অনলাইন শিক্ষা কার্যক্রম নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক নেটওয়ার্কের পক্ষ থেকে ২ জুলাই ২০২০ তারিখে এক অনলাইন সংবাদ সম্মেলনে একটি সংক্ষিপ্ত লিখিত বক্তব্য উপস্থাপন করা হয়। উক্ত বক্তব্যের পূর্ণাঙ্গ সংস্করণটি এখানে প্রকাশ করা হলো।

) মহামারীর কবলে বিপর্যস্ত উচ্চশিক্ষা পরিস্থিতি

কোভিড ১৯ মহামারীর বৈশ্বিক বিস্তারের ফলে চলতি বছরের মধ্য মার্চ থেকে বিগত সাড়ে তিনমাস ধরে বাংলাদেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শিক্ষা ও গবেষণা কার্যক্রম আক্ষরিক অর্থে বন্ধ রয়েছে। তবে এপ্রিল মাস থেকে ইউজিসি থেকে ‘অনলাইন-ক্লাস’ চালুর জন্য কিছু জরিপ কার্যক্রম লক্ষ্ করা গেলেও বিশ্ববিদ্যালয় সম্পূর্ণ খুলবার কোনো সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা বা সমন্বিত নির্দেশনা এখনো আসেনি। অথচ বিভিন্ন প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে অনলাইন শিক্ষা-কার্যক্রম শুরু, একটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক সিদ্ধান্তে ‘অনলাইন-ক্লাস’ চালু ও তার প্রতিক্রিয়ার শিক্ষার্থীদের আন্দোলন, এবং বিশ্বের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের করোনাকালে ‘অনলাইন-শিক্ষা’কে একটি আপৎকালিন ব্যবস্থা হিসেবে শুরু করার নানা উদাহরণ ও উদ্যোগ  থাকায় ‘অনলাইন-ক্লাস’ আলোচনার কেন্দ্রে রয়েছে। পাঠদান ও পরীক্ষা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় যেহেতু সেশন জ্যাম ও নানা সংকটে পড়ার আশঙ্কায় পড়েছে সমগ্র শিক্ষাঙ্গন, সেহেতু  শিক্ষা-জীবন পুনরুদ্ধার করার জন্য আপৎকালীন ব্যবস্থা হিসাবে বিশেষ অনলাইন শিক্ষা-কার্যক্রম চালু করা একটি সম্ভাব্য উপায় হতে পারে । তবে অপরিকল্পিত, অপ্রস্তুত, ও বৈষম্যমূলক পন্থায় প্রশাসনিক সিদ্ধান্ত ও চাপ প্রয়োগের মাধ্যমে তা চালুর চেষ্টা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর জন্য আত্মঘাতী হবে। তাই এসব শুরুর আগে আমাদেরকে প্রতিষ্ঠান, শিক্ষার্থী-শিক্ষকদের বাস্তব অসুবিধার কথা বিবেচনা করতে হবে। 

এ উদ্দেশ্যে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক নেটওয়ার্ক বিগত ২৭ শে জুন একটি ওয়েবিনারের আয়োজন করে। এই ওয়েবিনারে অংশ নেন বাংলাদেশের ঢাকা, চট্টগ্রাম, জাহাঙ্গীরনগর, রাজশাহী, জগন্নাথ, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, নর্থ-সাউথ, ও ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন বিভাগের শিক্ষকবৃন্দ । এছাড়াও শাবিপ্রবি ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাও উপস্থিত ছিলেন এ ওয়েবিনারে।  পরবর্তী কয়েকটি সভায় নানা পর্যায়ে যুক্ত হন যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও জাপান থেকে একাধিক বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত শিক্ষক। পরিস্থিতি পর্যালোচনা এবং শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের অভিজ্ঞতা বিবেচনায়  আমরা মনে করি, যেকোনো অনলাইন শিক্ষা কার্যক্রম বাস্তবায়নের আগে নতুন প্রযুক্তির জ্ঞানজাগতিক একাডেমিক ব্যবহার সম্পর্কে উপযুক্ত ধারণা অর্জন, বাংলাদেশের বিদ্যমান পরিস্থিতিতে অনলাইন শিক্ষা কার্যক্রম চালানোর প্রতিবন্ধকতা পূর্বশর্তগুলো চিহ্নিত করা, এবং সে অনুযায়ী প্রতিকার পদক্ষেপ নেওয়ার পরেই  কেবল অনলাইন শিক্ষা কার্যক্রমে যাওয়া যেতে পারে।  

) ‘অনলাইনশিক্ষার প্রাতিষ্ঠানিক প্রতিবন্ধকতাসমূহ 

২.১) বিশ্ববিদ্যালয়ে সংঘটিত যেকোনো শিক্ষা-কার্যক্রমের একটি অলঙ্ঘনীয় ও মৌলিক পূর্বশর্ত হচ্ছে সেখানে সংশ্লিষ্ট সকল শিক্ষার্থীর অংশগ্রহণের সমান সুযোগ থাকতে হবে। শিক্ষার্থীদের মধ্যে ন্যূনতম কোন বৈষম্য তৈরী করে এমন শিক্ষা-কার্যক্রম পরিচালনার নৈতিক অধিকার কোনো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেরই নেই। এধরণের প্রয়াসমাত্রই আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইনের দৃষ্টিভঙ্গী থেকে ‘শিক্ষা অধিকারে’র সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। বিদ্যমান পরিস্থিতিতে অনলাইনে ক্লাস শুরু করলে বৈষম্য অবশ্যম্ভাবী আকারে দেখা দিবে।

২.২) পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর প্রযুক্তিগত অবকাঠামো ও সক্ষমতা আজও  অনলাইন কার্যক্রম চালানোর ন্যূনতম পর্যায়ে পৌঁছাতে পারেনি।  যেমন, সাধারণ একাডেমিক এবং প্রশাসনিক কার্যক্রমেই বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ডিজিটাল সক্ষমতা ও দক্ষতা নিম্ন পর্যায়ের। এখানে পূর্ণাঙ্গ ওয়েবসাইট, শিক্ষার্থীদের প্রাতিষ্ঠানিক ইমেইল ও লিস্ট-সার্ভ, ই-রিসোর্স বা ই-লাইব্রেরীর তেমন কোনো অস্তিত্বই নেই। 

২.৪) বাংলাদেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ‘অন-ক্যাম্পাস’ কোর্সগুলোতেই পূর্ণাঙ্গ কারিকুলামের ব্যবহার যেখানে সীমিত সেখানে ‘অনলাইন’ কোর্সের জন্য বিশেষায়িত কারিকুলাম তৈরী ও বাস্তবায়নের কোনো বাস্তব ভিত্তি এখন অব্দি নেই। কারিকুলাম ও একাডেমিক প্রক্রিয়ার পর্যালোচনা ও পূনর্বিন্যাস না করে কোন ইন্টারনেটনির্ভর শিক্ষণ কার্যক্রমে যাওয়ার চেষ্টা বিদ্যাগত বা পেডাগোজিক্যালি গ্রহণযোগ্য নয়। এবিষয়ে যাথাযথ পদক্ষেপ নিতে করোনার দুর্যোগকালীন বিশেষ একাডেমিক ক্যালেন্ডার তৈরি করে সে সময় সীমার মধ্যে শেখানো সম্ভব এমন কারিকুলা ও সিলেবাস দরকার, যার কোনো অস্তিত্ব নেই। 

২.৬) বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর একাডেমিক অধ্যাদেশ, কারিকুলাম, শিক্ষা ও পরীক্ষা সংক্রান্ত বিধিসমূহ অনলাইন কার্যক্রম পরিচালনার ক্ষেত্রে নানা অন্তরায় হিসেবে দেখা দিয়েছে । নীতিগত সংস্কারের কোনো উদ্যোগও এখনো দেখা যায়নি। 

২.৭) বিগত মার্চ থেকে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর এই প্রতিবন্ধকতাগুলো উত্তরণে নিজস্ব কোনো পদক্ষেপ আমরা দেখতে পাইনি। ইউজিসি এবং শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনার অপেক্ষায় থাকা এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে কোনোরকম প্রস্তুতি ছাড়াই কেবল প্রশাসনিক আদেশে ‘অনলাইন-ক্লাস’ চালু করবার চেষ্টা আমাদের উদ্বিগ্ন করেছে। 

২.৮)    বিভাগ পর্যায়ের বাস্তবতা বিবেচনায় না নিয়ে, কারিকুলাম, পাঠদান, ক্যালেন্ডার, ব্যবহারিক কোর্স, ও পরীক্ষা বিষয়ে কোনো সুনির্দিষ্ট নির্দেশনা বা পরিকল্পনা নেই কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের। কেবল অস্পষ্ট দাপ্তরিক আদেশ দিয়ে ‘অনলাইন-ক্লাস’ চালুর প্রচেষ্টাকে নিয়ে আমরা সন্দিহান যে  বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের কর্তাব্যক্তিদের রাজনৈতিক আনুগত্য ও ফায়দা হাসিলের জন্য তাড়াহুড়ো করে লোকদেখানো ‘অনলাইন ক্লাস’ শুরু  হবে এবং শিক্ষার্থীদের মহামারী বিপর্যস্ত জীবনে আরো মারাত্মক সমস্যার জন্ম দিবে। 

২.৯) আশ্চর্যজনক হলেও সত্য যে ইউজিসি কর্তৃক শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের জন্য অনলাইনে জরিপ চালিয়ে নানা নীতি-নির্ধারণের প্রচেষ্টা চলছে, যেখানে বিভিন্ন সূত্রে জানা তথ্য ও অভিজ্ঞতায় দেখা যাচ্ছে বেশিরভাগ শিক্ষার্থীর এই অনলাইন জরিপে অংশগ্রহণের কোনো উপায়ই নেই, বা জরীপের প্রশ্নের মধ্যে নানান ফাঁক রয়েছে। শুধু অনলাইনে থাকতে পারা শিক্ষার্থীদের মাঝে জরিপ চালিয়ে কীভাবে ‘অনলাইন-ক্লাসে’ যুক্ত হওয়ার সক্ষমতা যাচাই হতে পারে তা আমাদের বোধগম্য নয়। 

২.১০)   শীর্ষস্থানীয় প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ক্যাম্পাস-ভিত্তিক ইন্টারনেট প্রযুক্তি ব্যবহারের সক্ষমতা বেশি থাকলেও বর্তমান পরিস্থিতিতে অনলাইন শিক্ষাক্রম চালু করে  সন্তানদের শিক্ষায় বিপুল পরিমাণ অর্থ-বিনিয়োগ করা মধ্যবিত্ত পরিবারগুলোকে আরো বেশি অর্থনৈতিক চাপে পড়েছে। একই কারণে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের চাকুরির অনিশ্চয়তা আরো বৃদ্ধি পাওয়ায় শিক্ষকরাও নানা চাপের মুখে বাধ্য হয়ে শিক্ষার গুণগত মান বিসর্জন দিচ্ছেন। 

) শিক্ষার্থীদের পরিস্থিতি প্রতিবন্ধকতাসমূহ

কোভিড ১৯ সংক্রমণরোধে সামগ্রিক ব্যর্থতা, তার ফলে দেশের আগে থেকেই জরাজীর্ণ স্বাস্থ্য ও চিকিৎসা ব্যবস্থার নিদারুণ বিপর্যয়, বিনা-চিকিৎসায় মৃত্যুর ক্রমবর্ধমান ঝুঁকি, সামগ্রিক অর্থনৈতিক বিপর্যয়, এবং রাজনৈতিক দমন-নিপীড়ণের কারণে বাংলাদেশের আপামর জনগোষ্ঠীর সাথে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীরাও একটি ভয়াবহ সময় পার করছে।  ইতোমধ্যে  অনলাইন শিক্ষাকে কেন্দ্র করে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীর আত্মহননের মত ঘটনাও ঘটেছে। কাজেই, বিদ্যমান আর্থ-সামাজিক, স্বাস্থ্য ও চিকিৎসা পরিস্থিতি বিবেচনায় রেখে বেশিরভাগ শিক্ষার্থীর অনলাইন কার্যক্রমে যুক্ত হবার সক্ষমতা যাচাই, তাদের আর্থ সামাজিক অবস্থা এবং জীবনের ঝুঁকি বিবেচনায় নিতে হবে। নাহলে শিক্ষার্থীদের মধ্যে নতুন বৈষম্য সৃষ্টি ও এবং অর্থনৈতিক ঝুঁকিতে থাকা পরিবারের শিক্ষার্থীদের ‘ঝরে পড়ার’ সম্ভাবনা বেড়ে যাবে। এ প্রসঙ্গে আমরা কিছু বিষয়ে আপনাদের মনোযোগ আকর্ষণ করতে চাই: 

৩.১) বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশন গত ২৩ মার্চ তারিখে একটি চিঠিতে সকল প্রাইভেট ও পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়কে অনলাইন ক্লাসে যাবার পরামর্শ দেয়।  প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়গুলো অনলাইন ক্লাসে গেলেও পাব্লিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো আগ্রহ দেখায়নি অবকাঠামোর অসুবিধা দেখিয়ে। ইউজিসির জরিপে জানা যায় যে ৮৫% এর কাছে ইন্টারনেট ব্যবহার করার মত ডিভাইস আছে। অর্থাৎ, বিদ্যমান অবকাঠামোয় শিক্ষার্থীদের ১৫ শতাংশের হাতে অনলাইন কার্যক্রমে যুক্ত হবার মত প্রযুক্তি নেই যা ২.১ এ বর্ণিত সকল শিক্ষার্থীর অভিগম্যতার শর্ত ভঙ্গ করে। 

৩.২) একটি বড় অংশের শিক্ষার্থীদের তথ্য-প্রযুক্তিগত দক্ষতাও নানাকারণে নিদারুণ অপর্যাপ্ত। প্রযুক্তিগত মাধ্যমের পরিবেশে যাদের অভ্যস্ততা কম তেমন শিক্ষার্থীদের জন্য অনলাইনে শিক্ষা কার্যক্রম কষ্টসাধ্য ও ক্লান্তিকর হয়ে উঠতে পারে এবং শিক্ষাগ্রহণের পর্য়ায়ে বৈষম্য থেকে যাবে।

৩.৩) মহামারীর কারণে বেশিরভাগ শিক্ষার্থীই বাড়ি ফিরে গেছে এবং প্রান্তিক স্থানে উপযুক্ত ইন্টারনেট সংযোগ নেই, বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিচ্ছিন্ন তাদের নতুন করে কম্পিউটার বা মোবাইল ফোন কেনার সামর্থ্য নেই। ইন্টারনেট সেবার অবকাঠামোগত উন্নয়ন এবং তা শিক্ষার্থীদের কাছে বিনামূল্যে পৌঁছানো ছাড়া শিক্ষাকে অনলাইনে নিয়ে গেলে তা শ্রেণিভেদে এবং গ্রাম-শহরভেদে নতুন ধরনের বৈষম্যের সৃষ্টি করবে। 

৩.৪) শিক্ষার্থীদের একটি বড় অংশ টিউশনি বা নানা ধরনের খণ্ডকালীন কাজের মাধ্যমে নিজের পড়ার খরচ যোগায়, অনেকে নিজ পরিবারেও অর্থনৈতিক অবদান রাখে। মহামারীর কারণে শিক্ষার্থীদের এই উপার্জনের সুযোগ প্রায় পুরোপুরিই বন্ধ হয়ে গেছে। অনেক বিভাগ এবং বিশ্ববিদ্যালয় কমিউনিটি তাদের চরম সংকটে পাশে দাঁড়ানোর চেষ্টা করলেও অনেক প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ই ফি আদায়সহ শিক্ষার্থীদের জন্য আর্থিক চাপ অব্যাহত রেখেছে। এমনকি জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন শিক্ষার্থীদের দারিদ্র নিয়ে নির্মম ও অবমাননাকর মন্তব্য পর্যন্ত করেছেন। 

৩.৫) অপরিকল্পিত লকডাউন বা ছুটির কারণে অনেক শিক্ষার্থী ক্যাম্পাস ছাত্রাবাস বা অন্য আবাসস্থলেই তাদের বইপত্রসহ অন্য শিক্ষা উপকরণ ফেলে রেখে বাড়ি গিয়ে সেখানেই আটকা পড়েছেন। 

৩.৬) ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি বিভাগের ২০০ জনের একটি ক্লাসের জরিপে দেখা যাচ্ছে যে ৪০ জন শিক্ষার্থীরই অনলাইন ক্লাসে অংশ নেবার মতো ডিভাইস বা ইন্টারনেট কেনার মত অর্থ নেই। অনুমান করা যেতে পারে যে সারাদেশের বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের ক্ষেত্রে এই অনুপাতটি আরো বেশি হবে। অথচ দুর্যোগের মাঝেও নতুন অর্থবছরের বাজেটে মোবাইল পরিসেবায় কর বৃদ্ধির ফলে মোবাইল ইন্টারনেট আরো দামী হয়ে উঠেছে যা আরো বেশি সংখ্যক শিক্ষার্থীর জন্য বোঝা হয়ে দাঁড়াবে। 

৩.৭) কেবল ‘স্মার্ট’ মোবাইল ফোন থাকাকেই শিক্ষার্থীর ক্ষেত্রে ‘অনলাইন ক্লাসে’ যোগ দেয়ার সক্ষমতা হিসেবে ধরে নেয়া হয়েছে। এই ধরনের দৃষ্টিভঙ্গী একদিকে যেমন ‘উচ্চ-শিক্ষা’র জ্ঞান-জাগতিক ব্যাপ্তিকে ছোট করে ফেলে।

৩.৮) ইন্টারনেটের উচ্চমূল্য ছাড়াও অনেক ভৌগলিক ও অর্থনৈতিকভাবে প্রান্তিক জেলায় ইন্টারনেটের বিস্তৃতি এবং গতি দুই-ই খুব সীমিত। এমন পরিস্থিতিতে বিডিরেনের ফ্রি জুম মিটিং এ তাদের প্রযুক্তি বৃত্তি বা সংযোগ বা ডিভাইস দিয়ে যুক্ত করার চেষ্টা করা হলেও অনেকের পক্ষে কাগজে-কলমের ৪জি কানেকশন থেকেও জুমে সংযুক্ত থাকার মতো ব্যন্ডউইডথ থাকবে না। জুমের জন্য বেশি গতির ইন্টারনেট কিনেও হয়তো অনেক শিক্ষার্থিই ক্লাসে যুক্ত থাকতে পারবেন না । 

৩.৯) অনেক এলাকায় বাসায় নেটওয়ার্ক দুর্বল হওয়ায় বাড়ি থেকে দূরে, রাস্তায় বা মাঠে, বা বাজার বা থানা সদরে গিয়ে সংযোগ পেতে হয়। এরকম স্থানে শিক্ষার্থীর পক্ষে ক্লাসের পাঠে মনঃসংযোগ করার মত পরিবেশও থাকবে না যা বৈষম্য বাড়াবে।

৩.১০) বিশেষত নারী শিক্ষার্থীদের এ পরিস্থিতিতে ক্ষতির শিকার হতে হবে বেশি যা শিক্ষাঅর্জনে লিঙ্গ বৈষম্য বাড়াবে। সাংস্কৃতিক কারণে নারীদের সীমিত ইন্টারনেট-অভিগম্যতা, করোনাকালে নারীর বিরুদ্ধে শারীরিক নির্যাতনের বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হার নতুন করে বৈষম্য তৈরি করতে পারে।

৩.১১)   বিদ্যুৎ বিভ্রাট কোনো কোনো এলাকায় নিয়মিত এবং লম্বা সময় ধরে চলে যার কারণে অনেক শিক্ষার্থী ডিভাইস চার্জ দেবার মত বিদ্যুৎ না থাকার অভিযোগও করেছেন। 

৩.১২)  করোনাকালে আক্রান্ত পরিবারের সদস্যদের অনলাইন ক্লাস বাড়তি চাপ হয়ে যাবে। ইতোমধ্যে অনেক শিক্ষকই ভীতিকর পরিস্থিতিতে থাকা শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে এই ধরনের অভিব্যক্তির মুখোমুখি হয়েছেন।

৩.১৩)  পরীক্ষা প্রক্রিয়া বিষয়ে কোনো সুনির্দিষ্ট নির্দেশনা না থাকার কারণে এমনকি প্রযুক্তিগত সক্ষমতা ও আর্থিক সংগতি থাকা শিক্ষার্থীরাও অংশগ্রহণের উদ্দীপনা পাবে না।  

৩.১৪)  প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে অনলাইন ক্লাস চলছে বিধায় পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা পিছিয়ে যাচ্ছে বলে একটা ভয় তৈরী হয়েছে। অথচ পরিসংখ্যানে দেখা যাচ্ছে প্রাইভেটের শিক্ষার্থীদের অনেকেই নিম্ন-মধ্যবিত্ত পরিবার থেকে আসে। এবং তাদের খরচও অনেক বেশি। উভয় ক্ষেত্রেই শিক্ষার্থীদের অনেককেই এখনো বাসা ভাড়া গুনতে হচ্ছে। 

৩.১৫) ইতোমধ্যে অনলাইন ক্লাসে অংশ নেয়া শিক্ষার্থীরা জানিয়েছেন শিক্ষকদের প্রশিক্ষণের ঘাটতির কারণে টাকা খরচ করে ক্লাস করেও তাদের কোনো লাভ হয় না। 

৩.১৬) স্টাডি সার্কেল বা গ্রুপ ডিস্কাশনের মত ‘সতীর্থ শিক্ষণ’বা ‘পিয়ার লার্নিং’ এর সুযোগ বন্ধ থাকায় শিক্ষার্থীদেও শেখার একটি মৌলিক উপায় অকার্যকর হয়ে আছে।

) শিক্ষকদের প্রতিবন্ধকতাসমূহ 

মহামারীর এই সময়ে চিকিৎসাহীন মৃত্যুর ঝুঁকির পাশাপাশি প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা চাকরি তথা অর্থনৈতিক ঝুঁকির মধ্যে থাকলেও আমরা শিক্ষার্থীদের সাথে একাডেমিক মিথস্ক্রিয়া জারি রাখার মাধ্যমে তাদের শিক্ষাজীবন সচল রাখবার জন্য বদ্ধ পরিকর। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের অনলাইন কার্যক্রমে যুক্ত হওয়ার ক্ষেত্রে কিছু সুনির্দিষ্ট প্রতিবন্ধকতা রয়েছে বলে আমরা মনে করি: 

৪.১) যেকোনো অনলাইন কার্যক্রমে অংশগ্রহণের ক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের সামনে এই মূহূর্তে অন্যতম প্রতিবন্ধকতা হচ্ছে ‘ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন ২০১৮’ এর কারণে সৃষ্ট শিক্ষকদের বিদ্যাজাগতিক স্বাধীনতা ও নিরাপত্তা বোধের বিপন্নতা। এই আইনে নির্যাতন-নিপীড়ণের অন্যতম শিকার হচ্ছেন সাংবাদিক-লেখক-শিল্পীসহ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক ও শিক্ষার্থী। এই আইনের উপস্থিতিতে যে কোন শিক্ষক শুধুমাত্র অনলাইনে পাঠদান করতে গিয়েই সরকার দলীয় শিক্ষার্থী, সহকমী বা প্রশাসন, বিশ্ববিদ্যালয়ের বাইরের কোনো রাজনৈতিক স্বার্থান্বেষী মহলের ইন্ধন বা প্রতিহিংসার শিকার হয়ে জেলে যেতে পারেন। কাজেই এই মহামারির কালে অন্তঃত অনলাইন শিক্ষার প্রয়োজনে হলেও আমরা এই আইন বাতিল করবার জোর দাবি জানাই। 

৪.২) দেশে এবং বিদেশে অনলাইনে শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করার অভিজ্ঞতায় দেখা যায় তা শ্রেণীকক্ষে পাঠদান বা গবেষণামূলক ব্যবহারিক শিক্ষণের চেয়ে গুণগতভাবে স্বতন্ত্র একটি প্রক্রিয়া। এজন্য শিক্ষকের আলাদা পাঠ-পরিচালনার দক্ষতা ও প্রযুক্তিগত প্রস্তুতির প্রয়োজন রয়েছে। এক্ষেত্রে শিক্ষকদের যেমন উপযুক্ত প্রযুক্তি ও প্রয়োজনীয় দক্ষতার অভাব রয়েছে, তেমনি বিশ্ববিদ্যালয়েরও প্রয়োজনীয় আইটি অবকাঠামোর (কার্যকর ওয়েবসাইট, লার্নিং ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম, আইটি ল্যাব, ক্যানভাস, ই-রিসোর্স শেয়ারিং, ই-ব্ল্যাকবোর্ড, প্লেজারিজম চেক সফটওয়্যার ইত্যাদির) অভাব রয়েছে।

৪.৩) এধরনের ভার্চুয়াল শেখার পরিবেশ (লার্নিং এনভায়রনমেন্ট) সত্যিকারের শ্রেণিকক্ষের শিক্ষার পরিবেশ থেকে অনেক ভিন্ন এবং এজন্য শিক্ষকদের প্রস্তুতির কোনো বিকল্প নাই। এক্ষেত্রে অধীত বিষয়কে অর্থপূর্ণ করে তোলার জন্য ‘সিনক্রোনাস’ এবং ‘অ্যাসিনক্রোনাস’ উভয় ধরনের শিক্ষা উপকরনের প্রয়োজন হবে। অর্থাৎ শিক্ষক কেবল আগের ক্লাসরুমের ‘লেকচারটি’ ক্যামেরায় অনলাইনে বা লাইভে করবেন – অনলাইন শিক্ষা সম্পর্কে এধরণের সরলীকৃত ভ্রান্ত ধারণা থেকে শিক্ষকদের বের করে নিয়ে আসাটা একটি বড় বিদ্যাগত চ্যালেঞ্জ হবে। ভার্চুয়াল পরিবেশে ক্লাস নিতে অভ্যস্ত হবার, মানিয়ে নেবার জন্য যে প্রশিক্ষণ প্রয়োজন তা অধিকাংশ শিক্ষকেরই নেই।

৪.৪) অনলাইন শিক্ষার জন্য ইলেকট্রনিক বই-পত্র, পাওয়ারপয়েন্ট, ভিডিও কন্টেন্ট, ছোট ডকুমেন্টারিসহ নানা কিছুর সমন্বয়ে ক্লাস সজ্জিত করতে হয়। এধরনের কন্টেন্ট তৈরীতে বাংলাদেশের অধিকাংশ শিক্ষকের কোনো প্রশিক্ষণ নেই। উপরন্তু এক্ষেত্রে ইন্টারনেটে বৈধভাবে কন্টেট বা ই-রিসোর্স কেনার সুযোগ সীমিত হওয়ার কারণে শিক্ষকেরা নানাভাবে কপিরাইট আইনের ফাঁদে পড়বার ঝুঁকিতে পড়বেন। শিক্ষক যদি শিক্ষার্থিদের সুবিধার কথা বিবেচনা করে গুগল ক্লাসরুম বা অন্য সামাজিক মাধ্যমে বইপত্রের  পিডিএফ কপি আপলোড করেন তা ঐ বইয়ের কপিরাইট লংঘন করবে এবং প্রকাশক আন্তর্জাতিক কপিরাইট আইনে মামলা করে দিতে পারে। 

৪.৫) অনেক শিক্ষক বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজস্ব নেটওয়ার্ক সুবিধার বাইরে থাকেন, অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজস্ব নেটওয়ার্কও দুর্বল। 

৪.৬) পৃথিবীব্যাপী গত কয়েকমাসের অচলাবস্থা, এবং স্থানীয় চিকিৎসা পরিস্থিতি দুরবস্থার কারণে আতঙ্ক সমাজের আর সবার মত শিক্ষকদেরও মানসিকভাবে বিপর্যস্ত করে রেখেছে। এর সাথে যুক্ত হচ্ছে মনোসংযোগের অভাব, অবসাদ, প্যানিক অ্যাটাকসহ নানা মানসিক জটিলতা। ইতিমধ্যেই সমাজের সংবেদনশীল মানুষ হিসেবে নিজ শিক্ষার্থীদের পাশে না থাকতে পারা, এবং দেশব্যাপী নানা অব্যবস্থাপনা ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে কথা বলার নৈতিক অধিকার ও সাহস হারানোর কারণে শিক্ষকদের আত্ম-বিশ্বাস, প্রত্যয়বোধসহ সার্বিক মানসিক স্থিতিই বিনষ্ট হয়েছে। 

) শিক্ষাজীবন পুনরুদ্ধারে করণীয়

আমরা মনে করি মহামারী মোকাবেলায় সরকার ও রাষ্ট্রের ব্যর্থতার একটি অন্যতম কারণ বিশ্ববিদ্যালয় প্রশ্নে রাষ্ট্র পরিচালকদের চিন্তা ও কল্পনাশক্তির ঐতিহাসিক ব্যর্থতা। কোভিড-১৯ মহামারীতেও আমরা স্পষ্ট দেখছি যে নীতি-নির্ধারণ বা সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর গবেষণা সক্ষমতা বৃদ্ধি ও ব্যবহারের কোনো আগ্রহ সরকারের তো নেই, উপরন্তু যৌক্তিক সমালোচনা ও পরামর্শের পথ রুদ্ধ করবার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়সহ জন-জীবনে নানা নিপীড়ণমূলক ভীতি বিস্তারেই সরকার অধিক তৎপর। 

এপরিস্থিতিতে ২০২০ শিক্ষাবর্ষের পরিণতি এবং বাংলাদেশের উচ্চশিক্ষার ভবিষ্যৎ চিন্তা করে এখনি কিছু কার্যকর পদক্ষেপ নিলে শিক্ষার্থীদের শিক্ষা-জীবন অনেকটুকু পুনরুদ্ধার করা সম্ভব। এমনকি সদিচ্ছা থাকলে এই সংকটকে উপলক্ষ্য করেই আমাদের উচ্চশিক্ষার গুণগত মান অনেকটুকু বাড়িয়ে নেয়াও সম্ভব।

২০২০ শিক্ষাবর্ষ পুনরুদ্ধারে আশু করণীয় 

৫.১) শিক্ষার্থীদের মহামারীকালিন বিপর্যস্ত অর্থনৈতিক পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়ে অবিলম্বে দেশের সকল পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের সংকটে থাকা শিক্ষার্থীদের এক বছরের জন্য মাসিক ৩০০০ টাকার বৃত্তির ব্যবস্থা করা ও প্রয়োজনে বৃদ্ধির প্রস্তুতি রাখা। 

৫.২) পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের কমপক্ষে ৫০% শিক্ষার্থীকে তথ্য-প্রযুক্তি সক্ষমতা অর্জনের জন্য এক-কালিন ২০,০০০ টাকার বৃত্তির ব্যবস্থা করতে হবে। অর্থনৈতিক বিচারে দুঃসাধ্য হলে তা দীর্ঘ মেয়াদী সুদহীন ঋণ হিসেবে দিতে হবে। 

৫.৩) উভয় ক্ষেত্রে শিক্ষার্থী নির্বাচন বিভাগীয় পর্যায়ে হবে এবং এক্ষেত্রে অনিয়ম রোধে সর্বোচ্চ ব্যবস্থা নিতে হবে। 

৫.৪) সকল প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের টিউশন ফি কমপক্ষে ৫০% হ্রাস করতে হবে। মহামারীকালিন সময়ে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের সকল শিক্ষকের চাকরি এবং পূর্ণ-বেতন নিশ্চিত করতে হবে। 

৫.৫) সকল শিক্ষার্থীর জন্য বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালিত কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণের জন্য বিনামূল্যে ইন্টারনেট নিশ্চিত করতে হবে দেশের সকল অঞ্চলে প্রয়োজনীয় গতির ইন্টারনেট প্রবাহ নিশ্চিত করতে হবে ।

৫.৬) শুরুতে শুধু স্নাতোকোত্তর ক্লাসের শিক্ষার্থীদের নিয়ে পরীক্ষামূলক ভাবে অনলাইন শিক্ষণ কার্যক্রম শুরু করা যেতে পারে । প্রাযুক্তিক অবকাঠামো নির্মাণের আগে স্নাতক শ্রেণির ক্লাস শুরু করা অনুচিত হবে।

৫.৬) ‘অনলাইন ক্লাস’ এর মতো বিভ্রান্তিকর পরিভাষায় বর্ণিত কিছু ইন্টারনেট নির্ভর লেকচারের পরিবর্তে বিভিন্ন বিষয়ে তাত্ত্বিক প্রশিক্ষণের জন্য ‘ই-লার্নিং’ কনটেন্ট’ তৈরীর ব্যবস্থা করতে হবে।  শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ, প্রযুক্তি ও অবকাঠামো নিশ্চিত করতে হবে। অনলাইন ক্লাস না বলে পুরো কার্যক্রমকে ই-শিক্ষণ সহশিক্ষা/সহযোগিতা হিসেবে নামকরণ করা হলে শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদের মধ্যে ‘অনলাইন ক্লাস’ নিয়ে তৈরী হওয়া অনিশ্চয়তা ও ভীতি দূর হবে।

৫.৭) ২০২০ শিক্ষাবর্ষের জন্য ‘ই-লার্নিং’, গবেষণা বা ব্যবহারিক কোর্স, মূল্যায়ন প্রক্রিয়া, এবং পরীক্ষা পদ্ধতির একটি পূর্ণাঙ্গ রূপরেখা বা রোড ম্যাপ তৈরী করতে হবে এবং সেই অনুযায়ী কারিকুলাম ও একাডেমিক অধ্যাদেশ পুনর্বিন্যাস করতে হবে। একইভাবে পূর্ববর্তী শিক্ষাবর্ষের বাকী থাকা যে কোন কার্যক্রমের জন্য সুনির্দিষ্ট কার্যক্রমের সুস্পষ্ট পরিকল্পনা থাকতে হবে। 

৫.৮) শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের বিদ্যাজাগতিক স্বাধীনতা ও নিরাপত্তা বিধানে ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্ট ২০১৮ বাতিল করতে হবে। এই আইন বহাল রেখে অনলাইন শিক্ষাকার্যক্রম চালুর কোনো সুযোগ নেই । 

.৯) অনলাইনে ই-শিক্ষণ চালু করার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অবকাঠামোগত পরিবর্তন আনতে হবে। যেমন – শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদের প্রাতিষ্ঠানিক ইমেইল দিতে হবে,  না পারা গেলে আপতকালীন ব্যবস্থা হিসেবে স্বল্প সময়ের মধ্যে শিক্ষার্থী-শিক্ষকদের ইমেইলের লিস্টসার্ভ বা তালিকা বিভাগ অনুযায়ী শিক্ষকদের কাছে পৌঁছাতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সময় থেকেই শিক্ষার্থীদের তথ্য আছে, সে তথ্যের ভিত্তিতে প্রত্যেকের ই-শিক্ষণে অংশ নেয়ার সক্ষমতা যাচাই করতে হবে। তারপর তাদের সক্ষমতা যাচাই শেষ হলে, প্রয়োজনীয় ডিভাইস যাদের প্রয়োজন তাদের কাছে পৌঁছাতে হবে। এবিষয়ে দুর্নীতির সমূহ সম্ভাবনা থাকায় শক্ত ভাবে মনিটরিং করতে হবে। মোবাইল অপারেটর কোম্পানিদের বিনামূল্যে সংকটাপন্ন শিক্ষার্থীদের নম্বরগুলোতে ব্যন্ডউইডথ সরবরাহ করতে হবে। বিডিরেনের মাধ্যমে পরিচালিত জুম ক্লাসগুলোতে অংশ নেয়াদের জন্য এটা করা অসম্ভব নয় তবে এর প্রস্তুতির জন্য কিছুটা সময় প্রয়োজন। মোবাইল অপারেটরদের গ্রামাঞ্চলের ইন্টারনেটের গতি বাড়ানোর জন্য চাপ দিতে হবে। 

৫.১০) শিক্ষকদের সিনক্রোনাস ও অ্যাসিনক্রোনাস কন্টেন্ট নির্মানে, সিলেবাস, কারিকুলাম পরিবর্তনে সময় এবং প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে, তাদের নেটওয়ার্ক ও ডিভাইসের (সিন্টিক ডিভাইস বা ল্যাপটপ) সহযোগিতা লাগলে তা দিতে হবে, তাদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে এবং টিচিং ও রিসার্চ এসিস্টেন্টদের জন্য ফান্ড দিতে হবে। 

৫.১১) মুনাফা বা আন্তর্জাতিক অর্থায়নকারী প্রতিষ্ঠানের স্বার্থ নয় বরং জীবন সংলগ্ন বিষয় এবং শিক্ষার্থিদের সার্বিক কল্যাণ মাথায় রেখে অনলাইন কার্যক্রমকে সাজাতে হবে। এই দুর্যোগে মোবাইল কোম্পানির মুনাফা বেড়েছে, কাজেই তাদের সামাজিক দায়িত্বের অংশ হিসেবে এখাতে অর্থ ব্যয় করতে হবে। করোনার কারণে বন্ধ থাকায়  বিশ্ববিদ্যালয়ের সাশ্রয়কৃত অর্থ শিক্ষার্থীদের জন্য ব্যয় করতে হবে। 

৫.১২) সমস্ত পরিকল্পনা ও পদক্ষেপ উপর থেকে চাপিয়ে না দিয়ে নিচ থেকে আসা উচিত। 

৫.১৩) যেহেতু প্যানডেমিক পরিস্থিতি দীর্ঘায়িত হতে যাচ্ছে, সকল বিশ্ববিদ্যালয়েই আগামী তিনমাসের মধ্যে কোভিড-১৯ পরীক্ষা, উপযুক্ত আইসোলেশন সেন্টার, এবং জীবন রক্ষাকারী জরুরী চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে হবে। পাশাপাশি কমপক্ষে ২০২২ সাল পর্যন্ত শারীরিক দূরত্ব ও নিরাপত্তা বজায় রেখে ‘অন-ক্যাম্পাস’ শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনার ব্যবস্থা করতে হবে। এসব শিক্ষার্থীদের ক্যাম্পাসে ফেরানোর জন্য অনিবার্য পূর্বশর্ত। 

বিশ্ববিদ্যালয়ের তথ্যপ্রযুক্তি সক্ষমতা বৃদ্ধিও জন্য ভবিষ্যত করণীয়

৫.১৪) যত দ্রুত সম্ভব বিশ্ববিদ্যালয়ের তথ্য-প্রযুক্তিগত সক্ষমতা বাড়াতে হবে। 

৫.১৫) বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের আবাসিক সংকটের সমাধান করতে হবে। 

৫.১৬) উচ্চ-শিক্ষার বাণিজ্যিকীকরণের পথ থেকে সরে এসে জাতীয় প্রয়োজনে একটি গুরুত্বপূর্ণ খাত হিসেবে উচ্চশিক্ষায় রাষ্ট্রীয় বিনিয়োগ ও বরাদ্দ বাড়াতে হবে। 

৫.১৭) বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর গবেষণা সক্ষমতা বৃদ্ধি করে রাষ্ট্র ও সমাজের প্রয়োজনে তার সর্বোচ্চ ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। 

বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক নেটওয়ার্ক বাংলাদেশের পাবলিক ও প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়সমূহের শিক্ষকদের নেটওয়ার্ক।

Sending
User Review
0 (0 votes)

লেখক সম্পর্কে

সম্পাদক বাংলাদেশের শিক্ষা

এই লেখাটি সম্পাদক কর্তৃক প্রকাশিত। মূল লেখার পরিচিত লেখার নিচে দেওয়া হয়েছে।

মন্তব্য লিখুন