বাড়ি শিক্ষার ইতিহাস বঙ্গবন্ধুর শিক্ষাভাবনা

বঙ্গবন্ধুর শিক্ষাভাবনা

বঙ্গবন্ধু
বঙ্গবন্ধু

ড. গোলাম কবীর লিখেছেন বঙ্গবন্ধুর শিক্ষাভাবনা নিয়ে

হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান-এর নাম বাংলাদেশের জন্মের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। একটি দেশের জন্মের সঙ্গে যার নাম জড়িত, তিনি স্বাভাবিকভাবেই দেশের প্রতিটি বিষয় সম্পর্কে গভীরভাবে চিন্তা করেছেন, সিদ্ধান্ত নিয়েছেন নানা ঘটনা-অনুষঙ্গের ওপর ভিত্তি করে। মানুষের রাজনৈতিক অধিকার অর্জনের আন্দোলন-সংগ্রামে তিনি ব্যস্ত থেকেছেন পুরো সময়টুকু জুড়ে। একটি দেশকে শূন্য থেকে গড়ে তোলার প্রক্রিয়ায় তিনি নিরলসভাবে কাজ করেছেন। যেহেতু একটি দেশের উত্থানের সঙ্গে তিনি জড়িত, সুতরাং দেশটির সূচনালগ্নে যেসব বিষয় বঙ্গবন্ধুকে বেশি ভাবিয়েছে, তার একটি হচ্ছে শিক্ষা। শিক্ষা যেহেতু একটি জাতির মানস গঠনে মূল ভূমিকা পালন করে, বঙ্গবন্ধু তাই রাষ্ট্রগঠনে এই দিকটির প্রতি বেশি গুরুত্ব দিয়েছেন। বঙ্গবন্ধুর শিক্ষাভাবনা বিষয়টিকে তাই দেখতে হবে স্বাধীন বাংলাদেশের গঠনের পটভূমি ও মানুষের চাহিদাকে কেন্দ্র করে।

বঙ্গবন্ধুর শিক্ষাভাবনা তাঁর ঐতিহাসিক আন্দোলন-সংগ্রামের ঘটনাসমূহের সঙ্গেও যুক্ত। ১৯৪৭-এর পর থেকে এই ভূখণ্ডে যতোগুলো প্রতিবাদ-সংগ্রামের ঘটনা ঘটেছে, বঙ্গবন্ধু সেগুলোর প্রতিটির সঙ্গে ওতোপ্রোতভাবে জড়িত ছিলেন। তিনি নিজেকে ছাত্র সংগ্রাম বা শিক্ষা সংগ্রামের ঘটনাপ্রবাহ থেকে কখনোই দূরে রাখেননি। এ-প্রসঙ্গে বলা যায়, পাকিস্তান আমলে একাধিক বৈষম্যমূলক শিক্ষানীতি এদেশের মানুষের ওপর চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছিলো। সেগুলোর প্রতিবাদে এদেশের ছাত্রজনতা বারবার আন্দোলন করেছে।

১৯৪৭-এর পর থেকে ১৯৭১, এই সময়ের মধ্যে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী মোট ছয়টি প্রধান শিক্ষা কমিশন গঠন করে। ১৯৫২ সালে মাওলানা মোহাম্মদ আকরম খাঁ শিক্ষা কমিশন, ১৯৫৭ সালে আতাউর রহমান খান শিক্ষা কমিশন, ১৯৫৯ সালে এস এম শরীফ কমিশন, ১৯৬৪ সালে বিচারপতি হামুদুর রহমান শিক্ষা কমিশন, ১৯৬৯ সালে এম নূর খান কমিশন এবং ১৯৭০ সালে শামসুল হক কমিশন গঠন করা হয়। এই স্বল্প সময়ের মধ্যে ছয়টি শিক্ষা কমিশন গঠন করার দুটো অর্থ হতে পারে। প্রথমত, কোনো কমিশনের সুপারিশ বাংলাদেশের মানুষজন মেনে নেয়নি। দ্বিতীয়ত, পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী শিক্ষা বিষয়ে তাদের একতরফা ও বৈষম্যমূলক সিদ্ধান্ত বারবার বাংলার জনগণের ওপর চাপিয়ে দিতে চেয়েছিলো। যেহেতু, পাকিস্তান-পর্বের গোটা সময়টিতেই রাজনৈতিকভাবে এ দেশ উত্তাল ছিলো এবং তাদের যে কোনো সিদ্ধান্ত বাংলার মানুষের সতর্ক নজরে ছিলো, তাই শিক্ষার মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে তারা কী করতে পারে, সেই বিষয়ে বাংলার মানুষ সবসময় সজাগ থেকেছে।

একজন রাজনৈতিক নেতা হিসেবে বঙ্গবন্ধু সবসময় জনগণের আবেগ ও অনুভূতিকে ধারণ করেছেন। বিভিন্ন শিক্ষানীতিতে বৈষম্যমূলক সুপারিশের প্রতিবাদে বাংলার ছাত্রজনতা যখন মাঠে নেমেছে, তখন তিনি ও তাঁর রাজনৈতিক সহকর্মীবৃন্দ সবসময় ছাত্রজনতার পাশে থেকেছেন। জনগণের পাশে থাকার এই বিষয়টিকে শুধু যে রাজনৈতিক নেতা হিসেবে জনগণের চাহিদা ও মনোভাবকে সমর্থন করা– বিষয়টিকে এমন সরলীকরণ করা ঠিক হবে না; বরং বঙ্গবন্ধুর যে বিষয়টিকে উপলব্ধি করে একটি দূরদৃষ্টিসম্পন্ন মনোভাব নিয়ে সমর্থন করেছেন, সেভাবে ভাবতে হবে। এই ভাবনার পেছনে মূল যুক্তি হচ্ছে, পাকিস্তান আমলে প্রতিটি ক্ষেত্রেই শিক্ষাকে কুক্ষিগত করার একটি প্রচেষ্টা ছিলো এবং শিক্ষাকে সংকুচিত করার প্রয়াস প্রতিটি ক্ষেত্রে লক্ষ্য করা গেছে। স্বাধীনতার পর সমস্ত সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও যুদ্ধবিধ্বস্ত নবগঠিত বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধুর শিক্ষাভাবনা নিয়ে সচেতনতা পাওয়া যায়। তিনি শিক্ষাকে সম্প্রসারিত করার এবং উন্মুক্ত ও স্বাধীনভাবে চলতে দেওয়ার নানা আয়োজনে সম্পৃক্ত ছিলেন। উদাহরণ হিসেবে, সম্পদের সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও বিশাল সংখ্যক প্রাথমিক বিদ্যালয়কে সরকারিকরণ ও ’৭৩-এর অধ্যাদেশের মাধ্যমে চারটি বিশ্ববিদ্যালয়কে স্বায়ত্তশাসন প্রদানের সিদ্ধান্ত দুটোর কথা বলা যায়।

প্রসঙ্গক্রমে এ-ও উল্লেখ করা যায়, ১৯৭০-এর উত্তাল দিনগুলোতেও তিনি বিভিন্ন সময়ে ভাষণ ও বক্তৃতায়ও শিক্ষার গুরুত্ব সরাসরি উল্লেখ করেছেন। তিনি একাধিকবার ‘সোনার বাংলা’ গড়তে ‘সোনার মানুষ’ গড়ার ওপর গুরুত্ব দিয়েছেন। ১৯৭০ সালে সাধারণ নির্বাচন উপলক্ষে তিনি যখন দেশবাসীর উদ্দেশ্যে বক্তব্য রাখছিলেন, তখন তিনি সরাসরি জানিয়েছিলেন, কোনো দেশ বা সমাজের বিকাশের জন্য শিক্ষাখাতে বিনিয়োগই হচ্ছে সর্বোৎকৃষ্ট, এর চেয়ে বড় বিনিয়োগ আর হতে পারে না। এর অংশ হিসেবে তিনি সমাজ থেকে নিরক্ষরতা দূরীকরণের কথাও বলেছিলেন বেতার-টেলিভিশনে প্রদত্ত ভাষণের সময়। বঙ্গবন্ধুর শিক্ষাভাবনা বিষয়ে অন্তর্ভুক্ত ছিলো বাধ্যতামূলক ও অবৈতনিক প্রাথমিক শিক্ষার বিষয়টিও। বাংলাদেশে প্রাথমিক শিক্ষা অবৈতনিক ও বাধ্যতামূলক হয় ১৯৯০ সালের পর। অথচ, কতোটুকু দূরদৃষ্টিসম্পন্ন হলে একজন নেতা হিসেবে তিনি এই বিষয়টির ওপর গুরুত্ব প্রদান করেছিলেন তারও বিশ বছর আগে। বাস্তবতা হলো, পাকিস্তান আমলে তৎকালীন শাসকগোষ্ঠী এসব বক্তব্য আমলে নেয়নি। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর যখন মাত্র সবকিছু গোছনো শুরু হলো, তখন তিনি এর প্রাথমিক কাজ শুরু করেছিলেন প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোকে জাতীয়করণের মধ্য দিয়ে। কিন্তু স্বাধীনতাবিরোধীদের চক্রান্তে তিনি বেশি সময় পেলেন না। স্বাধীনতার সাড়ে তিন বছরের মাথায় তাঁকে সপরিবারে নির্মমভাবে হত্যা করা হলো। অথচ, তিনি যেভাবে এগোচ্ছিলেন, তাতে তিনি বেঁচে থাকলে আজকে বাংলাদেশ যে অবস্থানে রয়েছে, তার চেয়ে বহুগুণে এগিয়ে থাকত— তা সন্দেহাতীতভাবেই বলা যায়।


একজন রাজনৈতিক নেতা হিসেবে বঙ্গবন্ধু সবসময় জনগণের আবেগ ও অনুভূতিকে ধারণ করেছেন। বিভিন্ন শিক্ষানীতিতে বৈষম্যমূলক সুপারিশের প্রতিবাদে বাংলার ছাত্রজনতা যখন মাঠে নেমেছে, তখন তিনি ও তাঁর রাজনৈতিক সহকর্মীবৃন্দ সবসময় ছাত্রজনতার পাশে থেকেছেন। জনগণের পাশে থাকার এই বিষয়টিকে শুধু যে রাজনৈতিক নেতা হিসেবে জনগণের চাহিদা ও মনোভাবকে সমর্থন করা– বিষয়টিকে এমন সরলীকরণ করা ঠিক হবে না; বরং বঙ্গবন্ধুর যে বিষয়টিকে উপলব্ধি করে একটি দূরদৃষ্টিসম্পন্ন মনোভাব নিয়ে সমর্থন করেছেন, সেভাবে ভাবতে হবে।


বঙ্গবন্ধুর শিক্ষাভাবনা শুধু প্রাথমিকেই থেমে থাকেনি, তিনি ভেবেছেন মাধ্যমিকের কথাও। পাকিস্তান আমলে তো বটেই, বাংলাদেশের বর্তমান বাস্তবতাও হচ্ছে, প্রাথমিক থেকে মাধ্যমিক স্তরে উত্তরণের সময় শিক্ষার্থীদের একটি বড় অংশ লেখাপড়া থেকে ঝরে পড়ে। বর্তমানে এই হার অনেকটা কমে এলেও পাকিস্তান আমলে এটি ভয়াবহ মাত্রায় ছিলো। তিনি সত্তরের নির্বাচনের ভাষণের সময় এটির ওপরও গুরুত্বারোপ করেছেন। তিনি প্রাথমিকের পাশাপাশি মাধ্যমিক শিক্ষার দ্বার যেন সবসময় খোলা থাকে তার ওপর গুরুত্ব আরোপ করেছিলেন। তিনি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশাপাশি মেডিক্যাল ও কারিগরি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠায় গুরুত্ব দিয়েছিলেন। ওই সময়কালে, যখন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা ছিলো হাতে গোনা, তিনি তখন এ-ধরনের বিশেষায়িত বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের ওপর গুরুত্ব আরোপ করে প্রাথমিক থেকে বিশ্ববিদ্যালয় স্তর পর্যন্ত সকল শিক্ষার্থী যাতে বিনা বাধায় লেখাপড়া করতে পারে, তার ওপর জোর দিয়েছিলেন। বিশেষ করে, দারিদ্র্য যেন এক্ষেত্রে কোনো বাধা না হয়ে দাঁড়ায়, সেটিকে লক্ষ্য রাখার কথা তাঁর বক্তৃতায় সরাসরি উল্লেখ করেছেন।

স্বাধীনতার পূর্ব ও পরবর্তী সময়ে বঙ্গবন্ধুর বিভিন্ন বক্তব্য ও কর্মপরিকল্পনা থেকে তাঁর শিক্ষা বিষয়ক ভাবনায় অনেকগুলো মৌলিক বিষয়কে চিহ্নিত করা সম্ভব। সেগুলো নিম্নে আলোচনা করা হলো:

প্রথমত, আমরা জানি, একটি দেশ গড়ার ক্ষেত্রে যে কয়েকটি বিষয়ের ওপর সর্বাধিক গুরুত্ব দেওয়া প্রয়োজন, তার একটি হচ্ছে শিক্ষা। বঙ্গবন্ধু তাঁর বিভিন্ন বক্তব্যে বিষয়টিকে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে গুরুত্ব দিয়েছেন। তিনি একটি দেশ গড়ার মূল উপাদান হিসেবে শিক্ষাকে অপরিহার্য হিসেবে গণ্য করেছেন।


১৯৭৪ সালে বাংলাদেশ মহিলা আওয়ামী লীগের প্রথম সম্মেলন উদ্বোধন করার সময় বক্তৃতায় তিনি স্পষ্টভাবে উল্লেখ করেছেন, যে দেশের মাত্র শতকরা ২০ ভাগ মানুষ শিক্ষিত সেখানে নারীদের মধ্যে শিক্ষার হার আরও অনেক কম। তিনি নারীদের লেখাপড়ার প্রতি আহ্বান জানিয়ে বলেছিলেন, ক, খ জানলেই শিক্ষিত হওয়া যায় না, শিক্ষার মাধ্যমে প্রত্যেককে একেকজন সত্যিকার অর্থেই আলোকিত মানুষ হতে হবে।


দ্বিতীয়ত, একটি দেশের শিক্ষায় কী থাকবে তা মূলত নির্ধারিত হয় উক্ত দেশের মানুষের চাহিদা ও আকাক্সক্ষা কী তার ওপর। গণমানুষের আকাক্সক্ষার সঙ্গে সম্পৃক্ত না করে কোনো নীতি গ্রহণ করা হলে তা দেশের উন্নয়নে কাজে আসে না। বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থার নীতি নির্ধারণের ক্ষেত্রে স্থানীয় সমাজের চাহিদা ও জাতীয় প্রয়োজন পূরণ করতে পারে এমন দক্ষ, যোগ্য ও আলোকিত মানুষ তৈরির ক্ষেত্রে গুরুত্ব প্রদান করেছিলেন।

তৃতীয়ত, বাংলাদেশ বর্তমানে প্রাথমিক শিক্ষায় নারী-পুরুষ সমতা অর্জন করেছে। মাধ্যমিক বা উচ্চ শিক্ষা স্তরে এই সমতা অর্জনে এখনো অনেকটা পথ পাড়ি দিতে হবে। সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশে শিক্ষার যে অবস্থা ছিলো, তখন নারীদের শিক্ষার অবস্থা ছিলো আরো শোচনীয়। অথচ, একটি দেশ নারী ও পুরুষ উভয়ের যৌথ অবদান ছাড়া এগুতে পারে না। জনসংখ্যার অর্ধেক নারী, তাদেরকে শিক্ষার আলো থেকে বঞ্চিত রেখে দেশের অগ্রগতি ও উন্নয়ন সম্ভব নয়, তা বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার পূর্বেই অনুধাবন করেছিলেন। ফলে, স্বাধীনতার পরপরই তিনি এ বিষয়ে নানা উদ্যোগ গ্রহণ করেছিলেন। প্রসঙ্গত, ১৯৭৪ সালে বাংলাদেশ মহিলা আওয়ামী লীগের প্রথম সম্মেলন উদ্বোধন করার সময় বক্তৃতায় তিনি স্পষ্টভাবে উল্লেখ করেছেন, যে দেশের মাত্র শতকরা ২০ ভাগ মানুষ শিক্ষিত সেখানে নারীদের মধ্যে শিক্ষার হার আরও অনেক কম। তিনি নারীদের লেখাপড়ার প্রতি আহ্বান জানিয়ে বলেছিলেন, ক, খ জানলেই শিক্ষিত হওয়া যায় না, শিক্ষার মাধ্যমে প্রত্যেককে একেকজন সত্যিকার অর্থেই আলোকিত মানুষ হতে হবে।

চতুর্থত, স্বাধীনতার পরপর বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অবস্থা ছিলো শোচনীয়। একদিকে প্রায় ধ্বংসস্তুপের ওপর দাঁড়িয়ে তিনি দেশকে গড়ার চেষ্টা চালাচ্ছেন, একই সঙ্গে তাঁকে মোকাবিলা করতে হচ্ছে দেশী ও বিদেশী নানা ষড়যন্ত্রের। এ অবস্থায়ও তিনি শিক্ষাক্ষেত্রে সবার প্রবেশ নিশ্চিত করতে চেয়েছেন। শিক্ষাক্ষেত্রে মেধাকে যথাযোগ্য মর্যাদায় লালন করার পাশাপাশি প্রয়োজনীয় সব ক্ষেত্রে দরিদ্র শিক্ষার্থীদের পৃষ্ঠপোষকতা দানের বিষয়ে তিনি গুরুত্ব আরোপ করেছিলেন। অর্থের অভাবে কোনো শিক্ষার্থীর শিক্ষা যেন ব্যাহত না হয়, সে বিষয়ে তিনি ছিলেন সচেতন। তিনি তাঁর প্রশাসনকে এসব বিষয়ে প্রয়োজনীয় নির্দেশ দিয়েছিলেন।

পঞ্চমত, শিক্ষাকে তিনি দেখেছেন ভবিষ্যতের জন্য শ্রেষ্ঠ বিনিয়োগ হিসেবে যা পূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে। তিনি বলেছিলেন, আগামী প্রজন্মের ভাগ্য শিক্ষকদের ওপর নির্ভর করছে। শিশুদের যথাযথ শিক্ষার ব্যত্যয় ঘটলে কষ্টার্জিত স্বাধীনতা অর্থহীন হবে। এক্ষেত্রে শিক্ষাকে কার্যকর করতে দেশ, সমাজ ও দেশের মানুষের জন্য সর্বাধিক উপযোগী করার মানসে তিনি শিক্ষাকে অভিন্ন, গণমুখী ও সর্বজনীন করার ওপর বিশেষ গুরুত্ব প্রদান করেছিলেন। বিশেষত, সমাজ থেকে নিরক্ষরতার অভিশাপ দূর করার জন্য তিনি নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে নিরক্ষরতা দূরীকরণে উদ্যোগী হয়েছিলেন। এর অংশ হিসেবেই সবার জন্য শিক্ষা নিশ্চিত করতে পাঁচ বছর বয়সী সকল শিশু যেন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে গমন করে, সে উদ্দেশ্যে ক্র্যাশ প্রোগ্রাম গ্রহণের সিদ্ধান্ত হয়েছিলো।

একটি যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশে এসব কর্মকাণ্ড বাস্তবায়ন করা সহজতর কাজ নয়। একদিকে খাদ্যাভাব, পর্যাপ্ত জনবলের সঙ্কট এবং সম্পদের সীমিত অবস্থা সত্ত্বেও শিক্ষাক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণ করতে তিনি কখনোই পিছপা হননি। তিনি যেসব সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, উক্ত অর্থনৈতিক অবস্থায় সেসব সিদ্ধান্ত গ্রহণে প্রচুর সাহস ও দূরদর্শিতার প্রয়োজন। যুদ্ধ শেষ হওয়ার পরপরই চল্লিশ হাজার প্রাথমিক বিদ্যালয় জাতীয়করণ করা কোনো অর্থেই সহজ সিদ্ধান্ত ছিলো না। এসব বিদ্যালয়ের সমস্ত শিক্ষক ও কর্মচারীকে সরকারি বেতনবিধির আওতায় আনা প্রচণ্ড খরচের বিষয়। কিন্তু দূরবর্তী লক্ষ্যকে সামনে রেখে তিনি এসব উদ্যোগ গ্রহণ করেছিলেন ঝুঁকি নিয়ে। তাঁর আমলে নেয়া এই সিদ্ধান্তের উপযোগিতা বাংলাদেশ অনুধাবন করেছে বিশ-তিরিশ বছর পর, যখন থেকে দেশের মানুষ এই উদ্যোগের সুফল পেতে শুরু করেছে।


বঙ্গবন্ধু ১৯৭৩ সালে উক্ত কালো আইন বাতিল করে দেশের চারটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় যথা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়কে স্বায়ত্তশাসন প্রদান করেছেন। উল্লেখ্য, এই স্বায়ত্তশাসন প্রদানের সময় বিভিন্ন মহল থেকে নানা ধরনের শঙ্কা উত্থাপিত করা হয়েছিলো বঙ্গবন্ধুর সামনে, কিন্তু সেগুলোকে তিনি গ্রাহ্য না করে বিশ্ববিদ্যালয় ও শিক্ষকদের স্বায়ত্তশাসনের পথ সুগম করেছেন।


বঙ্গবন্ধু শুধু যে এসব প্রাথমিক বিদ্যালয়কে সরকারিকরণ করে দায়িত্ব শেষ করলেন, তা কিন্তু নয়; তিনি এই স্বল্প সময়ের মধ্যে এগার হাজারের বেশি প্রাথমিক বিদ্যালয় স্থাপন করেছেন। এর বাইরে অনেক মাধ্যমিক বিদ্যালয় ও কলেজ স্থাপনেও তিনি কাজ করেছেন।

প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষা ছাড়াও বঙ্গবন্ধু উল্লেখযোগ্য কিছু কাজ করেছেন দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে নিয়ে। এর একটি বড় উদাহরণ হচ্ছে, ১৯৬২ সালে তৎকালীন আইয়ুব সরকার বিশ্ববিদ্যালসমূহের ওপর নিয়ন্ত্রণ আরোপের লক্ষ্যে একটি অধ্যাদেশ জারি করেছিলো যাকে ‘কালো আইন’ হিসেবে অভিহিত করা হয়। বঙ্গবন্ধু ১৯৭৩ সালে উক্ত কালো আইন বাতিল করে দেশের চারটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় যথা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়কে স্বায়ত্তশাসন প্রদান করেছেন। উল্লেখ্য, এই স্বায়ত্তশাসন প্রদানের সময় বিভিন্ন মহল থেকে নানা ধরনের শঙ্কা উত্থাপিত করা হয়েছিলো বঙ্গবন্ধুর সামনে, কিন্তু সেগুলোকে তিনি গ্রাহ্য না করে বিশ্ববিদ্যালয় ও শিক্ষকদের স্বায়ত্তশাসনের পথ সুগম করেছেন।

বাংলাদেশের ইতিহাসের প্রতিটি পালাবদলে অন্যতম বড় ভূমিকা পালন করেছে দেশটির বিশ্ববিদ্যালয়সমূহ এবং এর শিক্ষক ও শিক্ষার্থীবৃন্দ। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে বাষট্টির শিক্ষা আন্দোলন, ছেষট্টির ছয় দফা, ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধÑ প্রতিটি ক্ষেত্রেই বিশ্ববিদ্যালয় ও এর শিক্ষক-শিক্ষার্থীর ভূমিকা অপরিসীম। বঙ্গবন্ধু এসব আন্দোলন-সংগ্রাম প্রত্যক্ষ করেছেন খুব কাছে থেকে, যেহেতু তিনি নিজেই এসব আন্দোলনে সরাসরি নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। ফলে বিশ্ববিদ্যালয়ের শক্তিমত্তার জায়গাটুকু তিনি ভালোভাবেই উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন।

তিনি বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনার দায়িত্ব ও শিক্ষকদের জবাবদিহিতার জায়গাটি যথাক্রমে বিশ্ববিদ্যালয় ও শিক্ষকদের ওপরই ছেড়ে দিতে চেয়েছেন। বিশ্ববিদ্যালয় যেন অধীনস্ত মনোভাবনা পরিহার করে স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারে, সেজন্য তিনি স্বায়ত্তশাসনের অনুমোদন দেন। যদিও বঙ্গবন্ধুর সেই সুবিশাল ভাবনার যথাযথ মর্যাদা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়সমূহ ধারণ করতে পেরেছে কিনা সেটি নিয়ে আজকের দিনে আমরা বিস্তর আলাপ করতে পারি; কিন্তু বঙ্গবন্ধুর সিদ্ধান্তটি যে সঠিক ছিল তা অনুধাবন করা যায় বাংলাদেশে স্বৈরশাসনকালীন সময়ে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ভূমিকা বিশ্লেষণ করলে। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর দেশে নেমে আসে স্বৈরশাসনের কালো থাবা। প্রতিটি স্বৈরশাসক চেয়েছিলো বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে নিজের মতো করে কবজা করতে, কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর দৃঢ় অবস্থানের কারণে সেটি আর সম্ভব হয়নি। ফলে নব্বইয়ের স্বৈরশাসন বিরোধী আন্দোলনের মতো ঘটনা ঘটেছে মূলত বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদের নেতৃত্বে। এই ঘটনাই প্রমাণ করে বিশ্ববিদ্যালয় সম্পর্কে বঙ্গবন্ধুর চিন্তাভাবনা কতোটা দূরদর্শী ছিলো।


আজকে আমরা যে অবস্থানে রয়েছি, তার শুরু করে দিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। আমাদের এদিক দিয়েও দুর্ভাগ্য যে, বঙ্গবন্ধুর শিক্ষা বিষয়ক কর্মকাণ্ড, ভাবনা ও দর্শন নিয়ে বৃহৎ পরিসরে তেমন কোনো বিস্তর গবেষণা হয়নি।


বঙ্গবন্ধুর শিক্ষাভাবনা পর্যালোচনায় দেখা যায়, শিক্ষার সঙ্গে বঙ্গবন্ধু সমাজ ও দেশকে মিশিয়েছিলেন অঙ্গাঙ্গীভাবে। বিষয়টি আরও স্পষ্ট হয় যখন দেখা যায়, স্বাধীনতার ঠিক পরপরই ১৯৭২ সালে বাংলাদেশের অন্যতম শ্রেষ্ঠ বিজ্ঞানী ড. কুদরাত-এ-খুদাকে প্রধান করে তিনি স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম শিক্ষা কমিশন গঠন করেন। বাংলাদেশের তৎকালীন রাষ্ট্রীয় চার মূলনীতিকে কেন্দ্র করে আধুনিক ও যুগোপযোগী শিক্ষানীতি প্রণয়নে তাঁর এই উদ্যোগের ফলে স্বাধীন বাংলাদেশে যে কয়টি শিক্ষা কমিশন প্রতিবেদনকে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও সম্পূর্ণ নীতি হিসেবে মনে করা হয়, তার মধ্যে ড. খুদা কমিশন অন্যতম। এমনকি, স্বাধীনতার ৪০ বছর পরও ২০১০ সালে বর্তমান যে জাতীয় শিক্ষানীতি সংসদে গৃহীত হয়, তার মূল কাজই ছিলো ড. কুদরাত-এ-খুদা প্রণীত শিক্ষানীতিকে কেন্দ্র করে। কতোটুকু দূরদর্শী হলে এতো আগের একটি শিক্ষা কমিশনের প্রতিবেদন চল্লিশ বছর পরেও প্রাসঙ্গিক থাকে তা বলাই বাহুল্য।

বাংলাদেশের উন্নতিকল্পে শিক্ষার উন্নয়নে বঙ্গবন্ধু সর্বাধিক মনোযোগ দিয়েছিলেন— কোনো দ্বিধা বা সংশয় ব্যতিরেকেই কথাটি বলা যায়। কিন্তু তিনি নানা ধরনের উদ্যোগ গ্রহণ করলেও স্বাধীনতাবিরোধীদের চক্রান্তে দেশ স্বাধীন হওয়ার সাড়ে তিন বছর পরই নৃশংসভাবে নিহত হন। সন্দেহ নেই, তিনি বেঁচে থাকলে শিক্ষার উন্নয়নে গৃহীত এসব কর্মকাণ্ড দ্রুতগতিতে বাস্তবায়িত হতো। আজকে আমরা যে অবস্থানে রয়েছি, তার শুরু করে দিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। আমাদের এদিক দিয়েও দুর্ভাগ্য যে, বঙ্গবন্ধুর শিক্ষা বিষয়ক কর্মকাণ্ড, ভাবনা ও দর্শন নিয়ে বৃহৎ পরিসরে তেমন কোনো বিস্তর গবেষণা হয়নি। বাঙালি জাতির আশার বাতিঘর বঙ্গবন্ধু কন্যা গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাতির জনকের স্বপ্নের “সোনার বাংলাদেশ” বিনির্মাণের লক্ষ্যে ইতোমধ্যে “ভিশন-২০২১”, “ভিশন-২০৪১” এবং সর্বশেষ “ডেল্টা প্ল্যান-২১০০” ঘোষণা করেছেন এবং প্রত্যেকটি ভিশন সফলভাবে বাস্তবায়নে শিক্ষার উপর গুরুত্বারোপ করেছেন। একইসাথে বঙ্গবন্ধুর শিক্ষাভাবনা ও দর্শনকে আমলে নিয়ে আধুনিক, বিজ্ঞানমনস্ক ও কর্মমূখি শিক্ষানীতি প্রণয়ন করেছেন। বিশ্ববিদ্যালয়সমূহ ও বিভিন্ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান এ বিষয়ে এগিয়ে এলে শিক্ষা নিয়ে তাঁর অবদান আরও বেশি করে জানা সম্ভব হবে বলে আমি বিশ্বাস করি।

ড. গোলাম কবীর: প্রফেসর ও সভাপতি, উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।

কৃতজ্ঞতা: গৌতম রায়, সহকারী অধ্যাপক, শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউট, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়; মো. মামুনূর রশীদ সরকার, সহকারী অধ্যাপক, উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ও উদ্ভিদবিজ্ঞান সমিতি, উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।

কোন মন্তব্য নেই

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে