা করা সম্ভব হয় না। এতে করে শিক্ষার্থীও যেমন সেমিষ্টারে-সেমিষ্টারে কোনোরকমে উৎরে যেতে অস্থির থাকে, শিক্ষকও তাই। ফলে গবেষণা-নির্ভর উচ্চশিক্ষা অনেকটা পাঠ-নির্ভর হয়ে যেটুকু ছিল তারও অবনমন ঘটে। ক্রমশ উচ্চশিক্ষাও হয়ে ওঠে এক ধরণের নোট-গাইড, কোচিং, প্রাইভেট ও চোথা নির্ভর ব্যবস্থা।
চার. মুক্তিযুদ্ধের চতুর্থ দশক (২০০০—২০১০)
প্রশ্ন ১ : ডিভিশন, ষ্টার, ষ্ট্যাণ্ড এগুলো বাদ দিয়ে জিপিএ আনা হয়েছিল কেন?
মহৎ উত্তর : একটা বিশেষ নাম্বারের উপরে-নীচে থাকলেই তাকে সুনির্দিষ্ট ক্যাটাগরিতে ফেলে ডিভিশন ঘোষণা করা–এটা মূল্যায়নের আধুনিক ও বিজ্ঞানসম্মত পদ্ধতি নয়। কারণ এতে অনেক সময় দেখা যায় ১ নাম্বার কম পাওয়ার কারণেও কেউ সেকেণ্ড ডিভিশন পাচ্ছে, বা কারো ষ্টার মার্কস হচ্ছে না, বা কেউ ষ্ট্যাণ্ড করছে না, এমনকি ফেলও করছে। নাম্বার-ভিত্তিক মূল্যায়নের ফলে প্রত্যেক শিক্ষার্থী নাম্বার দিয়ে পৃথক পৃথকভাবে শনাক্ত হচ্ছে, এবং নাম্বারই হয়ে পড়ছে মানের নির্দেশক।
এতে বৈষম্য হচ্ছে, শিক্ষার্থীর কোমল মন ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। কিন্তু বিভিন্ন বিষয়ে প্রাপ্ত নাম্বারের ভিত্তিতে গ্রেড পয়েণ্ট এভারেজ করে ফলাফল ঘোষণা করা হলে শিক্ষার্থীরা কোনো বিষয়ের নাম্বার জানতে পারবে না। এতে বৈষম্য যেমন কমবে, শিক্ষার্থীর আত্মবিশ্বাসও বাড়বে। আর এটা মূল্যায়নের আধুনিক পদ্ধতিও।
ফলাফল : এসএসসি বা এইচএসসি পরীক্ষার ফলাফলে প্রায়শই দেখা যেতো প্রান্তের সাধারণের সন্তানেরা কেন্দ্রের অনেক সুবিধাপ্রাপ্ত অভিভাবকের সন্তানের চেয়ে বা তাদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের চেয়েও ভালো করছে, এবং তাদের কৃতিত্বের কথা পত্রপত্রিকা-টিভিতে ফলাও করে প্রচার করা হচ্ছে। ৪টা শিক্ষাবোর্ডের এসএসসি ও এইচএসসি-র বিভিন্ন শাখা মিলিয়ে প্রায় ৫শো কৃতি শিক্ষার্থীর অধিকাংশই প্রান্ত থেকে উঠে আসছে। অনেকেই সেই পরিচিতির মাধ্যমে পরবর্তী শিক্ষাজীবন ও কর্মজীবনে এগিয়ে যাওয়ার শক্তি পাচ্ছে। তাদের অভিভাবকরাও এক ধরণের সামাজিক মর্যাদা পাচ্ছে।
এটা বন্ধ করতে এবং ক্ষমতাকেন্দ্রের সাথে সাধারণের সন্তানের প্রতিযোগিতার বিজয় দৃশ্যমান না করতে ফলাফল নির্ধারণে জিপিএ পদ্ধতি সবচেয়ে উত্তম পন্থা হিসাবে হাজির হয়। নাম্বার না-প্রকাশের সুবিধা নিয়ে জিপিএ-তে ক্রমশ বাম্পার ফলানো যেমন সম্ভব হয়, তেমনি পরবর্তীতে অসাধু পথে নাম্বার জানার কৌশল উদ্ভাবনের সুযোগ দিয়ে ক্রমশ নাম্বারসহ জিপিএ প্রদানের মাধ্যমে মূল্যায়ন পদ্ধতিকেই অর্থহীন করে তোলা হয়। ততোদিনে কেন্দ্রের অভিভাবকের সন্তানেরা অধিকাংশই ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে চলে যায়, এবং তারই ধারাবাহিকতায় প্রশ্নফাঁস প্রকল্প শুরু করা, শিক্ষকদের অনৈতিক হতে বাধ্য করা এবং শতভাগ পাশ দিয়ে ক্রমশ ভালো-মন্দের ভেদ ঘুচিয়ে সমাজে সবকিছু একাকার করে দেওয়াও সম্ভব হয়।
প্রশ্ন ২ : পিইসি-জেএসসি কেন চালু করতে হলো?
মহৎ উত্তর : প্রাথমিক স্তর শেষের পর পঞ্চম শ্রেণী বা অষ্টম শ্রেণীতে সমগ্র দেশের শিক্ষার্থীরা প্রান্তিক যোগ্যতার কতখানি অর্জন করছে তার একটা একক কেন্দ্রীয় মূল্যায়ন থাকা উচিত। তাছাড়া অধিকাংশ শিক্ষার্থীর বৃত্তি পরীক্ষায় অংশগ্রহণের সুযোগ না থাকায় তাদের প্রতি এক ধরণের বৈষম্যও করা হয়। এমনও হতে পারে যে তারা বৃত্তি পাওয়ার উপযুক্ত ছিল। আর একবারে দশম শ্রেণীতে গিয়ে যেহেতু তাদের সরাসরি পাবলিক পরীক্ষায় বসতে হয়, সুতরাং পরীক্ষাভীতি কাটাতে পিইসি এবং জেএসসি পরীক্ষা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারবে। পাশাপাশি ফলাফল ও সার্টিফিকেট প্রাপ্তি শিক্ষার্থীদের মাঝে উদ্দীপনারও সৃষ্টি করবে। এতে করে অভিভাবকরাও খুশী হয়ে সন্তানের শিক্ষাকে আরো গুরুত্ব দিতে পারবেন।
ফলাফল : বিশ্বসভায় ২০১৫ সালের মধ্যে সকল শিশুর প্রাথমিক শিক্ষা নিশ্চিতের যে অঙ্গীকার করা হয়েছিল, এবং তার অনুকূলে যেসব দান-অনুদান-ধার ইত্যাদি পাওয়া গিয়েছিল এবং ভবিষ্যতে আরো যা পাওয়ার সম্ভাবনা ছিল তার লক্ষ্যে পিইসি-জেএসসি পরীক্ষা, শতভাগ পাশ এবং সার্টিফিকেট উন্মাদনার প্রয়োজন হয়। সেই লক্ষ্য পূরণে খাতায় কিছু লিখলেই নাম্বার দেওয়া, সবাইকে পাশ করিয়ে দেওয়া, পরীক্ষার হলে একে অপরের সহযোগিতা নিতে দেওয়া, শিক্ষকের সহযোগিতায় উত্তর লেখা, শিক্ষক কর্তৃক সবাইকে উত্তর বলে দেওয়া, প্রশ্নগুলো ফাঁস হতে দেওয়া ইত্যাদি কর্মকাণ্ড চালানো হয়।
এভাবে করে ২০১৫ সালের আগেই লক্ষ্যে পৌঁছানোর প্রত্যয়ও ঘোষণা করা হয়। আর দু-দুটি পরীক্ষা অবশ্যই নোট-গাইড ও কোচিংয়ের প্রবৃদ্ধি ঘটাতে ব্যাপক ভূমিকা রাখে, যার বার্ষিক লেনদেনের পরিমাণ লক্ষ কোটি টাকার উপরে; এবং যার সাথে সরকার, রাজনীতি ও প্রশাসনের প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ অন্যায্য প্রাপ্তির সম্পর্কও স্বাভাবিক বিষয়। পিইসি-জেএসসি-র ধারাবাহিকতায় এসএসসি-এইচএসসিতেও একই চাহিদা সৃষ্টি করা সম্ভব হয় এবং এর ফলে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর কাঁচামাল হিসাবে শিক্ষার্থী প্রাপ্তির ভাবনা একেবারে দূর করা সম্ভব হয়।
ততোদিনে যেহেতু ক্ষমতার কেন্দ্র বা প্রভাবশালীর সন্তানরা ভিন্ন ধারার শিক্ষাব্যবস্থায় চলে যেতে সক্ষম হয়, সেহেতু সাধারণের সন্তানকে শিশুকাল থেকেই তাদের শিক্ষক-অভিভাবকসহ এমত অনৈতিকতার চর্চায় নিমজ্জিত করা এবং ক্রমশ এটাকেই অনেকটা স্বাভাবিক করে তোলার মাধ্যমে ভবিষ্যতে তাদের নৈতিক শক্তিতে দাঁড়ানোর সামর্থ্যও প্রায় নেই করে দেওয়া যায়। নৈতিকভাবে দুর্বল মানুষ রাজনৈতিকভাবেও দৃঢ়চেতা হতে পারে না। ফলে এটা শেষাবধি দুর্বৃত্ত রাষ্ট্র ও রাজনীতিরই সহায়ক হয়।
পাঁচ. মুক্তিযুদ্ধের পঞ্চম দশক (২০১০—২০২০)
প্রশ্ন ১ : সৃজনশীল প্রশ্ন পদ্ধতি কেন চালু করা হয়েছিল?
মহৎ উত্তর : এটা আধুনিক শিক্ষাতাত্ত্বিকের উদ্ভাবিত পদ্ধতি এবং বিশ্বজুড়ে স্বীকৃত। এবং এই পদ্ধতি চালু হলে শিক্ষার্থীদের জ্ঞান-অনুভূতি-বিশ্লেষণ-কাজ—এর প্রত্যেকটি ক্ষেত্রে মূল্যায়ন করা সম্ভব হবে। এর ফলে শুধু মুখস্থ করে বা সিলেবাস পড়ে কেউ ভালো করতে পারবে না। সুতরাং কোচিংসহ নোট-গাইড ব্যবসাও বন্ধ হয়ে যাবে। শিক্ষার্থীরা চিন্তা করতে, জানতে, বুঝতে ও করতে দক্ষ হয়ে উঠবে। পাশাপাশি শিক্ষকরাও আধুনিক শিখন-শেখানো কার্যক্রমে দক্ষ হবে এবং সার্বিকভাবে শিক্ষার মান উন্নয়ন ঘটবে।
ফলাফল : পূর্বপ্রস্ততি, সদিচ্ছা ও ব্যবস্থাপনা না থাকায় শুরুতেই যথাযথ পদ্ধতি অনুসরণ করে পাঠ্যবই বানানো সম্ভব হয় না, শিক্ষক প্রশিক্ষণ যথাযথ হয় না, শিক্ষকের নির্বাচন প্রক্রিয়া বহুদিন থেকে ত্রুটিপূর্ণ হওয়ায় শিক্ষকরা প্রশিক্ষণ পেলেও তা বাস্তবায়ন করতে পারেন না, শিক্ষা-কর্তৃপক্ষ অদক্ষ ও দুর্নীতিপরায়ণ হওয়ায় তদারকি ও সহযোগিতার মান থাকে অতি নিম্ন।
ফলে প্রশ্নপত্র প্রণয়ন ও মূল্যায়নের ক্ষেত্রে ভয়ানক জটিলতা তৈরী হয় এবং দীর্ঘদিনের অভ্যস্ত ব্যবস্থা থেকে একবারে শতভাগ পরিবর্তনের ফলে ছাত্র-শিক্ষক-অভিভাবক সর্বস্তরে অস্থিরতা তৈরী হয়। শিক্ষার্থীর সাথে শিক্ষকরাও অথৈ জলে পড়ে বাঁচার উপায় খুঁজতে দাওয়াই হিসাবে ভিন্ন ভিন্ন মোড়কের নোট-গাইড বই পেয়ে যায়, এবং শিক্ষার্থীর সাথে শিক্ষকরাও সেগুলো ব্যবহার করতে অভ্যস্ত হয়ে ওঠেন। কোচিংগুলো আরো স্মার্ট হয়ে ওঠে। কিন্তু প্রশ্নফাঁস এবং মূল্যায়নে কারচুপি করে শতভাগ পাশের ধারাবাহিকতা অব্যাহত রাখার কারণে কারিকুলামের সীমাবদ্ধতা ও বাস্তবায়নের হযবরল অবস্থা নিয়ে কথা উঠলেও তা চাপা পড়ে যায়। এর মাধ্যমে সব দিক দিয়ে কেন্দ্র থেকে প্রান্ত পিছিয়ে পড়ে আরো।
প্রশ্ন ২ : প্রাথমিক স্তর ৬টি বই দিয়ে শেষ করিয়ে মাধ্যমিক স্তরে কেন একবারে ১৪টি বই দেওয়া হলো?
মহৎ উত্তর : মাধ্যমিক স্তরে এসেও অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত শিক্ষার্থীরা প্রাথমিক স্তরের মতো অল্প ক’টি বিষয়ই পাঠ করে। ফলে প্রযুক্তি, সঙ্গীত, চিত্রকলা, কৃষি, গার্হস্থ্য, শরীর-স্বাস্থ্য, জীবনজীবিকা ইত্যাদি অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় তারা জানতে-বুঝতে পারে না। নবম শ্রেণীতে গিয়েও শাখা বিভাজনের ফলে অধিকাংশ শিক্ষার্থী এগুলো বিষয় সম্পর্কে কোনো ধারণাই পায় না। অন্যদিকে ৬ষ্ঠ শ্রেণীতে ভর্তি হওয়া শিক্ষার্থীদের অধিকাংশই দশম শ্রেণীর আগেই ঝরে পড়ে। ফলে শিক্ষার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য ব্যহত হয়, জাতি-গঠন কাজও পিছিয়ে যায়। তাই এসব বিষয় মাধ্যমিক স্তরের শুরু থেকেই দেওয়া প্রয়োজন। এতে করে শিক্ষার্থীরা যেমন তাদের আগ্রহ ও ভালোলাগার বিষয়ে ভবিষ্যতে বিকল্প ভাবার সুযোগ পাবে, তেমনি ঝরে পড়া শিক্ষার্থীরাও উপকৃত হবে এবং এগুলো তাদের পেশাগত জীবনে সুবিধা দেবে।
ফলাফল : মাধ্যমিক স্তরে বিষয় বাড়িয়ে দিলেও স্কুলের সময় বাড়ানো সম্ভব হয় না, বরং নতুন নতুন স্কুলে ক্রমাগত দুই শিফট চালু করার চাপে সময় আরো কমতে থাকে। অন্যদিকে বিষয় বাড়ানোর সাথে সঙ্গতি রেখে বিষয়-ভিত্তিক শিক্ষক নিয়োগ দেওয়াও অধিকাংশ স্কুলে সম্ভব হয় না। সুতরাং একই সময়ের মধ্যে অধিক বিষয় সামাল দিতে গিয়ে সপ্তাহে বিষয়-প্রতি ক্লাস যেমন কমে যায়, ক্লাস-প্রতি সময়ও কমাতে হয়। এটা শিক্ষক ও শিক্ষার্থী উভয়কে ভয়ানক চাপে ফেলে।
অনেক শিক্ষক বিষয়-গুরুত্ব না বুঝে কম গুরুত্বপূর্ণ বিষয়েরও অধিক বাড়ির কাজ দিতে থাকেন। ফলে মাধ্যমিক স্তরে গণিত, বিজ্ঞান ও ভাষা বিষয়ে শিক্ষকরা আগে যতোটুকু সময় দিতে পারতেন এবং শিক্ষার্থীরাও আগে যতোটুকু সময় নিয়ে শিখতে পারতো তার পরিমাণ কমতে থাকে। এভাবেই মাধ্যমিক স্তরের শুরু থেকে গণিত, বিজ্ঞান ও ভাষা শিক্ষার আপেক্ষিক গুরুত্ব কমানোর ফলে প্রান্তের শিক্ষার্থীদের গণিত-বিজ্ঞান শুধু নয়, সারা জীবনের শিক্ষাতেই ভালো করার সম্ভাবনা কমে যায়।
প্রশ্ন ৩ : স্কুলগুলোতে কেন ছাত্রসংসদ নির্বাচন চালু করতে হলো?
মহৎ উত্তর : যতো ছোট বয়সে শিক্ষার্থীরা অপরের মতামত ও সংখ্যাগরিষ্ঠের মতামতকে গুরুত্ব দিতে শিখবে, নিজে দায়িত্ব নিতে শিখবে, পরিস্থিতি অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ করতে শিখবে ততো ভালো। এ বয়সের শিক্ষার্থীর মধ্যে গণতান্ত্রিক চর্চা ও নেতৃত্বের গুণ বিকাশ লাভ করলে তারা জাতিকে নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য তৈরী হবে। ভবিষ্যতে গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ ও উন্নত-স্মার্ট বাংলাদেশ নির্মাণের জন্য এটা খুবই প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ।
ফলাফল : শিক্ষার্থীরা যেখানে নাগরিক, অর্থাৎ বিশ্ববিদ্যালয় বা উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে, সেখানে ছাত্রসংসদ নির্বাচন করতে দিলে তা ক্ষমতার রাজনীতির জন্য ঝুঁকিপূর্ণ হয়। তাই সেটা যেহেতু বহুদিন ধরে বন্ধ করে রাখা হয়েছে, সেক্ষেত্রে স্কুলগুলোতে এসব ঝুঁকি একেবারে নেই। তাই সেখানে নির্বাচন দিয়ে বিষয়টার প্রতি কর্তৃপক্ষ যে আন্তরিক তা খানিকটা হলেও বোঝানো যাচ্ছে।
আর জাতীয় পর্যায়ে বহু ধরণের বিচিত্র নির্বাচন পরিস্থিতি চারপাশে দেখার-শোনার অভিজ্ঞতার ফলে স্কুল-শিক্ষার্থীরাও তার অনুকরণ করতে শুরু করছে। এতে শিক্ষার পরিবেশ যেমন দূষিত হচ্ছে, ক্লাস-কার্যক্রম একটু হলেও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। অভিভাবক-শিক্ষকরাও ক্রমশ এসবের সাথে জড়িয়ে পড়ার ঝুঁকিতে পড়ছেন। সবদিক দিয়ে প্রত্যাশিত বাংলাদেশের উপযোগী হয়েই প্রান্তের বা সাধারণের সন্তান তৈরী হয়ে উঠছে।
প্রশ্ন ৪ : স্কুলে ভর্তি পরীক্ষা বন্ধ করে কেন লটারী ও কোটা চালু করা হলো?
মহৎ উত্তর : ভর্তি পরীক্ষা শিশুদের প্রতি এক ধরণের নির্যাতন। এতে করে অভিভাবকরা যেমন ভালো স্কুলে বাচ্চা ভর্তি করানোর জন্য কোচিং-গাইড ইত্যাদি করতে থাকেন, তেমনি স্কুলগুলোতেও এর ফলে নানা অনিয়ম সৃষ্টি হয়। দীর্ঘদিন ধরে এটা চলার ফলে অপেক্ষাকৃত আগানো শিক্ষার্থীরা ভালো স্কুলগুলোতে জড়ো হয়, এবং বাকী স্কুলগুলো পেছানো শিক্ষার্থী নিয়ে সবসময় পিছিয়েই থাকে।
তাছাড়া অতিদূর থেকে অভিভাবকরা বাচ্চা নিয়ে ভালো স্কুলে আসেন বলে ট্রাফিক ব্যবস্থাসহ সামগ্রিক পরিবেশের উপরও নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। লটারী ও স্থানীয় কোটা ব্যবস্থা চালু হলে শিশুরা নির্যাতন থেকে বাঁচবে, অভিভাবকদের খরচ কমবে, প্রত্যেকটি স্কুল প্রায় একই মানের শিক্ষার্থী পাবে, স্কুলগুলোর মানের ব্যবধানও কমে আসবে। সর্বোপরি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের জন্য কোনো বিশেষ এলাকার ট্রাফিক, আবাসন ও পরিবেশের সংকট সৃষ্টির সম্ভাবনা কমে যাবে।
ফলাফল : পাবলিক পরীক্ষা শুধু নয়, স্কুল পর্যায়েরও মূল্যায়ন ব্যবস্থা নষ্ট করে দেওয়ায় লটারীর ফলে শ্রেণী-অনুপযোগী শিক্ষার্থীরাও ভর্তি হতে পারছে। ফলে অপেক্ষাকৃত ভালো স্কুলগুলোতেও শিক্ষার্থীদের মানের ব্যবধান অনেক বেড়ে গেছে। এমন ব্যবধানের শিক্ষার্থী নিয়ে যেভাবে ক্লাস পরিচালনা করা উচিত, তার আয়োজন অধিকাংশ স্কুল করতে পারছে না। ফলে এসব স্কুলের শিখন-শেখানো কার্যক্রম ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এভাবে স্কুলগুলোর মানেরও অবনমন ঘটছে।
অন্যদিকে অপেক্ষাকৃত খারাপ স্কুলগুলোতে ভর্তির সুযোগ পাওয়া অগ্রবর্তী শিক্ষার্থীরাও সেখানকার অপেক্ষাকৃত কম যোগ্য শিক্ষকের ক্লাসে একইভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। তারা এটা থেকে বাঁচতে ভিন্ন ধারার শিক্ষা বা বিকল্প উপায়ে ভালো স্কুলে ভর্তির চেষ্টা করছে। এই প্রক্রিয়ায় বাণিজ্যের সুযোগ আরো বাড়ছে। লটারী অনেক ক্ষেত্রেই লটারী হচ্ছে না, হয়ে উঠছে অনেকখানি ম্যানেজিং কমিটি নামের সরকারী দলের লোকজনের সিদ্ধান্ত। আবার লটারীতে নির্বাচিত হলেও ফল পাল্টানো যাচ্ছে। লটারীতে চান্স পেলেও আর্থিক লেনদেন ছাড়া অনেক ক্ষেত্রে ভর্তির সুযোগ হচ্ছে না। অভিভাবক ও শিক্ষার্থীর ভোগান্তি আগের চেয়ে আরো বাড়ছে। সবদিক দিয়ে বিদ্যালয়ের শিক্ষার পরিবেশ ও শিক্ষার মানের আরো ক্ষতি হচ্ছে।
প্রশ্ন ৫ : কলেজে ভর্তি পরীক্ষা বন্ধ করে কেন এসএসসি-র ফলাফল থেকে সরাসরি ভর্তির সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হলো?
মহৎ উত্তর : শিক্ষার্থীরা একটা পাবলিক পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে উত্তীর্ণ হচ্ছে মানেই সে পরবর্তী ধাপে পড়াশোনা করার যোগ্য। সুতরাং কেউ যদি ভর্তি হতে চায় তাহলে সে তার এসএসসি-তে প্রাপ্ত জিপিএ দিয়েই ভর্তি হবে–এটাই দুনিয়ার নিয়ম। তাছাড়া ভর্তি পরীক্ষা মানেই কোচিং, গাইড, অভিভাবকের ব্যয়, শিক্ষার্থীর হয়রানি, দুর্নীতির সুযোগসহ বহু কিছু। সুতরাং শিক্ষার্থীরা কলেজ পছন্দের ক্রম উল্লেখ করে আবেদন করবে, আর কলেজগুলো সর্বোচ্চ জিপিএ দেখে তাদের আসনসংখ্যা অনুযায়ী শিক্ষার্থী বেছে নেবে, কোনো হাঙ্গামা হবে না।
আর যেহেতু জিপিএ-র পাশাপাশি নাম্বারও জানিয়ে দেওয়া হচ্ছে, সেহেতু কলেজগুলো চাইলে নাম্বার দেখেও শিক্ষার্থী নির্বাচন করতে পারবে। অন্যদিকে শিক্ষার্থীরাও নিশ্চিত থাকবে যে, তার সর্বোচ্চ কাঙ্ক্ষিত কলেজ না পেলেও আসন থাকলে কোনো একটি কলেজে সে ভর্তি হতে পারবে। পরবর্তীতে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোও যাতে এটা অনুসরণ করতে পারে তার উদ্যোগ নেওয়া যাবে। আর সেটা সম্ভব হলে উচ্চশিক্ষায় ভর্তির ক্ষেত্রে শিক্ষার্থী, অভিভাবক ও বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের যে হাঙ্গামা এবং সময় ও অর্থ ব্যয়, তা ব্যাপকভাবে কমে আসবে। সার্বিকভাবে শিক্ষার পরিবেশের উন্নয়ন ঘটবে।
ফলাফল : প্রশ্নফাঁসের মহামারি সৃষ্টি ও মূল্যায়নে শিথিলতার ফলে জিপিএ-র বাম্পার ফলন এবং প্রায় শতভাগ পাশ নিশ্চিত হওয়ায় যোগ্যতার নির্দেশক হিসাবে জিপিএ প্রায় অর্থহীন হয়ে পড়েছিল। এ অবস্থায় কলেজগুলো ভর্তিপরীক্ষা না নিয়ে শুধু জিপিএ মান দেখে যখন ভর্তি করাতে লাগলো তখন ক্লাসে শিক্ষার্থীদের মানের ব্যবধান আগের তুলনায় অনেক বেড়ে গেল। বিশেষ করে বিজ্ঞান ও গণিতের ক্ষেত্রে এটা চরম বিশৃঙ্খল পরিস্থিতির তৈরী করলো। অন্যান্য বিষয়ের ক্ষেত্রেও কমবেশী একই ধরণের সংকট তৈরী হলো।
এতে করে বহু প্রতিবন্ধকতা নিয়েও উচ্চ মাধ্যমিক স্তরের কিছু ভালো কলেজ যেটুকু মান রেখে চলার চেষ্টা করছিল সেটাও ভেঙে পড়লো। টিকে থাকলো শুধু হলিক্রস-নটরডেমের মতো মিশনারীদের কয়েকটি কলেজযারা বলা যায় একরকম সরকারের অবাধ্য হয়ে, এমনকি প্রশাসনিক অসহযোগিতা নিয়েও ভর্তি পরীক্ষা অব্যাহত রাখার চেষ্টা করে যেতে লাগলো।
তবে স্বায়ত্তশাসিত বিশ্ববিদ্যালয়গুলো রাজী না হওয়ায় সরকার অনেক হুমকি দিয়েও শেষ পর্যন্ত বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে শুধু জিপিএ স্কোর দেখে ভর্তির সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসে। আর সে-সময় থেকেই ফি বছর প্রশ্ন উঠতে থাকে, এ-প্লাস আর গোল্ডেন এ-প্লাস পাওয়া শিক্ষার্থীরাও কেন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষায় এতো খারাপ করছে? এটা যেহেতু সরকারের জন্য বিব্রতকর, সেজন্য নানা হুমকি-ধামকি দিয়েও তারা আপাতত চুপ আছে। তবে আগামীতে এর উপায় অনুসন্ধানের চেষ্টা নতুন কারিকুলাম (২০২১)-এর মধ্য দিয়ে করা হবে তার ইঙ্গিত দেওয়া হয়েছে।
ছয় : ২০২০ থেকে চলমান …
প্রশ্ন ১ : প্রাথমিক ও জুনিয়র বৃত্তি পরীক্ষা কেন বাতিল করা হলো?
মহৎ উত্তর : বৃত্তি সবাই পায় না, এতে অনেক শিক্ষার্থী মানসিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তাছাড়া বৃত্তি একটা প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষা, যা এ বয়সের শিক্ষার্থীদের জন্য খুব ক্ষতিকর।
প্রকৃত উত্তর : শিক্ষার মানের উন্নতি দেখাতে অনেক বছর থেকে বৃত্তির সংখ্যা ধারাবাহিকভাবে বাড়ানো হয়েছে কিন্তু টাকার পরিমাণ তেমন বাড়ানো হয়নি। বরং সময়ের সাথে সাথে এর পরিমাণ তুলনামূলকভাবে অনেক কমে গেছে। ৫ টাকা স্কুল-বেতনের সময় বৃত্তির পরিমাণ যেখানে ৩০ টাকা ছিল, হাজার টাকা স্কুল-বেতনের সময় সেখানে বৃত্তির পরিমাণ হয়েছে দুশো টাকা।
ক্রমাগত বৃত্তির সংখ্যা বাড়িয়ে সাধারণের সন্তান ও অভিভাবকদের অনেকটা মিথ্যে তুষ্টিতে ভোগানো হয়েছে, কিন্তু এতে করে স্কুলগুলোতে বৃত্তির টাকা প্রদান জনিত কাজ বেড়েছে—দুর্নীতি তৈরী হয়েছে, অনেক শিক্ষার্থী টাকা পায় না, বা অনেক অভিভাবক হয়রানির শিকার হয়ে টাকা নেন না, ইত্যাদি। পরিস্থিতি নিরসনে শিক্ষা কর্তৃপক্ষকে বৃত্তিপ্রাপ্তদের ব্যাংক একাউণ্ট খুলিয়ে বৃত্তির সামান্য টাকা ব্যাংকে পাঠানোর ব্যবস্থা করতে হয়েছে। এতেও এনআইডি, জন্মনিবন্ধন ইত্যাদি মিলিয়ে সারাদেশের অভিভাবক ও শিক্ষার্থীদের সময়ের অপচয় ও ভোগান্তি থামে না।
অন্যদিকে ভালো স্কুলগুলোতে বৃত্তিপ্রাপ্ত শিক্ষার্থী অধিক ভর্তি হওয়ায় বেতন ও ভর্তি ফি মওকুফ করতে গিয়ে প্রতি বছর তাদের লক্ষ লক্ষ টাকা আয় কমে যায়। সরকার সারাদেশের শিক্ষার্থীদের মোট যতো টাকা বৃত্তি দেয়, স্কুলগুলোর বেতন ও ভর্তি ফি মওকুফ করতে হয় তার চেয়ে প্রায় শতগুণ বেশী। ফলে তারা বৃত্তিপ্রাপ্ত শিক্ষার্থীদের অবহেলার চোখে দেখতে থাকে, বেতন দিতেও বাধ্য করতে থাকে।
এ নিয়ে শিক্ষা-কর্তৃপক্ষ ও স্কুল-কর্তৃপক্ষ (উভয়ে সরকারী রাজনীতিরই কর্তৃপক্ষ)-এর মধ্যে সম্পর্কের টানাপোড়েন চলে। পরিশেষে এটা-সেটা আগু-পিছু এলোমেলো বহু কিছু করে সকল সমস্যার সমাধান নতুন কারিকুলামে খোঁজা হয় এভাবে যে, এটা যেহেতু সাবেকী লিখিত পরীক্ষা এবং এটা নতুন কারিকুলামের সাথে সাংঘর্ষিক, তাই এ ধরণের পরীক্ষা সম্পূর্ণ বাতিল করা প্রয়োজন।
প্রশ্ন ২ : করোনায় একটানা ৫৪৪ দিন শিক্ষা-প্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখা এবং অটোপাশ দেওয়া হলো কেন?
মহৎ উত্তর : করোনা বা কোভিড-১৯ এমন এক ভাইরাস এবং এর মাধ্যমে পৃথিবী এমন একটি মহামারি বা অতিমারির সম্মুখীন হয়েছে যার নজির মানব-সভ্যতার ইতিহাসে নেই। বাংলাদেশ অত্যন্ত ঘনবসতিপূর্ণ দেশ এবং এদেশের শিক্ষার্থী-সংখ্যা প্রায় ৪ কোটি। বিপুল সংখ্যক এই মানবসম্পদের জীবন ঝুঁকিমুক্ত রাখতে ও তাদের শিক্ষাজীবনের ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করার সর্বোচ্চ পদক্ষেপ হিসাবেই দীর্ঘদিন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখতে হয়েছে। এ সময়ে শিক্ষার্থীরা যেহেতু স্বাভাবিক পাঠগ্রহণ কার্যক্রম থেকে দূরে ছিল সেহেতু তাদেরকে পাঠ্যবইয়ের সিলেবাস ভিত্তিক মূল্যায়ন করা সম্ভব ছিল না। সে-কারণেই পূর্ববর্তী পরীক্ষার ফলাফলের ভিত্তিতে ফলাফল নির্ধারণ বা অ্যাসাইনমেণ্টের ভিত্তিতে মূল্যায়ন বা সিলেবাস খুবই সংক্ষিপ্ত করে পরীক্ষা গ্রহণ করতে হয়েছে।
প্রকৃত উত্তর : পৃথিবীর মধ্যে যেসব দেশ করোনা মহামারিতে অপেক্ষাকৃত কম আক্রান্ত ছিল, বাংলাদেশ ছিল তাদের মধ্যে একটি। সর্বাধিক আক্রান্ত দেশগুলোও কখনো একটানা সারা দেশের সকল ধরণের শিক্ষা-প্রতিষ্ঠান এক মাসও বন্ধ রাখেনি। জাতিসংঘের ঘোষিত নীতিও ছিল বন্ধের ক্ষেত্রে সবার শেষে শিক্ষা-প্রতিষ্ঠান এবং খোলার ক্ষেত্রে সবার আগে শিক্ষা-প্রতিষ্ঠান¾এটা হতে হবে।
তাই তারা করোনার ওয়েব বা ওঠানামা বিবেচনা করে স্বাস্থ্যবিধি মেনে শ্রেণী-কার্যক্রম, ল্যাব ও পরীক্ষা পরিচালনা করেছে। কিন্তু বাংলাদেশের সরকার যেহেতু যথাযথভাবে নির্বাচিত ছিল না এবং তার সকল দপ্তর দীর্ঘদিন ধরে দুর্নীতি, লুটপাট ও নৈরাজ্যের সাথে যুক্ত ছিল, সে-কারণে করোনা পরিস্থিতি তাদের পক্ষে যথাযথভাবে সামাল দেওয়া সম্ভব ছিল না। উপরন্তু এটা তাদের জন্য বাড়তি লুটপাটেরও বড়ো একটা উপায় হিসাবে হাজির হয়। এই চরম নৈরাজ্যকর পরিস্থিতিতে ছাত্রসমাজ যেন একত্রিত হতে না পারে ও প্রতিবাদ না করতে পারে সে-কারণে তার জন্য উচ্চস্তরের শিক্ষা-প্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখা জরুরী ছিল।
আর দীর্ঘদিন ধরে শিক্ষার নিম্ন ও মধ্য স্তরে সাধারণ ধারার শিক্ষা ধ্বংসের যেসব ফরমুলার বাস্তবায়ন চলছিল করোনা পরিস্থিতি সেগুলোর মধ্যে বাড়তি একটা মওকার মতো হাজির হয়। সরকার এই মওকা অটোপাশ, বিকল্প মূল্যায়ন পদ্ধতি, সংক্ষিপ্ত সিলেবাস ও মূল্যায়নে শিথিলতা এনে করোনাকালে শুধু নয়, করোনা-পরবর্তীকালেও সর্বোচ্চভাবে ব্যবহার করেছে। এভাবে পুরো একটা প্রজন্মের শিক্ষা শুধু নয়—তাদেরকে গৃহবন্দী করে, খেলাধুলা ও মেলামেশার সুযোগ থেকে বঞ্চিত করে, মোবাইল-ইন্টারনেটে আসক্ত করে, শারীরিক ও মানসিকভাবে পঙ্গু করে দেওয়া সম্ভব হয়েছে।
প্রশ্ন ৩ : নতুন সমন্বিত একমুখী শিক্ষাক্রম—২০২১ কেন আনা হলো?
মহৎ উত্তর : চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা, ফাইভ-জি গ্রহণের উপযোগী মানবসম্পদ তৈরী, পরীক্ষাভীতি দূর করা, কোচিং-গাইড বন্ধ করা, স্মার্ট বাংলাদেশের জন্য স্মার্ট নাগরিক গড়ে তোলা, অভিজ্ঞতাভিত্তিক ও আনন্দদায়ক শিক্ষাপদ্ধতি চালু করা, প্রতিযোগিতামূলক মনোভাব দূর করা, সহযোগিতামূলক মনোভাব বৃদ্ধি করা, ইত্যাদিসহ বহু কিছুর জন্য এই কারিকুলাম বহু গবেষণা ও অভিজ্ঞতার ফলাফল।
সম্ভাব্য উত্তর : মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষার্থীদের বিজ্ঞান ও গণিত শিক্ষাকে বিপর্যস্ত ও সঙ্কুচিত করে উচ্চশিক্ষা স্তরে বিজ্ঞান অনুষদকে শুধু নয়—সমাজবিজ্ঞান, বাণিজ্য এমনকি মানবিক অনুষদকেও ক্ষতিগ্রস্ত করা। নবম-দশম শ্রেণীতে পদার্থবিজ্ঞান, রসায়ন, জীববিজ্ঞান ও গণিতকে সঙ্কুচিত করে, বিষয় বেছে নেওয়ার সুযোগ বন্ধ করে এবং এলোমেলো বিষয়ের ভারে বিপর্যস্ত করে ইংলিশ ভার্শনের শিক্ষার্থীদের ইংলিশ মিডিয়ামের দিকে ঠেলে দেওয়া এবং বাংলা ভার্শনের শিক্ষার্থীদের একটা অংশকেও এ ধরণের অস্থির প্রতিযোগিতায় নামানো।
জীবনযাপনে ধর্মীয় আচার-আচরণ অনুসরণ করেও যেসব অভিভাবক সাধারণ ধারায় সন্তান পড়াতেন তাদের একটা অংশকে কওমী ধারার দিকে চলে যেতে বাধ্য করা। ইংলিশ ভার্শন স্কুল-কলেজকে ক্রমশ বন্ধ করে দেওয়া এবং সাধারণ ধারাকে অনেকটা কারিগরী ধারায় নিয়ে যাওয়া, যেখান থেকে মূলত করে-খাওয়া শিক্ষার্থী বের হবে, আর তারা কেরানী-কামলা ইত্যাদি হিসাবে দেশে-বিদেশে কাজ করে রেমিটেন্স ও কর্মপ্রবাহ চাঙ্গা রাখবে। দেশে নিম্নমানের প্রচুর ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল সৃষ্টির সুযোগ দেওয়া এবং এখান থেকে ব্যাপকসংখ্যক শিক্ষার্থীর অকৃতকার্য হওয়া।
ইংলিশ মিডিয়ামের মাধ্যমে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রার বহির্গমন ঘটানো এবং এ ধরণের স্কুল প্রতিষ্ঠা ও পরিচালনার নানা প্রক্রিয়া ও ব্যবস্থায় ফেলে সরকার ও কর্তৃপক্ষের আয়ের সুযোগ সৃষ্টি করা। সার্বিকভাবে প্রান্তের শিক্ষার্থীদের মধ্য থেকে উচ্চতর দক্ষতার মানব সম্পদ সৃষ্টির সম্ভাবনা আরো কমানো এবং এ ধরণের লোকবল প্রায় সম্পূর্ণ (মূলত প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারত থেকে) আমদানী করা। সার্বিকভাবে শিক্ষাখাতে বরাদ্দের ক্রমহাসমান ধারা চলমান রাখার জন্য সরকারের ঘাড়ে থাকা সাধারণ ধারা থেকে ব্যাপক সংখ্যাক শিক্ষার্থীকে ভিন্ন ধারায় সরিয়ে ফেলা।
পরিশেষে
প্রকৃতপক্ষে বাংলাদেশের ইতিহাস হলো, মধুর ও মহৎ কথার আড়াল দিয়ে এর সাধারণ ধারার শিক্ষা ধ্বংসের ইতিহাস। এই ইতিহাসের বিগত ৫০ বছর ধরে গৃহীত পদক্ষেপসমূহের মধ্যে যেগুলো উপরে আলোচিত হলো তার উদ্দেশ্য ও ফলাফল পর্যালোচনা করলে এর পেছনে একটা গভীর ধ্বংস-পরিকল্পনার ছাপ অনেকটা স্পষ্টভাবেই পাওয়া যায়। কিন্তু কেন করা হলো এই ধ্বংস? এককথায় বললে, করা হলো আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক শক্তির ইশারায় তাদের স্বার্থ সংরক্ষণ করতে এবং দেশে ক্ষমতার গদি টেকাতে ও ক্ষমতাকে ঝুঁকিমুক্ত রাখতে। কিন্তু এতো সহজে এটা করা সম্ভব হলো কেমন করে? এই প্রশ্নের সোজা উত্তর হলো, এদেশের জাতীয় রাজনীতির চরিত্রের কারণে।
এদেশের জাতীয় রাজনীতি ঐতিহাসিকভাবে সুবিধাবাদী। এখানে জাতীয় রাজনীতি মানে ছাত্রদের রক্ত ও ত্যাগের বিনিময়ে দাবী আদায় করে ক্ষমতায় গিয়ে শিক্ষাস্বার্থ ভুলে ছাত্রদেরই লাঠিয়াল বাহিনী বানিয়ে গদি টেকানোর নাম, অথবা ছাত্রদের জাতির ভ্যানগার্ড আখ্যা দিয়ে তাদেরকে কৃষকের, শ্রমিকের, মুটে-মজুর-মজলুমের করে, নিজের সকল সমস্যা ভুলিয়ে সর্বত্র দাবড়িয়ে নিয়ে শেষে ছিঁবড়ে বানিয়ে রাজপথে ছেড়ে দেওয়ার নাম। তাই এই রাজনীতির দিক থেকে অতীতের নকল, প্রশ্নফাঁস, শতভাগ পাশ ইত্যাদি দিয়ে শিক্ষাধ্বংসের প্রকল্প বিষয়ে শুধু নয়, সাম্প্রতিক করোনাকে শিক্ষাধ্বংসের মওকা হিসাবে ব্যবহার ও একমুখী সমন্বিত কারিকুলামের নামে শিক্ষার সাধারণ ধারাকে একেবারেই তার বৈশিষ্ট্য থেকে সরিয়ে ফেলার যে কার্যক্রম চালানো হচ্ছে তা নিয়ে তেমন কোনো উচ্চবাচ্যই শোনা যায়নি।
প্রকৃতপক্ষে এদেশের রাজনীতি শুরু থেকেই শিক্ষাকে নাবালেগদের বিষয় করে রেখেছে, তাই তার সাবালেগত্ব আজ স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছরেও আসেনি—মাঝ থেকে শিক্ষা যেটুকু পরাধীন আমলে ছিল, সেটুকুও ধ্বংস হয়ে গেছে। বস্তুত শিক্ষা ধ্বংসের মাধ্যমেই গোটা দেশকে ধ্বংস করে দেওয়া গেছে। ঘুরতে হলে তাই সবাইকে এখানেই মনোযোগ দিতে হবে।
২রা ডিসেম্বর ২০২৩ তারিখ জাতীয় প্রেসক্লাবের ভিআইপি লাউঞ্জে ‘শিক্ষা ও শিশু রক্ষা আন্দোলন (শিশির)’ এবং ‘গন্তব্য’ আয়োজিত সেমিনারে উপস্থাপিত প্রবন্ধের পরিমার্জিত রূপ।
লেখক পরিচিতি
রাখাল রাহা 'সম্পাদনা' প্রতিষ্ঠানের এডিটর-ইন-চীফ এবং সাহিত্য, শিক্ষা ও সম্পাদনা নিয়ে কাজ করছেন। তিনি শিক্ষা ও শিশু রক্ষা আন্দোলনের একজন সংগঠক। তিনি শিক্ষার নানা প্রসঙ্গ নিয়ে প্রতিনিয়ত লিখছেন এবং শিক্ষাবিষয়ে তাঁর নানা প্রকাশনা রয়েছে।