অপার সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও বাংলাদেশের শিক্ষা অনেকদিন ধরেই বেশ কিছু নির্দিষ্ট সমস্যার বৃত্তে ঘুরপাক খাচ্ছে। এসব সমস্যার কারণ হিসেবে তিনটি বিষয় প্রণিধানযোগ্য: শিক্ষাকে রাষ্ট্রীয়ভাবে অগ্রাধিকারভিত্তিক বিনিয়োগের ক্ষেত্র হিসেবে চিহ্নিত না করা, শিক্ষার নানা সিদ্ধান্তগ্রহণ প্রক্রিয়ায় সুনির্দিষ্ট অবস্থান না থাকা এবং আনুষ্ঠানিক শিক্ষাপ্রক্রিয়ায় সমন্বিত শিক্ষাদর্শন ও শিক্ষাউন্নয়নের রূপরেখা নিশ্চিত না করতে পারা।
স্বাধীনতার পর বাংলাদেশের বাজেট-প্রস্তুত প্রক্রিয়ায় শিক্ষাকে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হতো, যদিও এই বাজেটে শিক্ষার জন্য বরাদ্দ কখনোই প্রত্যাশিত পর্যায়ে যেতে পারেনি। বাজেট বক্তৃতার পরদিন সংবাদপত্রের অবধারিত শিরোনাম ছিলো: শিক্ষার জন্য সর্বোচ্চ বরাদ্দ। অর্থাৎ, রাষ্ট্রীয়ভাবেই শিক্ষার জন্য সর্বোচ্চ বরাদ্দের বিষয়টি অলিখিতভাবে হলেও গুরুত্বপূর্ণ ছিলো, যা প্রতিফলিত হতো সরকারের বাজেটে।
কালক্রমে শিক্ষা এককভাবে সর্বোচ্চ বরাদ্দের অবস্থানটি হারালেও শিক্ষার সঙ্গে অন্যান্য সেক্টরকে যুক্ত করে শিক্ষার জন্য সর্বোচ্চ বরাদ্দের দাবি করা হতো। অর্থাৎ, শিক্ষার জন্য সর্বোচ্চ বরাদ্দ যে গর্বের, সেই বোধটুকু প্রতিফলিত করার চেষ্টা করা হতো। সাম্প্রতিক সময়ে শিক্ষার প্রতি এই গুরুত্বটুকুও অনেকটা কমে গেছে।
২০২১-২১ অর্থবছরে বাজেটে শিক্ষার জন্য যেখানে বরাদ্দ করা হয়েছিলো জিডিপির ২.০৯ শতাংশ, সেখানে এই হার ২০২১-২২ অর্থবছরে ২.০১ শতাংশ, ২০২২-২৩ অর্থবছরে ১.৮৩ শতাংশ, ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ১.৭৬ শতাংশ এবং বর্তমানে অর্থাৎ ২০২৪-২৫ অর্থবছরে ১.৬৯ শতাংশ। দেখা যাচ্ছে, শিক্ষার জন্য বরাদ্দ প্রতি বছর ক্রমান্বয়ে কমছে। বাজেটে শিক্ষার জন্য বরাদ্দের এই চিত্র থেকেই অনুধাবন করা সম্ভব যে, শিক্ষাউন্নয়নের রূপরেখা সুনির্দিষ্ট করতে শিক্ষাকে রাষ্ট্রীয়ভাবে অগ্রাধিকারে ক্ষেত্র হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে না।
যে পরিমাণ অর্থ শিক্ষার জন্য প্রতি বছর বরাদ্দ করা হয়, তার একটি অংশ যথাযথভাবে ব্যবহৃত বা খরচ হয় না বলে কিছু আলোচনা শোনা যায়। ফলে, অনেকে বাজেটে বরাদ্দের চেয়েও যথাযথভাবে খরচের বিষয়টিকে গুরুত্ব প্রদান করেন। প্রকৃতপক্ষে, শিক্ষাউন্নয়নের রূপরেখা সুনির্দিষ্ট করতে শিক্ষার জন্য যথাযথ বরাদ্দ এবং যথাযথভাবে খরচ করার মধ্যে কোনো বিরোধ নেই। রাষ্ট্র যদি শিক্ষায় পর্যাপ্ত পরিমাণ বিনিয়োগ করে, তাহলে সেই বিনিয়োগ স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদে আশানুরূপ ফল নিয়ে আসে।
প্রকৃতপক্ষে, শিক্ষাউন্নয়নের রূপরেখা সুনির্দিষ্ট করতে শিক্ষার জন্য যথাযথ বরাদ্দ এবং যথাযথভাবে খরচ করার মধ্যে কোনো বিরোধ নেই। রাষ্ট্র যদি শিক্ষায় পর্যাপ্ত পরিমাণ বিনিয়োগ করে, তাহলে সেই বিনিয়োগ স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদে আশানুরূপ ফল নিয়ে আসে।
এই বিনিয়োগ একদিকে যেমন শিক্ষা-সংশ্লিষ্ট অবকাঠামোগত উন্নয়নে সহায়ক হয়, তেমনি তা মানবসম্পদ তৈরিতে কার্যকর ভূমিকা পালন করে। এই মানবসম্পদই একটি নির্দিষ্ট সময় পর দীর্ঘমেয়াদে দেশকে প্রতিদান দিতে শুরু করে। শিক্ষার জন্য বরাদ্দ যেমন মানবসম্পদ উন্নয়নে রাষ্ট্রের দর্শনকে প্রতিফলিত করে, তেমনি এই বরাদ্দ যথাযথভাবে ব্যবহারের বিষয়টি প্রশাসনিক সক্ষমতার পরিচয় প্রদান করে ও শিক্ষাউন্নয়নের রূপরেখা নিশ্চিত করে। প্রতিযোগিতামূলক বিশ্বে রাষ্ট্রকে সক্ষম করে তোলার জন্য উভয়দিককে সমন্বিতভাবে গুরুত্ব প্রদান না করা হলে শিক্ষা থেকে প্রকৃত সুফল পাওয়া সম্ভব হবে না।
শিক্ষা-সেক্টর থেকে প্রত্যাশিত ফল না আসার আরেকটি বড় কারণ হচ্ছে, শিক্ষার নানা সিদ্ধান্তগ্রহণ প্রক্রিয়ায় সুনির্দিষ্ট অবস্থান ও শিক্ষাউন্নয়নের রূপরেখা না থাকা। উদাহরণস্বরূপ বলা যেতে পারে, আগামী পঞ্চাশ বা একশ বছরে বাংলাদেশেকে আমরা কোন পর্যায়ে নিয়ে যেতে চাই, তার কোনো সমন্বিত পরিকল্পনা না থাকা। বর্তমানে বাংলাদেশের শিক্ষা পরিচালিত হচ্ছে দুটো আলাদা মন্ত্রণালয় দিয়ে। এই মন্ত্রণালয় দুটোর সমন্বয়হীনতা শিক্ষার এক স্তরের সঙ্গে অন্যান্য স্তরে সংযোগটিকে দুর্বল করার ক্ষেত্রে নেতিবাচক ভূমিকা রাখছে।
সর্বশেষ শিক্ষাক্রমের উদাহরণটিই এখানে আলোচিত হতে পারে। মাধ্যমিক পর্যায়ে যেভাবে শিক্ষাক্রম বাস্তবায়নের পরিকল্পনা করা হয়েছে তার সাথে প্রাথমিক পর্যায়ের পার্থক্য রয়েছে। অপরদিকে, বিগত কয়েক দশক ধরে শিক্ষার নানা বিষয়ে গবেষণা ছাড়া বিস্তর পরীক্ষানিরীক্ষা করা হচ্ছে। এসো নিজে করি, প্রশ্নব্যাংক, সৃজনশীল পরীক্ষা, প্রাথমিকে পাবলিক পরীক্ষা, নতুন শিক্ষাক্রম—একেক সময় একেক কার্যক্রমের মধ্যে শিক্ষাকে মূলত এক ধরনের অস্থিরতার মধ্যে রাখা হয়েছে।
শিক্ষা ও শিক্ষাউন্নয়নের রূপরেখা এমন একটি বিকাশ-প্রক্রিয়া যেখানে সুস্থিরভাবে ধারাবাহিক পরিকল্পনার মাধ্যমে অতি সতর্কভাবে পরিবর্তন আনতে হয়, কিন্তু কিছুদিন পরপর যেভাবে পরিবর্তন আনা হয়, তাতে শিক্ষা একটি নির্দিষ্ট আঙ্গিকে সুস্থির হতে পারছে না। দেশের জাতীয় শিক্ষানীতির সঙ্গেও এসব পরিবর্তন অনেকক্ষেত্রে সঙ্গতিহীন হয়ে থাকছে। একটি দেশে যখন শিক্ষানীতি তৈরি করা হয় নানা পরিপ্রেক্ষিত বিবেচনায়, তখন এটি আশা করা সঙ্গত যে, সরকার সেই শিক্ষানীতি বাস্তবায়নে সর্বোচ্চ প্রচেষ্টা গ্রহণ করবে। বাংলাদেশে এর উল্টোচিত্র বিদ্যমান।
- শিক্ষার মান ও শিক্ষাধ্বংসের কালপঞ্জী : ১৯৭২—২০২২
- প্রশ্নফাঁস ও শতভাগ পাশ: কাঠামোগত, সংগঠনগত ও ব্যবস্থাপনাগত ভিত্তি
- প্রয়োজন সুস্থির, সুনির্দিষ্ট ও পরিকল্পনামাফিক শিক্ষাউন্নয়নের রূপরেখা
- ওমর শেহাবের ‘নতুন শিক্ষাক্রমে দুটি বড় ভুল’ : একটি ‘ব্যক্তিগত’ প্রতিক্রিয়া
- শারীরিক শাস্তি বা শাসন : শিক্ষকের হাতের বেতই কি তবে সমাধান?
জাতীয় শিক্ষানীতি ২০১০-এ প্রাথমিক শ্রেণিকে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত উন্নীত করার যে সুপারিশ করা হয়েছিলো, সেটি চৌদ্দ বছরেও বাস্তবায়িত হয়নি। প্রসঙ্গত মনে রাখা দরকার যে, এই একই সুপারিশ ১৯৭৪ সালে প্রথিতযশা বিজ্ঞানী ড. কুদরাত-এ-খুদার নেতৃত্বে বাংলাদেশের প্রথম শিক্ষা কমিশন করেছিলো। অর্থাৎ, বাংলাদেশের শিক্ষার জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ সুপারিশ পঞ্চাশ বছরেও বাস্তবায়ন করা যায়নি। শিক্ষার সিদ্ধান্তগ্রহণ প্রক্রিয়ায় সুনির্দিষ্ট অবস্থানের যে ঘাটতি রয়েছে, সেটি অনুধাবনের জন্য এই একটি উদাহরণই যথেষ্ট!
বর্তমান শিক্ষানীতির নানা কৌশল বাস্তবায়নের সঙ্গে শিক্ষার জন্য বরাদ্দের বিষয়টিও জড়িত। হয় শিক্ষার জন্য পর্যাপ্ত বরাদ্দ না থাকায় শিক্ষানীতির সুপারিশসমূহ বাস্তবায়ন করা যাচ্ছে না, অথবা শিক্ষানীতি বাস্তবায়ন করা হবে না বলেই শিক্ষার জন্য পর্যাপ্ত বরাদ্দ প্রদান করা হচ্ছে না—দুটোর মধ্যে কোনটি সঠিক, সেটির উত্তর সরকারের কাছে রয়েছে। কিন্তু, এটুকু ঠিক যে, শিক্ষানীতি বাস্তবায়িত না হয় শিক্ষার নানা সিদ্ধান্তগ্রহণ প্রক্রিয়া একধরনের নির্বাহী আদেশে চলছে, যা প্রকৃতপক্ষে শিক্ষায় অস্থিরতা সৃষ্টি করছে,বা শিক্ষায় কোনো সুস্থির অবস্থান তৈরি হচ্ছে না।
বাজেটে শিক্ষার জন্য বরাদ্দ কিংবা শিক্ষায় সুস্থির একটি অবস্থানে না থাকা উভয়ই আবার দেশের জন্য কোনো নির্দিষ্ট শিক্ষাদর্শন না থাকার বিষয়টির সাথে সম্পর্কিত। বর্তমান শিক্ষানীতির কৌশল অনুযায়ী বাংলাদেশ কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষার প্রতি গুরুত্ব আরোপ করেছে। দক্ষ জনশক্তি তৈরি ও দেশের সার্বিক উন্নতির জন্য কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষা গুরুত্বপূর্ণ, কিন্তু এর কার্যকর বাস্তবায়নে শিথিলতা রয়েছে।
আবার, এও প্রশ্ন যে, আমরা কি বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তিতে নেতৃত্বদানের মতো করে আমাদের শিক্ষার্থীদের গড়ে তুলবো, নাকি আমাদের উদ্দেশ্য থাকবে শুধু দক্ষ কর্মী তৈরি করা? শিক্ষার মাধ্যমে আমরা কি আমাদের শিক্ষার্থীদের জন্য দক্ষতার ওপরই ফোকাস করবো বেশি, নাকি নৈতিক ও মানবিক গুণাবলীর বিকাশের মূল হাতিয়ার হবে আমাদের শিক্ষা? একটি আরেকটির প্রতিপক্ষ নয়, বরং পরিপূরক; কিন্তু আমাদের জাতীয় শিক্ষাদর্শন আসলে কোনো নির্দিষ্ট ক্ষেত্রকে কি প্রতিফলিত করে?
আমাদের শিক্ষাউন্নয়নের রূপরেখা কী, স্বল্পমেয়াদী লক্ষ্য কী এবং দীর্ঘমেয়াদে শিক্ষার মাধ্যমে আমরা কী অর্জন করতে চাই, এসব বিষয়ে কি আমাদের কোনো জাতীয় শিক্ষাদর্শন রয়েছে? নাকি, তরণী আমাদের ভেসে চলছে উদ্দেশ্যহীনভাবে? একটি শিশু কি তার চাহিদা ও আগ্রহ অনুযায়ী প্রাথমিক থেকে উচ্চশিক্ষাস্তর পর্যন্ত তার বিকাশের সমস্ত সুযোগ পাচ্ছে? প্রাথমিক থেকে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার মধ্যকার যে সংযোগ ও ধারাবাহিকতা থাকা দরকার, তা কি আমাদের শিক্ষাপ্রক্রিয়ায় উপস্থিত? রাষ্ট্রীয়ভাবে আমরা যে পর্যায়ে আগামী কয়েক দশকে যেতে চাই, তার সঙ্গে শিক্ষার সংযোগ কতোটুকু? এরকম অনেক প্রশ্ন রয়েছে, যেগুলোর উত্তর অজানা।
বাংলাদেশ অপার সম্ভাবনাসময় দেশ। জনসংখ্যার একটি বিরাট অংশ শিশু, কিশোর, তরুণ ও যুবক, যাদেরকে যথাযথভাবে প্রস্তুত করা গেলে আগামী দিনগুলোতে তারাই দেশকে নেতৃত্ব দেবে। ফলে, শুরু থেকেই শিক্ষাউন্নয়নের রূপরেখা ও তাদেরকে এমনভাবে গড়ে তোলা প্রয়োজন, যাতে একদিকে তারা দেশকে সঠিক নেতৃত্বদানের মাধ্যমে এগিয়ে যেতে পারে, অন্যদিকে পরিবর্তিত পরিস্থিতির প্রয়োজনে যথাযথ সিদ্ধান্তগ্রহণ করতে পারে। যে তরুণদের মধ্যে হতাশার রেখা দেখা যায় দেশে, তারাই দেশের বাইরে নানা প্রতিকূলতার মধ্যেও নিজের যোগ্যতার প্রমাণ রাখছে।
ফলে, আমাদের শিক্ষার্থীরা যথাযথভাবে তাদের যোগ্যতা ও দক্ষতা প্রদর্শন করতে পারবে না, প্রশ্ন সেখানে থাকছে না, বরং তাদেরকে বিকশিত করার জন্য পর্যাপ্ত ও যথাযথ আয়োজন, দর্শন, পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নের সক্ষমতা আমরা তৈরি করতে পারছি না, প্রশ্ন সেখানে। ক্ষেত্র প্রস্তুত, প্রয়োজন পরিচর্যা ও অগ্রাধিকারের।
বাংলাদেশের শিক্ষা ও শিক্ষার মাধ্যমে জাতীয় উন্নতি নিশ্চিত করা রাষ্ট্রীয় অগ্রাধিকারের বিষয় হওয়া প্রয়োজন। সুস্থির, সুনির্দিষ্ট ও পরিকল্পনামাফিক স্বল্প-মধ্য-দীর্ঘমেয়াদী শিক্ষাউন্নয়ন শুধু মানবিক মানুষই তৈরি করবে না, বরং প্রত্যেককে সম্পদে পরিণত করবে। বাংলাদেশের শিক্ষার আয়োজন পরিচালিত হওয়া প্রয়োজন সেই লক্ষ্যকে কেন্দ্র করেই।
(নিবন্ধটি ‘আজকের পত্রিকা’র তৃতীয় প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষ্যে গত জুন মাসে লেখা। এটি ছাপা সংস্করণে প্রকাশিত হলেও অনলাইনে প্রকাশিত হয়নি, ফলে লেখাটি এখানে পুনঃপ্রকাশ করা হলো।)
লেখক পরিচিতি
গৌতম রায় রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটে সহযোগী অধ্যাপক হিসেবে কর্মরত রয়েছেন।