এদেশে শিক্ষকদের দুর্দশার অন্ত নেই। বেসরকারি প্রাথমিক বা মাধ্যমিক বিদ্যালয়গুলোর শিক্ষকদের দুর্দশা সরকারি বিদ্যালয়ের চেয়ে কিছুটা হলেও বেশি। হাজারো সমস্যার আবর্তে কোনোমতে বেঁচে থাকা এসব বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা নতুন বছরের শুরুতে জাতীয়করণ বিষয়ে একটি বড় আনন্দের সংবাদ পেলেন।
গত ৮ জানুয়ারি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নানা ধরনের ২৬ হাজার ২০০টি বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়কে জাতীয়করণ করার ঘোষণা দিয়েছেন। এর ফলে বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা সরকারি মূল বেতনের পাশাপাশি অন্যান্য সুবিধাদিও পাবেন। শিক্ষকদের ব্যক্তিগত সুবিধা বৃদ্ধির পাশাপাশি এই সিদ্ধান্তের ফলে বিদ্যালয়গুলোও নানভাবে আগের চেয়ে উপকৃত হবে। সরকারি ও বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলো মধ্যকার যে দূরত্ব ছিল, তা পুরোপুরি দূর হবে। এর ফল হিসেবে আশা করা যেতে পারে যে, বেসরকারি বিদ্যালয়গুলোর জাতীয়করণ করার ফলে সরকারি নানা সুবিধা পাওয়ার পর সেগুলোর গুণগত মান বর্তমানের চেয়ে অনেকাংশে বৃদ্ধি পাবে।
নব্বইয়ের দশকের শুরু বা ১৯৯১ সাল থেকে বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা জাতীয়করণ করার দাবিতে আন্দোলন করে আসছিলেন। ওই সময়েই বাংলাদেশে প্রাথমিক শিক্ষাকে অবৈতনিক ও বাধ্যতামূলক করা হয়। প্রাথমিক শিক্ষা উন্নয়নে নেয়া হয় নানা ধরনের উদ্যোগ। পরবর্তী সময়েও প্রাথমিক শিক্ষায় নানা ধরনের দেশি-বিদেশি সহায়তা এসেছে কিন্তু বেসরকারি প্রাথমিক শিক্ষকদের জীবনমান উন্নয়নে বড় কোনো উদ্যোগ নেয়া হয়নি। অর্থাৎ ১৯৯১ সালের পর থেকে ক্ষমতায় আসা সরকারগুলো
বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের এই দাবির প্রতি নজর দেয়নি। এ আন্দোলন করতে গিয়ে শিক্ষকরা নানাভাবে নাজেহাল হয়েছেন, দিনের পর দিন ক্লাশ বন্ধ রেখে রাস্তায় তাঁদের পড়ে থাকতে হয়েছে। এমনকি বর্তমান সরকারের আমলেও বলা হয়েছিল, এ ধরনের জাতীয়করণ করার পরিকল্পনা এই সরকারের নেই। কিন্তু শেষতক শিক্ষকদের দাবি মেনে জাতীয়করণের ঘোষণাটি লাখো শিক্ষকের মুখে যেমন হাসি ফুটিয়েছে, তেমনি শিক্ষার প্রতি, বিশেষত প্রাথমিক শিক্ষায় রাষ্ট্রের দায়ভারের বিষয়টিতে সরকারের ঘোষণাটি সার্বিক অর্থেই ইতিবাচক হিসেবে দেখা দিয়েছে।
প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণার পর থেকেই বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সব শিক্ষকের চাকরি যে জাতীয়করণ হয়ে গেল, তা নয়। তিনটি ধাপে এই ঘোষণা বাস্তবায়ন করা হবে। চলতি বছর অর্থাৎ ২০১৩ সালের ১ জানুয়ারি থেকে ২২ হাজার ৯৮২টি নিবন্ধিত বা এমপিওভুক্ত বিদ্যালয়ের ৯১ হাজার ২৪ জন শিক্ষক এ সুবিধা পাবেন। পরবর্তী পর্যায়ে আগামী ১ জুলাই থেকে স্থায়ী বা অস্থায়ীভাবে পাঠদানের অনুমতি পাওয়া, কমিউনিটি ও সরকারি অর্থায়নে এনজিও পরিচালিত দুই হাজার ২৫২টি বিদ্যালয়ের নয় হাজার ২৫ জন শিক্ষক এর আওতায় আসবেন। সর্বশেষ পর্যায়ে ২০১৪ সালের ১ জানুয়ারি থেকে পাঠদানের অনুমতির সুপারিশপ্রাপ্ত ও অনুমতির অপেক্ষমান ৮৬০টি বিদ্যালয়ের তিন হাজার ৭৯৬ জন শিক্ষক জাতীয়করণের আওতায় আসবেন। সব মিলিয়ে মোট এক লাখ তিন হাজার ৮৪৫ জন শিক্ষককে জাতীয়করণের আওতায় আনা হবে। পুরো প্রক্রিয়াটি বাস্তবায়ন করতে সরকারের অতিরিক্ত ৬৫১ কোটি টাকা খরচ হবে বলে শিক্ষামন্ত্রী জানিয়েছেন।
স্বাভাবিকভাবেই এই ঘোষণার পর থেকে বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা উৎফুল্ল। শিক্ষকরা যখন জাতীয়করণের আন্দোলনটি শুরু করেছিলেন, তখন তাঁদের দাবি ছিল শুধু রেজিস্টার্ড প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদেরকে জাতীয়করণের আওতায় আনা। প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণায় তাঁরা ছাড়াও আরও কয়েক ধরনের বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা একইসাথে জাতীয়করণের আওতায় চলে আসলেন- মোটামুটি না চাইতেই পেয়ে যাওয়ার মতো অবস্থা।
১৯৭৩ সালের ১ জুলাই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ৩৬ হাজার ১৬৫টি বিদ্যালয়কে জাতীয়করণের আওতায় এনেছিলেন। তারপর কিছু কিছু বিদ্যালয়কে জাতীয়করণ করা হলেও এবারকার মতো এতো বড় পরিসরে জাতীয়করণ করা হয়নি। সেদিক দিয়ে বলা যায়, বর্তমান প্রধানমন্ত্রী তাঁর পিতার পথ অনুসরণ করলেন। দেশের প্রাথমিক শিক্ষার উন্নয়নের জন্য এটি একটি বিরাট পদক্ষেপ।
যে কাজটির জন্য শিক্ষকরা দীর্ঘদিন সংগ্রাম করছিলেন, তাদের সে প্রত্যাশা পূরণ হয়েছে। সরকারি ও বেসরকারি বিদ্যালয়গুলোতে আগে উন্নয়নের জন্য সরকার থেকে যে বরাদ্দ যেত, তাতে সঙ্গতকারণেই একটি বৈষম্য বিরাজমান ছিল। এখন আর সেই বৈষম্য থাকছে না। বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোকে এতোদিন টাকাপয়সা বা বিদ্যালয়ের উন্নয়ন নিয়ে দুর্ভোগ পোহাতে হতো, নানাভাবে বিদ্যালয়ের তহবিল সংগ্রহের কাজটি করতে হতো শিক্ষকদের। এই ধরনের কাজ আর তাঁদেরকে করতে হবে না। যদিও এই ঘোষণার দ্বারা যে বিদ্যালয়গুলোর চেহারা রাতারাতি পরিবর্তন হয়ে যাবে তা নয়; কিন্তু শিক্ষকরা মানসিকভাবে নির্ভার থাকবেন অনেকক্ষেত্রে। প্রশ্ন হচ্ছে, এই নির্ভরতার কোনো ছাপ কি দেখা যাবে শিক্ষার গুণগত মান পরিবর্তনের দিক দিয়ে?
সরকারি ও বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোর শিক্ষার্থীদের ফলাফল ও অন্যান্য সূচক তুলনা করলে দেখা যাবে, কিছু ব্যক্তিক্রম ছাড়া বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলো গুণগত মানের দিক দিয়ে সরকারি বিদ্যালয়গুলোর তুলনায় পিছিয়ে আছে। এর কারণ হিসেবে অনেক সময়ই বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা নানা ধরনের সুযোগ-সুবিধার অভাব কিংবা সরকারের তরফ থেকে বৈষম্যের কথা তুলে ধরতেন। এখন যেহেতু সেই বৈষম্য অপসারিত হতে যাচ্ছে, সুতরাং শিক্ষকদের কাছ থেকে তাঁদের বিদ্যালয়গুলোর গুণগতমান বৃদ্ধির একটা প্রচেষ্টা দৃশ্যমান হবে বলে আশা করা যায়।
সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা বেসরকারি বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের চেয়ে অনেক বেশি বিষয়ভিত্তিক প্রশিক্ষণ পেয়েছেন। এটিকেও বেসরকারি বিদ্যালয়গুলোর পিছিয়ে থাকার একটি কারণ হিসেবে মনে করা হয়। তবে সব চেয়ে বড় কারণ সম্ভবত শিক্ষকদের মানসিকতার মধ্যেই লুকায়িত থাকে। শিক্ষকরা কিন্তু চাইলে তাঁদের বিদ্যালয়ে পড়ালেখার মান বাড়াতে পারেন- সেজন্য অন্য কারো মুখাপেক্ষী হতে হয় না। অনেক বিদ্যালয়ে শিক্ষককে দেরিতে এসে আগে চলে যেতে দেখা যায়, অনেকে ঠিকমতো ক্লাশ নেন না, অনেকক্ষেত্রে তাঁরা শিক্ষার্থীদের বাড়ির কাজ যথাযথভাবে মূল্যায়ন করেন না, শিক্ষক নিজে যা জানেন তাও ঠিকমতো শিক্ষার্থীদের কাছে সঞ্চারিত করতে চান না।
একজন শিক্ষক যদি চান তাঁর শিক্ষর্থীদের উপযুক্তভাবে গড়ে তুলতে, তাহলে শত বাধাও তাঁকে দমাতে পারবে না। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে সেরকমভাবে শিক্ষার্থীদের গড়ে তুলতে কতো শতাংশ আন্তরিকভাবে কাজ করেন, সেটি একটি বিরাট প্রশ্ন। অন্য আট-দশটি পেশার মতো শিক্ষকতা নিছকই একটি পেশা নয়, এর সঙ্গে নানা অনুষঙ্গ জড়িত। একজন শিক্ষক যদি সেগুলো উপলব্ধি করেন, তাহলে পেশাগত বিষয়গুলোকে সামনে রেখে নানা দাবিদাওয়া তুলেও তিনি নিজের কর্তব্যকর্ম যথাযথভাবে সম্পন্ন করতে পারেন। জাতীয়করণ করার ফলে যেহেতু তাদের অনেক সমস্যার সমাধান হবে, সুতরাং শিক্ষকরা এবার বাড়তি অনেক চিন্তা বাদ দিয়ে পড়ালেখার প্রতি মনোনিবেশ করতে পারবেন বলে আশা করতে চাই। ১৯৯১ সাল থেকে চলে আসা শিক্ষকদের জাতীয়করণের দাবি সবসময়ই যৌক্তিক ছিল।
ফলে সরকার শিক্ষকদেরকে জাতীয়করণের সুবিধা প্রদান করে আসলে বাড়তি কোনো দায়িত্ব পালন করে নি; বরং পুরো বিষয়টিকে শিক্ষার প্রতি সরকারের ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গির প্রমাণ হিসেবেই দেখা যেতে পারে। সরকার এতোগুলো বিদ্যালয়কে একসঙ্গে জাতীয়করণ না করলে কারও কিছু বলার ছিল না। সরকার চাইলে কিছু বিদ্যালয়কে জাতীয়করণ করে বাকিগুলোকে এর বাইরে রাখতে পারতো। সুতরাং সরকারের এই ইতিবাচক পদক্ষেপের এখন প্রতিদান দেয়ার পালা- শিক্ষকদের পক্ষ থেকে। অন্তত জাতীয়করণ করার আগে শিক্ষার গুণগত মানের দিক দিয়ে বিদ্যালয়গুলো যে অবস্থায় ছিল, শিক্ষকরা যদি সেখান থেকে উত্তরণ ঘটাতে না পারেন, তাহলে জাতীয়করণ করা আর না করার মধ্যে কোনো পার্থক্য থাকবে না।
আশা করি, শিক্ষকরা তাদের নিজ দায়িত্বের প্রতি মনোযোগী হবেন এবং গুণগত শিক্ষা নিশ্চিত করার মাধ্যমে জাতীয়করণের সুফল দিক সবার সামনে তুলে ধরবেন। আগামী দিনগুলোতে যদি এটা প্রতিষ্ঠা করা যায় যে, বিদ্যালয় জাতীয়করণ করা হলে তা গুণগত শিক্ষা নিশ্চিত করতে সহায়ক হয়, তাহলে তা নিশ্চয়ই মাধ্যমিক শিক্ষার ক্ষেত্রেও অনুঘটক হিসেবে কাজ করবে। তখন হয়তো এমপিওভুক্তি বা জাতীয়করণ নিয়ে এখনকার মতো বেসরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের আন্দোলন করতে হবে না। সরকারও চাইলে শিক্ষাখাতে জাতীয় আয়ের অন্তত ছয় শতাংশ বরাদ্দ রেখে এসব সমস্যার সমাধান সহজেই করতে পারে।
তবে জাতীয়করণ করার ঘোষণার পাশাপাশি প্রধানমন্ত্রী যত্রতত্র বিদ্যালয় স্থাপন করলে অনুমোদন দেয়া হবে না বলে যে ঘোষণা দিয়েছেন, সেটি নিয়ে ভাববার অবকাশ রয়েছে। আমাদের দেশে অধিকাংশ প্রাথমিক বিদ্যালয়ই স্থাপিত হয়েছে ‘যত্রতত্র’। স্থানীয় শিক্ষানুরাগী তরুণরা এসব বিদ্যালয় নিজ উদ্যোগে স্থাপন করেছে। আজকে যতোগুলো বিদ্যালয় জাতীয়করণের আওতায় এসেছে, তার অধিকাংশই ‘যত্রতত্রভাবে’ গড়ে তোলা। এভাবে বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার সুবিধা যেমন রয়েছে, তেমনি অসুবিধাও কিছু আছে।
দেশের কোন জায়গায় কীভাবে কয়টি বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা যেতে পারে, সরকারের, বিশেষত প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সেরকম গাইডলাইন আছে। সরকারের আর্থিক সক্ষমতার অভাবের কারণে অনেক জায়গায় বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করতে পারে না। সেসব জায়গায় বিদ্যানুরাগী তরুণরা যদি বিদ্যালয় গড়ে তুলে, তাহলে ক্ষতি কী? তবে দেখতে হবে, সেসব বিদ্যালয় যেন গাইডলাইন মেনেই তৈরি করা হয়। যদি গাইডলাইন মেনে বিদ্যালয় তৈরি করা না হয়, তাহলে সেটি চালুর অনুমতি না দিলেই তো হয়! কর্তৃপক্ষের অনুমতি ছাড়া কেউ তো আর বিদ্যালয়ের কাজকর্ম পরিচালনা করতে পারবে না! অনেক জায়গা বিশেষত হাওর বা চা বাগানের মতো দুর্গম এলাকায় যেখানে সরকার এখনই বিদ্যালয় চালু করতে পারছে না, সেখানে স্থানীয় মানুষরা যদি বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করতে চায়, তাহলে লাভ ছাড়া ক্ষতি নেই। প্রধানমন্ত্রীর এই ঘোষণাটি প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় নিশ্চয়ই সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়ে বিচার করবে, কিন্তু কোনো সিদ্ধান্ত নেয়ার আগে বিষয়টি পুনরায় ভাবা দরকার।
লেখক পরিচিতি
গৌতম রায় রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটে সহযোগী অধ্যাপক হিসেবে কর্মরত রয়েছেন।