যতোটা পেছনের দিকে যাওয়া যায়, দেখা যাবে শিক্ষাগুরুর মর্যাদা বা শিক্ষকের মান ততোই বেশি ছিলো। ছবিসূত্র: Adobe Stock
যতোটা পেছনের দিকে যাওয়া যায়, দেখা যাবে শিক্ষাগুরুর মর্যাদা বা শিক্ষকের মান ততোই বেশি ছিলো। ছবিসূত্র: Adobe Stock

বিশ্ব শিক্ষক দিবস ২০২৩-এর প্রতিপাদ্য বিষয় হচ্ছে, “কাঙ্ক্ষিত শিক্ষার জন্য শিক্ষক: শিক্ষক স্বল্পতা পূরণ বৈশ্বিক অপরিহার্যতা”। এই প্রতিপাদ্যটির মধ্যদিয়ে শিক্ষকের মর্যাদা, শিক্ষকের মান এবং শিক্ষার মানের একটি চিত্র সহজেই অনুমান করা যায়।

যতোটা পেছনের দিকে যাওয়া যায়, দেখা যাবে শিক্ষাগুরুর মর্যাদা বা শিক্ষকের মান ততোই বেশি ছিলো। অর্থাৎ, দিন যতো যাচ্ছে, শিক্ষাগুরুর মর্যাদা ততোই লোপ পাচ্ছে। শিক্ষাগুরুর মর্যাদা লোপ পাবার জন্য রাষ্ট্র যতোটা দায়ী, ততোটা সমান দায়ী শিক্ষক সমাজ নিজেই!

বাংলাদেশের শিক্ষাপ্রণালী প্রাচীনকাল থেকেই চলে আসছে। বৌদ্ধ বিহার, ব্রাহ্মণ মঠ, গুরু-শিষ্য, টোল ইত্যাদির মাধ্যমে প্রাচীন শিক্ষাচক্র পরিচালিত হতো। মুঘল শাসনামলে বাংলাদেশে শিক্ষাচক্র অত্যন্ত প্রভাবিত হয়, তখন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে গুরু-শিষ্যের একটি অপ্রাতিষ্ঠানিক সংক্ষিপ্ত শিক্ষাব্যবস্থার প্রচলন হয়।

আঠারশ শতকের প্রারম্ভে ব্রিটিশ শাসনামলে স্কুল এবং কলেজ শিক্ষাপদ্ধতি গড়ে ওঠে। ইংরেজি ভাষা বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থার একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হিসেবে বিবেচিত হতে থাকে। ১৯৫২ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারি ভাষা আন্দোলনের মাধ্যমে বাংলাদেশের মাতৃভাষা বাংলা সরকারের শিক্ষার অফিসিয়াল ভাষা হিসেবে গ্রহণ করা হয়।

১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ-পরবর্তী বাংলাদেশে নতুন ধারার শিক্ষাব্যবস্থা শুরু হয়। ১৯৭৩ সালে অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে জাতীয়করণ করা হয়। এই শিক্ষাব্যবস্থায় প্রাথমিক শিক্ষা, মাধ্যমিক শিক্ষা, উচ্চশিক্ষা এবং পেশাদার শিক্ষা ইত্যাদি ভাগে ভাগ করা হয়।

স্তরভেদে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়, শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশনের নির্দেশনা মোতাবেক পরিচালিত হয়। সাথে সাথে শিক্ষার মানোন্নয়নে বাংলাদেশ সরকার বিভিন্ন প্রকল্প ও পদক্ষেপ নেয়, যেগুলো শিক্ষকের মান উন্নয়ন ও শিক্ষার মানোন্নয়নে যথাযথ অবদান রাখতে পারেনি।

প্রাথমিক ও গণশিক্ষা প্রতিমন্ত্রী জাকির হোসেন বলেন, “দেশের প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মোট শিক্ষকের সংখ্যা ৪ লাখ ২৭ হাজার ৯৭১টি। এর মধ্যে কর্মরত আছেন ৩ লাখ ৯০ হাজার ৪৫ জন। তিনি জানান, শূন্যপদের মধ্যে প্রধান শিক্ষক পদে ২৯ হাজার ৮৫৮টি এবং সহকারী শিক্ষক পদে ৮ হাজার ৬৮টি শূন্য আছে”। তবে এ হিসেব বেসরকারি এবং কিন্ডারগার্টেন বিদ্যালয়গুলোর শিক্ষকদেরকে বাদ দিয়ে করা। এছাড়াও বেনবেইজের হিসেব অনুসারে, মাধ্যমিক পর্যায়, উচ্চশিক্ষা, কারিগরি ও মাদ্রাসা শিক্ষায় প্রায় ৬ লক্ষ ৬৮ হাজার শিক্ষক রয়েছেন।

শিক্ষামন্ত্রী দীপু মনি বলেন, “উচ্চশিক্ষা পর্যায়ে শিক্ষা সনদ জালিয়াতি বন্ধে একটি অটোমেশন সফটওয়্যার প্রবর্তনের কাজ চলছে। সফটওয়্যারটি চালু হলে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের সব তথ্য সংরক্ষণ করা সম্ভব হবে এবং অনলাইনে পৃথিবীর যেকোনো স্থান থেকে সনদ যাচাই করা যাবে। এতে সনদ জালিয়াতি বন্ধ করা সম্ভব হবে”। “ইতোমধ্যে জাল সনদধারী ৬৭৮ জন শিক্ষক-কর্মচারীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে”, বলেন তিনি। সূত্র: ডেইলী স্টার, ০৩ অক্টোবর ২০২৩।

বিভিন্ন প্রতিবেদনে দেখা গেছে, ইউরোপ কিংবা আমেরিকার তুলনায়ে এশিয়াতে শিক্ষকদের সম্মান দেয়ার প্রবণতা অত্যধিক। বিশেষত, চীন, দক্ষিণ কোরিয়া, তাইওয়ান ও মালয়েশিয়াতে শিক্ষকের মান ও সামাজিক মর্যাদা অনেক উপরে। আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতেও শিক্ষকের মান ও মর্যাদা বিশ্বের প্রথম ১০টি দেশের মধ্যে রয়েছে।

আর এ কারণেই আন্তর্জাতিকভাবে যেসকল প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষা নেয়া হয়, সেখানে এ সকল দেশের শিক্ষার্থীরাই সবচেয়ে ভালো করে থাকে। মনে করা হয়, শিক্ষকের মান ও মর্যাদা রয়েছে বলেই যোগ্য শিক্ষক পাওয়া এবং ধরে রাখাও সহজ এ সকল দেশে।

গবেষণায় দেখা গেছে, চীন, ভারত বা ঘানায় এখনো পরিবারগুলো তাদের সন্তানদের শিক্ষক হতে উৎসাহিত করে। বিবিসি বাংলার খবরে বলা হয়, শিক্ষক হিসেবে মর্যাদা পাওয়ার সম্ভাবনা সবচেয়ে কম যেসব দেশে, তার মধ্যে রয়েছে ব্রাজিল, ইসরায়েল এবং ইতালি।

কোনো সন্দেহ ছাড়াই আমরা এখন বলতে পারি, শিক্ষকের মান ও মর্যাদা নিশ্চিত করা কোনো নৈতিক দায়িত্ব নয়, এটি একটি দেশের শিক্ষার মানের জন্য জরুরি। যে সকল নির্দশক দিয়ে বোঝা যায় যে শিক্ষকের মান ও মর্যাদা কোন দেশে কতটুকু তার মধ্যে রয়েছে:

ক. বেতন এবং আনুষাজ্ঞিক সুযোগ-সুবিধা;

খ. সম্মান প্রদান ও স্বীকৃতি;

গ. শিক্ষকবান্ধব কর্মপরিবেশ;

ঘ. পেশাগত উন্নয়নের সুব্যবস্থা;

ঙ. শিক্ষকের সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষমতা;

চ. শিক্ষক সমিতির মাধ্যমে দাবি আদায়ের সুযোগ;

ছ. শিক্ষকবান্ধব সরকারি নীতিসমূহ, এবং

জ. শিক্ষকদের প্রতি জনগণের দৃষ্টিভঙ্গি।

আমরা প্রতিনিয়তই লক্ষ্য করছি যে, বাংলাদেশে,

১. শিক্ষকদের বেতন এবং সুযোগসুবিধা অত্যন্ত নিম্নমানের। তার সাথে রয়েছে নানামূখী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষকদের বেতন ও সুযোগ-সুবিধার বৈষম্য;

২. শিক্ষকদের কর্মএলাকা নির্ধারণে অনিয়ম এবং স্বাভাবিক বদলির ব্যবস্থা না থাকা;

৩. সীমিত পদোন্নতির ব্যবস্থা থাকা; অভিজ্ঞতা ও পারদর্শিতার ভিত্তিতে পদোন্নতি না থাকা;

৪. শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পর্যাপ্ত শিক্ষাসামগ্রীর ব্যবস্থা না থাকা, ফলে কখনো কখনো শিক্ষক নিজের অর্থে শিক্ষাসামগ্রী কিনে ক্লাস পরিচালনা করে থাকেন;

৫. শিক্ষকদের বিশ্রাম এবং ক্লাসের প্রস্তুতি নেয়ার জন্য যথেষ্ট সময় না থাকা;

৬. বিদ্যমান মানবসম্পদের অসম বণ্টনের ফলে কোনো কোনো বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের কাজের চাপ বেশি থাকে আবার কোনো বিদ্যালয় পালাক্রমে ছুটি ভোগ করতে পারে;

৭. পেশাগত উন্নয়নের সুযোগ সীমিত আবার পেশাগত উন্নয়নের সুযোগসমূহ ক্ষমতা ও পক্ষপাতিত্বের ভিত্তিতে বণ্টন করা হয়;

৮. শিক্ষকদেরকে নানারকম রাষ্ট্রীয় কাজে ব্যবহার করা। যেমন, আদমশুমারি, ভোটার তালিকা করা, ভোট গ্রহণ, গৃহ ও ল্যাট্রিন গণনা ইত্যাদি;

৯. গ্রেড বিবেচনায় অপেক্ষাকৃত উচ্চগ্রেডের চাকুরিজীবি কর্তৃক শিক্ষকদের অসম্মান এবং অবহেলা করার প্রবণতা;

১০. শিক্ষাব্যবস্থায় অনভিজ্ঞ ক্যাডারের অনুপ্রবেশ যা শিক্ষকের মোটিভেশন তৈরি না করে ভুল দিকনির্দেশনা প্রদান করে থাকে।

দুবাইয়ের একটি আন্তর্জাতিক শিক্ষক সম্মেলন কক্ষের দেয়ালে লেখা রয়েছে, ‘দ্য স্ট্যাটাস অব দ্য টিচার্স ইজ ইকুয়াল টু দ্য কোয়ালিটি অব এডুকেশন। অর্থাৎ একটি দেশের শিক্ষকের মান ও মর্যাদা বাড়লে সে দেশের শিক্ষার গুণগত মান যেমন বাড়ে, আবার ঠিক একইভাবে শিক্ষার গুণগত মান বাড়লেও তা শিক্ষকের মান ও মর্যাদাকে বাড়ায়। এক্ষেত্রে রাষ্ট্র আগে শিক্ষকের মান ও মর্যাদা বাড়াবে না শিক্ষক আগে গুণগত শিক্ষাদান করবেন, সেটি নিয়ে তর্ক করলে তা অনেকটা ডিম আগে না মুরগি আগে, সেটির মতো অমীমাংসিত রয়ে যাবে।

কেবল শিক্ষক হিসেবে কি সৈয়দ মুজতবা আলীর ‘পাদটীকা’ গল্পের পণ্ডিতমশাইয়ের চেয়ে বেশি মর্যাদা পেতেন? গল্পটিতে এক লাট সাহেব স্কুল পরিদর্শনে এসে প্রথাগত সামান্য একটু সৌজন্য প্রকাশ করাতে পণ্ডিতমশাই একেবারে বিগলিত হয়ে পাঠকদের বুঝিয়ে দেন, শুধু অর্থাভাবে নয়, সম্মানহীনতার কারণেও কতটা বুভুক্ষু হয়ে আছেন তিনি।

লাট এলেন। “হ্যালো, পানডিট” বলে সাহেব হাত মেলালেন। রাজসম্মান পেয়ে পণ্ডিতমশাইয়ের সব যন্ত্রণা লাঘব হলো। বারবার ঝুঁকে সাহেবকে সেলাম করলেন—এই অনাদৃত পণ্ডিতশ্রেণি সামান্যতম গতানুগতিক সম্মান পেয়েও যে কীরকম বিগলিত হতেন, তা তাঁদের সে সময়কার চেহারা না দেখলে বিশ্বাস করার উপায় নেই।

এই চরম অবহেলার মধ্যে একটি দিকজ্ঞানশূণ্য শিক্ষাব্যবস্থায় শিক্ষকদের আত্নসন্তুষ্টি থাকবার কোনো কারণ থাকতে পারে না। আর আত্নসন্তুষ্টি না থাকলে শিক্ষক মনযোগসহকারে আন্তরিকভাবে নিজ দায়িত্ব পালন করবেন তেমনটি আশা করাও বোকামি নয় কি? অতএব, বাংলাদেশের শিক্ষকদের মান বাড়ানোর জন্য সরকারের নিম্নোক্ত পদক্ষেপ গ্রহণ করা প্রয়োজন:

১. শিক্ষার সর্বস্তরে, সকল পেশাজীবিদের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করার জন্য আশু ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।

২. মনিটরিং নয়, বরং মেনটরিং-এর ওপর জোর দিতে হবে।

৩. শিক্ষার বিষয়বস্তুতে কমপক্ষে ৪০ শতাংশ মূল্যবোধ শিক্ষার ব্যবস্থা রাখতে হবে।

৪. পদবীকে নয় ব্যক্তিকে সম্মান কর— এই নীতি চালু করতে হবে।

৫. পর্যাপ্ত শিক্ষক নিয়োগ করতে হবে এবং কোনো শূন্য পদ রাখা যাবে না। প্রয়োজনে শিক্ষক নিয়োগের সময় অপেক্ষমান ট্যালেন্ট পুল তৈরি করতে হবে।

৬. পর্যায়ক্রমে শিক্ষকদের বেতন-ভাতা বৃদ্ধি করতে হবে।

৭. সরকারি, বেসরকারি বা প্রাইভেট এসব ক্যাটাগরি করে বেতন-ভাতার বৈষম্য সৃষ্টি করা যাবে না।

৮. শিক্ষকদের পেশাগত উন্নয়নে সকলের সমান সুযোগ সৃষ্টি করতে হবে। এ ক্ষেত্রে কোনো বৈষম্য করা যাবে না।

৯. শিক্ষকদের মানসিক স্বাস্থ্য সুরক্ষিত রাখার জন্য ভ্রমণ, স্বাস্থ্য পরীক্ষা এবং স্বাস্থ্য সেবার হটলাইন চালু করতে হবে।

১০. শিক্ষার সাথে সংশ্লিষ্ট নয় এমন কোনো কাজে শিক্ষকদেরকে নিযুক্ত করা যাবে না।

১১. প্রতি বছর নির্দিষ্ট সময়ে নিয়ম মেনে সকল শিক্ষকের মান ও পারদর্শিতার মূল্যায়ন হতে হবে যার ভিত্তিতে পদোন্নতির সুযোগ সৃষ্টি করতে হবে।

১২. শিক্ষক নিয়োগে স্বচ্ছতা বজায় রাখাসহ শিক্ষকদের থেকে নানা অজুহাতে চাদা আদায় চিরতরে বন্ধ করতে হবে।

শিক্ষকের মান ও মর্যাদার বিষয়টি যে আসলে বায়বীয় কোনো বিষয় নয়, সৈয়দ মুজতবা আলী সম্ভবত এটাই বোঝাতে চেয়েছেন। আর্থিকভাবে নড়বড়ে একজন শিক্ষককে যে লোকদেখানো সম্মান দেখানো হয়, তা যে যেকোনো মুহূর্তে ফাটা বেলুনের মতো চুপসে যেতে পারে, পণ্ডিতমশাইয়ের ছোট ছোট ছাত্রকেও তা বোঝাতে কোনো অসুবিধা হয়নি।

আমাদের মতো সীমিত সম্পদের দেশে নীতিনির্ধারকদের অন্য গুরুত্বপূর্ণ বিষয় বাদ দিয়ে শিক্ষায় আরও বেশি বিনিয়োগ করবেন কি-না, বা এখানে বিনিয়োগ করলে শিক্ষকেরা তার সদ্ব্যবহার করতে পারবেন কি-না, এ নিয়ে বহুবার চিন্তা করতে হয়। অন্যদিকে, মুজতবা আলীর পণ্ডিতমশাইয়ের চেয়ে শিক্ষকদের অবস্থা এখন অনেক ভালো হলেও অন্যদের সঙ্গে তুলনা করলে তাঁদের হতাশা বেশি বৈ কম নয়।

শিক্ষার গুণগত মান বাড়ানোর জন্য যে প্রবল তাগিদ অনুভব করা দরকার, সঙ্গত কারণেই সেটি দুর্বল হতে চলেছে। শিক্ষকের মান ও মর্যাদা বৃদ্ধির জন্য সার্বিক ব্যবস্থা না নিলে শিক্ষার ফল ক্রমশ তিতেই হতে থাকবে।

1 মন্তব্য

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে