নকলের নানা রূপ

নকলের নানা রূপ সম্পর্কে সাধারণের ধারণাই কী? ছবিসূত্র: 123rf.com
নকলের নানা রূপ সম্পর্কে সাধারণের ধারণাই কী? ছবিসূত্র: 123rf.com

নকল করা যে ঘৃণার্হ এটি সবাই জানে। মানে কয়জনে, সেটি নিয়ে কথা বলতে গেলে ঝামেলা বেড়ে যাবে। সে-আলাপে যাওয়ার আগে ভেবে দেখা প্রয়োজন যে, নকল বলতে সাধারণে আসলে কোন কাজগুলোকে বোঝে। নকলের নানা রূপ সম্পর্কে সাধারণের ধারণাই বা কী!

নকল এক ধরনের চৌর্যবৃত্তি তো বটেই। না বলে পরের দ্রব্য নিলে তাকে চুরি বলে। আর যে-নম্বর বা ফলাফল একজনের পাওয়ার কথা নয়, সেটি অসদুপায় অবলম্বন করে অর্জন করাকেই আমি নকল বলে অভিহিত করি। শিক্ষাজীবনের বিভিন্ন পর্যায়ে নকলের নানা রূপ বুঝে বা না বুঝে আমরা অনেকেই এই কাজগুলো করেছি।

ধরুন, প্রশ্নফাঁস নিয়ে দেশ টালমাটাল। পরীক্ষার আগের রাতে বা সকালে প্রশ্ন পেয়ে যাচ্ছে কেউ কেউ টাকার বিনিময়ে। অথবা কাউকে শিক্ষক উত্তর বলে দিচ্ছেন বা বাইরে থেকে নকল সাপ্লাই আসছে। এসএসসি, এইচএসসির মতো পাবলিক পরীক্ষাই শুধু নয়; বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্নফাঁসের অসংখ্য অভিযোগ ও প্রমাণ আছে। এরকম নকল আমরা অনেকেই করিনি বা করলেও স্বীকার করবো না। কিন্তু নিজেরা ফিসফাস করে নৈর্ব্যক্তিক প্রশ্নের উত্তর মেলায়নি, এমন কাউকে পাওয়া কঠিন হয়ে যাবে। নৈতিকতার এই জায়গাটি গোলমেলে। সন্তান প্রশ্নের উত্তর চিরকুটে লিখে নিয়ে গেছে— এই পরিস্থিতিতে যে অভিভাবকের লজ্জায় মাথা কাটা যাবে, সেই তিনিই পরীক্ষার কক্ষে দেখাদেখি করা বা উত্তর মেলানোকে খারাপ চোখে দেখেন না। এই না দেখাটা সন্তানকে প্রভাবিত করে। যে-কারণে পরীক্ষা কক্ষে অল্পস্বল্প কথা বলাকে শিক্ষার্থীসমাজ তাদের মৌলিক অধিকার বলেই মনে করে।

নকলের নানা রূপ যেমন আছে, তেমনি নকল যারা করছে তাদেরও রকমফের আছে। কারো নকল দরকার পাশ করার জন্য, আবার কারো নকল দরকার সামাজিক মানমর্যাদা বা ভালো শিক্ষার্থীর তকমা ধরে রাখার জন্য। ধরা যাক, অখ্যাত কোনো এক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। নকল সাথে নিয়ে এসেছে। সে জানে যে তার আশেপাশে যারা পরীক্ষা দিচ্ছে, তারা তাকে সাহায্য করতে পারবে না। অন্যদিকে, আরেকজন বিখ্যাত স্কুলের আপাতত বখে যাওয়া শিক্ষার্থী। তার পড়াশোনার অবস্থা অখ্যাত বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীর মতোই। কিন্তু যেহেতু তার সাথের লোকজন পড়াশোনায় ভালো, সে তাদের থেকে শুনে বা অন্যান্য ফন্দিফিকির করে সব ঠিক উত্তরে গোল্লা ভরাট করে ফেললো। আপনার চোখে কি দুজনেই সমান অপরাধী?

বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষাগুলোতেও এ-ধরনের ঘটনা অহরহ ঘটে। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষায় যাতে নিজের কোচিঙের পরীক্ষার্থীদের আসন এক কাতারে পড়ে, সেজন্য কোচিং সেন্টারের কর্মীবাহিনী ভর্তি ফর্ম বিতরণের সময় থেকেই তৎপর থাকে। আসন বিন্যাসের এবং পরীক্ষাকক্ষে দেখাদেখির সুযোগ নিয়ে অনেককেই এমন সব বিষয়ে বা প্রতিষ্ঠানে ভর্তি হতে দেখেছি, আসন বিন্যাসে এবং ইনভিজিলেশনে কড়াকড়ি থাকলে ফলাফল নিশ্চিতভাবেই অন্যরকম হতো।

বিদেশে উচ্চশিক্ষার্থে যারা আসেন, তারা জানেন যে বাইরে পড়তে আসার পরে যে-বিষয় নিয়ে বারবার সাবধান করা হয়, সেটি হচ্ছে প্লেইজারিজম বা চৌর্যবৃত্তি। নকলের নানা রূপ যে রয়েছে, এটি তার একটি। একে সোজা বাংলায় বললে বলতে হবে, তোমার লেখা তোমাকেই লিখতে হবে, অন্য কারোটা দেখেই লেখো আর মুখস্থ করেই লেখো, সেটি প্লেইজারিজম। ধরা পড়লে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে বহিষ্কার, ডিগ্রি বাতিল, ফান্ডিং বন্ধ যেকোনো শাস্তি হতে পারে।

মজার ব্যাপার হচ্ছে বাংলা মুলুকে প্লেইজারিজম করেনি এরকম কেউ নেই। আমাদের শিক্ষকরা এতে উৎসাহ দেন। ধরুন, যে শিক্ষকের কাছে বাংলা বা ইংরেজির কোচিং করেন, তাঁর দেয়া নোট সবাই লিখলে সেটি প্লেইজারিজম নয় কোন যুক্তিতে? অথবা রচনা বই দেখে মুখস্থ করা বাংলায় রচনা অথবা ইংরেজি এসে? নবম বা দশম শ্রেণির একজন শিক্ষার্থীর কতোটা বাংলা জানার কথা? খাতা পড়লেই বুঝে যাওয়ার কথা কোনটি নিজের লেখা আর কোনটি মুখস্থ উগড়ানো। নকলের নানা রূপ নিয়ে বলতে গেলে এই মুখস্থের প্রসঙ্গ আসবেই।

আর এই গণ্ডগোল শুধু রচনা মুখস্থেই সীমাবদ্ধ নয়। যে শিক্ষক পরীক্ষার প্রশ্ন করবেন, তাঁর কাছে যারা প্রাইভেট পড়ে তাদেরকে সাজেশন বা প্রশ্ন দাগানো বা সিলেবাস সংক্ষিপ্ত করে দেয়া বহুদিন ধরেই ওপেন সিক্রেট। সেই সাজেশন ছোটো হতে হতে কখনো-সখনো ছাপানো প্রশ্নপত্রের আনঅফিসিয়াল রূপ নেয়। বিদ্যালয়ে এবং কোনো কোনো কলেজেও শিক্ষকদের দুর্নীতির কাছে জিম্মি থাকে শিক্ষার্থীরা। মনপসন্দ না হলে সঠিক উত্তরেও নম্বর না দেয়া অথবা কম দিয়ে শিক্ষার্থীকে জিম্মি করা প্রাইভেট পড়ার জন্যে— এও তো ওপেন সিক্রেট। বাংলাদেশের আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপটে প্রাইভেট পড়ানো আমার কাছে দোষণীয় মনে হয় না, যতোক্ষণ সেটি সম্পূর্ণভাবে নীতিবিবর্জিত হচ্ছে।

শৈশব-কৈশোরের এই কুম্ভীলকবৃত্তির দায় যদি পুরোপুরি শিক্ষক এবং অভিভাবকের ওপরেই ছেড়ে দিই, বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে দায় শিক্ষার্থীর ওপরেও অনেকাংশে বর্তায়। যে অ্যাসাইনমেন্ট বা প্রজেক্ট একজন শিক্ষার্থী নিজে শিখে করছে না, সেই নম্বর বা গ্রেডিং তার প্রাপ্য নয়।

মুখস্থবিদ্যার ভূত তাড়াতে আমাদের শিক্ষাবিষয়ক নীতিনির্ধারকেরা কিছু পদক্ষেপ নিয়েছেন। সফলভাবে বাস্তবায়িত হলে সেখান থেকে অনেকখানি সুফল পাবার কথা; কিন্তু বিভিন্ন কারণে তা হয়নি। যেমন, মাধ্যমিক এবং উচ্চ-মাধ্যমিক পর্যায়ে কমিউনিকেটিভ ইংরেজি চালু করা। ২০০১ সালের মাধ্যমিক পরীক্ষার্থীরা প্রথম এই পদ্ধতিতে পরীক্ষা দেয়। ২০০১ সালের আগে পাঠ্যসূচিতে ইংরেজি গদ্য এবং পদ্য ছিলো। ইংরেজি প্রথম ও দ্বিতীয় পত্রে বিশাল সংখ্যক শিক্ষার্থী সম্পূর্ণভাবেই মুখস্থের ওপর নির্ভরশীল ছিলো। কমন পড়েনি, তাই লিখেনি, এই উক্তি এবং যুক্তি বহুল প্রচলিত ছিলো। নিজে থেকে যে লেখা যায় এই ধারণার অনুপস্থিতি চোখ এড়ানোর কথা নয়। কমিউনিকেটিভ ইংরেজি এই মুখস্থ করার ঝামেলা থেকে মুক্তি দেবার কথা; কিন্তু ঝামেলা হয়ে যায় অন্যত্র।

কমিউনিকেটিভ ইংরেজি শেখার পদ্ধতির উদ্দেশ্য ছিলো যে, আগের পদ্ধতির মতো গদ্য বা পদ্যের প্রশ্নোত্তর অথবা রচনা মুখস্থ করে ইংরেজি শেখার বদলে খবরের কাগজ বা অন্য বইপুস্তক পড়ে অথবা ইংরজি খবর শুনে, ইংরেজিতে কথা বলার চর্চার মাধ্যমে ইংরেজি ভাষায় দক্ষতা অর্জন হবে। অনেকটা আমরা বাংলা যেভাবে শিখি সেভাবেই। সমস্যা হয়ে দাঁড়ায়, এই পদ্ধতি ঠিকভাবে কাজে লাগাতে শ্রেণিকক্ষে শিক্ষকদেরকে যেভাবে পড়ানোর কথা সেরকম শিক্ষকের অভাব। সেই সাথে শিক্ষার উপকরণের অভাব, শহরের শিক্ষার্থীরা দৈনন্দিন চলাফেরায় ইংরেজি ভাষার চলচ্চিত্র, গান, টিভি অনুষ্ঠান থেকে যেভাবে অবচেতনে হলেও অনেক কিছু শিখছে, মফস্বলে বা গ্রামে সেই সুযোগ থাকছে না। সেখানে পাঠ্যপুস্তকই মূল ভরসা।

মুখস্থের ওপর জোর কমে যাওয়ায় নিজে নিজে লিখতে বাধ্য হচ্ছে শিক্ষার্থীরা, কিন্তু ইংরেজি ব্যাকরণের ওপরে জোর কমে যাওয়ায় খুব সাধারণ বাক্যও ভুল ইংরেজিতে লিখতে দেখছি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে। কমিউনিকেটিভ ইংরেজি শিক্ষার বর্তমানে প্রচলিত এই পদ্ধতিকে আরও বেশি কার্যকর করার উপায় নিয়ে গবেষণা হওয়া দরকার। আরও গবেষণা হতে পারে এই পদ্ধতির শিক্ষার্থীদের সাথে আগের পদ্ধতির শিক্ষার্থীদের তুলনামূলক দক্ষতার ওপর। আগে লেখাপড়ার মান ভালো ছিলো এই দায়সারা সংলাপে সত্যিকারের অবস্থা বোঝা যায় না।

এই যে শিক্ষার্থী, শিক্ষক, এবং অভিভাবকের ত্রিবেণীসংগম, আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার সামগ্রিক দুর্দশার দায় কার কতোটুকু, সেই আলোচনা এই স্বল্পপরিসরে সম্ভব নয়। নকলের নানা রূপ তুলে ধরাই এখানে মূল আলোচ্য বিষয়। আর এর ফলাফল তো চোখের সামনেই। যে শিক্ষার্থী ইংরেজি বা বাংলায় সর্বোচ্চ গ্রেড নিয়ে মাধ্যমিকের গণ্ডি পেরিয়ে আসে, বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষায় তারাই হাবুডুবু খায়। আবার ভিত্তি মজবুত নয় বলে যারা উচ্চশিক্ষার্থে দেশের বাইরে যেতে চায়, তারা হিমশিম খায় আইএলটিএস বা এই ধরনের বিশেষায়িত পরীক্ষায়, যেখানে আসনবিন্যাস বা সংক্ষিপ্ত সাজেশনের কোনো বালাই নেই।

এরপর যখন শুনি শিক্ষিত লোকে শুদ্ধ বাংলা বা ইংরেজি বলতে বা লিখতে পারে না, তখন হাসবো না কাঁদবো সেটি নিয়ে দ্বিধান্বিত হয়ে পড়ি। গোড়ায় গলদ থাকলে এরকমই হবে। স্যারের নোট ছাড়া কি ইংরেজি লেখা যায়? বাংলা রচনা লেখানোর মূল উদ্দেশ্য আঠারো বা কুড়ি পৃষ্ঠা ভরে ‘সময়ের মূল্য’ বা ‘শ্রমের মর্যাদা’ লেখানো নয়, বরং নিজে নিজে চিন্তা করে লেখার ক্ষমতা অর্জন করা যাতে ‘তোমার প্রিয় কবি’ শুধু নয়, একজন লিখতে পারবেন নিজের অপ্রিয় কবিকে নিয়েও। হোক সেটি বাংলা বা ইংরেজিতে।

কোন মন্তব্য নেই

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে