বাড়ি গবেষণা

গবেষণাপত্র বা রিসার্চ পেপার লিখবেন কীভাবে?

উচ্চতর বা বিশ্ববিদ্যালয়ে ডিগ্রি
উচ্চতর বা বিশ্ববিদ্যালয়ে ডিগ্রি, ছবি-কৃতজ্ঞতা: ntvbd.com

নবীন গবেষক ও শিক্ষার্থীদের জন্য গবেষণার একটি ভীতিকর অংশ হলো গবেষণালব্ধ ফলাফলকে গবেষণাপত্র বা রিসার্চ পেপার আকারে লেখা। আমার পিএইচডি বা মাস্টার্স ছাত্রদের হাতে ধরে ধরে সেটা শিখাই। এই অধ্যায়ে কীভাবে রিসার্চ পেপার লিখা শুরু করতে হবে, তাই নিয়ে সংক্ষিপ্ত আকারে লিখছি।

গবেষণাপত্র বা রিসার্চ পেপারের মূল উদ্দেশ্য হলো গবেষণায় কী পেয়েছেন, সেটাই সংক্ষিপ্ত আকারে জানানো। খেয়াল রাখবেন, আপনি হয়তো বছর খানেক কাজ করেছেন, তাই সবকিছুর খুঁটিনাটি জানেন ঠোটস্থ ভাবে, কিন্তু পাঠকের সেই গভীর জ্ঞান নাও থাকতে পারে। কাজেই গবেষণাপত্র বা রিসার্চ পেপারের শুরুটা করতে হবে গবেষণার বিষয়টির প্রেক্ষিত বা background নিয়ে আলোচনা করে।


পেপারের শুরুতেই থাকে abstract বা সারাংশ। এই অংশটি ৫/৬ বাক্যের বেশি হওয়া উচিত না। এই অংশের কাজ হলো গবেষণাপত্রটির সংক্ষিপ্তসার তুলে ধরা খুব অল্প জায়গায়।

পেপারের শুরুতেই থাকে abstract বা সারাংশ। এই অংশটি ৫/৬ বাক্যের বেশি হওয়া উচিত না। এই অংশের কাজ হলো গবেষণাপত্রটির সংক্ষিপ্তসার তুলে ধরা খুব অল্প জায়গায়। যেমন, সমস্যাটা কী, তার সমাধান করলে লাভ কী, আপনি কী করেছেন, এবং এই পেপারে কী তথ্য/ফলাফল/প্রমাণ তুলে ধরা হয়েছে, সেটা। অনেকেই এই অংশটি অতি দীর্ঘায়িত করে ফেলেন। সেটা ঠিক না। অনেক কনফারেন্স বা জার্নালে অবশ্য শব্দসীমা বেঁধে দেয়া থাকে, তার চেয়ে বেশি দেয়া যায় না। আপাতত এই অংশটিতে সর্বোচ্চ ৬ বাক্য থাকবে এটাই লক্ষ্য স্থির করবেন।

এবার পেপারের মূল অংশ। পেপারের শুরুতে সাধারণত ভূমিকা বা introduction সেকশন থাকে, শেষে থাকে উপসংহার বা conclusion। ভূমিকাতে মূল সমস্যা নিয়ে প্রেক্ষিত নিয়ে বলতে হবে। স্টানফোর্ডের ইনফোল্যাবের প্রফেসর জেনিফার উইডোমের এই নিয়ে দারুণ একটা ফরমুলা আছে, সেটা এরকম। ভূমিকাতে ৫টি অংশ থাকবে:

  • সমস্যাটা কী?
  • সেটা সমাধান করা কেনো দরকার (কী লাভ হবে এটা করে)?
  • সমস্যাটা সমাধান করা কেনো কঠিন?
  • আপনি কী করছেন সেটা সমাধানে? এবং,
  • অন্যরা কী করেছে, তার চাইতে আপনার পদ্ধতির সুবিধা কী কী?

কাজে ইন্ট্রোডাকশন লেখার সময়ে ৫টা প্যারা লিখবেন অন্তত, উপরের ৫টা পয়েন্ট নিয়ে।


এখানে ফলাফল উপস্থাপন (ছক বা চিত্র) করাই যথেষ্ট না, বরং তার চাইতে গুরুত্বপূর্ণ হলো সেই ফলাফল ব্যাখ্যা করা। ডিসকাশন বা আলোচনা অংশে অনেক জোর দিতে হবে। ফলাফল ভালো হলে তো বটেই, খারাপ হলে সেটার সম্ভাব্য ব্যাখ্যাও দিতে হবে।

এর পরে থাকতে পারে background বা motivation অংশ, যেখানে এই পেপারের বিষয়ে কিছু প্রাথমিক ধারণা সংক্ষেপে দেয়া হবে। মূলত কনসেপ্ট বা ধারণাগুলা সংক্ষেপে লিখে সেসব বিষয়ের নানা পেপারের সাইটেশন দিতে হবে।

এবারে আসবে আপনার পেপারের টেকনিকাল বা কারিগরি অংশটি। পেপার কীসের উপরে, তার উপরে নির্ভর করবে এখানে কী থাকবে। এই অংশে সিস্টেম ডিজাইন/আর্কিটেকচার থাকতে পারে, থিওরির অংশ থাকতে পারে, এক্সপেরিমেন্টাল মেথডলজি থাকতে পারে, ইত্যাদি। অবশ্যই চিত্রের সাহায্যে ব্যাখ্যা করতে হবে।

পরের অংশে থাকবে আপনার এক্সপেরিমেন্টাল রেজাল্ট বা ফলাফল ও তার বিশ্লেষণ। এখানে ফলাফল উপস্থাপন (ছক বা চিত্র) করাই যথেষ্ট না, বরং তার চাইতে গুরুত্বপূর্ণ হলো সেই ফলাফল ব্যাখ্যা করা। ডিসকাশন বা আলোচনা অংশে অনেক জোর দিতে হবে। ফলাফল ভালো হলে তো বটেই, খারাপ হলে সেটার সম্ভাব্য ব্যাখ্যাও দিতে হবে।

রিলেটেড ওয়ার্ক বা এই বিষয়ে অন্য কে কী কাজ করেছেন, সেটার অবস্থান নিয়ে একটু দ্বিমত আছে। কেউ কেউ পেপারের সব শেষে সেটা দিতে পছন্দ করেন, আবার কেউ কেউ পেপারের শুরুতে। পেপারের বিষয়ের উপরেও অনেক ক্ষেত্রে এটা নির্ভর করে। তবে এই অংশের মোদ্দা কথা হলো অন্য কে কী কাজ করেছে তা উল্লেখ করা, এবং বিনয়ের সাথে তাদের কাজের সাথে আপনার কাজের পার্থক্য বা সুবিধাগুলা উল্লেখ করা। (বিনয়ের সাথে করাটা গুরুত্বপূর্ণ, অমুকের কাজ “জঘন্য” এই টাইপের কিছু কখনোই লিখতে যাবেন না!)। পার্থক্যগুলা ছক আকারে দিতে পারলে ভালো হয়।

সবশেষে আসে conclusion বা উপসংহার। এই অংশে থাকবে এই পেপারে কী পড়লেন পাঠক, তার উপরে কিছু কথা। এই অংশে এই পেপারে কী কাজ দেখানো হয়েছে তা ছাড়াও এই কাজের ভিত্তিতে কী সুবিধা পাওয়া যাবে এবং ভবিষ্যতে আপনি আর কী করতে পারেন (future work) সেই বিষয়ে বলা চলে।


রিসার্চ পেপার আসলে গল্প বলা— আপনার রিসার্চকে সহজে বুঝিয়ে বলা। কীভাবে শুরু করবেন তার হদিস এখনো না পেলে এক কাজ করুন, আপনার মা বাবা বউ ভাই বোন বন্ধু— এমন কেউ যে এই বিষয়ে কিছুই বোঝেনা, তাকে ১০ মিনিটে ব্যাপারটা বুঝিয়ে বলুন।

এবং সবশেষে bibliography/reference এই অংশটি তো থাকছেই, যেখানে আপনার সাইট করা সব পেপারের তথ্য দিতে হবে।

ব্যাস, এই নিয়মগুলা মেনে চললেই লিখতে পারবেন গবেষণাপত্র। মনে রাখবেন, পাঠক কিন্তু আপনার চাইতে কম জানেন এই বিষয়টা, কাজেই আপনার কাছে জলবৎ তরলং জিনিষও আসলে বুঝিয়ে বলতে হবে।

গবেষণাপত্র আসলে গল্প বলা— আপনার রিসার্চকে সহজে বুঝিয়ে বলা। কীভাবে শুরু করবেন তার হদিস এখনো না পেলে এক কাজ করুন, আপনার মা বাবা বউ ভাই বোন বন্ধু— এমন কেউ যে এই বিষয়ে কিছুই বোঝেনা, তাকে ১০ মিনিটে ব্যাপারটা বুঝিয়ে বলুন। তার পর কীভাবে বোঝালেন, সেটাকেই ভাষায় লিখেন উপরের কাঠামো অনুসারে।

(মূল লেখাটি প্রকাশিত হয়েছে লেখক রাগিব হাসানের “গবেষণায় হাতেখড়ি” বইতে, প্রকাশক আদর্শ প্রকাশনী। লেখকের অনুমতিক্রমে এখানে পুনঃপ্রকাশিত। বানানরীতি লেখকের নিজস্ব।)

লেখক পরিচিতি

ড. রাগিব হাসান মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দ্যা ইউনিভার্সিটি অব অ্যালাবামা অ্যাট বার্মিংহাম-এ অধ্যাপক হিসেবে কর্মরত রয়েছেন। তিনি বাংলাদেশের শিক্ষার নানা প্রসঙ্গ নিয়ে নিয়মিত লেখালেখি করছেন।

1 মন্তব্য

  1. অনেক পয়েন্টেই একমত হওয়া গেল না।
    ১।
    “পেপারের শুরুতেই থাকে abstract বা সারাংশ। এই অংশটি ৫/৬ বাক্যের বেশি হওয়া উচিত না। … আপাতত এই অংশটিতে সর্বোচ্চ ৬ বাক্য থাকবে এটাই লক্ষ্য স্থির করবেন।”
    এটা নির্ভর করে আপনি কোথায় লেখা পাঠাবেন তার উপর। আপনি যে ফিল্ডে কাজ করেন সেখানে কী স্টান্ডার্ড কী সেটা খেয়াল করুন। একটা জার্নাল বেছে সেখানে দৈবচয়ন করে দেখুন অ্যাবস্ট্রাক্টের সাইজ কেমন হয়। তারপর লিখতে বসুন। কনফারেন্সের ক্ষেত্রে সাধারণত শব্দ সংখ্যা লেখা থাকে। আমি যে ফিল্ডে কাজ করি সেখানে বেশীরভাগ ক্ষেত্রে ৫০০ শব্দ। সুতরাং, ৫-৬ বাক্যে লিখতে হবে এটা সাধারণীকরণ করা যাবে না।

    ২।
    “অবশ্যই চিত্রের সাহায্যে ব্যাখ্যা করতে হবে।”
    কিছু জার্নালের ক্ষেত্রে সত্য/পরামর্শ হতে পারে এটা। কিন্তু কখনোই এ বাক্যে “অবশ্যই” বলা যাবে না।

    ৩।
    “পাঠক কিন্তু আপনার চাইতে কম জানেন এই বিষয়টা,”
    এটা নতুন আমার কাছে। উচ্চতর গবেষণায় লেখা টেক্সট পত্রিকার অপ-এড নয়। এটার পাঠকশ্রেণী বিশেষজ্ঞরাই।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Exit mobile version