বাড়ি সাক্ষাৎকার মাছুম বিল্লাহ: “শিক্ষা নিয়ে লেখালেখি করলে পরিবর্তন আসে, হয়তো সবসময় সেটি দৃশ্যমান...

মাছুম বিল্লাহ: “শিক্ষা নিয়ে লেখালেখি করলে পরিবর্তন আসে, হয়তো সবসময় সেটি দৃশ্যমান হয় না”

শিক্ষা নিয়ে লেখালেখি ও শিক্ষার নানা প্রসঙ্গ সম্পর্কে বলেছেন মাছুম বিল্লাহ
শিক্ষা নিয়ে লেখালেখি ও শিক্ষার নানা প্রসঙ্গ সম্পর্কে বলেছেন মাছুম বিল্লাহ

বাংলাদেশে শিক্ষা নিয়ে লেখালেখি করছেন অনেকেই। প্রতিনিয়ত যারা শিক্ষা নিয়ে লেখালেখি করছেন, মাছুম বিল্লাহ তাঁদের একজন। ইংরেজিতে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জনের পর কয়েকটি ক্যাডেট কলেজ ও ঢাকার একাধিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষকতা করে ২০০৩ সাল থেকে ব্র্যাকের শিক্ষা কর্মসূচিতে (পেইস) ইংরেজি বিশেষজ্ঞ হিসেবে যোগদান করেন এবং এখনও সেখানেই কর্মরত। নেতৃত্ব দিচ্ছেন ইংলিশ টিচার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ETAB)। বাংলাদেশের মাধ্যমিক পর্যায়ে শিক্ষকদের ইংরেজি প্রশিক্ষণে অবদানের জন্য আন্তর্জাতিক টিসল কর্তৃপক্ষ তাঁকে টিসল প্রেসিডেন্ট অ্যাওয়ার্ডে ভূষিত করে। বাংলাদেশে শিক্ষা নিয়ে লেখালেখি, এর প্রভাব, মত প্রকাশের পর প্রতিক্রিয়া ও অভিজ্ঞতা ইত্যাদি নানা বিষয়ে বাংলাদেশের শিক্ষার পক্ষ থেকে তাঁর সঙ্গে কথা বলেছেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহকারী অধ্যাপক গৌতম রায়

গৌতম রায়: বাংলাদেশে যারা শিক্ষা নিয়ে লেখালেখি করেন নিয়মিত, তাদের অন্যতম আপনি। প্রশ্ন হচ্ছে, কেন আপনি শিক্ষা নিয়ে নিয়মিত লিখছেন?

মাছুম বিল্লাহ: ধন্যবাদ। আমার লেখালেখির বিষয়টিতে আপনার দৃষ্টি আকৃষ্ট হওয়ার জন্য আবারও ধন্যবাদ। আমি দীর্ঘদিন শিক্ষকতার সাথে সরাসরি জড়িত ছিলাম। বর্তমানে ব্র্যাক শিক্ষা কর্মসূচিতে কাজ করছি, সেটিও শিক্ষকদের নিয়ে, শিক্ষকতা নিয়ে, শিক্ষাদান নিয়ে। যদিও আমি বিভিন্ন ধরনের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কাজ করেছি, কিন্তু বেশি সময় কেটেছে ক্যাডেট কলেজে। আমি শিক্ষকতা করেছি ক্যান্টনমেন্ট কলেজ, ক্যাডেট কলেজ (সিলেট, কুমিল্লা, মির্জাপুর), রাজউক উত্তরা মডেল কলেজ এবং খুব স্বল্পসময়ের জন্য বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ে। একেক জায়গায় একেক ধরনের সমস্যা দেখেছি। যেখানেই কাজ করেছি, সেখানকার সমস্যাই আমাকে নাড়া দিয়েছে। ফলে, সমস্যার গভীরে যেতে এবং কিছু সমাধান বের করার জন্য উদ্যেগী হয়েছিলাম। ভেবেছি, দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এবং বৃহত্তর অর্থে আমাদের দেশের গোটা শিক্ষক সমাজ নানাবিধ সমস্যার মুখোমুখি।  সমস্যা-সংকুল পরিবেশে শিক্ষকদের শিক্ষাদান করতে হয়। সেটি তাঁরা কীভাবে করবেন, কোন পরিস্থিতিতে কী করতে হবে ইত্যাদি বিষয় নিয়ে ভাবনা এবং কিছু কিছু সমস্যার সমাধান বের করে গোটা শিক্ষক সমাজকে আমার অভিজ্ঞতাগুলো শেয়ার করার একটি প্রয়াস হচ্ছে এই লেখালেখি। দেশের শিক্ষাব্যবস্থায় যেসব সমস্যা রয়েছে, সেগুলো তুলে আনা এবং নীতি-নির্ধারকদের কিছুটা হলেও সেনসেটাইজ করা। কারণ, একটি দেশে শিক্ষা যদি শক্ত ভিত্তির ওপর দাঁড়াতে পারে, তাহলে দেশের অন্যান্য সমস্যা সহজেই সমাধান করা যায়। একজন শিক্ষক হিসেবে আমি এটি বিশ্বাস করি এবং সেই বিশ্বাস থেকেই শিক্ষা নিয়ে লেখালেখি করার চেষ্টা করা।

আমি যখন ক্যান্টনমেন্টে শিক্ষকতা শুরু করলাম, সেখানে গিয়ে দেখলাম বাইরের প্রাইভেট শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের চেয়ে সেখানকার অবস্থা কতোটা আলাাদা, কতোটা ভিন্ন! শিক্ষকদের অর্থনৈতিক সমস্যা নিয়ে চিন্তা করতে হয় না, তাঁরা পরিস্কার ও ছিমছাম পরিবেশে থাকছেন। তখন আমার মনে দাগ কাটলো শিক্ষায় এতো বিভক্তি কেন বা এতো পার্থক্য কেন? প্রাইভেট শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যারা আছেন, তাঁদের অর্থনৈতিক চিন্তা করতে করতেই জীবন কেটে যায়। কখন তাঁরা সত্যিকার শিক্ষাদানে মনোযোগী হবেন? তাছাড়া দলাদলি, কমিটির লোকজনকে খুশি রাখা, এলাকার প্রভাবশালী ও মাস্তান ম্যানেজ করা, ছাত্রনেতাদের তোয়াজ করে চলা ইত্যাদির কোনোকিছুই নেই ক্যান্টনমেন্ট কলেজগুলোতে। অবশ্য আছে সিভিল-মিলিটারি কনফ্লিক্ট, তবে সেটি সেভাবে প্রকাশিত হয় না। এই যে বাহ্যিক ও অভ্যন্তরীণ নানা বিষয় কীভাবে ম্যানেজ করে চলতে হয় শিক্ষকদের, সেসব বিষয়ও আমি আমার লেখায় তুলে ধরার চেষ্টা করি।

আপনার এসব লেখালেখি আদৌ কোনো কাজে আসছে? কোনো পরিবর্তন হচ্ছে?

আমি শিক্ষকতায় থাকাকালীন অনেক বিষয় দেখতাম অর্থ ছাড়াই সমাধান করা যায়। রাজউক কলেজে থাকাকালীন দেখতাম, প্রথম সাময়িক পরীক্ষা, দ্বিতীয় সাময়িক পরীক্ষা ও বার্ষিক পরীক্ষা দেশের বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন সময়ে নেওয়া হতো। এক প্রতিষ্ঠান থেকে অন্য প্রতিষ্ঠানে বেশ গ্যাপে এই পরীক্ষাগুলো অনুষ্ঠিত হতো। অভিজ্ঞতায় দেখেছি, কোনো পরিবারের একটি ছেলে রাজউকে পড়ে, তার বোন কিংবা ভাই উত্তরাতেই অন্য একটি প্রতিষ্ঠানে পড়াশুনা করে। রাজউকে প্রথম সাময়িক পরীক্ষা মার্চেই শেষ, উত্তরা হাইস্কুলে দেখা গেলো এপ্রিলের শেষে কিংবা মে মাসে। ফলে, পরিবারটি পারিবারিক কোনো অনুষ্ঠান ভালোভাবে করতে পারে না। কারণ, যার পরীক্ষা শেষ হয়েছে সে মুক্ত দিন কাটাচ্ছে; অপরদিকে আরেকজন পরীক্ষার চাপে অস্থির হয়ে আছে।

পুরো দেশেই এই অবস্থা। আমি তখন প্রস্তাব করেছিলাম পুরো দেশের প্রথম সাময়িক পরীক্ষা বা দ্বিতীয় সাময়িক পরীক্ষা দেশের সর্বত্র একই সময়ে করার জন্য। তাতে দেশের রাজনীতিবিদগণও তাদের রাজনৈতিক কর্মসূচি দেয়ার একটি সময় নির্ধারণ করতে পারবেন। দেখা যায়, রাজনৈতিক কর্মসূচির জন্য কেউ কেউ ভালোভাবে পরীক্ষা দিতে পারলেও অনেকের পরীক্ষা কঠিন রাজনৈতিক কর্মসূচির মধ্যে পড়ে যায়। যখন পুরো দেশ জানবে যে, মার্চ মাসে ২৮ তারিখ থেকে দেশের মাধ্যমিক বিদ্যালয়গুলোতে প্রথম সাময়িক পরীক্ষা শুরু হবে, তখন প্রত্যেকে সেভাবেই প্রস্তুতি নিবে। যেমন, এসএসসি বা এইচএসসি পরীক্ষার তারিখ সবাই জানে। বিষয়টি নিয়ে বেশ কয়েকবার ইংরেজি ও বাংলা পত্রিকায় লিখেছিলাম। তার পরপরই দেখলাম মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তর দেশের মাধ্যমিক বিদ্যালয়গুলোতে আভ্যন্তরীণ পরীক্ষাগুলো দেশের সর্বত্র একই সময়ে নেওয়ার ঘোষণা দেয় এবং বর্তমানে পরীক্ষাগুলো সেভাবেই হচ্ছে। আমি বলছি না যে, আমার শিক্ষা নিয়ে লেখালেখি করার কারণেই এটি হয়েছে। তবে আমি এর ক্রেডিট কিছুটা নিতে পারি এজন্য যে, কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণ করে আমি কয়েকবার বিষয়টি নিয়ে বাংলা ও ইংরেজি পত্রিকায় লিখেছিলাম।

দ্বিতীয়ত, আমাদের বোর্ডের সার্টিফিকেটগুলো ইংরেজি ও বাংলায় লেখার জন্য শিক্ষাবোর্ডগুলোক অনুরোধ করেছিলাম বেশ কয়েকবার। কারণ, বিদেশে উচ্চশিক্ষা কিংবা চাকরির জন্য সার্টিফিকেট ইংরেজিতে করতে হয়। সেই সার্টিফিকেট বোর্ড থেকে ইংরেজি করানো যে কতো ঝামেলার, তা কেবল ভুক্তভোগীই জানেন। কলেজ ও স্কুলের প্রধানদের সুপারিশ, প্রমাণপত্র ও দস্তখত নিয়ে বোর্ডে যেতে হয়। একজন হয়তো সেই স্কুল ও কলেজ দশ বছর কিংবা বিশ বছর আগে এমনকি তারও বেশি পূর্বে ছেড়ে এসেছেন। সব কাজ বাদ দিয়ে সার্টিফিকেট ইংরেজি করানোর জন্য ছুটতে হয় স্কুল, কলেজ এবং তারপর শিক্ষা বোর্ডে। আর শিক্ষা বোর্ডে গেলেই যে সার্টিফিকেট ইংরেজিতে করে দিবে, তাও নয়। সেখানে রয়েছে বহু আনুষ্ঠানিকতা। সময় ক্ষেপণ আর দুর্নীতি তো আছেই। এগুলো উল্লেখ করে আমি বোর্ড সার্টিফিকেটের একপাশে বাংলা ও অপরপাশে ইংরেজি করার প্রস্তাব করেছিলাম। এখন কিন্তু তাই হচ্ছে, একপাশে ইংরেজি অপরপাশে বাংলা। তাতে, আমাদের বাংলাকেও সম্মান করা হলো, পাশাপাশি সার্টিফিকেটও আন্তর্জাতকি মানের হলো। যাদের ইংরেজিতে সার্টিফিকেট প্রয়োজন তাদের আর হয়রান হতে হলো না। এগুলো দেখে মনে হয় শিক্ষা নিয়ে লেখালেখি করে কাজ হয়তো হয়।

তাছাড়া বিভিন্ন সভা-সেমিনারে যখন শিক্ষকদের সাথে পরিচয় হয়, তখন অনেকেই জানান অমুক বিষয়টি আপনার লেখা পড়ে জেনেছি কিংবা পেডাগজি-অ্যন্ড্রাাগজি শুধু নাম শুনেছি, আপনার লেখা পড়ে বুঝলাম বিষয় দুটো আসলে কি! কিংবা কেউ যখন বলেন, কর্মসহায়ক গবেষণার কথাও আপনার লেখা পড়ে জেনেছি। এর পূর্বে বিষয়টি সম্পর্কে তেমন কোনো ধারণা ছিলো না। এসব শুনলে মনে হয় শিক্ষা নিয়ে লেখালেখি অনেকক্ষেত্রেই কাজে আসে। অনেক শিক্ষা কর্মকর্তাও অনেক সময় ফোন করে কিংবা ইমেইল করে কোনো লেখা পড়ে আমাকে জানান। বলেন, আমাদের কথা আপনি লিখলেন। আমরা আমাদের কর্তৃপক্ষকে জানাতে চাই কিন্তু নানা কারণে পারি না। তখন মনে হয়, লেখালেখি কিছুটা হলেও কাজে আসে। শিক্ষা নিয়ে লেখালেখি করলে পরিবর্তন আসে হয়, হয়তো সবসময় সেটি দৃশ্যমান হয় না।

আপনি একটি প্রতিষ্ঠানে কাজ করেন। চাকরি সংসার সামলিয়ে কীভাবে লেখালেখিতে সময় দেন? অর্থাৎ, লেখালেখির এই বাড়তি উদ্দীপনা কীভাবে আসে এবং অন্যান্য কাজের সাথে লেখালেখির বিষয়টি কীভাবে সামাল দেন?

লেখালেখি করা একটি নেশা, একটি কমিটমেন্ট। আমার জন্য তো শিক্ষা নিয়ে লেখালেখি করা আরও আনন্দের, কারণ শিক্ষা নিয়েই কাজ করি আমি। পত্রিকা অফিস থেকে অনেক সময় ফোন করে বলে রাত আটটার মধ্যে একটি লেখা দিতে। তারা সাধারণত এক-দুদিন আগে সবকিছু ঠিকঠাক করে রাখেন, কিন্তু বিশেষ কোনো লেখার প্রয়োজন হলে এই কাজটি করেন। তারা আত্মবিশ্বাস নিয়েই আমার কাছে লেখা চান যে, আমি ওই সময়ের মধ্যে লেখা পাঠাতে পারবো। তাদের সেই অনুরোধকে সম্মান জানাতে হয়, একটু কষ্ট হলেও।

এছাড়া সাধারণত সপ্তাহের বন্ধের দিন বেশি লিখি। প্রতিদিন সন্ধ্যায় লিখি। এমনকি, অনেকে যখন অফিসে একটু কাজ হালকা থাকলে কিংবা অবসর পেলে গল্প করে সময় কাটান, আমি ওই সময়টুকু লেখার কাজে লাগাই। তবে, বেশিরভাগ লেখাই রাতে ও বন্ধের দিন লিখি। অফিসের কোনো কাজ ফেলে রাখি না, সব কাজ হয় সবার আগেই করে ফেলি, জমা দিই কিংবা সবার সাথে, কখনও পেছনে পড়ি না। পুরো সময়টিই এভাবে কাজে লাগাই। বাসার কাজের ক্ষেত্রে প্রায় একই সূত্র অবলম্বন করি যাতে যা লিখতে চেয়েছি সেটি যেন লেখা হয়।

অফিসের ট্যুরে গেলে সাথে ল্যাপটপ থাকে, সেখানে রাতে লিখি। ট্যুরে গেলেও লেখার অনুরোধ পাই। অনেকক্ষেত্রে কষ্টকর হলেও অনুরোধ ফেলা যায় না। আমার এক ভক্ত আমাকে একটি ছোট ট্যাব উপহার দিয়েছিলেন। সেটি নিয়ে একবার সিলেট যাচ্ছি। পথে বসেই একটি পত্রিকা থেকে সম্পাদক ফোন দিয়ে শিক্ষার একটি বিষয়ের ওপর বেশ বড়সড় একটি লেখা চাইলেন। কিন্তু ওই ট্যাবে বাংলা লেখাটা একটু কষ্টকরই ছিল। অপরদিকে সেটি ছিল নতুন, ফলে ভালোভাবে তখনও ব্যবহার করতে পারতাম না। যাহোক, রাতের মধ্যে লিখে পাঠিয়ে ছিলাম। পাশাপাশি, পরদিন সকালে মিটিঙের প্রস্তুতিও রাতেই নিয়েছিলাম। এভাবেই সময় ম্যানেজ করি।

আপনি যে প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন, আপনার লেখালেখির বিষয়গুলো তারা কীভাবে গ্রহণ করে? নাকি, আপনার লেখালেখির সাথে তাদের কোনো সম্পর্ক নেই?

চমৎকার প্রশ্ন করেছেন। আমি বাংলাদেশের যেসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কাজ করেছি, একটি অদ্ভুত ব্যাপার লক্ষ্য করেছি যে, শিক্ষা নিয়ে যারা চিন্তা করেন বা গভীরে যেতে চান, প্রচলিত পদ্ধতির একটু বাইরে গিয়ে যারা কাজ করেন বা একটু বেশি করতে চান, শিক্ষা নিয়ে লেখালেখি করেন, তাদেরকে কোনো প্রতিষ্ঠানই উৎসাহ প্রদর্শন করে না। আমি যখন ক্যাডেট কলেজে শিক্ষকতা করি, তখনও নিয়মিত ইংরেজি দৈনিকে লিখতাম। এই লেখার জন্য আমার একবার শাস্তি হলো, বদলি করা হলো কুমিল্লা থেকে মির্জাপুর ক্যাডেট কলেজে। কারণ, লেখার দুয়েকটি লাইন ক্যাডেট কলেজের বিরুদ্ধে গিয়েছিলো।

বর্তমানে যে প্রতিষ্ঠানে কাজ করছি, সেটি শিক্ষার বিশাল সেক্টরে কাজ করে দেশে এবং বিদেশে। পাবলিক পরীক্ষার ফল যখন প্রকাশিত হয়, তখন কিছু কিছু পত্রিকা থেকে আমার কাছে মতামত, ফলাফল সম্পর্কে আমার বিশ্লেষণ জানতে চায়। দুয়েকজন এভাবেও বলেন যে, ব্র্যাক থেকে আপনাদের মতামত থাকতেই হবে। অর্থাৎ, তাঁরা ধরেই নিয়েছেন যে আমি ব্র্যাকের মুখপাত্র হিসেবে লিখছি। অথচ এসব শিক্ষা নিয়ে লেখালেখি, মতামত বা বিশ্লেষণ ব্র্যাক কর্তৃপক্ষ বিশেষ করে শিক্ষা বিভাগ কোনদিন দেখেছে কি না আমার জানা নেই।

ব্র্যাক এশিয়া ও আফ্রিকার দশটি দেশে শিক্ষা নিয়ে কাজ করে। আমার ইচ্ছে ছিলো এসব দেশের শিক্ষা নিজ চোখে দেখে দেশের শিক্ষায় অবদান রাখবো। তাদের শিক্ষার সাথে আমাদের শিক্ষা তুলনা করবো কিংবা তুলনামূলক আলোচনা করবো। তাদের ভালো অংশগুলো যাতে আমরা গ্রহণ করতে পারি, সেগুলো প্রকাশ করব কিংবা বই লিখবো যাতে দেশের মানুষ জানতে পারে, দেশের শিক্ষকসমাজ জানতে পারেন, সরকারও কিছু গ্রহণ করতে পারে এবং সেটি অবশ্যই ব্র্যাকের সম্পদ হিসেবে থাকবে। কিন্তু আমার স্বপ্ন, স্বপ্নই রয়ে গেছে। শুধু একবার আফ্রিকাতে গিয়েছিলাম স্বল্প সময়ের জন্য। সেখানে যতটুকু দেখেছি তা নিয়ে লিখেছি, নিজের লেখা বইয়ে লিপিবদ্ধ করেছি। পত্রিকায়ও লিখেছি। সেই লেখা বিভিন্ন পত্রিকা নিজেরাই অনলাইন থেকে নিয়ে ছেপে দিয়েছে। অনেক শিক্ষক জানিয়েছেন, ধন্যবাদ দিয়েছেন একটি দেশের শিক্ষাব্যবস্থা সম্পর্কে তাদেরকে জানানোর জন্য। তারা কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছেন।

শিক্ষার উদ্দেশ্যে বা পেপার প্রেজেন্টেশনের জন্য যেসব দেশে গিয়েছি, হয় নিজের খরচে গিয়েছি, বা আয়োজনকদের খরচে গিয়েছি; বিশেষ করে আমেরিকা, কানাডার মতো উন্নত দেশে। মনে আছে, কানাডা যাওয়ার সময় কানাডা সরকারের ট্যুরিজম বিভাগ একটি অনুদান দিয়েছিলো। ভাগ্যিস আমি সেটি পেয়ে সেখানে গিয়েছিলাম টেসল- কনফারেন্সে অংশগ্রহণ করার জন্য। একইভাবে আমেরিকাতেও গিয়েছি আয়োজকদের খরচে। চায়নাতে গিয়েছি আয়োজকদের খরচে। মালয়েশিয়াতে যাওয়ার খরচও পেয়েছিলাম, শ্রীলংকা যাওয়ার খরচ পেয়েছিলাম। আমার অফিস থেকে অবশ্য এ-বিষয়ে সহায়তা পাইনি।

তবে, ব্র্যাকের কাছে আমি অনেক শিখেছি, এখনও শিখছি।

প্রতিটি প্রতিষ্ঠানের কর্মীদের লিখিত বা অলিখিত কিছু নিয়মকানুন থাকে। আপনি যদি এমন কিছু লিখেন যা আপনার প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে যায়, তাহলে সেটি কীভাবে মোকাবিলা করবেন? আপনার প্রতিষ্ঠান সরকারের সাথে কাজ করেন। আপনার লেখালেখিতে যদি সরকারের সমালোচনা আসে, তাহলে সেটি আপনার প্রতিষ্ঠান কীভাবে দেখবে?

আমি সাধারণত বাংলাদেশের শিক্ষা, শিক্ষকদের অবস্থা, তাদের পেশাগত উন্নয়নের জন্য লিখি। তাতে, সরকারের কিছু সমালোচনা বা প্রশংসা থাকে। আমার প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে যায় এমন লেখা সাধারণত লিখি না, বরং শিক্ষায় ব্র্যাক কী যোগ করেছে, কীভাবে অবদান রাখছে সে-রকম বিষয় কোনো কোনো লেখায় প্রাসঙ্গিকভাবে থাকে। শিক্ষা নিয়ে লেখালেখি করার সময় কিছু বিষয় তো সচেতনভাবে মাথায় রাখতে হয়।

২০১৮ সালে বিশ্ব শিক্ষক দিবস উপলক্ষ্যে আমাকে সম্মাননা দিয়েছিল। শিক্ষা মন্ত্রণালয় কর্তৃক গঠিত জাতীয় কমিটি যারা আমাকে নির্বাচিত করেছিলেন তাদের একজন (জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্রেজারার) আমাকে ফোনে বলেছিলেন যে, আপনি তো সরকারেরও সমালোচনা করেন, তবে সেটি গঠনমূলক। তৎকালীন শিক্ষামন্ত্রী আমার হাতে সম্মাননা ক্রেস্ট তুলে দিয়েছিলেন। বুঝা গেল, সরকারের সমালোচনা যদি গঠনমূলক হয় তাহলে খুব একটা সমস্যা হয় না।

আমি দেখেছি, আপনার লেখা বিভিন্ন দৈনিক বা অনলাইন মিডিয়াগুলো প্রকাশ করে। তাদের সাথে আপনার যোগাযোগ কীভাবে হয়? আপনি কীভাবে তাদের লেখা পাঠান? অর্থাৎ, বিভিন্ন মিডিয়ায় আপনি কীভাবে শিক্ষা নিয়ে লেখালেখি করেন, সেই প্রক্রিয়াটি জানতে চাচ্ছি।

প্রথমদিকে যখন লিখতাম, পত্রিকার ঠিকানা দেখে ডাকযোগে লেখা পাঠাতাম। লেখা ছাপা হতো এবং তাতে উৎসাহ পেতাম। আত্মবিশ্বাস বাড়তো যে, আমি যা লিখছি তার একটি স্বীকৃতি আছে। লেখার মান আছে বলে তাদের কাছে গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছে। তারপর যখন ইমেইলের প্রচলন হলো, ইমেইলেই লেখা পাঠাতাম বা এখনও তাই করি। পরে দেখি, কিছু কিছু পত্রিকা থেকে ফোন করে লেখা চায়। হঠাৎ কোনো বিষয়ের ওপর লেখা পাঠানোর অনুরোধ আসে। এভাবেই লেখা নানা জায়গায় প্রকাশিত হয়।

আপনার লেখা পড়ে পাঠকরা কি যোগাযোগ করেন? বিষয়ে কোনো বিশেষ ঘটনা জানাতে পারেন? আপনার লেখা পড়ে কখনও কোনো সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ যোগাযোগ করেছে আপনার সাথে? সেটিও জানতে চাই।

পাঠকরা কেউ কেউ চিঠি লিখতেন প্রশংসা বা সমালোচনা করে। ইমেইল প্রচলনের পর কেউ কেউ ইমেইল করেন। ফোনও করেন অনেকে। সরকারি শিক্ষা অফিসার, সরকারি বিদ্যালয় ও কলেজের শিক্ষক, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকগণ লেখা পড়ে প্রশংসা করে জানান। বেসরকারি বিভিন্ন পর্যায়ে শিক্ষকদের অনেকেই লেখা পড়ে তাঁদের প্রতিক্রিয়া জানান, যেখানে দু-একটি পয়েন্ট তাঁদের কাছে স্পষ্ট নয়, সেগুলোর ব্যাখ্যা জানতে চান।

শুধু এক-দুজন নয়, এটি মোটামুটি নিয়মিতই হয়ে থাকে। শিক্ষা কর্মকর্তা বা শিক্ষকদের ইমেইল বা ফোন পাই। প্রকাশিত লেখা যে ফেসবুকে দেওয়া যায় সে বিষয়টি আমার জানা ছিলো না। এখন অনেক লেখাই প্রকাশের পর ফেসবুকে পোস্ট করি। সেখানেও কেউ কেউ মন্তব্য করেন, প্রশংসা বা সমালোচনা করেন।

যখন ইংরেজি পত্রিকা অবজারভার’ খুব নামকরা ছিলো, তখন সেখানে নিয়মিত লেখা প্রকাশিত হতো লিড কলামিস্ট হিসেবে। একবার ইংরেজি নিয়ে একটি লেখার ওপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের পরিচালক অত্যন্ত প্রশংসা করে আমাকে চিঠি লিখেছিলেন। সেখানে তিনি আমাকে উল্লেখ করেছিলেন, একজন কনসাস এডুকেশনিস্ট হিসেবে। আমি তখন ঘাটাইল ক্যান্টনমেন্ট কলেজে শিক্ষকতা করি। আমাকে চায়ের দাওয়াত দিয়েছিলেন এবং বেশ কিছু সুপারিশ চেয়েছিলেন শিক্ষার উন্নয়নের জন্য। শিক্ষা নিয়ে লেখালেখি করার এটি একটি বড় অর্জন আমার জন্য।

আরেকবার এক লেখা পড়ে আমেরিকান লাইফ ইনসুরেন্সের বড় বড় কর্মকর্তারা আমার বাসা খুঁজে বাসায় এসেছিলেন, কারণ কিছু লেখা তাদের প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে গিয়েছিলো। পরে অনেক আলোচনা হলো, কথা হলো। তাদের প্রধান কার্যালয়ে যাওয়ার দাওয়াত দিয়েছিলেন। আরেকবার বাংলাদেশ পোস্টাল ডিপার্টমেন্ট থেকেও একজন এসেছিলেন একটি লেখা পড়ে। তবে অনেক প্রতিক্রিয়াই নানা কারণে বিস্তারিত প্রকাশ করতে পারছি না।

বিদেশি শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদের কাছ থেকেও অনেক প্রতিক্রিয়া পেয়েছি ইমেইলে।

আপনি একটি কলেজে শিক্ষক হিসেবে ছিলেন। সেখান থেকে এলেন একটি এনজিওতে। দুই ভূমিকার মধ্যে আপনি কোনটিকে প্রাধান্য দেন? আপনি কি মনে করেন, শিক্ষক হিসেবে থাকলে আপনি সমাজে আরও বেশি অবদান রাখতে পারতেন?

আমি কয়েক ধরনের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কাজ করেছি। ক্যান্টনমেন্ট কলেজ (ঘাটাইল — টাঙ্গাইল), সিলেট ক্যাডেট কলেজ, কুমিল্লা ক্যাডেট কলেজ, মির্জাপুর ক্যাডেট কলেজ, রাজউক উত্তরা মডেল কলেজ, বাউবি, বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় ইত্যাদি প্রতিষ্ঠানে শিক্ষকতা করেছি। সর্বত্রই দেখেছি শিক্ষকদের সুযোগ সীমিত। শিক্ষকতায় থাকলেও লেখালেখি করতাম, করেছিও। তবে, ব্র্যাকের মতো একটি বড় বা আন্তর্জাতিকমানের এনজিওতে এসে দেশ-বিদেশের বিভিন্ন শিক্ষক সংগঠন, পেশাগত সংগঠনের সাথে যোগাযোগ রাখা, দেশে-বিদেশে সভা-সেমিনারে যাওয়ার সুযোগটি হয়েছে। এই সুযোগ শুধু শিক্ষকতায় থাকলে হয়তো হতো না। তবে, শিক্ষকতা খুব উপভোগ করেছি, যদিও সেখানে অনেক সমস্যা ছিলো। আরেকটি কথা, শিক্ষক থাকাকালীন শিক্ষকতা ও পেডাগজির অনেক বিষয় আমার অজানা ছিলো যা পরে বিদেশি শিক্ষাবিদদের সংস্পর্শে এসে জেনেছি।

ইংরেজি বিষয়ের একজন সাবেক শিক্ষক হিসেবে আপনি প্রায়ই ইংরেজি শিক্ষার নানা বিষয় নিয়ে লিখেন। আমাদের বর্তমান ইংরেজি শিক্ষার মূল সমস্যা কী? এবং সেগুলো কীভাবে দূর করা যায় বলে মনে করেন?

আমরা একটি বিষয় লক্ষ্য করেছি যে, বর্তমান সময়ে ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা ইচ্ছায় হোক বা অনিচ্ছায়, পছন্দ করে হোক বা না করে হোক হিন্দি ছবি, নাটক, বিজ্ঞাপন ইত্যাদি প্রতিনিয়ত টিভির পর্দায় দেখছে ও শুনছে। এই শুনে শুনে ও দেখে দেখে তারা হিন্দি বলা শিখে ফেলেছে। অর্থাৎ, তারা ভাষার দুটো গুরুত্বপূর্ণ দক্ষতা শোনা ও বলা অর্জন করে ফেলেছে। তারা ভারতে যায়নি, স্কুলে যায়নি, হোমওয়ার্ক করেনি, কোনো কোচিং সেন্টারে যায়নি, বা কোন প্রাইভেট টিচারের কাছে পড়েনি হিন্দি শিখতে। হিন্দি শিখতে গিয়ে জীবনে কোনো বার্ষিক পরীক্ষা বা পাবলিক পরীক্ষা দেয়নি। কিন্তু হিন্দি বলতে পারে এবং হিন্দি শুনে বুঝতে পারে অর্থাৎ তারা দুটো  গুরুত্বপূর্ণ ভাষাদক্ষতা অর্জন করে ফেলেছে। অথচ ইংরেজি আমরা ক্লাসে পড়ি, বাসায় পড়ি ও পড়াচ্ছি, কোচিঙে পড়াচ্ছি, প্রাইভেট টিউটরের কাছে পড়ছি, ক্লাসে পরীক্ষা দিচ্ছি, প্রাইভেট টিউটরের কাছে বা কোচিঙে পরীক্ষা দিচ্ছি, পাবলিক পরীক্ষা দিয়ে সার্টিফিকেট অর্জন করছি কিন্তু হিন্দির মতো ইংরেজি বুঝি না বা বলতে পারি না। কেন?

শোনা, বলা, পড়া ও লেখা- ভাষাশিক্ষার এই চার ধাপেই প্রশিক্ষণের বাড়তি বন্দোবস্ত বারো বছর ধরেই বিভিন্ন মাত্রায় হওয়া প্রয়োজন। স্কুল ও কলেজের বিদ্যমান কাঠামোর মধ্যেই এই উদ্যোগ সুচারুরুপে বাস্তবায়ন করা সম্ভব। স্নাতক পর্যায়ে বাড়তি প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা সম্ভব। শ্রেণিকক্ষের ইংরেজি শিখন-শেখানো যদি বাস্তবের মতো না হয়, তাহলে পরীক্ষায় পাস করাই হবে কেবল বা সার্টিফিকেট অর্জিত হবে কিন্তু ইংরেজি শেখা হবে না। শিক্ষার্থীরা ইংরেজি বাইরেই শিখবে, ইংরেজি শেখানোর কোচিং সেন্টারে ভর্তি হবে, আর আগ্রহ হারাবে শ্রেণিকক্ষের ইংরেজি ক্লাসে অংশগ্রহণ করতে। শ্রেণিকক্ষে যেদিন বাস্তবের মতো ইংরেজি পড়ানো শুরু হবে, সেদিন হয়তো শিক্ষার্থীরা শরীর ও মন নিয়ে শ্রেণিকক্ষে ফিরে আসবে। এখন আসে শুধু শরীর নিয়ে, মন থাকে অন্যত্র। কাজেই বাধ্যতামূলক বিষয় হিসেবে ইংরেজি পড়ছে শুধু পাস নম্বর পাওয়ার জন্য, ইংরেজি শিখে নিজে জীবনে কাজে লাগানোর জন্য নয়।

ভাষা শিখতে হবে অবচেতনভাবে, সচেতনভাবে নয় । গবেষণায় দেখা গেছে যে, অবচেতনভাবে ইংরেজি শেখা সচেতনভাবে শেখার চেয়ে অনেক বেশি কার্যকর ও দীর্ঘস্থায়ী। অসংখ্য গবেষণায় দেখা গেছে, যেসব শিক্ষার্থী অবচেতনভাবে ইংরেজি শিখে, তারা দ্রুত ও অধিকতর বাস্তবসম্মতভাবে ইংরেজি শিখতে পারে। আর যারা গতানুগতিক, সচেতন, বিশ্লেষণধর্মী পদ্ধতিতে ভাষা শিখে, তারা প্রথম গ্রুপের মতো ততোটা দ্রুত ভাষা আয়ত্ত্ব করতে পারে না। 

সচেতনভাবে বলতে বুঝি সতর্কতার সাথে ইংরেজি গ্রামার বিশ্লেষণ করা,ইংরেজি ভোকাবিউলারি মুখস্থ করা ও ইংরেজির তথ্যগুলোকে বাংলায় ভাষান্তর করা। আমরা সচেতনভাবে ইংরেজির যন্ত্রপাতি ব্যবহার নিয়ে অধ্যয়ন করি যেন ভাষা একটি গাড়ি ,ইংরেজি কাট আপ করে অংশগুলো বসানো, অক্ষরে অক্ষরে, নিয়মের পর নিয়ম ব্যবহার করে। ফল হচ্ছে, এভাবে একজন শিক্ষার্থী প্রচুর গ্রামারের নিয়ম জানে, ভাষান্তর করতে পারে কিন্তু সে ভালোভাবে কথা বলতে পারে না এবং ইংরেজি ভাষার কোনো লোকের কথা সহজে বুঝতে পারে না। অবচেতনভাবে ভাষা শেখা খুবই ফলপ্রসু। এই পদ্ধতিতে বোধগম্য ইংরেজি আমাদের মস্তিষ্কে প্রবেশ করায়। বাকি কাজগুলো অবচেতনে মস্তিষ্ক করে ফেলে। সচেতনভাবে আমরা ইংরেজি গল্প, প্রবন্ধ, কথোপকথন, ছবি ও উপন্যাস উপভোগ করি। এখানে আমরা কখনও গ্রামার নিয়ে চিন্তা করি না, বা কোনো শব্দ মুখস্থ করার চেষ্টা করি না। বেশি কষ্ট না করে ইংরেজি শেখার পদ্ধতিই হচ্ছে অবচেতনভাবে শেখা। তবে অনেক শিক্ষার্থী অবচেতনভাবে ইংরেজি শিখতে ভয় পায়; কারণ তারা নিজেদের ওপর বিশ্বাস রাখতে পারে না। তারা রিলাক্সড মুডে ও মজা করে ইংরেজি শিখতে ভয় পায়। তারা প্রাকৃতিকভাবে এবং বিনা কষ্টে ইংরেজি শিখতে ভয় পায়।

কোনো ভাষার গ্রামার হলো ওই ভাষার গঠন প্রকৃতি যার উপর ভিত্তি করে ওই ভাষায় কোনোকিছু লেখা হয় এবং শুদ্ধ করে কথা বলার সময়ও ব্যাপারটি লক্ষ্য করা হয়। একটি ভাষা লেখার ও বলার ক্ষেত্রে গ্রামারের নিয়ম মেনে চলতে হয়। আর, একটি ভাষা শেখার উদ্দেশ্য হলো, আমরা যাতে আমাদের প্রাত্যহিক জীবনে ওই ভাষা ব্যবহার করে আমাদের দৈনন্দিন চাহিদা মেটাতে পারি। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, ইংরেজি শেখার ক্ষেত্রে আমরা কি প্রথম গ্রামার শিখবো, নাকি ইংরেজি শব্দ ব্যবহার করা শিখবো? আমাদের দেশে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দেখা যায়, আমরা ইংরেজি গ্রামার দিয়ে ইংরেজি শেখা শুরু করি যেটি বাস্তবসম্মত ও বিজ্ঞানসম্মত নয়।

আমরা ৪০ শতাংশ যোগাযোগ শ্রবণের মাধ্যমে করি। দ্বিতীয় মাধ্যমটি হচ্ছে কথা বলা বা স্পিকিং। আমরা  প্রতিদিনকার যোগাযোগের ৩৫ শতাংশ করে থাকি স্পিকিংয়ের মাধ্যমে। পড়ার মাধ্যমে আমরা ১৬ শতাংশ এবং  লেখার মাধ্যমে ৯ শতাংশ যোগাযোগ করে থাকি। অতএব দেখা যায়, ভাব-আদান প্রদান ও যোগাযোগের জন্য শ্রবণের ভূমিকা সবচেয়ে বেশি। তারপরেই আসে কথা বলা বা স্পিকিং; অথচ আমাদের পুরো পরীক্ষা পদ্ধতি, অ্যাসেসমেন্ট সবকিছুর ক্ষেত্রে ৯ শতাংশ অর্থাৎ শুধু রাইটিং স্কিল বা লেখার নিয়ে ব্যস্ত। এই ৯ শতাংশ ও রিডিং স্কিলের ১৬ শতাংশ অর্থাৎ ২৫ শতাংশের ওপর নির্ভর করে পাবলিক পরীক্ষায় গ্রেডিং  বা একজন শিক্ষার্থীর মেধা যাচাই করা হচ্ছে। সেটির ভিত্তিতেই আমরা বলে দিচ্ছি শিক্ষার্থীদের যে, তুমি ইংরেজিতে এ+ পেয়েছো; অর্থাৎ ইংরেজিতে তুমি মাস্টার। যেখানে লিসেনিং ৪০ শতাংশ, স্পিকিং ৩৫ শতাংশ অর্থাৎ ৭৫ শতাংশ আমরা পড়ানো বা মানযাচাইয়ের ক্ষেত্রে স্পর্শই করছি না সেখানে কীভাবে আমরা শিক্ষার্থীদের মূল্যায়ন করছি?

দ্বিতীয়টি হচ্ছে বলা বা স্পিকিং। পরিচিত বা অপরিচিত যে কারুর সাথেই হোক, কথা বলে আমরা ভাব বিনিময় করি, পরিচিত হই, নিজকে জানাতে চাই, অন্যের সম্পর্কে জানতে চাই। ভালো কথা বলে অন্যের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাই। কিন্তু আমাদের পরীক্ষা পদ্ধতিতে বা ইংরেজি পড়ানোর ক্ষেত্রে এই স্কিলটি একবারেই অবহেলিত। শিক্ষক নিজেও চর্চা করেন না, শিক্ষার্থীদেরকেও করান না।  

শিক্ষা নিয়ে লেখালেখি করার একটি বড় কারণ হলো ইংরেজি শেখা ও শেখানো নিয়ে আমার আগ্রহ। আমি ইংরেজি শিখন-শেখানোর ওপর অনেক প্রবন্ধ ও বই লিখেছি যাতে শিক্ষকদের একটি বিরাট অংশ শিক্ষার্থীরা কেন ইংরেজি পড়বে এবং তাদেরকে কীভাবে পড়াতে হবে এই বিষয়দুটো জানতে পারেন এবং সে-অনুসারে চর্চা করান। আমরা হঠাৎ করে রাষ্ট্রীয় সিদ্ধান্ত বদলাতে পারবো না, তবে নিজ শ্রেণিকক্ষ বদলাতে পারবো। লিসেনিং বা স্পিকিং রাষ্ট্রীয় পরীক্ষায় না থাকলেও একজন শিক্ষক কীভাবে নিজের লিসেনিং ও স্পিকিং বাড়াতে পারেন এবং শিক্ষার্থীদের লিসেনিং ও স্পিকিং চর্চা করাতে পারেন যা তাদের শ্রেণিকক্ষে ইংলিশ ফর টুডে ব্যবহার করেই সম্ভব। শিক্ষকরা যেন এগুলো করতে পারেন, সেজন্য আমি লিখে যাচ্ছি। কোনো সভা-সেমিনারে সুযোগ পেলে একই কথা সেখানেও বলছি। এখানে পরিবর্তন আসবে, তবে একটু ধীরে।

ভিন্ন একটি বিষয় জানতে চাই। শিক্ষা নিয়ে লেখালেখি করার কারণে কিছু বিরূপ প্রতিক্রিয়া আপনি পেয়েছেন তা কিছুক্ষণ আগেই জানলাম। কিন্তু, কখনও বড় কোনো অসুবিধার সম্মুখীন হয়েছেন? কীরকম?

ডেইলি স্টারে একটি লেখা ছাপানোর ফলে ক্যাডেট কলেজে আমার বিরুদ্ধে তদন্ত হলো। সেনাবাহিনী সদর দপ্তর থেকে তদন্ত টিম গেল কলেজে। আমি তখন কুমিল্লা ক্যাডেট কলেজে কর্মরত। আমি একটু ভয় পেয়েছিলাম, তবে, টিমের একজন আমাকে একটি বদ্ধ কক্ষে ডেকে নিয়ে বলেছিলেন, বিল্লাহ সাহেব, আপনি ভয় পাবেন না। এখানকার আইনে যা হয় হবে কিন্তু আমরা আপনাকে নিয়ে আলোচনা করেছি’।

ইন্ডিপেন্ডেটে লেখা ছাপানোর ফলে শ্রীলংকার হাইকমিশনার একবার তাঁর অফিসে ডেকেছিলেন এবং দু’ঘন্টার বেশি সময় ধরে রুদ্ধদ্বার বৈঠক করেছিলেন তাঁর অন্যসব অ্যপয়েন্টমেন্ট বাদ দিয়ে। লেখাটি শিক্ষা নিয়ে ছিলো না অবশ্য, ছিলো তাঁদের দেশের এলটিটিইদের নিয়ে, তাদের দমন করার বিষয় নিয়ে। যদিও তাঁদের হাইকমিশনে ডেকে নিয়ে গিয়েছিলেন, একটু তো ভয়ের ব্যাপার ছিলো; কিন্তু সেরকম কিছু হয়নি।

ইত্তেফাকের একটি লেখা নিয়ে প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের তৎকালীন মন্ত্রী ফোন করেছিলেন। প্রথমে মন্ত্রণালয়ের পাবলিক রিলেশন অফিসার, তারপর মন্ত্রীর পিএস এবং সবশেষে মন্ত্রী মহোদয়। প্রথমদিকে শুভেচ্ছা বিনিময়ের পর বেশ কড়া কথা বলেছিলেন, এক ধরনের থ্রেট দিয়েছেন। সবশেষে আবার বলেছিলেন, অনেক কথা বলেছি কিছু মনে করবেন না। আপনি তো কলম চালান, আর আমরা সরাসরি জনগণের সাথে কাজ করি। আপনার মায়া এত উথলে উঠলো কীভাবে এ-ধরনের কথাও তিনি বলেছেন।

বাংলাদেশে ইংরেজি শিক্ষার অবস্থা নিয়ে একটি লেখা লিখেছিলাম। সেই লেখাটি ইংরেজি শেখানোর একটি নামকরা প্রতিষ্ঠান তাদের মতো করে বা পরিবর্তিত করে তাদের লিফলেটে লিখে ব্যবসায়িক উদ্দেশ্যে দেশের সর্বত্র বিতরণ করেছিলো। পরে ওই প্রতিষ্ঠানে যারা ভর্তি হয় তাদের সবার হাতে দিয়েছিলো। কেউ কেউ আমাকে ফোন করে বেশ রেগে বলেছিলেন, Õআপনাদের জন্যই তো দেশে আজ ইংরেজির এই অবস্থা! আপনি এটি কীভাবে লিখলেন। একদিন রাতে আমাকে আরও একজন যখন ফোন দিলো, তখন আমি তার কাছে বিষয়টি পুরোপুরি জানতে চেয়েছিলাম। আমি অবশ্য ব্যখ্যা দিয়েছিলাম এভাবে যে, আমি লিখেছি একভাবে আর তারা নিজেদের স্বার্থে ভিন্নভাবে লিখেছে।

আমি দেখেছি, আপনি একই বিষয়ের ওপর লেখা বাংলা ইংরেজিতে উভয় ভাষাতেই লিখেন প্রকাশ করেন। দুটো ভাষায় কেন? কোন ভাষাটিকে প্রাধান্য দেন লেখার ক্ষেত্রে? কেন?

এর একটি বড় কারণ হচ্ছে নিজের ইংরেজি চর্চাটি ধরে রাখা। দ্বিতীয়ত, আমি কিন্তু লেখালেখির শুরু থেকে ইংরেজিতেই লিখতাম। তৎকালীন ইংরেজি সব পত্রিকাতেই লিখতাম, ডেইলি স্টারেও লিড কলামিস্ট ছিলাম। দেখেছি, অনেকে শুধু ইংরেজি পত্রিকা পড়েন, বাংলা পড়েন না। তাদের জন্য ইংরেজি লেখাগুলো কাজে আসে। অনেক সময় প্রশিক্ষণ করাতে গিয়ে কিংবা কোনো সভা-সেমিনারে শিক্ষকদের সাথে কথা হলে কেউ কেউ বলতেন, আপনার লেখাগুলো পড়ি কিন্তু সব বুঝি না। যদি বাংলায় লিখতেন তাহলে ভালো হতো। আমারও একই কথা মনে হলো। ইংরেজি পত্রিকা অনেকেই পড়েন না, এমনকি কলেজের ইংরেজির শিক্ষকরাও পড়েন না। আমার বন্ধু যারা সরকারি কলেজে শিক্ষকতা করছেন তাদেরকে জিজ্ঞেস করেও জেনেছি যে, তারা ইংরেজি পত্রিকা পড়েন না।

সরকারি কলেজের শিক্ষক যারা ইংরেজি অনার্স ও মাস্টার্সে পড়াচ্ছেন, তাদের শিক্ষার্থীদের উত্তরপত্র মূল্যায়ন করছেন অথচ তারা ইংরেজি পত্রিকাই পড়েন না। কেন? মূলত আমার সেদিন থেকে হুশ হলো, ইংরেজিতে তাহলে কাদের জন্য লিখছি। সরকারি কলেজের ইংরেজির শিক্ষকই যদি ইংরেজি পত্রিকা না পড়েন, তো পড়েনটা কে?

অনেকে অফিসে স্ট্যাটাস সিম্বল হিসেবে দু’একটা ইংরেজি পত্রিকা রাখা হয়, কিন্তু সেগুলো পড়ার জন্য নয়। সেই থেকে চিন্তা করলাম বাংলায় লিখি, কমবেশি যদি কেউ উপকৃত হন এই আশায়। বাংলায় লেখা শুরুর পর থেকে শিক্ষকগণ তাঁদের মতামত ও প্রতিক্রিয়া বেশি বেশি জানাচ্ছেন। আর আমিও এখন বাংলাকেই প্রাধান্য দিচ্ছি। তবে, মূলত শিক্ষা নিয়ে লেখালেখি করলেও আমি মাঝেমধ্যে অন্য অনেক বিষয় নিয়েও লিখি।

আপনার প্রতিষ্ঠানে আপনি কী ধরনের কাজ করেন? বিস্তারিত জানতে চাই। এই কাজ বাংলাদেশের শিক্ষার উন্নয়নে কীভাবে সহায়ক ভূমিকা পালন করছে?

মাধ্যমিক শিক্ষকদের বিষয়ভিত্তিক প্রশিক্ষণ দেওয়া, প্রধান শিক্ষক ও সহকারী প্রধান শিক্ষকদের ম্যানেজমেন্ট প্রশিক্ষণ প্রদান করা, প্রশিক্ষণ মডিউল তৈরি করা, প্রশিক্ষকদের পেশাগত উন্নয়ন করা, প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত শিক্ষকদের মধ্যে থেকে মাস্টার ট্রেইনার তৈরি করা, শিক্ষার্থীদের জন্য মেন্টরিং কার্যক্রম পরিচালনা করা ইত্যাদি আমার কাজের মূল অংশ। ব্র্যাক শিক্ষা কর্মসূচির একটি বড় প্রশিক্ষক বাহিনী আছে, প্রাথমিক ও মাধ্যমিকের জন্য। তাঁদের আমি যেহেতু দেখাশুনা করি, তাঁদের পেশাগত উন্নয়নের জন্য কাজ করতে হয়।

তবে ব্র্যাক শিক্ষা কর্মসূচির মাধ্যমিকের কাজ অনেকটাই সংকুচিত হয়ে আসছে, কারণ সরকার বড় বড় প্রজেক্টের মাধ্যমে মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে উন্নয়নে কাজ করছে। সরকারের এসব প্রকল্পে ব্র্যাকের মাস্টার ট্রেইনার অর্থাৎ শিক্ষকদের মধ্যে থেকে পটেনশিয়াল শিক্ষকদের প্রশিক্ষক বানানোর ধারণাটি গ্রহণ করেছে। তারা ব্র্যাকের তৈরি মাস্টার ট্রেইনারদের ব্যবহার করছে এবং তারা নিজেরাও মাস্টার ট্রেইনার তৈরি করছে। ব্র্যাকই মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে এই ধারণাটি প্রচলন করে এবং আমি সেটির সাথে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত ছিলাম। দেশের সর্বত্র ব্র্যাকের ৫০০ মাস্টার ট্রেইনার রয়েছেন। তাঁরা নিজেদের পেশাগত উন্নয়নের সাথে সাথে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে বাংলাদেশের শিক্ষার উন্নয়নে অবদান রেখে চলেছেন। তাদের মধ্যে ৭০-৭৫ জন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন বিশবিদ্যালয় থেকে দেড় মাসের একটি কোর্স করে এসেছেন। কেউ কেউ আমেরিকা, ইংল্যান্ডসহ অন্যান্য দেশ থেকে  উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করে সেসব দেশের ভালো ভালো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কাজ করছেন। দু’একজন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকও হয়েছেন। এসব মাস্টার ট্রেইনারদের দু’একজন ছাড়া কারুর বিষয়ভিত্তিক মাস্টার্স ডিগ্রিও ছিলো না, তাঁরা ছিলেন সাধারন গ্রাজুয়েট। আমাদের উৎসাহ পেয়ে তাদের অনেকেই পরে বিষয়ভিত্তিক মাস্টার্স ডিগ্রি অর্জন করেছেন, বিদেশে গিয়েছেন ও উচ্চশিক্ষা নিয়েছেন। তাদের মধ্যে এমনও দু’চারজন ছিলেন যে, জীবনে প্রথম ঢাকায় এসেছিলেন। তাদের অনেকে এখন দেশের বিভিন্ন নামীদামী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কাজ করছেন।

কয়েকজন মাস্টার ট্রেইনার ব্র্যাকের এশিয়া বা আফ্রিকার দেশগুলোতে গিয়েছেন এবং ওইসব দেশের উপযোগী প্রশিক্ষণ মড্যুল বানিয়েছেন ও প্রশিক্ষণ পরিচালনা করেছেন। তাদের মধ্যে দু’জন আমার সাথে আফ্রিকা ও শ্রীলংকা গিয়েছেন। তাঁরা এখন ঢাকার ভালো প্রতিষ্ঠানে আছেন।

মেধাবী শিক্ষার্থী যারা উচ্চশিক্ষায় নিয়োজিত অথচ আর্থিক অবস্থা ভালো নয়, তাদের জন্য ব্র্যাকের একটি কর্মসূচি আছে যা মেধাবিকাশ নামে পরিচিত। আমি সেটিও দেখাশুনা করি। এই কর্মসূচির প্রায় চারহাজার শিক্ষার্থী দেশের বিভিন্ন মেডিকেল কলেজ, ইঞ্জিনিয়ারিং বিশ্ববিদ্যালয়, কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় ও সাধারন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেন। মেয়ে শিক্ষার্থীরা প্রতিমাসে চার হাজার এবং ছেলে শিক্ষার্থীরা প্রতিমাসে তিন হাজার টাকা করে বৃত্তি পান। এছাড়া ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ে বিশজনের মতো মেধাবিকাশের শিক্ষার্থী আছেন যারা প্রতিমাসে নয় হাজার টাকা করে বৃত্তি পান। এটিও আমি সরাসরি দেখাশুনা করি। 

যারা ব্র্যাকের প্রশিক্ষণ নিয়েছেন, তাঁরা এখন জানেন কেন শিক্ষার্থীদেরকে বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ করাতে হয়, ফিডব্যাক বিষয়টি কী, কেন ফিডব্যাক নিতে হয়, কীভাবে ফিডব্যাক দিতে হয় ইত্যাদি। ইংরেজি গ্রামারের চেয়ে ভাষা কীভাবে পড়াতে হয়, কেন পড়াতে হয়, কীভাবে ইংরেজি বাস্তব জীবনে ব্যবহৃত হয় ইত্যাদিও তারা জানেন। এসব প্রশিক্ষণের সাথে আমি জড়িত। এসব প্রশিক্ষণ বিশাল সংখ্যক শিক্ষকদের সরাসরি কাজে লেগেছে। তাঁরা নিজ নিজ বিদ্যালয়ে গিয়ে তাঁদের সহকর্মীদের এবং পাশের বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের সাথে প্রশিক্ষণের বিষয়বস্তু নিয়ে আলোচনা করেন। তাতে অন্যরাও উপকৃত হন।

২০২০ সালে কভিড-১৯ পরিস্থিতির ভেতরেও আমরা মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রায় ২৫০০ শিক্ষককে অনলাইনে প্রশিক্ষণ দিয়েছি পেডাগজির ওপর। তাদের জীবনে সেটিই ছিলো প্রথম অনলাইন প্রশিক্ষণ। সরকার বা অন্য কোনো সংস্থা এই কভিড-১৯ পরিস্থিতিতে বেসরকারি শিক্ষকদের জন্য তেমন কোনো প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করেনি। একমাত্র ব্র্যাক করেছে যা ছিলো ইউনিক একটি পদক্ষেপ। আমি এগুলোর সাথে জড়িত ছিলাম ও এগুলো আমি এনজয় করেছি।

পাশাপাশি, মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের নেতৃত্ব বিকাশের জন্য রয়েছে মেন্টরিং কার্যক্রম। আমি যে ইউনিট দেখাশুনা করি সেই ইউনিটেরই কাজ এটি। এটিও লক্ষ লক্ষ শিক্ষার্থীদের সরাসরি কাজে লাগছে।

সম্প্রতি উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা ব্যুরো (বিএনএফই) কর্তৃক পরিচালিত ব্র্যাক কর্তৃক বাস্তবায়নকৃত একটি প্রকল্প যা আউট অফ স্কুল চিলড্রেন’ নামে পরিচিত, সেখানেও আমি কাজ করছি। ব্র্যাক এটি চট্টগ্রাম ও গাইবান্ধায় প্রায় বিশ হাজার শিক্ষার্থীযারা স্কুল থেকে ঝরে পড়েছিল কিংবা কখনও বিদ্যালয়ে যায়নিতাদের জন্য ৬৬৬টি বিদ্যালয় পরীক্ষামূলকভাবে পরিচালনা করছে। আমি বর্তমানে এই প্রকল্পের চিফ অফ পার্টি হিসেবে কাজ করছি।

আমার সাথে এতোক্ষণ নানা বিষয় নিয়ে কথা বলার জন্য আপনাকে আন্তরিক ধন্যবাদ জানাচ্ছি। আশা করছি, আপনার শিক্ষা নিয়ে লেখালেখির মাধ্যমে বাংলাদেশের শিক্ষা সেক্টর আরও উপকৃত হবে।

আপনাকেও ধন্যবাদ। ধন্যবাদ বাংলাদেশের শিক্ষা ওয়েবসাইটকে। আমার বেশ কিছু লেখা এখানেও প্রকাশিত হয়েছে। আপনাদের মাধ্যমে আমার বক্তব্য প্রকাশ করতে পেরে আমি আনন্দিত।

কোন মন্তব্য নেই

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Exit mobile version