বাড়ি প্রচ্ছদ

প্রত্যয় স্কিম : বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের সাথে বৈষম্যমূলক আচরণের কারণ কী?

বিদ্যমান পেনশন ব্যবস্থা ও প্রত্যয় স্কিম নিয়ে এই তুলনামূলক ছবিটি তৈরি করেছে প্রথম আলো, প্রকাশিত হয়েছে প্রথম আলোতে ১ জুলাই তারিখে। ছবিসূত্র: প্রথম আলো
বিদ্যমান পেনশন ব্যবস্থা ও প্রত্যয় স্কিম নিয়ে এই তুলনামূলক ছবিটি তৈরি করেছে প্রথম আলো, প্রকাশিত হয়েছে প্রথম আলোতে ১ জুলাই তারিখে। ছবিসূত্র: প্রথম আলো

প্রত্যয় স্কিম বাতিলের জন্য সারাদেশে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা কর্মবিরতি পালন করছেন। এই কর্মসূচির মধ্যেই সরকার প্রত্যয় স্কিম বাস্তবায়ন করছে। এর ফলে সরকার ও বিশ্ববিদ্যালয় বলতে গেলে মুখোমুখি অবস্থায় দাঁড়িয়েছে।

যেকোনও দেশের আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিবর্তনের সাথে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূমিকা জড়িত থাকে। বাংলাদেশের অতীত ইতিহাসও অন্তত তাই বলে। বাংলাদেশের প্রতিটি বড় বড় রাজনৈতিক কর্মসূচির সাথে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের একটি উল্লেখযোগ্য ভূমিকা দেখতে পাওয়া যায়।

এমনকি বর্তমান সরকারের অতীতের সকল খারাপ সময়েই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা পাশে দাঁড়িয়েছেন। অথচ এই সরকারের আমলেই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা লাঞ্চিত ও অপমানিত। উদাহরণ হিসেবে প্রত্যয় স্কিম নিয়ে বর্তমান ঘটনাটিই বলা যায়। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের প্রতি এমন বিমাতাসূলভ আচরণের সূত্রপাত ২০১৫ সালের ৯ম পে-স্কেলের মাধ্যমে।

আমার দৃষ্টিতে, প্রত্যয় স্কিম নিয়ে যে প্রতিবাদ চলছে, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের এমন ধরনের কর্মসূচি সেই ২০১৫ সালেই নেয়া উচিত ছিলো। তখন এর জোরালো প্রতিবাদ হলে সরকার এমনটি করতে সাহস পেতো না।

তবে প্রত্যয় স্কিম নিয়ে আমার সহকর্মীদের এমন কর্মসূচিতে আন্তরিক ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করছি। দেশে থাকলে এমন কর্মসূচিতে স্ব-শরীরে উপস্থিত থাকতে পারতাম। যেহেতু স্ব-শরীরে উপস্থিত থাকতে পারছি না, তাই এই লেখার মাধ্যমে আমি আমার সহকর্মীদের প্রতি সহমর্মিতা ও সহমত পোষণ করছি।

আমার কাছে ঠিক বোধগম্য নয় যে, ঠিক কী কারণে বর্তমান সরকার প্রত্যয় স্কিম নামে পেনশনের বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষদের প্রতি এমন নেতিবাচক মনোভাব পোষণ করছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের সাথে এমন বৈষম্যমূলক আচরণের কী কী কারণ থাকতে পারে তা সরকারই ভালো বলতে পারে।

অনেকেই এমন বৈষম্যমূলক আচরণের জন্য আমলাদের দায়ী করেন। আমিও অন্যদের সাথে একমত। তবে অন্যরা যেভাবে নিজেদেরকে আমলাদের সাথে তুলনা করছেন আমি সেদিন থেকে ভিন্নমত পোষণ করছি। আমি ব্যক্তিগতভাবে আমলাদের সুযোগ সুবিধার সাথে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের সুবিধার তুলনা করতে অনাগ্রহী।

সরকার আমলাদের কী সুবিধা দিচ্ছে সেই প্রশ্ন তোলার চেয়ে শিক্ষকদের জন্য কেন স্বতন্ত্র পে স্কেল ও উচ্চশিক্ষা কমিশন করছে না সে প্রশ্নটি করা জরুরী। আমার দৃষ্টিতে বেশ কিছু কারণে সরকার বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদেরকে এমন হেনস্তা করার সাহস পেয়েছে। এই কারণগুলো নিম্নে তুলে ধরা হলো।

এক.

আমলা কিংবা সরকার মনে করতে পারে যে, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা স্বল্পপরিশ্রমে সমপরিমাণ বেতন-বোনাস পেয়ে থাকেন। আমলারা সকাল-বিকাল অফিস করলেও শিক্ষকেরা সেটা করেন না। এদিক থেকে আমলাদের একটা চাওয়া থাকতে পারে।

এর উত্তরে বলা যেতে পারে প্রতিটি কাজের ধরন আলাদা। শিক্ষকতা ও গবেষণা নিয়ম বেঁধে সম্ভব নয়। নিয়ম বেঁধে ক্লাস করানো যেতে পারে, কিন্তু গবেষণা কখনওই সম্ভব নয়। গবেষণা একটি সৃজনশীল ব্যাপার। এজন্য একজন শিক্ষককে (যিনি গবেষণা করেন) সর্বক্ষণ চিন্তা করতে হয়।

আমার ক্ষেত্রে যা হয় তা হলো, আমি যদি কার্ড খেলি বা আড্ডা দিই, সেখানেও মনে মনে মাথায় তথ্যউপাত্তের ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ ঘুরতে থাকে। একটি প্রবন্ধের যুক্তিতর্ক কী হতে পারে, প্রচলিত লিটারেচারে এই প্রবন্ধের মৌলিক অবদান কী হবে, প্রাপ্ত ফলাফল কীভাবে প্রতিষ্ঠিত তত্ত্বের সাথে একমত কিংবা ভিন্নমত পোষণ করতে পারে— এই বিষয়গুলো মাথায় সবসময় কাজ করে।

সুতরাং, এই চিন্তাকে সকাল-বিকাল ফ্রেমে বাঁধা বোকামি ছাড়া অন্যকিছু নয়। তাছাড়া অনেকেই ভাবেন যে, একজন শিক্ষক প্রতি সপ্তাহে ৬ থেকে ৮ ঘণ্টার বেশি ক্লাসে পড়ান না। এই ধারণাটিও ভুল। এই ৬ থেকে ৮ ঘণ্টা পড়ানোর জন্য একজন শিক্ষককে সমপরিমাণ সময় ব্যয় করতে হয় পড়াশোনা ও প্রস্তুতি নেয়ার জন্য।

পাশাপাশি গবেষণার কাজ থাকলে তো কথাই নেই। আমাদের দুর্ভাগ্য যে, আমাদের শিক্ষার্থীরা মনে করেন শিক্ষকেরা কিছুই করেন না। কিন্তু বাস্তবতা হলো লেখাপড়ার ধরণের কারণে শিক্ষার্থীরা জানেনই না আমরা কী কাজ করি। তবে এই ব্যাপারটি বিজ্ঞানের শিক্ষার্থীদের জন্য ভিন্ন হতে পারে।

আরও একটি বিষয় উল্লেখ না করলেও নয় যে, আমলারা যে সময় ব্যয় করেন, তার জন্য যে অতিরিক্ত সুযোগ-সুবিধা পান, সেটি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা পান না। আমলারা গাড়ির খরচের জন্য যে টাকা পান, তা দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন সহযোগী অধ্যাপকের বেতন দেয়া সম্ভব! 

দুই.

এটি বলা খুব একটা অন্যায় হবে না যে, অনেকেই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হতে চান। কিন্তু নানা কারণে হয়তো হতে পারেন না। পরে তাঁদের অনেকেই বিসিএস ক্যাডার হয়ে শিক্ষকতা পেশার প্রতি এক ধরনের উষ্মা পোষণ করেন। এবং ভাবেন যে, যারা নিয়োগ পেয়েছেন তারা তেমন আহামরি কিছু নন। অর্থাৎ এখানে একটি অলিখিত মেধার প্রতিযোগিতা চলে আসে।

যেহেতু সরকার আমলাদের ওপর অধিক নির্ভরশীল, সেহেতু এই সুযোগটা কাজে লাগিয়ে আমলারা ফায়দা নেয়ার চেষ্টা করছেন। অনেকেই আমলাদের সাথে সরকারের ঘনিষ্ঠতার কারণ হিসেবে বিতর্কিত নির্বাচন ব্যবস্থার কথা বলতে পারেন।

তবে এখানে আমার মতামত একটু ভিন্ন। আমাদের অধিকাংশ রাজনীতিবিদদের উচ্চশিক্ষার অভাব, গবেষণা পদ্ধতি ও তার প্রয়োগের জ্ঞানের অভাব এবং নীতি-নির্ধারণের তাত্ত্বিক ও প্রায়োগিক জ্ঞানের অভাবের কারণে সরকারকে আমলাদের ওপর নিরর্ভরশীল হতে হয়। সেজন্য সরকার আমলাদের কথা শুনতে একপ্রকার বাধ্য থাকে।

তাছাড়াও সরকারের ধারণা আছে যে, বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক নিয়োগে মেধাবীদের প্রাধান্য দেয়া হয় না। এটি কিছু কিছু ক্ষেত্রে সত্য হলেও পুরোপুরি সত্য নয়। তবে এটি বলা বাহুল্য হবে না যে, এমন নিয়োগের জন্য পরোক্ষভাবে সরকারই দায়ী।

সরকারের নানা পর্যায়ের তদবির রাখতে গিয়েই ভিসিদের এমন নিয়োগ দিতে হয়। উল্লেখ্য, আমার জানামতে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকতা পৃথিবীর কোথাও শুধু যোগ্যতা দিয়েই হয় না। উন্নত বিশ্বে নিজের সুপারভাইজারের সহযোগিতা ছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হওয়া অনেক ক্ষেত্রেই কঠিন।

আপনার একাডেমিক সিভি যতোই ভালো হোক না কেন, সুপারভাইজারের রেফারেন্স ছাড়া শিক্ষকতা পাওয়া খুবই দুষ্কর। এই সত্যগুলো আবার দেশের বাইরের প্রতিষ্ঠিত বাংলাদেশী শিক্ষকেরা কিছুতেই স্বীকার করতে চান না। একটি আলাদা ভাব নিয়ে থাকেন যে, উনারা নিজেদের জ্ঞান ও যোগ্যতায় শিক্ষক হয়েছেন। এই সত্যটা প্রবাসী শিক্ষকদের স্বীকার করা উচিত।

তিন.

খুব অপ্রিয় হলেও এটা সত্য যে, বর্তমান সরকার হয়তো ভুলে গেছে যে সেনা-সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন প্রথম বিশ্ববিদ্যালয় থেকেই শুরু হয়েছিলো। প্রথমে শিক্ষার্থী, পরে শিক্ষকদের আন্দোলনে বিক্ষোভ সারা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছড়িয়ে পড়েছিলো। সেই আন্দোলনকে পুঁজি করে সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের পতন হয়।

সেদিক থেকে সরকার হয়তো চিন্তা করেছ যে, কোনোভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ই হয়তো সরকারের ভিত নাড়িয়ে দিতে পারে। সেদিক থেকে যদি একটি মেরুদণ্ডহীন উচ্চশিক্ষা ব্যবস্থা প্রচলন সম্ভব হয়, তাহলে অন্তত সরকারের ক্ষমতায় থাকা নিয়ে খুব একটা চিন্তা করতে হবে না।

সরকার হয়তো এটিও চুড়ান্ত বলে ধরে নিয়েছে যে, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা সরকার পরিবর্তনের সাথে জড়িত নন কিংবা ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা নির্ধারক হিসেবে কাজ করেন না। সেদিক থেকে বিশ্ববিদ্যালয় ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের প্রতি সরকারের এক ধরনের উষ্মা থাকতে পারে।

সেদিক থেকে সরকার হয়তো চিন্তা করেছ যে, কোনোভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ই হয়তো সরকারের ভিত নাড়িয়ে দিতে পারে। সেদিক থেকে যদি একটি মেরুদণ্ডহীন উচ্চশিক্ষা ব্যবস্থা প্রচলন সম্ভব হয়, তাহলে অন্তত সরকারের ক্ষমতায় থাকা নিয়ে খুব একটা চিন্তা করতে হবে না।

চার.

বাংলাদেশের প্রায় সকল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমিতির নেতৃত্বে আওয়ামী সমর্থিত প্যানেলের শিক্ষকেরা ক্ষমতায় রয়েছেন। সরকার হয়তো এটা ভেবেছে যে, আন্দোলন করতে হলে এসব শিক্ষকদেরকে সরকারের বিপক্ষে দাঁড়াতে হবে। প্রগতিশীল শিক্ষকেরা হয়তো সেই সাহসটা করবেন না।

এমন অভিজ্ঞতা সরকারকে অতীতে শিক্ষক সমিতি দিয়েছিলো বিধায় সরকার এমনটি মনে করছে। সরকারের মনে রাখা উচিত হবে যে, আমলাদের রাজনৈতিক কোনও চেতনা নেই। চেতনা থাকলে একটা পর্দা বা বালিশের দাম হাজার থেকে লাখ টাকা হতো না। সরকার পরিবর্তনের সাথে সাথে আমলাদের চেতনা ও আনুগত্য পরিবর্তন হয়।

আমলারা নিজেদের মধ্যে পেশাদারিত্ব গড়ে তুললেও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা পারেননি। যেকোনও ব্যাপারে আমলারা এক ও অনবদ্য। যদিও আমলাদের এই পেশাদারিত্ব আমাদেরকে বারবার জাতি হিসেবে লজ্জিত করেছে। আজ পর্যন্ত শুনলাম না যে সুযোগ সুবিধা নিতে গিয়ে কোনও আমলা বলেছেন যে আমি বিএনপি-জামায়াত সমর্থিত আমলা, আমি আওয়ামীপন্থী আমলাদের সাথে একাত্মা পোষণ করবো না।

অথচ বিশ্ববিদ্যালয়ের যেকোনও সমস্যার ব্যাপারে কথা উঠলেই এখানে শিক্ষকেরা বিভিন্ন দলে উপদলে বিভক্ত হয়ে পড়েন। আমাদের শিক্ষকদেরকে এই জায়গাটা নিয়ে ভাবতে হবে। নিজেদের দাবি ও সম্মান আদায়ে সকল শিক্ষককে একত্রে আন্দোলন করতে হবে। এছাড়া সরকার আমাদের কথা শুনবে বলে মনে হয় না।

পাঁচ.

বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু কিছু উপাচার্য যে দুর্নীতি করেননি তেমনটা কিন্তু নয়। এব্যাপারে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা বরাবরই সোচ্চার। তবে পরোক্ষভাবে এই দুর্নীতির দায় সরকারের।

বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে উপাচার্য নিয়োগের যে পদ্ধতি সরকার তৈরি করেছে, তা চালু রেখে কোনোভাবেই একটি দক্ষ প্রশাসন উপাচার্যের দ্বারা চালানো সম্ভব নয়। উপাচার্য নিয়োগে যোগ্যতার চেয়ে ভিন্ন ধরনের সম্পর্কেই সরকার বেশি প্রাধান্য দেয়।

এর ফলে শিক্ষকেরা উপাচার্য, উপ-উপাচার্য, রেজিষ্ট্রার, কোষাধক্ষ্য হওয়ার জন্য আমলাদের সুপারিশের জন্য দৌড়াচ্ছেন। দৌড়াচ্ছেন স্থানীয় থেকে জাতীয় পর্যায়ের নেতাদের কাছে। এতে একজন নতজানু ব্যক্তি অধিকাংশ বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন পদে নিয়োগপ্রাপ্ত হচ্ছেন। নিয়োগের পরে এসব শিক্ষক সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ের লোকদের কথা শুনতে বাধ্য থাকেন।

উপাচার্য নিয়োগ সরকারীভাবে হতে পারে। তবে সেখানে প্রাথমিক ক্রাইটেরিয়া হিসেবে যোগ্যতাকেই প্রাধান্য দেয়া উচিত। আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন নিয়োগ, দুর্নীতি ও অনিয়মের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করলেও কিন্তু আজ পর্যন্ত একজন আমলাকে দেখলাম না যে তারা তাদের একজনের অপকর্মের জন্য অন্যদের কেউ এর সমালোচনা বা প্রতিবাদ করছেন।

যার সাথেই কথা বলবেন শুনবেন যে, আমার স্যারের মতো ভালো মানুষ পৃথিবীতে কোথাও নেই। আমলাদের সকলেই দুর্নীতিবাজ তেমনটি নয়। তবে সাম্প্রতিক সময় পুলিশের সাবেক আইজিপি, ডিআইজি এবং মতিউরের ছাগল কাণ্ডে এটা অনুমান করা যায় যে আমলারা নিজেদের আখের গোছানোর জন্য সব কিছু করছে।

অন্যথায় মাসিক ৮০ হাজার টাকার বেতনে একজন আমলা শত শত বিঘার জমির মালিক হতে পারতেন না। সরকার আমলাদের দুর্নীতির ব্যাপারে উদাসীন। এর ফলে সমাজের সর্বস্তরে সম্পদের সুষম বণ্টনের অভাব পরিলক্ষিত হয়।

আমার এই চিন্তাধারা অন্যদের কাছে যৌক্তিক মনে নাও হতে পারে। যুক্তি ভিন্ন থাকলেও এটি সত্য যে, প্রত্যয় স্কিম নামে সরকার বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকের সর্বস্ব কেড়ে নিয়েছে। পেনশনের নতুন এই প্রত্যয় স্কিম নিয়ে এমন কাজের অধিকার সরকারের নেই বা থাকা উচিত নয়।

একটি দেশের জ্ঞান উৎপাদনে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের বিকল্প নেই। আমলারা জ্ঞান-বিজ্ঞানের খুব একটা চর্চা করেন না, বা সেটি তাঁদের কাজও নয়। কিছু কিছু আমলা সরকারের দেয়া স্কলারশিপে দেশের বাইরে পড়াশোনা করে আসেন। কিন্তু তারা নিজেদের পরিবর্তন করেন না।

কিংবা উচ্চশিক্ষা লাভের পর কাজের ধরনের কারণে সেই অর্জিত জ্ঞান প্রয়োগের সময় পান না। এখানেও সাধারণ জনগণ ভাবেন যে, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা সরকারের দেয়া বৃত্তিতে দেশের বাইরে পড়াশোনা করতে যান। এটি প্রায় নিরানব্বই ভাগ ভুল ধারণা। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা নিজেরা চেষ্টা করে প্রতিযোগিতার মাধ্যমে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ে ডিগ্রি অর্জন করতে যান।

প্রত্যয় স্কিম নিয়ে ও অপরাপর বিষয়ে বিদ্যমান সমস্যা সমাধানের জন্য উচ্চশিক্ষা কমিশন গঠন ও স্বতন্ত্র পে-স্কেল প্রদানের জোর দাবি জানাই। সরকারের আমলাতান্ত্রিক রাষ্ট্রের কাঠামো নিশ্চিত করতে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের মান নষ্ট করে ‘মানসম্মত’ শিক্ষা পাওয়ার আশা একেবারের হাস্যকর।

প্রত্যয় স্কিম বাতিল করে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের শুধু শুধু সুবিধা দেয়ার পক্ষেও আমি নই। আধুনিক বিশ্বের সাথে তাল মিলিয়ে সরকারের বরং শিক্ষক নিয়োগের নীতিতে পরিবর্তন আনা জরুরি।

সরকার আইন করতে পারে যে, পিএইচডি ডিগ্রি ও ইনডেক্সড জার্নালে প্রকাশিত প্রবন্ধ ছাড়া শিক্ষক নিয়োগ করা যাবে না। এটি যতো তাড়াতাড়ি করবে ততোই দেশ ও জাতির জন্য মঙ্গলজনক হবে। শুধু নিয়োগ নয়, পদন্নোতির ক্ষেত্রেও কর্ম অভিজ্ঞতা থেকে গবেষণার যোগ্যতাকে প্রাধান্য দেয়া উচিত এবং এই ব্যাপারে নীতি প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন জরুরি।

প্রত্যয় স্কিম নিয়ে ও অপরাপর বিষয়ে বিদ্যমান সমস্যা সমাধানের জন্য উচ্চশিক্ষা কমিশন গঠন ও স্বতন্ত্র পে-স্কেল প্রদানের জোর দাবি জানাই। সরকারের আমলাতান্ত্রিক রাষ্ট্রের কাঠামো নিশ্চিত করতে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের মান নষ্ট করে ‘মানসম্মত’ শিক্ষা পাওয়ার আশা একেবারের হাস্যকর।

একটি দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষাকে পথে মিশিয়ে সে জাতি হয়তো কানাডায় বেগম পাড়া বানিয়ে খবরের কাগজে শিরোনাম হতে পারে, জ্ঞানবিজ্ঞানে উন্নত হতে পারে না।

এখানে উল্লেখ করা যায় যে, দেশে যে সরকারি কলেজে আছে সেখানেও সরকার চরম বৈষম্য সৃষ্টি করেছে। একজন ব্যক্তি বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজ থেকে সার্টিফিকেট নিয়ে সরকারি আমলা হয়ে মুচকি হেসে বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ে কিছু শেখানো হয় না!

আমরা বিদ্যমান বৈষম্যের প্রতিবাদ জানাই। প্রত্যয় স্কিম বাতিল এবং শিক্ষক নিয়োগ ও পদোন্নতির নীতিমালা পরিবর্তন করে এর যথাযথ সমাধান জরুরি। সেই সাথে জরুরি হচ্ছে শিক্ষকদের জন্য স্বতন্ত্র পে-স্কেল আর উচ্চশিক্ষা কমিশন গঠন।

আমি প্রত্যাশা করি যে, সরকার প্রত্যয় স্কিম ও পেনশন নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের সাথে দুরত্ব বাড়িয়ে নিজের ও দেশের ক্ষতি করবেন না।   

সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয় : যেসব দিকে নজর দিতে হবে

দেশের ৬৯১টি সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয় এবং মাধ্যমিক শিক্ষা প্রশাসনে স্থবিরতা এবং অস্থিরতা নিরসন প্রয়োজন। তাতে দেশের ২০,৩৫৩টি মাধ্যমিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান উপকৃত হবে।
দেশের ৬৯১টি সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয় এবং মাধ্যমিক শিক্ষা প্রশাসনে স্থবিরতা এবং অস্থিরতা নিরসন প্রয়োজন। তাতে দেশের ২০,৩৫৩টি মাধ্যমিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান উপকৃত হবে।

দেশের ৬৯১টি সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয় এবং মাধ্যমিক শিক্ষা প্রশাসনে স্থবিরতা এবং অস্থিরতা নিরসন প্রয়োজন। তাতে দেশের ২০,৩৫৩টি মাধ্যমিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান উপকৃত হবে।

মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের দুটি শাখা। যথা, কলেজ শাখা এবং বিদ্যালয় ও পরিদর্শন শাখা। কলেজশাসিত মাউশির কলেজ শাখার আন্তঃক্যাডার বৈষম্য ছাড়া তেমন একটা বঞ্চনা না থাকলেও বিদ্যালয় ও পরিদর্শন শাখায় কর্মরত শিক্ষক/কর্মকর্তাদের ইতিহাস শোষণ-বঞ্চনার।

এ যেন স্বাধীন দেশেরই আরেক উপনিবেশবাদের গল্প। সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয় থেকে সদ্য বিদায়ী একজন শিক্ষক বিষয়টিকে এভাবে বলেছেন, ‘মাধ্যমিক যেন কলেজ শাখার কলোনীতে পরিণত হয়েছে।’ 

এখানে কর্মরত শিক্ষক-কর্মকর্তাগণ অপ্রাপ্তির নানা ধরনের হতাশায় নিমজ্জিত। ব্যানবেইজ পরিসংখ্যান ২০২২ অনুযায়ী দেশে বর্তমানে ২০৩৫৩টি মাধ্যমিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান রয়েছে এবং ৪৭৪৭টি কলেজ রয়েছে। তবে কলেজ শাখার সাধারণ শিক্ষা ক্যাডার সংখ্যায় কম হলেও মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের ৯৫ ভাগের বেশি পদে কলেজ শিক্ষকগণ (শিক্ষা ক্যাডার) বসে আছেন।

সঙ্গত কারণে দীর্ঘদিন ধরে প্রায় ৮১ শতাংশ (মাউশির অধীনে মোট প্রতিষ্ঠানের) মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে মানব সম্পদ ব্যবস্থাপনা কার্যক্রমের গতি মন্থর হয়ে আছে। তাছাড়া মাউশিতে কর্মরত প্রায় সকল কর্মকর্তা (প্রকৃত অর্থে তিনটি পদ ব্যতীত) কলেজ শিক্ষক হওয়ায় মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষকগণ অধিদপ্তরে তাঁদের দাপ্তরিক কাজের ক্ষেত্রে তেমন কোনো সুবিধা পান না, উল্টো অনেকক্ষেত্রেই নানা ধরনের ভোগান্তির শিকার হন।

এ শাখায় কর্মরত শিক্ষক/কর্মকর্তাদের চাকুরী শুরু হয় দশম গ্রেডে সহকারী শিক্ষক হিসেবে এবং এ পদের শিক্ষাগত যোগ্যতা বিসিএস সাধারণ শিক্ষা ক্যাডারের প্রবেশ পদের প্রাথমিক যোগ্যতার সমান। অতিরিক্ত যোগ্যতা হিসেবে বাধ্যতামূলকভাবে শিক্ষায় ব্যাচেলর ডিগ্রি, যা তাদের জন্য অতিরিক্ত কোনো সুবিধা তো নয়ই, বরং বঞ্চনাই যেন বাড়িয়ে দিয়েছে বলে সরকারি মাধ্যমিকের শিক্ষকগণ মনে করেন।

সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয় বা উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসারের কার্যালয়ে সহকারী শিক্ষক বা শিক্ষিকা/সহকারী মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসার নন ক্যাডার দশমগ্রেডভুক্ত পদটি বিষয় ভিত্তিক চার বছর মেয়াদি স্নাতক বা তিন বছর মেয়াদি স্নাতক পাসসহ স্নাতকোত্তর ডিগ্রি থাকার সাপেক্ষে নিয়োগযোগ্য।

এ ছাড়াও শিক্ষায় এক বছর মেয়াদী ব্যাচেলর ডিগ্রি (বিএড) থাকা বাধ্যতামূলকভাবে প্রয়োজন। সাত বছর চাকরি করার পর পরবর্তী ধাপে পদোন্নতিযোগ্য। তবে সহকারী উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসার পদটি বর্তমানে মাউশিতে কর্মরত কর্মচারীদের থেকে পদোন্নতি দিয়ে পূরণ করা হয়।

সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়/উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসারের কার্যালয়ে সিনিয়র শিক্ষক/উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসার নন-ক্যাডার ৯ম গ্রেডভুক্ত পদটি ২০১৫ সালে সৃষ্ট, তবে ১/১২/২০০৩ সালে পদটি ক্যাডার পদ হিসেবে সৃষ্টির উদ্যোগ ছিলো শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের। সহকারী শিক্ষক বা শিক্ষিকা/সমমান পদোন্নতি দিয়ে এ পদ পূরণ করা হয়। স্বপ্ন দেখানো হয় পরবর্তী ধাপে পদোন্নতি হবে।

কিন্তু জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের ১৫/১০/২০১৯ তারিখে জারিকৃত স্মারক নং সম/সওবা/প-২২/০৩( সি. স্কে. গে.) /অংশ( ১৮)১-২৫৮ এর ক্রমিক ‘গ’-এ পরিপত্র অনুযায়ী সমগ্রেডে পদোন্নতি বিধিসম্মত নয়। তাই সিনিয়র শিক্ষক/সমমান (নন ক্যাডার ৯ম গ্রেড) এবং সহকারী প্রধান শিক্ষক/সমমান (বিসিএস সাধারন শিক্ষা ক্যাডার ৯ম গ্রেড) দুটি পদই নবম গ্রেডে হবার কারণে পরবর্তী ধাপে পদোন্নতি দেয়া সম্ভব হচ্ছে না এবং এই বিধিমালা সংশোধনেরও কোনো উদ্যোগ নেই। ফলে মাধ্যমিকের বন্ধ্যাকরণ প্রক্রিয়া কার্যত এখান থেকেই শুরু হয়েছে বলে অনেকেরই বিশ্বাস।

সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয় বা জেলা শিক্ষা অফিসার কার্যালয়ে সহকারী প্রধান শিক্ষক বা শিক্ষিকা/সহকারী জেলা শিক্ষা অফিসার বিসিএস সাধারণ শিক্ষা ক্যাডার ৯ম গ্রেডভুক্ত একটি পদ। ২০১৩ সালে বাংলাদেশ সরকারি কর্ম কমিশন ‘বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিস (বয়স, যোগ্যতা ও সরাসরি নিয়োগের জন্য পরিক্ষা) বিধিমালা ২০১৪’ প্রণয়নের পূর্বে  বিসিএস (সাধারণ শিক্ষা) ক্যাডারভুক্ত নবম গ্রেডের সহকারী প্রধান শিক্ষক/সহকারী প্রধান শিক্ষিকা/সহকারী জেলা শিক্ষা অফিসার পদে নিয়োগের জন্য এই তিনটি পদের নাম বিসিএস পরীক্ষা বিধিমালায় সংযোজনের জন্য শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কাছে পত্র মারফত জানতে চায়।

শিক্ষা মন্ত্রণালয় কোনো ধরনের সদুত্তর না দেওয়ায় বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিস (বয়স, যোগ্যতা ও সরাসরি নিয়োগের জন্য পরীক্ষা) বিধিমালা ২০১৪ এর তফসিল-১ এর ১৩নং ক্রমে কলেজ শাখার দুটি প্রবেশ পদের পর (গ) সহকারী জেলা শিক্ষা অফিসার (ঘ) সহকারী প্রধান শিক্ষক (ঙ) সহকারী প্রধান শিক্ষিকা নামের পদগুলো সংযোজন করা সম্ভব হয়নি।

শিক্ষা মন্ত্রণালয় স্মারকের চিঠির কোনো জবাব না দেওয়ায় বিসিএস নিয়োগ বিধিতে পদটি যুক্ত করা হয়নি। ফলে উন্মুক্ত বিজ্ঞপ্তি দিয়ে নিয়োগ প্রক্রিয়া বন্ধ আছে। এই ধাপ থেকে পরবর্তী উচ্চতর ধাপ ষষ্ঠ গ্রেড প্রধান শিক্ষক/ জেলা শিক্ষা অফিসার পদে পদোন্নতির কোনো বাধা নেই। কিন্তু বিধিগত জটিলতার কারণে নিচের দিক থেকে পদোন্নতি দিয়ে এই ধাপে কাউকে আনা যাচ্ছে না বা নতুন করে কাউকে নিয়োগ করা যাচ্ছে না। ফলে উপরের দিকে শূন্যতা তৈরি হচ্ছে।

উপ-পরিচালকের কার্যালয়ে সহকারী বিদ্যালয় পরিদর্শক/পরিদর্শিকা বিসিএস-সাধারণ শিক্ষা ক্যাডারে নবম গ্রেডভুক্ত একটি পদ। পদটি ক্যারিয়ার পাথ বহির্ভূত সহকারী প্রধান শিক্ষক/সমমান পদ হিসেবে দুই বছর চাকরি করার পর এখানে পদায়ন করা হতো। কিন্তু নবম গ্রেড থেকে পরবর্তী ধাপে পদোন্নতিযোগ্য অষ্টম গ্রেডে কোনো পদ নেই।

পূর্বের পদসোপানে পদটি ছিলো কিন্তু বারবার পদটিকে আপডেট করার কথা বলা হলেও কর্তৃপক্ষ কোনো কথাই কানে তোলেননি। ফলে শিক্ষা প্রশাসনের নজরদারির অন্যতম পদটি কার্যত অকার্যকর হয়ে পড়েছে।

এ পদের গুরুত্ব বিবেচনায় নিয়ে জাতীয় শিক্ষানীতি-২০১০-এ শিক্ষা কার্যক্রম পরিদর্শনের জন্য প্রধান শিক্ষা পরিদর্শকের কার্যালয় স্থাপনের কথা বলা হয়েছে। এছাড়াও শিক্ষাক্রম বাস্তবায়নে তদারকের দায়িত্ব এই পদটির উপরে।

সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয় বা জেলা শিক্ষা অফিসারের কার্যালয়/উপপরিচালকের কার্যালয়/মাউশি প্রধান কার্যালয়ে প্রধান শিক্ষক/জেলা শিক্ষা অফিসার/সহকারি পরিচালক/বিদ্যালয় পরিদর্শক/পরিদর্শিকা বিসিএস সাধারণ শিক্ষা ক্যাডারে ষষ্ঠ গ্রেডভুক্ত একটি পদ। এই ধাপ থেকে পরবর্তী ধাপে পদোন্নতি প্রক্রিয়া দীর্ঘদিন যাবত বন্ধ আছে। ফলে মাউশি প্রধান কার্যালয়সহ অন্যান্য আঞ্চলিক কার্যালয় এর উপরের পদটি ভারপ্রাপ্ত দিয়ে দীর্ঘদিন ধরে চালানো হচ্ছে।

উপ-পরিচালকের কার্যালয়/মাউশি প্রধান কার্যালয়ে উপ-পরিচালক বিসিএস সাধারণ শিক্ষা ক্যাডারে ৫ম গ্রেডভুক্ত একটি পদ। পূববর্তী ধাপ থেকে এই ধাপে পদোন্নতি প্রক্রিয়া দীর্ঘদিন যাবত বন্ধ আছে। ফলে মাউশি প্রধান কার্যালয়সহ অন্যান্য আঞ্চলিক কার্যালয় পদটি ভারপ্রাপ্ত দিয়ে চালানো হচ্ছে।

মাউশি প্রধান কার্যালয়ে পরিচালক বিসিএস সাধারণ শিক্ষা ক্যাডারে চতুর্থ গ্রেডভুক্ত একটি পদ। Bangladesh civil service Recruitment, 1981 মোতাবেক পরিদর্শক/পরিদর্শিকা পদ হতে পদোন্নতি পেয়ে উপপরিচালক হওয়ার সুযোগ থাকলেও ১৯৮৯ সালের সংশোধনীতে উপপরিচালক পদ হতে পদোন্নতির ক্ষেত্রে ফিডার পদ হিসেব বিদ্যালয় পরিদর্শক/ পরিদর্শিকা পদের সাথে কলেজ শাখার সহযোগী অধ্যাপক ও টিটি কলেজের উপাধ্যক্ষ্যের একটি সমন্বিত গ্রেডেশন লিস্ট তৈরি করে পদোন্নতি বিধান চালু করা হয়। ফলে মাধ্যমিক থেকে এ পদে পদোন্নতির পথ প্রায় বন্ধ হয়ে যায়। এখন পদটি শিক্ষা ক্যাডার থেকে পূরণ করা হচেছ। 

এগুলোর বাইরে কিছু পরিসংখ্যানগত বৈষম্য এখানে আলোচনা করা হলো।

সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয় ও মাধ্যমিক শিক্ষা প্রশাসনের বর্তমানে কোনো সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয় সহকারী প্রধান শিক্ষক বা সহকারী জেলা শিক্ষা অফিসার পদে কেউ কর্মরত নেই। ৫০০টি সহকারী প্রধান/শিক্ষিকা সমমান ও ৬৪টি সহকারী জেলা শিক্ষা অফিসার পদ শূন্য রয়েছে। উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসারের প্রায় দুইশত পদ শূন্য রয়েছে। আরও অনেকগুলো শূন্য হওয়ার পথে।

এ বছরেই প্রায় সকল পুরনো সরকারি হাইস্কুলে প্রধান শিক্ষক ও প্রায় সকল জেলা শিক্ষা অফিসারের পদে শূন্য হয়ে যাবে। দেশে মোট সরকারি হাইস্কুল রয়েছে ৬৯১টি, যার মধ্যে ৩১৯টি পুরনো।

শিক্ষা প্রশাসনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ পদ উপ-পরিচালক আঞ্চলিক কার্যালয় এবং বিদ্যালয় পরিদর্শক পদগুলো দীর্ঘদিন যাবত শূন্য রয়েছে। উপ-পরিচালক পদগুলো জেলা শিক্ষা অফিসার/প্রধান শিক্ষকদের দিয়ে ভারপ্রাপ্ত করে কোনোমতে কাজ চালানো হচ্ছে। কিন্তু সহকারী বিদ্যালয় পরিদর্শক ও বিদ্যালয় পরিদর্শক পদগুলো ভারপ্রাপ্ত হয়েও বর্তমানে কর্মরত কেউ নেই। ফলে ১০ অঞ্চলে সহকারী বিদ্যালয় পরিদর্শক ১০ জন এবং বিদ্যালয় পরিদর্শক ১০ জন সম্পূর্ণরূপে শূন্য রয়েছে।

সহকারী প্রধান শিক্ষক বা সহকারী জেলা শিক্ষা অফিসার পদে পদোন্নতি না হওয়ার কারণে প্রধান শিক্ষক বা জেলা শিক্ষা অফিসার পদ এবং এর পরবর্তী উচ্চতর ধাপের পদসহ শিক্ষা প্রশাসনের সব গুরুত্বপূর্ণ পদ আগামী কয়েক বছর যাবত শূন্য থাকবে এবং বিধি সংশোধন না হলে এটা যুগ যুগ এরকমই চলতে থাকবে। এছাড়া প্রায় ১৯ বছর চাকরি করেও টাইম স্কেল বা সিলেকশন গ্রেড পাননি প্রায় ছয় হাজার শিক্ষক।

ডিজিটাল তথা স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্যে সরকার মাধ্যমিক পর্যায়ে ষষ্ঠ শ্রেণি থেকে আইসিটি বিষয়টি বাধ্যতামূলকভাবে  চালু করেছে। এরই ধারাবাহিকতায় সকল এমপিওভুক্ত বিদ্যালয়গুলোর জন্য ১৯৯৪ সাল থেকেই আইসিটি বিষয়ে শিক্ষকের পদ সৃজন ও নিয়োগ করা হলেও সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে এ বিষয়ে কোনো পদ সৃজনই এখন পর্যন্ত হয়নি।

এ ছাড়াও লিডিং প্রতিষ্ঠান হিসেবে সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে কম্পিউটার ল্যাব স্থাপন করা হলেও এখানে কোনো ল্যাব সহকারী নিয়োগ করা হয়নি। ফলে সরকারের কোটি কোটি টাকা ব্যয়ে স্থাপিত ল্যাবগুলো কার্যত অচল হয়ে পরে আছে।

অন্যদিকে এমপিওভুক্ত স্কুলগুলোতে ল্যাব সহকারী নিয়োগ করা হচ্ছে। এটি ভালো পদক্ষেপ, কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে সরকারি বিদ্যালয়গুলোতে ল্যাব সহকারী নিয়োগ হবে না কেন?

সরকারি মাধ্যমিকে ১৯৯৮ সালে প্রধান শিক্ষক (বিসিএস সাধারণ শিক্ষা ক্যাডার) হিসেবে নিয়োগপ্রাপ্ত হয়ে পরবর্তী উচ্চতর ধাপে পদোন্নতি না পেয়ে এ বছরে (২০২৪) প্রায় সকল প্রধান শিক্ষকই অবসরে চলে যাচ্ছেন বা ইতোমধ্যে অনেকেই চলে গেছেন।

সহকারী শিক্ষক ও সিনিয়র শিক্ষক পদকে ক্যাডার মর্যাদা প্রদানসহ সরকারি মাধ্যমিক শিক্ষক/শিক্ষিকাদের পদ-সোপানে ক্যাডার মর্যাদার নতুন একাডেমিক ধাপ সংযোজন করে তাদের পদোন্নতির সুযোগ না বাড়ালে শিক্ষক/শিক্ষিকাদের অনেকে আগামী তিন থেকে চার বছরের মধ্যে তাদের স্ব স্ব ভোগরত স্কেলের সর্বোচ্চ ধাপে পৌঁছে যাবেন।

ফলে আগামী তিন-চার বছরের মধ্যে তাদের বার্ষিক বেতন বৃদ্ধি বন্ধ হয়ে যাবে। এ-কারণে শিক্ষক/শিক্ষিকাগণ আগামী দুই/তিন বছরের মধ্যে বড় ধরনের আর্থিক ক্ষতির মধ্যে পড়তে যাচ্ছেন। ফলে এ খাতে কর্মরত শিক্ষক/কর্মকর্তাদের মধ্যে হতাশা বিরাজ করছে এবং এখানে বড় ধরনের বিশৃংখলা তৈরি হতে পারে বলে মাধ্যমিক নিয়ে কাজ করা বিদগ্ধজন মনে করেন।

উপরে বর্ণিত বিদ্যমান সোপানে উপযুক্ত সংস্কারের অভাবে সৃষ্ট বৈষম্য শিরোনাম অংশে বিদ্যালয় ও পরিদর্শন শাখা কর্মরত শিক্ষক/কর্মকর্তাদের বর্তমান পদ ও পরবর্তী ধাপে পদোন্নতিতে বিধিবিধানগত জটিলতা থাকার কারণে মাধ্যমিক শিক্ষা প্রশাসনের প্রায় সকল পদ ভারপ্রাপ্ত বা অনেক জায়গায় পদশূন্য অবস্থায় চলছে।

এতে দেশের মাধ্যমিক শিক্ষা প্রশাসন এবং মাধ্যমিক শিক্ষার আইডল খ্যাত জিলা স্কুলগুলোসহ অন্যান্য নামী সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের মতো প্রতিষ্ঠানগুলোর গুরুত্ব ও ঐতিহ্য ম্লান হতে চলেছে।

এছাড়াও দীর্ঘদিন পদোন্নতি বঞ্চিত হয়ে একই পদে অবস্থান করে শিক্ষক/কর্মকর্তাগণ হতাশার মধ্যদিয়ে অবসরে চলে যাচ্ছেন এবং নতুন মেধাবীরাও এখানে চাকরি নিয়ে এসে বেশিদিন থাকছেন না বা অনেকেই এ শাখায় চাকরি নিতে চান না। ফলে দেশের শিক্ষার জন্য অপূরণীয় ক্ষতি সাধিত হচ্ছে এবং আর্থিকভাবেও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে সরকার।

তাছাড়া ২০২৩ সাল থেকে চালু হওয়া নতুন শিক্ষাক্রম বাস্তবায়ন ও হুমকিতে পড়বে শিক্ষা প্রশাসনের এই অবস্থার কারণে। কারণ বিদ্যালয় ও পরিদর্শন শাখাকে দুর্বল করে এ শিক্ষাক্রম সঠিকভাবে বাস্তবায়ন কঠিন হয়ে পড়বে। হতাশায় নিমজ্জিত কোনো জনশক্তি দিয়ে ভালো ফলাফল আশা করা কতটা সমীচীন, সেটি আর একটি প্রশ্ন।

এ থেকে মুক্তির উপায় কী? পদোন্নতি প্রক্রিয়া শুরু করতে হলে একটি সুসামঞ্জস্য পদ সোপান প্রণয়ন করা অতীব জরুরি। সরকারের অন্যান্য দপ্তরের পদ সোপানের সাথে তুলনা করলে যে বিষয়টি চলে আসে সেটি হলো সরকারি মাধ্যমিকের প্রবেশ পদ এবং পরবর্তী ধাপ সিনিয়র শিক্ষক পদ মিলিয়ে নিচের এই দুটি পদকে ক্যাডারভুক্ত করলে খুব সহজেই এই জটিলতা নিরসন করা সম্ভব।

অন্যথায় বিদ্যমান পদ সোপানে ধাপগত যে জটিলতা রয়েছে তা সহজে নিরসন করে একটি সুসমাঞ্জস্য পদ সোপান প্রণয়ন বেশ দুরূহ। অনেক ক্ষেত্রেই তা সম্ভব নয় বলে মাধ্যমিক নিয়ে কাজ করা বিদগ্ধজন মনে করেন। মাধ্যমিকের সমস্যা সমাধানের জন্য একটি সুসামঞ্জস্য পদ সোপান প্রণয়ন করতে হবে। আর সেটি সুষ্ঠুভাবে করা সম্ভব স্বতন্ত্র মাধ্যমিক শিক্ষা অধিদপ্তর গঠনের মাধ্যমে।

শিক্ষকস্বল্পতা : ইউনেস্কো-টিচার টাস্কফোর্সের প্রতিবেদন রীতিমতো আঁতকে উঠার মতো

শিক্ষকস্বল্পতা নিয়ে সম্প্রতি ইউনেস্কো একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। আমরা জানি, ইউনেস্কো জাতিসংঘের বিশেষায়িত একটি এজেন্সি, যা শিক্ষার উন্নয়নে নিবেদিত। ছবিসূত্র: pxhere.com
শিক্ষকস্বল্পতা নিয়ে সম্প্রতি ইউনেস্কো একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। আমরা জানি, ইউনেস্কো জাতিসংঘের বিশেষায়িত একটি এজেন্সি, যা শিক্ষার উন্নয়নে নিবেদিত। ছবিসূত্র: pxhere.com

শিক্ষকস্বল্পতা নিয়ে সম্প্রতি ইউনেস্কো একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। আমরা জানি, ইউনেস্কো জাতিসংঘের বিশেষায়িত একটি এজেন্সি, যা শিক্ষার উন্নয়নে নিবেদিত। বৈশ্বিক ও আঞ্চলিক নেতৃত্বের মাধ্যমে শিক্ষার উন্নয়নকে ত্বরান্বিত করা, সদস্য দেশগুলোর জাতীয় শিক্ষা পদ্ধতিকে শক্তিশালী করতে সহায়তা করা যাতে সকল শিক্ষার্থী সুষম শিক্ষা গ্রহণ করতে পারে, সেটি নিয়েই সংস্থাটির মূল কাজ।

এছাড়াও সংস্থাটি পরিবর্তিত শিক্ষার মাধ্যমে বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জসমুহ মোকাবিলা করতে সহায়তা করে। এভাবেই ইউনেস্কো শিক্ষাক্ষেত্রে বৈশ্বিক নেতৃত্ব দিয়ে যাচ্ছে। সংস্থাটি শিক্ষাকে সর্বোচ্চ প্রাধান্য দিয়ে যাচ্ছে, কারণ শিক্ষা হচ্ছে মানুষের মৌলিক অধিকার। শুধু তাই নয়, শিক্ষা বিশ্বে শান্তি, স্থিতিশীলতা এবং টেকসই উন্নয়নের ভিত্তি।

ইউনেস্কো-টিচার টাস্কফোর্স শিক্ষকদের ওপর একটি বৈশ্বিক প্রতিবেদন পেশ করেছে যা রীতিমতো ভয়ংকর। এই প্রতিবেদন অনুযায়ী গোটা পৃথিবী শিক্ষকস্বল্পতা প্রত্যক্ষ করছে যার ফলে এসডিজি-৪ এবং শিক্ষা ২০৩০ এজেন্ডা বাস্তবায়নকে বাধাগ্রস্ত করবে।

২০৩০ সালের মধ্যে পৃথিবীতে ৪৪ মিলিয়ন প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ে শিক্ষকস্বল্পতা দেখা দেবে বলে ইউনেস্কো আশংকা করছে। সাব-সাহারান আফ্রিকার দেশগুলোতে আরও ১৫ মিলিয়ন শিক্ষক প্রয়োজন হবে, কারণ আকর্ষণ না থাকার কারণে শিক্ষকতা পেশা ছেড়ে চলে যাচ্ছেন নিয়োগকৃত শিক্ষকগণ। এটি শুধু উন্নয়নশীল বিশ্বেই নয়, উন্নত বিশ্বের দেশগুলোতেও শিক্ষকরা পেশা ছেড়ে অন্য পেশায় যাচ্ছেন, যা শিক্ষকস্বল্পতা বাড়াচ্ছে।

বাংলাদেশে আমরা কী দেখলাম? ৯৭ হাজার শিক্ষকের পদ খালি। দেশে বেকারত্ব চরমে, অথচ ৯৭ হাজারের শিক্ষক পদের বিপরীতে দরখাস্ত পড়েছে ২০ হাজার। তার মানে হচ্ছে, ইতোমধ্যে ৭৭ হাজার পদ খালি রয়েছে। ইউনেস্কো প্রতিবেদন বলছে, শিক্ষকস্বল্পতা মোকাবিলা করার জন্য প্রয়োজন আন্তর্জাতিক সহযোগিতা, প্রয়োজন শিক্ষায় বর্ধিত বিনিয়োগ, শিক্ষকদের ক্ষমতায়নের রোডম্যাপ তৈরি করা এবং রাষ্ট্রে এমন পলিসি অবলম্বন করা যাতে প্রতিটি শিশুকে একজন দক্ষ শিক্ষক, এবং শিক্ষায় প্রকৃত আগ্রহী একজন শিক্ষক পড়াবেন এবং প্রয়োজনীয় সব ধরনের একাডেমিক ও সহ-একাডেমিক কার্যাবলীতে সঠিকমাত্রার সহায়তা প্রদান করবেন।

রাষ্ট্র যখন এই বিষয়টি নিশ্চিত করবে তখন ভালো শিক্ষক নিয়োগ এবং তাদের ধরে রাখার বিষয়গুলোকে গুরুত্ব প্রদান করবে। সকল অভিভাবক ভালো শিক্ষকদের কাছে তাদের সন্তানদের পড়াতে চান, কিন্তু তাদের সন্তান যখন বড় হবে, তাদের সন্তান যদি ভালো ফল লাভ করে, তবে তারা তাদের অন্য পেশায় যেতে শুধু উৎসাহিত নয়, বাধ্য করেন। এ দৃশ্য শুধু বাংলাদেশের নয়, বলা যায় গোটা পৃথিবীর।

সকল অভিভাবক তাদের সন্তানদের ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, প্রশাসক বানাতে চান, কিন্তু পড়াতে চান ভালো শিক্ষকের কাছে। তাহলে ভালো শিক্ষক সমাজে আসবে কোত্থেকে? ভবিষ্যত প্রজন্ম ভালো শিক্ষক কোথায় পাবে? এই সত্য যখন পরিবার ও রাষ্ট্র উপলব্ধি করতে পারবে, তখনই আমরা ভালো শিক্ষক পাব শিক্ষকতায়, তাদের ধরে রাখার তাগিদ অনুভব করবো।

শিক্ষকস্বল্পতা শুধু একটি সংখ্যা নয়, এটি এক ধরনের ক্রাইসিস যা শিক্ষাকে অবনমিত করছে বিশ্বব্যাপী। এর ফল অত্যন্ত গভীর ও সুদূরপ্রসারী। শিক্ষকস্বল্পতা মানে হচ্ছে শ্রেণিকক্ষের আকার আরও বড় হওয়া। আর শ্রেণিকক্ষের আকার বড় হওয়া মানে কর্মরত শিক্ষকদের ওপর আরও চাপ বেশি চাপ প্রয়োগ করা।

শিক্ষকদের ওপর চাপ শিক্ষাকে আরও নিম্নমুখী করবে। শিক্ষকতা পেশাকে আরও তিক্ত করে তুলবে। শিক্ষায় বৈষম্য আরও বাড়াবে এবং শিক্ষায় অর্থনৈতিক চাপ বৃদ্ধি পাবে। অর্থাৎ প্রাতিষ্ঠানিক ও রাষ্ট্রীয় বিনিয়োগের চেয়ে ব্যক্তির ও পারিবারিক বিনিয়োগ আরও বেড়ে যাবে, যা শিক্ষার জন্য আরও একটি বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে হাজির হবে।

সর্বশেষ প্রজেকশনে দেখা যায় যে, এসডিজি-৪ লক্ষ্যমাত্রা বাস্তবায়ন করতে প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে অতিরিক্ত শিক্ষক নিয়োগের জন্য প্রয়োজন হবে ১২.৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলার, মাধ্যমিকে প্রয়োজন হবে ১০৬.৮ বিলিয়ন ডলার এবং যৌথভাবে প্রাথমিক ও মাধ্যমিকে ২০৩০ সালের মধ্যে অতিরিক্ত ১২০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার প্রয়োজন হবে।

এই অর্থের সংস্থান কোথা থেকে হবে? উন্নয়নশীল দেশগুলো বিভিন্ন ধরনের চ্যলেঞ্জের মুখে শিক্ষায় বাজেট কুঞ্চিত করে যেখানে জীবনধারণকারী বিষয়, পরিবেশ রক্ষা, নিরাপত্তা খাতে বাজেট বাড়িয়ে যাচ্ছে?

শিক্ষক স্বল্পতা সমস্যাটি আঞ্চলিক নয়, এটি বৈশ্বিক। উন্নত এবং পরিকল্পিত শিক্ষাকাঠামো থাকার পরেও ইউরোপ এবং উত্তর আমেরিকার মতো ধনী দেশগুলোতেও মানসম্মত শিক্ষক নিয়োগ এবং তাদের ধরে রাখতে তারা হিমশিম খাচ্ছে, যা শিক্ষার সার্বিক মান বজায় রাখতে চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলে দিচ্ছে।

অর্থনৈতিকভাবে পিছিয়ে পড়া ও উন্নয়নশীল দেশগুলোর কী অবস্থা? তারা তো উপযুক্ত শিক্ষকই নিয়োগ দিতে পারছে না। যারা শিক্ষকতায় উপযুক্ত নয়, বাধ্য হয়ে তাদের নিয়োগ দিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু তারাও একসময় অন্য পেশায় চলে যাচ্ছে। এভাবে শিক্ষাক্ষেত্র রাষ্ট্রীয় ও বৈশ্বিক পর্যায়ে অর্থনৈতিকভাবেও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।

প্রাথমিক শিক্ষায় ক্ষতির পরিমাণ ২০১৫ সাল থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত ছিল ৪.৬২ শতাংশ যা বেড়ে বর্তমানে দ্বিগুণ হয়েছে। কারণ শিক্ষকগণ শিক্ষকতায় প্রবেশের পাঁচ বছরের মধ্যে তাদের পেশা বদল করছেন। এর আর্থসামাজিক প্রভাব এবং বিস্তৃতি মোকাবিলা করা অত্যন্ত দুরূহ করা হয়ে দাঁড়িয়েছে।

শিক্ষকস্বল্পতা দূর করার জন্য প্রয়োজন সার্বিক পদক্ষেপ। শুধু ভালো শিক্ষক নিয়োগ করলেই হবে না, নিয়োগের পর তাদের মোটিভেশন, স্বাস্থ্য সুরক্ষা, উপযুক্ত প্রশিক্ষণ, কাজের পরিবেশ এবং সামাজিক মর্যাদার বিষয়গুলোকেও বিশেষভাবে দৃষ্টি দিতে হবে। শিক্ষকতা পেশায় চমৎকার পদসোপান তৈরি করা এবং স্বায়ত্বশাসন নিশ্চিত করাও প্রয়োজন।

শিক্ষায় শুধু নারীর নয়, পুরুষের অংশগ্রহণকেও জোর দিতে হবে। সিদ্ধান্ত গ্রহণকারী পন্থায় শিক্ষকদের কার্যকরীভাবে যুক্ত করতে হবে। নতুন শিক্ষকদের ধরে রাখার জন্য বিনিয়োগ বাড়াতে হবে, তাদের ধরে রাখার জন্য বিভিন্ন আকর্ষণীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।

আমরা দেখেছি, বাংলাদেশ ব্যাংকের লোভনীয় চাকরিও বহু মেধাবী তরুণ কর্মকর্তাদের ধরে রাখতে পারেনি কারণ সিদ্ধান্ত গ্রহণে তাদের ভূমিকা গৌণ করায় এবং ক্ষমতায়নের ক্ষেত্রেও তারা ত্রুটি দেখতে পেয়েছেন বলে।

এই বিষয়গুলো শিক্ষকতা পেশার ক্ষেত্রে অত্যন্ত দৃঢ়ভাবে দেখার সুপারিশ করছে ইউনেস্কো। সংস্থাটি বিশেষভাবে এবং আশু সমাধানের জোর দিচ্ছে অর্ধেকের মতো শিক্ষক যারা পেশা ছেড়ে চলে গেছেন, তাদের শূন্যস্থানগুলো দ্রুত পূরণ করার।

মুখস্থনির্ভর শিক্ষা ও মেধার বিকাশ

মুখস্থনির্ভর শিক্ষা ও স্মরণশক্তিকে মেধা বলে চালিয়ে দেওয়ার মানসিকতা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে বলে মন্তব্য করেছেন মাননীয়  শিক্ষামন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী। ছবিসূত্র: Rex Heer, Center for Excellence in Learning and Teaching, Iowa State University is licensed under a CC BY-SA (Attribution-ShareAlike) 4.0 International License.
মুখস্থনির্ভর শিক্ষা ও স্মরণশক্তিকে মেধা বলে চালিয়ে দেওয়ার মানসিকতা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে বলে মন্তব্য করেছেন মাননীয়  শিক্ষামন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী। ছবিসূত্র: Rex Heer, Center for Excellence in Learning and Teaching, Iowa State University is licensed under a CC BY-SA (Attribution-ShareAlike) 4.0 International License.

মুখস্থনির্ভর শিক্ষা ও স্মরণশক্তিকে মেধা বলে চালিয়ে দেওয়ার মানসিকতা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে বলে মন্তব্য করেছেন মাননীয়  শিক্ষামন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী।

তিনি বলেছেন, “বর্তমান কারিকুলামে শিখন পদ্ধতি ভিন্ন। গতানুগতিক শিক্ষার ধারণা থেকে এ পদ্ধতি পুরোপুরি আলাদা। এটা অভিজ্ঞতানির্ভর শিক্ষা। গতানুগতিক শিক্ষাকে যেভাবে দেখা হয় যে, শুধু কিছু তথ্য মুখস্থ করবো, মানে মেমোরি ড্রাইভেন প্রসেস, সেখান থেকে বের হয়ে আসতে হবে। তাহলেই স্মার্ট বাংলাদেশ গড়তে পারবো।

মাননীয় মন্ত্রী আরও বলেন, “নলেজ, ভ্যালুজ ও স্কিলস— এই তিনটির সমন্বয়ে হবে আমাদের শিক্ষা। সাম্প্রদায়িকতামুক্ত, সমতা, জাতীয়তাবোধ, কর্মমুখী শিক্ষা ও দক্ষতা নিশ্চিত করতে হবে। নলেজ দেওয়ার জায়গায় এবং মূল্যবোধের জায়গায় শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ দিতে হবে”।

তিনি মুখস্থনির্ভর শিক্ষা বিষয়ে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কিছু উক্তি সেখানে উল্লেখ করেছেন যে, শিক্ষার্থীদের বিশাল একটি অংশ যদি খুব কম বয়সে ঝরে পড়ে, তাহলে তো আমরা স্মার্ট প্রজন্ম তৈরি করতে পারব না।

প্রধানমন্ত্রী মুখস্থনির্ভর শিক্ষা বিষয়ে আরও বলেছেন, আমাদের লক্ষ্য হচ্ছে, শিশুরা শুধু মুখস্থবিদ্যা শিখবে না, একটা শিশুর ভেতর যে মেধা ও মনন থাকে, সেটাকে বিকশিত হওয়ার সুযোগ দেয়া। তার ওই মেধা দিযেই যেন সে এগিয়ে যায, সেদিকে লক্ষ্য রেখে আমাদের শিক্ষাক্রম এবং শিক্ষা দেওয়ার পদ্ধতিতে পরিবর্তন আনা হচ্ছে।

মাননীয় শিক্ষামন্ত্রী নিজে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর মুখস্থনির্ভর শিক্ষা বিষয়ে এই উক্তিগুলো উল্লেখ করেছেন ১৪ মে রাজধানীর একটি হোটেলে ‘লার্নিং এক্সিলারেশন ইন সেকেন্ডারি এডুকেশন প্রজেক্টে’র উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে। বিশ্বব্যাংকের সহায়তায় এ প্রজেক্ট বাস্তবায়ন করছে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তর।

আমাদের শিক্ষার্থীদের প্রকৃত মেধার বিকাশে উক্ত কথাগুলো অত্যন্ত মূল্যাবান বলে আমরা মনে করছি। তাঁরা দু’জনই প্রকৃত শিক্ষাগ্রহণ ও শিক্ষাদানের পদ্ধতির দিকেই ইঙ্গিত করেছেন।

প্রশ্ন হচ্ছে, কোনোকিছু মুখস্থ করা এবং শিক্ষার্থীর অন্তর্নিহিত মেধার বিকাশ কি একই জিনিস, নাকি একে অপরের পরিপূরক? নাকি এ দুটো বিষয়ের মধ্যে পার্থক্য রয়েছে? পার্থক্য থেকে থাকলে সেটি কতটুকু?

শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষক, কোচিং সেন্টারের শিক্ষক কিংবা গৃহশিক্ষক কর্তৃক সরবরাহকৃত কোনো তথ্য বা উত্তর যখন কোনো শিক্ষার্থী আত্মস্থ করে হুবহু পরীক্ষায় খাতায় লিখে, সেটি এক ধরনের নকল বা মুখস্থনির্ভর শিক্ষা, যেটিকে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন, মাথায় নকল নিয়ে যাওয়ার মতো বিষয়টি।

হুবহু অন্যের তথ্য মাথায় নিয়ে নির্দিষ্ট সময় পরে খাতায় ঢেলে দেয়া এক ধরনের এক শক্তি, তবে তাকে ঠিক মেধা বলা যায় না। বাস্তব জীবনে কিছু বিষয় প্রাকৃতিকভাবে আমাদের মজ্জাগত হয়ে যায়, আত্মস্থ হয়ে যায় বার বার অনুশীলন, ব্যবহার এবং চর্চা করার ফলে।

কিন্তু নির্দিষ্ট প্রশ্নোত্তর বা বিষয় যখন মেমোরিতে ধরে রাখার জন্য আমরা বার বার পড়ি, হয়তো সে বিষয়টির সবকিছু বুঝি না কিংবা আংশিক বুঝি কিংবা অনেকটাই বুঝি না, সেটি হচ্ছে মেমোরাইজেশন বা মুখস্থবিদ্যা বা মুখস্থনির্ভর শিক্ষা। এই বিষয়টিকে সকল শিক্ষাবিদ নিরুৎসাহিত করেন, নিষেধ করেন। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ও শিক্ষামন্ত্রী সেই কথাগুলোই আবারও স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন।

কোনোকিছু শুনে বা পড়ে মেমোরিতে দীর্ঘদিন ধরে রাখতে পারা বা মুখস্থনির্ভর শিক্ষা এক ধরনের শক্তি, তবে মুখস্থনির্ভর শিক্ষা ইতিবাচকভাবে ব্যবহার করতে পারলে মেধার পরিস্ফূরণেও সহায়ক হয়, অনেক বিষয়ের ব্যাপ্তি আরও বৃহত্তর করা যায়।

আমার মনে আছে, ব্র্যাক শিক্ষা কর্মসূচিতে আমাদের এক সহকর্মী ছিলেন (বর্তমানে তিনি অবসরে গেছেন), যিনি ব্র্যাক শিক্ষা কর্মসূচির পুরো দেশের ব্র্যাক পাঠাগারগুলো তিনি দেখতেন।

একবার ইউরোপের কয়েকটি দেশে তাঁকে যেতে হয়েছিল আন্তর্জাতিক পাঠাগার বিষয়ক কোনো সেমিনারে। কিন্তু তিনি ইংরেজি সেভাবে জানতেন না। কিন্তু তাঁর সাহস আছে যেকোনো পরিস্থিতি তিনি মোকাবিলা করে আসতে পারবেন। তিনি আমাদের কাছ থেকে লিখে নিলেন কী কী ধরনের প্রশ্ন তাঁকে করা হতে পারে, উত্তরে তিনি কী কী বলতে পারেন।

সেই লিখে নেয়া পুরো বিষয়গুলো তিনি একেবারে মুখস্থ করে ফেলেছেন এবং সেভাবেই তিনি উপস্থাপন করে, দর্শকদের উত্তর দিয়ে দেশে চলে এসেছেন। সেই থেকে মুখস্থনির্ভর শিক্ষা বিষয়কে আমি এক ধরনের শক্তি বলে থাকি।

ব্র্যাকে আমি আরও একজন সহকর্মী দেখেছি, যিনি বর্তমানে ভারতে বসবাস করছেন। তাঁকে ব্র্যাক শিক্ষা কর্মসূচিতে বলা হতো ‘তথ্যভান্ডার’। আমি প্রথম যোগদান করার পর সমস্ত বিভাগ ও এরিয়ার সব ধরনের কর্মকর্তাদের নামের তালিকা চাইলাম। তিনি আমাকে হুবহ সবার কথা বলে দিলেন। তাঁর কাছে প্রকৃত অর্থে লিখিত নেই, তিনি সব মুখস্থ রাখতেন।

যেমনটি ব্রিটিশরা যখন আমাদের পাক-ভারত উপমহাদেশ শাসন করতো, তখন তাদের সুবিধার জন্য মানুষরূপী কিছু কম্পিউটার তারা ব্যবহার করতেন। অর্থাৎ ওই যুগে তো কম্পিউটার অবিষ্কার হয়নি, অথচ অনেক তথ্য তাঁদের তৎক্ষণাৎ প্রয়োজন হতো যা কিছু কর্মকর্তা-কর্মচারীদের নিকট থেকে পাবার ব্যবস্থা করেছিলেন।

তারা ওসব তথ্যের গভীর রহস্য বুঝতেন না বা তাদের বুঝতে দিতেন না, তবে প্রয়োজনে তথ্য বলে দিতে পারতেন। সেই থেকেই মুলত মুখস্থবিদ্যাকে ঠিক ইতিবাচকভাবে নেওয়া হয় না এবং কবিগুরু রবিন্দ্রনাথ ঠাকুরও ওই বিষয়টিকেও ইঙ্গিত করেছিলেন। উঠতি বয়সের শিক্ষার্থীরা এ কাজটি করলে তাদের নিজস্ব রিজনিং ফ্যাকাল্টি, সৃজনশীল বিষয় পরিস্ফুটনে বাধাগ্রস্ত হয়। ধীরে ধীরে নিজস্বতা হারিয়ে ফেলে। তাই মুখস্থনির্ভর শিক্ষা বিষয়টিকে এখনও নিরুৎসাহিত করা হয়।

এর উল্টোটি হচ্ছে মেধার প্রসার। সেটিকে আমার এভাবে বলতে পারি— কোনো যুক্তিপ্রদর্শনমূলক লেখা, যেমন আমি এই বিদ্যালয়ে কেন ভর্তি হয়েছি, যদিও বিদ্যালয়টি স্বনামধন্য নয়। তার যৌক্তিক কিছু কারণ থাকতে পারে। যেমন বিদ্যালয়টি আমার বাসার কাছে, এখানে আমি হেঁটে আসতে পারি, আমার সময় কম খরচ হয়, ট্রান্সপোর্টের কোনো চিন্তা করতে হয় না, শ্রেণিতে শিক্ষার্থীসংখ্যা কম, তাই শিক্ষকগণ সকল শিক্ষার্থীর দিকে প্রায় সমান দৃষ্টি দিতে পারেন ইত্যাদি।

এ প্রশ্নগুলো আামি ঢাকার অভিজাত এলাকার একটি বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের জিজ্ঞেস করেছিলাম। খুব সন্তোষজনক উত্তর কেউ দিতে পারেনি, যদিও তাদের মেধা আছে কিন্তু নিজস্ব চিন্তাভাবনা করার চর্চা, অভ্যাস এবং শক্তি হারিয়ে ফেলেছেন শিক্ষকদের দেয়া নোট আর গাইড পড়ে আর প্রাইভেট পড়ে।

আমি অবাক হয়ে গিয়েছিলাম যে, একজন শিক্ষার্থীও আমি উপরে যে কথাগুলো বলেছি, তার একটিও বলেনি। এই বিষয়টিকেই নিরুৎসাহিত করা হচ্ছে। শিক্ষার্থীদের একটি সমস্যা দেয়া হবে, সেটি তারা সীমিত সম্পদ দিয়ে কোনো কোনো উপায়ে সমাধান করতে পারে সেটি হচ্ছে মেধা। এই ধরনের চর্চা আমাদের শিক্ষার্থীদের হচ্ছেনা। মন্ত্রী মহোদয় সেটিই বলেছেন।

মুখস্থনির্ভর শিক্ষা বা না বুঝে মুখস্থ করার ফল কী? আমি যখন রাজউক কলেজে শিক্ষকতা করি, তখন শিক্ষার্থীদের একদিন পরীক্ষা করার জন্য হঠাৎ লিখতে দিয়েছিলাম ‘ট্রাফিক জ্যামে তাদের অভিজ্ঞতা’। ওখানকার সকল শিক্ষার্থীই বাছাই করে নেয়া হয়, সব ধরনের চর্চাও করানো হয় কিন্তু দেখলাম সঠিক যুক্তিসহ কোনো শিক্ষার্থীই সন্তোষজনক লেখা লিখতে পারেনি।

আমি বলে দিলাম কয়েকটি পয়েন্ট, তারপরও সেভাবে কেউই লিখতে পারেনি। কিন্তু তাদের যদি বলা হতো আগামীকাল এটির ওপর একটি প্যারাপ্রাফ লিখতে হবে, তাহলে দেখা যেতো ক্লাসের সবাই সুন্দর করে লিখতে পারতেন, কারণ সবাই সেটি বুঝে কিংবা না বুঝে কিংবা চিন্তা না করে মুখস্থ করে আসতেন। এটাই মুখস্থনির্ভর শিক্ষা।

আবৃত্তিকার, ছড়াকার, গায়ক, হাফেজ দর্শকদের মাতিয়ে রাখেন। তাঁরা বিষয়টির গভীরে না গেলেও তাদের মুখস্থশক্তির বা মুখস্থনির্ভর শিক্ষা দ্বারা কিন্তু দর্শকদের অভিভুত করে ফেলেন। এখন যে গান তারা গাইলেন, যে কবিতা পাঠ করলেন, তার নিগূঢ় রহস্য, বিভিন্ন ধরনের ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণ করতে পারলেন, কোন ধরনের কবিতা ও গান  সেটিও ভালোভাবে আবিষ্কার করতে পারলেন, বৈশিষ্টাবলী বুঝলেন।

একইভাবে যিনি কোরানের আয়াত শুধু মুখস্থ না তার অর্থ, ব্যাখ্যা সুন্দরভাবে করলেন এবং নিজের জীবনেও বাস্তবায়ন করছেন, সেটি হচ্ছে বাস্তব প্রয়োগ। সেটি তিনি অন্য মানুষদেরও শেখাতে পারেন, বুঝাতে পারেন, সেই অনুযায়ী অন্যদের জীবনযাপনে উদ্ধুদ্ধ করতে পারেন। এখানেই শুধু মুখস্থ করা আর মুখস্থের সাথে ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ ও প্রয়োগ করতে পারার মধ্যে তফাৎ।

এখানেই শুধু মুখস্থবিদ্যা ও মেধার মধ্যে পার্থক্য বুঝা যায়। তাছাড়া ব্লুম ট্যাক্সোনমির প্রথম স্তরটিও কিন্তু স্মরণ রাখা অর্থাৎ তথ্য মুখস্থ রাখার বিষয়। মুখস্থ রাখা তথ্যের ওপর নির্ভর করেই আস্তে আস্তে সামনে আগাতে হয়, এবং তখন তথ্যের ব্যাখ্যা, বিশ্লেষণ ও প্রয়োগের বিষয় চলে আসে। অতএব কিছু তথ্য মুখস্থ রাখা প্রয়োজন।

স্মৃতিশক্তি মানুষের একটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। কোনোকিছু পাঠ করে যদি কিছুই মনে না থাকে তবে তা পড়ে লাভ কী? তাছাড়া কিছু বিষয় মুখস্থ না করলে তা আত্মস্থ হয় না। তাই যা আত্মস্থ করা প্রয়োজন, তা কিছু মুখস্থ করাও আবশ্যক। কিন্তু আমাদের পরীক্ষা পাসের জন্য যেসব তথ্য মুখস্থ করা হয়, তা অপ্রয়োজনীয়।

মুখস্থ করা সব তথ্যের মাঝে সম্পর্ক না বুঝলে তা মাথায় রাখা আর কম্পিউটারের মেমরি চিপসে থাকা একই কথা। আমরা যদি কেবল ইন্টিলিজেন্স কোশেন্ট-এর চর্চা করি ইমোশনাল ইন্টিলিজেন্সকে বাদ দিয়ে, তার মানে হচ্ছে, রোবটিক বুদ্ধিমত্তারই একমাত্র মূল্যায়ন করা, আবেগিত বুদ্ধিমত্তার নয়। ফলে শিক্ষার্থীর সততা, ন্যায়বোধ, দেশগ্রেম, সমাজবোধ, কল্যাণচিন্তা, সৃষ্টিশীলতা, মানবিকতা ইত্যাদি মানবিক গুণাবলী বিচার চরম অবহেলিত থেকে যায়। তাই-ই হচ্ছে এবং এজন্যই অনেকে না বুঝে কিছু মুখস্থ করাকে দায়ী করেছেন।

সর্বজনীন পেনশনে নতুন সিদ্ধান্ত ও শিক্ষকদের মধ্যে অসন্তোষ

স্বায়ত্তশাসিত, রাষ্ট্রায়ত্ত, সংবিধিবদ্ধ বা সমজাতীয় সংস্থায় আগামী জুলাই থেকে যোগ দেয়া চাকুরেদের সর্বজনীন পেনশনে যুক্ত হওয়া বাধ্যতামূলক করেছে অর্থ মন্ত্রণালয়।
স্বায়ত্তশাসিত, রাষ্ট্রায়ত্ত, সংবিধিবদ্ধ বা সমজাতীয় সংস্থায় আগামী জুলাই থেকে যোগ দেয়া চাকুরেদের সর্বজনীন পেনশনে যুক্ত হওয়া বাধ্যতামূলক করেছে অর্থ মন্ত্রণালয়।

স্বায়ত্তশাসিত, রাষ্ট্রায়ত্ত, সংবিধিবদ্ধ বা সমজাতীয় সংস্থায় আগামী জুলাই থেকে যোগ দেয়া চাকুরেদের সর্বজনীন পেনশনে যুক্ত হওয়া বাধ্যতামূলক করেছে অর্থ মন্ত্রণালয়। তারা বিদ্যমান পেনশনের বদলে সর্বজনীন পেনশন কর্মসূচির ‘প্রত্যয়’ স্কিমে অন্তর্ভুক্ত হবেন।

সরকারের সর্বজনীন পেনশনে এ তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্তে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা জোরালো প্রতিবাদ জানিয়েছেন। অর্থ প্রতিমন্ত্রী ওয়াসিকা আয়শা খান সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে বলেন, সব নাগরিককে পেনশনের আওতায় আনতেই সর্বজনীন পেনশন কর্মসূচি চালূ করা হয়েছে। সার্বিকভাবে বৃহত্তর স্বার্থের বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে সংশ্লিষ্টরা এ সিদ্ধান্তের বিরোধিতা থেকে সরে আসবেন বলে তিনি আশা করেন।

সর্বজনীন পেনশনে নতুন এ সিদ্ধান্তে স্বায়ত্তশাসিত ও রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানের বেশিরভাগ কর্মকর্তা-কর্মচারী ক্ষুদ্ধ হলেও চাকরির ভয়ে কেউ প্রকাশে মুখ খুলছেন না। তবে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা রয়েছেন সরব। তাঁরা বলছেন, এ প্রজ্ঞাপন কার্যকর হলে বাংলাদেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা বৈষম্যের শিকার হবেন।

একই বেতন স্কেলের আওতাধীন শিক্ষক, কর্মকর্তা-কর্মচারীর জন্য সরকারের ভিন্ন নীতি সংবিধানের মূল চেতনার সঙ্গেও সাংঘর্ষিক। তাঁরা প্রয়োজনে সর্বজনীন পেনশনে এই সিদ্ধান্ত বাতিলের জন্য আন্দোলনে যাবেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের সমিতিগুলো এরই মধ্যে এ সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করে বিবৃতি দিয়েছে।

বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি ফেডারেশনের সভাপতি এবং শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক অধ্যাপক ড. মো. আখতারুল ইসলাম বলেন, বঙ্গবন্ধু শিক্ষকদের সম্মান করতেন। তিনি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে স্বায়ত্তশাসন দিয়ে গেছেন। সেই শিক্ষকদের প্রদেয় সুবিধা বন্ধ করে দেয়া হবে আর তা নিয়ে আলোচনা করতে হবে, এটিই আমাদের জন্য লজ্জার।

তিনি বলেছেন, ৩০ জুনের পর আমাদের যে নতুন সহকর্মীরা আসবেন, তাঁরা জানবেন তারা কোন সুযোগ-সুবিধা পাবেন না। তাহলে মেধাবীরা শিক্ষকতায় কেন আসবেন? ফেডারেশনের মহাসচিব অধ্যাপক ড. নিজামুল হক ভূঁইয়া বলেন, আমরা আমাদের জন্য কিছু করছি না। ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে রক্ষার জন্য, মেধাবীদের বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকতায় ধরে রাখার জন্য কাজ করছি।

তিনি বলেন, যে ভয়াবহ সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে, তাতে দেশের শিক্ষাব্যবস্থা ভেঙ্গে পড়বে। মেধাবীর এ পেশায় আসবে না। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক শাহেদ রানা বলেন, হঠাৎ করে এমন প্রজ্ঞাপনের ফলে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের মধ্যে হতাশা ও অসন্তুষ্টি দেখা দিয়েছে।

ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমিতির সভাপতি বলেন, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো এখন সম্পূর্ণ স্থিতিশীল। পেনশন বিষয়ে নতুন সিদ্ধান্ত সারাদেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো অস্থিতিশীল করে তোলার পায়তারা বলে মনে হচ্ছে।

বিদ্যমান সরকারি পেনশন ব্যবস্থা থেকে সরিয়ে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় ও তার অঙ্গপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষক, কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের সর্বজনীন পেনশনে আওতাভুক্ত করার সিদ্ধান্তে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যও। তিনি বলেছেন, ‘এর ফলে ভাল কিুছ হবে না। আমি বিষয়টি নিয়ে শিক্ষামন্ত্রীর সাথে কথা বলবো।’

হঠাৎ করেই এমন একটি বিজ্ঞাপন জারির ফলে সারাদেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের মধ্যে চরম হতাশা ও অসন্তুষ্টির সৃষ্টি হয়েছে। এই প্রজ্ঞাপন কার্যকর হলে বাংলাদেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা চরম বৈষম্যের শিকার হবেন বলেও কেউ কেউ মন্তব্য করেছেন।

অর্থ মন্ত্রণালয় পেনশন বিষয়ে দুটি বিজ্ঞাপন জারি করে। সর্বজনীন পেনশনে এক প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, স্বশাসিত, স্বায়ত্তশাসিত, রাষ্ট্রায়ত্ত, সংবিধিবদ্ধ বা সমজাতীয় সংস্থা এবং এদের অধীন অঙ্গপ্রতিষ্ঠানে আগামী ১ জুলাই থেকে নিয়োগ পাওয়া কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সরকার পেনশন ব্যবস্থাপনার আওতাভুক্ত করলো।

একই দিন সর্বজনীন পেনশন স্কিম বিধিমালা সংশোধন করে আরেক প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, সংস্থাগুলোর কর্মকর্তা-কর্মচারীর ওপর ১ জুলাইয়ের পর থেকে ‘প্রত্যয়’ কর্মসূচি বাধ্যতামূলক। বিদ্যমান প্রগতি, প্রবাস, সুরক্ষা ও সমতা— এই চার পেনশন কর্মসূচি ঐচ্ছিক হলেও নতুন স্কিম বাধ্যতামূলক।

প্রত্যয় স্কিমে চাঁদার বিষয়ে প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছে, মূল বেতনের সর্বোচ্চ ১০ শতাংশ বা সর্বোচ্চ ৫ হাজার টাকা— এ দুয়ের মধ্যে যেটি কম, সংশ্লিষ্ট সংস্থা তা চাকরিজীবীর বেতন থেকে কেটে রাখবে এবং সমপরিমাণ অর্থ সংস্থা দেবে। দুই অঙ্ক একত্রে চাকরিজীবীর পেনশন আইডির বিপরীতে সর্বজনীন পেনশন তহবিলে জমা করবে।

যেদিন প্রতি মাসের বেতন দেয়া হয়, তার পরের কর্মদিবসের মধ্যেই সর্বজনীন পেনশনে এ কাজটি করতে হবে। এ জমা অর্থের পরিমাণ ও মেয়াদের ভিত্তিতে অবসরকালীন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা-কর্মচারী পেনশন ভোগ করবেন। সর্বজনীন পেনশন স্কিম বিধিমালা সংশোধন করে যে প্রজ্ঞপন জারি করা হয়েছে, তা প্রায় ৪০০ সংস্থার ওপর কার্যকর হবে।

যেসব সংস্থা ৫০ শতাংশের বেশি সরকারি অর্থায়নে চলে, সর্বজনীন পেনশনে সেগুলোকে রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছে। আর স্বশাসিত বা স্বায়ত্তশাসিত সংস্থা বোঝানো হয়েছে সেগুলোকে, যারা আলাদা কোনো আইনের মাধ্যমে গড়ে ওঠেছে। এর মধ্যে কোনো কর্তৃপক্ষ, কর্পোারেশন, কমিশন, সংস্থা, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়, ইনস্টিটিউশন, কাউন্সিল, একাডেমি, ট্রাস্ট, বোর্ড, ফাউন্ডেশন ইত্যাদি রয়েছে। বাংলা একাডেমি ও ঢাকা শিক্ষা বোর্ডও এই তালিকায় রয়েছে। এসব প্রতিষ্ঠানে ১৪ লাখের বেশি কর্মকর্তা-কর্মচারী রয়েছেন।

অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা যায়, দেশের প্রতিটি প্রাপ্তবয়স্ক নাগরিককে সর্বজনীন পেনশনে আনতে গত আগস্টে চালু করা হয় সর্বজনীন পেনশন কর্মসূচি। তখন চার শ্রেণির মানুষের জন্য চারটি স্কিম চালু করা হয়। সে সময় একটি প্রজ্ঞাপন দিয়ে জানিয়ে দেয়া হয় হয় যে, সুবিধামতো সময়ে সরকার আরও দুটি স্কিম চালু করে স্বায়ত্তশাসিত, রাষ্ট্রায়ত্ত এবং সরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের এ কর্মসূচির আওতায় নিয়ে আসবে। সেই ধারাবাহিকতায় এই সিদ্ধান্ত।

সর্বজনীন পেনশনে এই সিদ্ধান্তে আসার আগে এ-সংক্রান্ত প্রতিষ্ঠানগুলোতে বিদ্যমান পেনশন সুবিধা পর্যালোচনা করা হয়েছে। বর্তমানে বিভিন্ন কমিশন ও করপোরেশন সরকারি কর্মচারীদের আদলেই পেনশন দেয়া হয়, যা এ ধরনের মোট প্রতিষ্ঠানের ২৫ শতাংশের বেশি নয়।

এর বাইরে প্রায় ৪৫ থেকে ৫৫ শতাংশ প্রতিষ্ঠানে প্রদেয় ভবিষ্য তহবিলের মাধ্যমে মাধ্যমে অবসর সুবিধা দেয়া হয়। এ তহবিলে চাকরিজীবীরা তাদের মূল বেতনের ১০ শতাংশ জমা দেন, আর সংস্থা দেয় ৮ দশমিক ৩৩ শতাংশ। অবসরের পর এ টাকা এবং এর বাইরে প্রতিবছর দুই মাসের মূল বেতনের সমান আনুতোষিক অর্থাৎ গ্রাচুইটি তারা পান।

আবার, ১০ থেকে ১৫ শতাংশ এ ধরনের প্রতিষ্ঠানে প্রদেয় ভবিষ্য তহবিলও নেই। এক্ষেত্রে অবসরের পর চাকরিজীবীরা শুধু গ্রাচুইটি পেয়ে থাকে। তবে সরকারের নতুন সিদ্ধান্ত অনুযায়ী এসব প্রতিষ্ঠানের সবাইকে পেনশনের আওতায় আনার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এটিকে তো ইতিবাচকই মনে হয়।

তবে, মানুষের একটি ভয় থেকে যায় যে, সরকারের অনেক মহতী উদ্যোগই নাগরিকদের সুবিধা দিতে পারে না অসাধু, লোভী এবং দেশপ্রেমহীন অনেক কর্মকর্তা ও পলিসি মেকারদের কারণে। সেই বিষয়টি যদি নিশ্চিত করা যায়, অর্থাৎ এখানে পরিবর্তন অবশ্যই আনা অবশ্যই প্রয়োজন সেটি করা গেলে এই উদ্যোগকে একটি কলাণ্যকার ও শুভ বলা যায়।

ক্যাডেট কলেজে বর্ধিত টিউশন ফি মেধাবীদের পড়াশুনায় যেন বাধা হয়ে না দাঁড়ায়

ক্যাডেট কলেজ একটি বিশেষায়িত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। সেখানে বর্ধিত টিউশন ফি কি মেধাবীদের বাধা হয়ে দাঁড়াবে? ছবিসূত্র: উইকিমিডিয়া কমন্স
ক্যাডেট কলেজ একটি বিশেষায়িত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। সেখানে বর্ধিত টিউশন ফি কি মেধাবীদের বাধা হয়ে দাঁড়াবে? ছবিসূত্র: উইকিমিডিয়া কমন্স

ক্যাডেট কলেজ একটি বিশেষায়িত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। সেখানে বর্ধিত টিউশন ফি কি মেধাবীদের পড়াশোনায় বাধা হয়ে দাঁড়াবে? ক্যাডেট কলেজের ভর্তি প্রক্রিয়া, শিক্ষদান পদ্ধতি ও ধরন, প্রশিক্ষণ, শিক্ষাসংক্রান্ত কার্যাবলী পরিচালনা, সাংস্কৃতিক ও খেলাধুলা বিষয়ক কর্মকাণ্ড অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের চেয়ে আলাদা।

প্রাথমিক সামরিক প্রশিক্ষণ, পুরোপুরি আবাসিক এবং অ্যাকাডেমিক কার্যকলাপের মতো সমানভাবে গুরুত্বপূর্ণ অতিরিক্ত ও সহ-শিক্ষাক্রমিক কার্যাবলী ক্যাডেট কলেজগুলোকে অনন্যতা দান করেছে। যদিও অনেকেরই ধারণা, এখানে শুধু লেখাপড়াই হয়, আর পাবলিক পরীক্ষার ফলাফল দেখে অনেকে তাই মনে করেন।

আসলে সপ্তম শ্রেণি থেকে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত পুরো সময়টিকে বলা হয় প্রশিক্ষণকাল। একটি বিশেষ প্রশিক্ষণের মধ্যে দিয়ে শিক্ষার্থীদের ছয় বছর অতিবাহিত করতে হয়। সামরিক ও বেসামরিক সেক্টরে যোগ্য কর্মকর্তা তৈরির লক্ষ্যে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে ১৯৫৮ সালে ফৌজদারহার ক্যাডেট কলেজ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে আমাদের দেশে ক্যাডেট কলেজের যাত্রা শুরু।

ব্রিটিশ পাবলিক স্কুলের আদলে এখানার লেখাপড়া ও প্রশাসনিক কার্যবালী পরিচালিত হতো। প্রথম অধ্যক্ষ ছিলেন স্যার উইলিয়াম মরিস ব্রাউন। এই ক্যাডেট কলেজের সাফল্য ও শিক্ষাদানের ধারা প্রশংসিত তৎকালীন কর্তৃপক্ষ ১৯৬৩ সালে ঝিনাইদহ, ১৯৬৫ সালে মির্জাপুর এবং ১৯৬৬ সালে রাজশাহী ক্যাডেট কলেজ প্রতিষ্ঠা করেন।

বাংলাদেশে বর্তমানে তিনটি গার্লস ক্যাডেট কলেজসহ মোট বারটি ক্যাডেট কলেজ রয়েছে। এখানকার লেখাপড়া কিন্তু শ্রেণিকক্ষেই। রাতের পড়াও শ্রেণিকক্ষে শিক্ষকদের তত্ত্বাবধানে অনুষ্ঠিত হয়। সিভিল ও মিলিটারি প্রশাসনের সমন্বয়ে এখানকার প্রশাসন। এটিও এক ধরনের ব্যতিক্রম।

শিক্ষার্থীরা যেভাবে তাদের হাউস থেকে একাডেমিক ব্লকে আসা-যাওয়া করেন, ডাইনিং হলে কীভাবে একসাথে সবাই খাবার গ্রহণ করেন— এর সবগুলোর মধ্যেই রয়েছে আলাদা ধরনের শিক্ষা, যা বাইরের প্রতিষ্ঠানগুলোতে অনুপস্থিত। একটি বাৎসরিক ক্যালেন্ডার অনুসরণ করা হয়, যেখানে সব ধরনের কার্যবালীর উল্লেখ থাকে এবং সমস্ত ক্যাডেটকে সব ধরনের খেলাধুলার সাথে পরিচিতি থাকতে হয়, অংশগ্রহণ করতে হয়।

সব ধরনের সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের চর্চা নিয়মিত হয়ে থাকে। এখানে শিক্ষার্থীদের বেতন নির্ধারিত হয় অভিভাবকের আয়ের ওপর। সম্প্রতি এ বেতন বৃদ্ধি করা হয়েছে বা বর্ধিত টিউশন ফি করা হয়েছে ৩০ শতাংশ পর্যন্ত। এ পরিপ্রেক্ষিতে ক্যাডেট কলেজের শিক্ষার্থীদের বর্ধিত টিউশন ফি কমানোর প্রস্তাব দিয়েছেন ঝিনাইদহ-২ আসনের সংসদ সদস্য মো. নাসের শাহরিয়ার জাহেদী

তিনি বলেন, ১৯ ধাপে ক্যাডেট কলেজ সমূহে বর্ধিত টিউশন ফি করা হয়েছে। এর মধ্যে সর্বোচ্চ পর্যায়ের মধ্যে ১৮ নম্বর ধাপে অভিভাবকের যদি এক লাখ টাকার ওপর আয় হয়, সেখানে টিউশন ফি দিতে হয় ২০ হাজার টাকা। যেটি ৩০ শতাংশ বাড়ালে ২০২৪ সাল থেকে দিতে হবে ২৬ হাজার টাকা। অর্থাৎ বর্ধিত টিউশন ফি হবে ৬ হাজার টাকা।

মাঝামাঝি পর্যায়ে অভিভাবকের ৪০ হাজার টাকা যদি ইনকাম হয়, তখন বাচ্চার জন্য তাকে দিতে হবে ১৬ হাজার ২৫০ টাকা, যা তার পুরো রোজগারের ৪০ শতাংশ। এ অবস্থায় বর্ধিত টিউশন ফি না করে বরং এটিকে আরও সহনীয় পর্যায়ে পুনঃনির্ধারণের বিবেচেনা করার জন্য সরকারকে প্রস্তাব দেন মাননীয় সংসদ সদস্য।

জবাবে আইনমন্ত্রী বলেন, ক্যাডেট কলেজসমূহে ক্যাডেটদের টিউশন ফি ব্যতীত নিজস্ব আয়ের উৎস না থাকায় ও অর্থ মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী নিজস্ব আয় বৃদ্ধির লক্ষ্যে প্রাথমিকভাবে বর্ধিত টিউশন ফি নিয়ে এই প্রস্তাব থাকলেও তা বৃদ্ধি করা হয়নি। পরবর্তীতে সপ্তম শ্রেণির নবাগত ক্যাডেটদের টিউশন ফি ২০টি ধাপে বাড়ানো হয়। এর মধ্যে সর্বনিম্ন ধাপে ফি ১৫০০ টাকা। আর সর্বোচ্চ ধাপে ২৮ হাজার ৬০০ টাকা করা হয় যা পূর্বে ছিল ২২ হাজার টাকা।

মন্ত্রী বলেন, অসচ্ছল পরিবারের মেধাবী সন্তানদের জন্য ক্যাডেট কলেজে একটি ‘এনডোমেন্ট ফান্ড’ গঠনের পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে। যার মাধ্যমে অসচ্ছল মেধাবী শিক্ষার্থীরা আগের তুলনায় অনেক বেশি ফল ভোগ করবে। বিশেষভাবে উল্লেখ্য যে, ক্যাডেট কলেজসমূহে আবাস পেনশনের থোক বরাদ্দ না থাকায় ২০২২-২৩ অর্থবছর থেকে ক্যাডেট কলেজের অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের অবসর ভাতা প্রদান বন্ধ রয়েছে।

কিছুক্ষণ পর মন্ত্রী বলেন, আমি এই মাত্র প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে জানতে পারলাম, পেনশন বাবদ যে টাকাটা দেয়ার কথা ছিলো সরকারের পক্ষ থেকে, প্রধানমন্ত্রী সেই অর্থ বরাদ্দের ফাইল সই করেছেন।

মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে ধন্যবাদ। দেশের মেধাবী সন্তানদের জাতির যোগ্য নাগরিক হিসেবে গড়ে তোলার জন্য ক্যাডেট কলেজের শিক্ষকগণ যে অক্লান্ত পরিশ্রম করেন, তাদের পেনশন বন্ধ হয়ে যাওয়ার মতো ঘটনা প্রধানমন্ত্রীর দৃষ্টিগোচর হলে তিনি তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা গ্রহণ করেছেন। এটি একটি অত্যন্ত সময়োপয়োগী ও প্রশংসনীয় পদক্ষেপ।

বাবা-মায়ের আয়ের ওপর ভিত্তি করে ক্যাডেট কলেজে শিক্ষার্থীদের টিউশন ফি নির্ধারণ করা হয়। শিক্ষার্থীদের টিউশন ফি সর্বনিম্ন এক হাজার ৫০০ টাকা থেকে সর্বোচ্চ ২২ হাজার টাকা নির্ধারিত ছিলো। সম্প্রতি নিম্নধাপের টিউশন ফি অপরিবর্তিত রেখে অন্যান্য ধাপগুলোর জন্য বর্ধিত টিউশন ফি করার প্রস্তাব করা হয়েছে।

এক্ষেত্রে বর্ধিত টিউশন ফি নিয়ে সর্বোচ্চ ধাপের টিউশন ফি প্রস্তাব করা হয়েছে ২৮ হাজার ৬০০ টাকা। এ বৃদ্ধির হার সর্বশেষ ২০১৬ খ্রিষ্টাব্দে প্রবর্তিত টিউশন ফির তুলনায় ৩০ শতাংশের বেশি নয়। ৫ মে সংসদের প্রশ্নোত্তর সংসদ কাজে প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত আইনমন্ত্রী আনিসুল হক এ তথ্য জানান।

এর আগে স্পীকার ড. শিরীন শাারমিন চৌধুরীর সভাপতিত্বে সংসদের বৈঠক শুরু হয়। প্রশ্নোত্তরে ঝিনাইদহ-২ আসনের স্বতন্ত্র সংসদ সদস্য নাসের শাহরিয়ার জাহেদী ক্যাডেট কলেজের বর্ধিত টিউশন ফি নিয়ে এই নতুন প্রস্তাব যৌক্তিক পর্যায়ে নির্ধারণ করা হবে কি না, তা জানতে চান।

এ বিষয়ে সরকার দলের এমপি সালাউদ্দিন মিয়াজীর সম্পূরক প্রশ্নের জবাবে মন্ত্রী বলেন, ক্যাডেট কলেজের পেনশন-সংক্রান্ত বকেয়া অর্থ প্রধানমন্ত্রী ৫ মে তারিখেই অনুমোদন দিয়েছেন। তারা যেহেতু একটি সুখবর পেয়েছেন, এখন হয়তো টিউশন বৃদ্ধির যৌক্তিক পর্যায় নির্ধারণের বিবেচনা করতে পারেন। তবে এ বিষয়ে তিনি অভিভাবকদের ক্যাডেট কলেজ পরিষদের কাছে একটি আবেদন করার পরামর্শ দেন।

ক্যাডেট কলেজের একজন সাবেক শিক্ষক হিসেবে আমি বলতে চাই, যে ক্যাডেট বাড়িতে মাটির সানকিতে ভাত খেতেন, সেই ক্যাডেটই কলেজে দেশের সর্বোচ্চ পর্যাযের সেনা ও সিভিল অফিসারদের ছেলেমেয়েদের সাথে পড়াশুনা করেছেন। একই ডাইনিংয়ে কাটা চামচ দিয়ে খেয়েছেন, একই পোশাক পড়ে কৃতিত্বের সাথে কলেজ থেকে পাস করে বিশ্ববিদ্যালয়ে উচ্চশিক্ষা নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হয়েছেন। বিদেশে উচ্চশিক্ষার জন্য গিয়েছেন। এই হচেছ ক্যাডেট কলেজ!

সেই বিষয়টি যেন এখনও থাকে! অর্থাৎ, ওই ক্যাডেটদের মতো দেশের মেধাবী সন্তানরা অর্থের অভাবে যাতে এখানকার আদর্শ শিক্ষা থেকে বঞ্চিত না হন।

আবার এও দেখেছি, দরিদ্র ক্যাডেট বাবা এলাকায় চাঁদা তুলে নামমাত্র ফিতে ক্যাডেট কলেজে পড়িয়েছেন, সেই ক্যাডেট  বোর্ডে প্রথম স্থান অধিকার করেছেন। আর আমরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদ ও  সাবেক বাংলাদেশে ব্যাংকের গভর্নর ড. আতিউর রহমান তাঁর ক্যাডেট কলেজে পড়ার ইতিহাস নিজেই লিখেছেন।

তাঁর লেখা থেকে আমরা জানতে পেরেছি যে, এলাকার স্থানীয় মার্কেটের ছোট ছোট ব্যবসায়ীরা চাঁদা তুলে তাঁর অর্থের খরচ জুগিয়েছিলেন মির্জাপুর ক্যাডেট কলেজে ভর্তি হওয়ার জন্য। আর তৎকালীন অধ্যক্ষ তাঁর কলেজে ফি কোনো কোনো ক্ষেত্রে কমিয়ে, কোনো কোনো ক্ষেত্রে একেবারে মওকুফ করে তার পড়াশুনার ব্যবস্থা করেছিলেন। 

সেই ব্যবস্থা যাতে এখনও থাকে সেটিই আমাদের কাম্য। অর্থাৎ দেশের মেধাবী সন্তানগণ যাতে এখানে আগের মতোই পড়তে পারেন, অর্থনৈতিক দৈন্যতা যাতে তাদের পড়াশোনার পথে বাধা হয়ে না দাঁড়ায় সেই ব্যবস্থা নেয়ার জন্য কর্তৃপক্ষের নিকট অনুরোধ করছি।

নতুন শিক্ষাক্রমে শিক্ষার্থী মূল্যায়ন ও পাবলিক পরীক্ষা নিয়ে অস্পষ্টতা

নতুন শিক্ষাক্রমে থাকা নানা বিষয় নিয়ে যতো আলোচনা হচ্ছিলো, তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য আলোচনা হলো পাবলিক পরীক্ষা কীভাবে গ্রহণ করা হবে।
নতুন শিক্ষাক্রমে থাকা নানা বিষয় নিয়ে যতো আলোচনা হচ্ছিলো, তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য আলোচনা হলো পাবলিক পরীক্ষা কীভাবে গ্রহণ করা হবে।

২০২৩ সালের জানুয়ারি মাস থেকে নতুন শিক্ষাক্রম চালুর পর থেকে এ নিয়ে আলোচনা ও সমালোচনা যেন পিছু ছাড়ছে না। আর এর পেছনে যৌক্তিক কারণও রয়েছে। নতুন শিক্ষাক্রমে থাকা নানা বিষয় নিয়ে যতো আলোচনা হচ্ছিলো, তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য আলোচনা হলো পাবলিক পরীক্ষা কীভাবে গ্রহণ করা হবে, তার স্বরূপ কী হবে এবং উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তির বা বিদেশে উচ্চশিক্ষা গ্রহণের ক্ষেত্রে প্রতীকের মাধ্যমে যে মূল্যায়ন, সেটি কীভাবে অ্যাডজাস্ট করা হবে।

প্রথমেই বলা প্রয়োজন যে, নতুন শিক্ষাক্রমে এতো বিশাল পরিবর্তন যেখানে করা হলো, সেখানে পাবলিক পরীক্ষা নিয়ে কর্তৃপক্ষ খুব একটা চিন্তা যে করেননি, সেটি কিন্তু বার বার প্রকাশ পাচ্ছে। সচেতন অভিভাবক, শিক্ষক ও শিক্ষাসংশ্লিষ্টরা বিষয়টি বার বার তুলছেন বিভিন্ন ফোরামে। কিন্তু কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে আমরা একটি কথা শুনে আসছি যে, নতুন শিক্ষাক্রমে আনুষ্ঠানিক কোনো লিখিত পরীক্ষা হবে না, সেটির মাধ্যমে যে মূল্যায়ন সেটি সঠিক নয়।

লিখিত পরীক্ষা হলেই বাজারে নোট-গাইডের ব্যবসা শুরু হয়ে যাবে। কিন্তু আনুষ্ঠানিক কোনো লিখিত পরীক্ষা না থাকায় নতুন শিক্ষাক্রমে শিক্ষার্থীরা পড়াশুনা করছে না। শিক্ষার্থীরা কোনো বাধ্যবাধকতার মধ্যে নেই। একাদশ শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষার্থীদের মাইল্ড বাধ্যবাধকতার মধ্যে থাকতে হয়। পরীক্ষা বা পড়াশুনার অত্যাধিক চাপ নয়, তবে এক ধরনের তাগিদের মধ্যে থাকতে হয়। কারণ, এই বয়সে নিজেরা এসব বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়ার জন্য উপযুক্ত নয়।

তাছাড়া প্রতিযোগিতা যাতে অসুস্থতা সৃষ্টি না করে, সেটিকে কীভাবে পরিমার্জন করে সুস্থ প্রতিযোগিতার আয়োজন করা যায়, নতুন শিক্ষাক্রমে সেটি নিয়ে কাজ করার প্রয়োজন ছিলো। 

আমরা যারা শিক্ষা নিয়ে মাঠে কাজ করি, শিক্ষাবিষয়ে চিন্তা-ভাবনা করি, তারা কিন্তু বারবার বলে আসছি নতুন শিক্ষাক্রমে লিখিতভাবে খুবই ভালো কিছু বিষয় রয়েছে, কিন্তু বাস্তবের সাথে এর মিল অনেক কম। এই শিক্ষাক্রমকে অর্থবহ করতে হলে কমপক্ষে ৫০ শতাংশ লিখিত পরীক্ষা থাকতেই হবে।

আমরা যতোই বলি, নতুন শিক্ষাক্রমের সাথে সংশ্লিষ্টরা ততোই শক্ত অবস্থানে চলে যাচ্ছিলেন যে, লিখিত পরীক্ষা মানে মুখস্থ, লিখিত পরীক্ষা মানে প্রাইভেট পড়া, লিখিত পরীক্ষা মানে নোট-গাইডের ব্যবসা। কোনোটিই কিন্তু থেমে নেই, শুধু থেমে গেছে শিক্ষার্থীদের জানার আগ্রহ, বইপড়া আর বিদ্যালয়ের প্রতি আকর্ষণ। এমনটি হয়েছে যে, বহু শিক্ষার্থী কোনো ধরনের বই দেখে পড়তে পারছে না, এটি আমি নিজে ঘুরে ঘুরে দেখেছি, দক্ষতা আর যোগ্যতা অর্জন তো দূরের কথা।

নতুন শিক্ষামন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী দায়িত্ব নেয়ার পর বিষয়টি নিয়ে বেশ আলোচনা হচ্ছে। তিনি নতুন শিক্ষাক্রমে মূল্যায়নসহ সার্বিক বিষয় নিয়ে একাধিক সভা করেছেন এনসিটিবি কর্মকর্তাদের সাথে। শিক্ষাবিদ, অভিভাবকসহ বিভিন্ন মহলের উদ্বেগ, অসন্তোষ এবং লিখিত পরীক্ষা যুক্ত করার দাবির পরিপ্রেক্ষিতে শিক্ষামন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণের প্রথম দিনেই তিনি নতুন শিক্ষাক্রমে মূল্যায়নপদ্ধতি পরিবর্তনের ইঙ্গিত দিয়েছিলেন।

গত ১৪ জানুয়ারি ২০২৪ তারিখে শিক্ষামন্ত্রী বলেছিলেন, শিক্ষাবর্ষ মাত্র শুরু হয়েছে। ধারাবাহিক মূল্যায়নের কাজগুলোও শুরু হয়েছে। নতুন শিক্ষাক্রমে কাজ করতে গিয়ে যদি কোনো সমস্যা মনে হয়, তাহলে পরিবর্তন অবশ্যই আসবে। গত ১ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ তারিখে শিক্ষামন্ত্রী এনসিটিবি এবং শিক্ষা কারিকুলামের সঙ্গে যুক্ত কর্তৃপক্ষ ও ব্যক্তিদের নিয়ে বৈঠক করে তিনি মূল্যায়ন পদ্ধতির বিভিন্ন বিষয় সম্পর্কে জানতে চান।

একই সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে জন-অসন্তোষ নিরসনে তা যাচাই-বাছাইয়ের পরামর্শ দেন। এরপরই ফেব্রুয়ারি মাসে মূল্যায়নপদ্ধতি ও শিক্ষাক্রম নিয়ে ১৪ সদস্যবিশিষ্ট সমন্বয় কমিটি গঠনের কথা জানায় শিক্ষা মন্ত্রণালয়। নতুন কমিটি একটি সুপারিশ করেছে, যেখানে বলা হয়েছে, যোগ্যতা ও কার্যক্রমভিত্তিক মূল্যায়নের পাশাপাশি লিখিত পরীক্ষা রাখতে হবে এবং এই দুই অংশের মধ্যে আন্তসম্পর্ক বজায় রাখতে বলেছে।

তবে, নতুন শিক্ষাক্রমে বই যেভাবে তৈরি করা হয়েছে, তাতে কতোটা সেটি সম্ভব হবে সেটি একটি প্রশ্ন। হাতে-কলমে যে মূল্যায়ন হবে, তার ওয়েটেজ বা গড় ভারিত্ব হবে ৫০ শতাংশ। অন্যদিকে লিখিত অংশের ওয়েটেজ হবে ৫০ শতাংশ। চূড়ান্ত মূল্যায়নে সনদ/ট্রান্সক্রিপ্টের ৭ পর্যায়ের স্কেলে যোগ্যতা ও পারদশির্তার সূচক অভিভাবক ও অংশীজনের অবহিত করারও সুপারিশ করেছে কমিটি।

এই সাত পর্যায়ের স্কেল সম্পর্কে বিদ্যালয়, শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও অভিভাবক পুরোপুরি অন্ধকারে। কবে সবগুলো আলোর মতো স্পষ্ট হবে, সেই আশায়ই সংশ্লিষ্টরা বসে আছেন। ৫০ শতাংশ লিখিত পরীক্ষার কথা বলা হলো ২৬ মার্চ ২০২৪, এপ্রিলেও একই কথা চলছে। কিন্তু ১৪ মে ২০২৪ বাংলাদেশের প্রায় সমস্ত পত্রিকায় দেখলাম, ১৩ মে সচিবালয়ে শিক্ষামন্ত্রীর সভাপতিত্বে এক সভায় পাবলিক পরীক্ষায় মূল্যায়ন  নিয়ে আলোচনা ও প্রাথমিক সিদ্ধান্ত হয় যে, নতুন শিক্ষাক্রমে এসএসসি পরীক্ষার সামষ্টিক মূল্যায়নের লিখিত অংশের ওয়েটেজ হতে যাচ্ছে ৬৫ শতাংশ। আর কার্যক্রমভিত্তিক অংশের ওয়েটেজ হবে ৩৫শতাংশ।

কার্যক্রম বলতে বোঝানো হচ্ছে, অ্যাসইনমেন্ট করা, উপস্থাপন, অনুসন্ধান, প্রদর্শন, সমস্যার সমাধান করা, পরিকল্পনা প্রণয়ন ইত্যাদি। আরও সহজ করে বললে হাতে-কলমে কাজ। সেখানে উপস্থিত ছিলেন ঢাকা শিক্ষা বোর্ড ও এনসিটিবির কর্মকর্তাগণ। মাননীয় কর্মকর্তাদের নিকট সবিনয় জানতে চাই যে, শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও অভিভাবকগণ নতুন শিক্ষাক্রমে আসলে কোন পদ্ধতিটি অবলম্বন করবেন, তাদের কি আসলেই বিভ্রান্ত হওয়ার কথা নয়? 

ঘটনা এখানেই শেষ নয়, এই ৬৫ শতাংশ পরীক্ষার মার্কিং কীরকম হবে। সেটি কি মার্কিংই থাকবে, নাকি গ্রেডিং হবে, নাকি নম্বর সিম্বলে রূপান্তরিত করা হবে? এ আলোচনা কিন্তু দেখলাম সেখানে অনুপস্থিত। আবার এই নিয়ে কথা হবে, কয়েক মাস কেটে যাবে তখন সংশ্লিষ্টরা আবার কিছু খসড়া সিদ্ধান্ত নেবেন। এভাবে সময় তো বসে থাকছে না।

বিদ্যালয়গুলোর ও শ্রেণিকক্ষগুলোর বাস্তব অবস্থা জানার জন্য আপনারা একটু গোপনে গিয়ে যদি দেখেন, তাহলে দেখতে পাবেন, নতুন শিক্ষাক্রমে পড়াশুনার আসলে কী হাল হয়েছে। অনেকে বলছেন যে, এগুলো তো কোন সিদ্ধান্ত নয়, শুধু সময় ক্ষেপণ!

যোগ্যতাভিত্তিক শিক্ষাক্রম চালুর পর এ পর্যন্ত কর্তৃপক্ষের যেসব আলোচনা, তার সবই লিখিতভাবে অর্থাৎ থিওরিটিক্যালি পজিটিভ, ভীষণ ইতিবাচক। যেসব কথা পরিকল্পনায় যেভাবে লেখা আছে সেগুলো অবশ্যই সুন্দর, সেটি নিয়ে আমরা কতোটা আত্মতৃপ্তিতে ভুগতে পারি? 

আমরা বলছি বাস্তব কথা নিয়ে। নতুন শিক্ষাক্রমে লিখিত কোনো পরীক্ষাই তারা রাখবেন না। পাবলিক পরীক্ষা কীভাবে হবে, সেটি নিয়ে যে শিক্ষাক্রম বা ব্যবস্থায় চিন্তা করা হয় না, সেটি যে কতো গলদে ভর্তি তার প্রমাণ আমরা বার বার পাচ্ছি।

এখন তাঁরা বলছেন, নতুন শিক্ষাক্রমে এক ঘণ্টার একটি লিখিত পরীক্ষা নেয়া হবে। তবে, বার বার নিজেদের স্থানটি ধরে রাখার জন্য বলছেন যে, সেটি আগের পরীক্ষার মতো হবে না। তারা যতোগুলো কথা বলতেন, তার মধ্যে একটি ছিল পরীক্ষার কোনো টেনশন শিক্ষার্থীদের মধ্যে থাকবে না।

পুরনো শিক্ষাক্রম অনুযায়ী, শিক্ষার্থীদের তিন ঘণ্টার লিখিত পরীক্ষায় অংশ নিতে হতো। অর্থাৎ দশটি বিষয় হলে একজন শিক্ষার্থীকে ত্রিশ ঘণ্টার পরীক্ষা দিতে হতো। নতুন শিক্ষাক্রমে এখন দিতে হবে পঞ্চাশ ঘন্টার অর্থাৎ শিক্ষার্থীদের পাঁচ ঘণ্টারপরীক্ষা দিতে হবে।

শিক্ষার্থীরা যখন এসএসসি পরীক্ষার সেন্টারে যাবে, তাদের সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত সেন্টারে থাকতে হবে। এই দীর্ঘ সময় তারা কী খাবে? কোথায় খাবে? এ চিন্তা কিন্ত কর্তৃপক্ষ এখনও করেননি।

আমার সাথে দু’একজনের কথা হয়েছে। আমি যখন এই প্রশ্ন জিজ্ঞেস করেছি, তখন হালকা করে বলা হলো, খাওয়ার ব্যবস্থা করা হবে। এতগুলো শিক্ষার্থীর খাবার আয়োজন কে করবে, কীভাবে করা হবে? মূল্যায়নের পরিবর্তে শত শত শিক্ষার্থীর খাওয়ার পেছনে যে আয়োজন ও সময় নষ্ট হবে সেটি হতে পারে পিকনিক, কোনো মূল্যায়ন নয়।

শুধু তাই নয়, এত শত শত কিংবা হাজার হাজার শিক্ষার্থীরা পাঁচ ঘণ্টা ধরে এক্সপেরিমেন্ট করবে, পরীক্ষা দিবে, তাদের সুপারভাইজ করার মতো এতো জনবল কি ওই সেন্টারের আছে?

বিষয়টি কিন্তু আরও এক জায়গায় ধোঁয়াশা রাখা হলো। পরীক্ষা কি সেন্টারে হবে না পার্শ্ববর্তী কোনো বিদ্যালয়ে হবে? বোর্ডের পরীক্ষা নিতে হবে, লিখিত পরীক্ষা নিতে হবে, এসব দাবির পরিপ্রেক্ষিতে  কর্তৃপক্ষের এমন উত্তর। আমরা কিন্তু এখনও স্পষ্ট করে বুঝতে পারছি না যে, পাবলিক পরীক্ষা আসলে কোথায় হবে এবং কীভাবে হবে।

প্রথম বলা হলো, পাশের বিদ্যালয়ে পাবলিক পরীক্ষা হবে। পাশের বিদ্যালয়ে পরীক্ষা হওয়া মানে সেটি কোনো মূল্যায়ন নয়। দুই বিদ্যালয়ের মধ্যে যদি রেষারেষি থাকে, শত্রুতা থাকে, তাহলে মূল্যায়ন একরকম হবে। আবার যদি মিউচুয়াল আন্ডারস্ট্যন্ডিংয়ের মাধ্যমে মূল্যায়ন করা হয়, সেটিও কোনো মূল্যায়ন হবে না। বিষয়টি কিন্তু স্পষ্ট করা হয়নি।

আবার যখন আলোচনা হলো, তখন বলা হচ্ছে, পরীক্ষা হবে সেন্টারে। একটি সেন্টারে পরীক্ষার্থী থাকে কয়েক হাজার। প্রতিটি পরীক্ষার্থী যদি ৫ ঘণ্টা পর্যন্ত পরীক্ষা দেয়, তাহলে সেটি মূল্যায়ন করা বা পর্যবেক্ষণ করার জন্য এত শিক্ষক কোথায় পাওয়া যাবে? এ চিন্তাও কিন্তু তারা করেনি।

প্রথম বলা হলো, বিদ্যালয় সবকিছু করবে। তারপর শিক্ষার্থীদের মূল্যায়নে বোর্ডগুলোর ভূমিকা কী হবে— এসব প্রশ্ন ওঠার পরে তারা বলছেন বোর্ড থেকেই প্রশ্নপত্র তৈরি করা হবে। আবার সাথে সাথে বলা হচ্ছে, পরীক্ষা আগের মতো হবে না। পুরো বিষয়টিতে কিন্তু গোলমাল লেগে আছে। যখনই তাদের প্রশ্ন করা হয়, তখন তারা সাথে সাথে একটি উত্তর দিয়ে দেন, তারা কিন্তু পরিকল্পনা প্রকাশ করার সময় সেগুলো বলছেন না। অর্থাৎ, এগুলো তাদের চিন্তায় আছে কি না সেই প্রশ্ন থেকে যাচ্ছে। 

প্রথম বছরের অভিজ্ঞতার ভিত্তিকে ধাপে ধাপে কার্যক্রমভিত্তিক অংশের ওয়েটেজ বাড়ানো হবে। লিখিত অংশের প্রশ্নপত্র হবে কার্যক্রমের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল রেখে। অর্থাৎ প্রশ্ন হবে দুই অংশের মধ্যে আন্তসম্পর্ক বজায় রেখে। বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয়েছে, এখন এনসিটিবি দ্রুত আনুষঙ্গিক প্রক্রিয়া শেষ করলে এটিকে চূড়ান্ত অনুমোদনের জন্য পূর্বনির্ধারিত জাতীয় শিক্ষাক্রম সমন্বয় কমিটির (এনসিসিসি) সভায় তোলা হবে।

ওই কমিটির সুপারিশ অনুযায়ী লিখিত ও কার্যক্রমভিত্তিক মূল্যায়ন মিলিয়ে সময়টি পাঁচ ঘণ্টাই রাখা হয়েছে। নতুন শিক্ষাক্রম অনুযায়ী দশম শ্রেণি শেষে যে পাবলিক পরীক্ষা হবে, সেটির নাম এখনকার মতো মাধ্যমিক স্কুল সার্টিফিকেট পরীক্ষাই রাখা হচেছ। তারা কিন্তু পরীক্ষার নামসহ সবই উল্টে দিতে চাচ্ছিলেন। এবং বাস্তবতার কথা অনেকক্ষেত্রে চিন্তা না করে অনেককিছু বলেই যাচ্ছেন, বিদ্যালয় ও শিক্ষার করুণ দশার কথা কিন্তু চিন্তা করছেন না।

আমরা জানি, দশম শ্রেণি শেষে যে পাবলিক পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়, সেটির নাম ১৯৬২ সাল থেকেই মাধ্যমিক স্কুল সার্টিফিকেট (এসএসসি) পরীক্ষা নামে পরিচিত। শিক্ষাক্রম-সংশ্লিষ্টরা নিজেদের জায়গাটি ঠিক রাখার জন্য বলেই যাচ্ছেন, শিক্ষার্থীদের অর্ধবার্ষিক ও বার্ষিক মূল্যায়নের ধরন এখনকার মতো থাকছে না।

নতুন শিক্ষাক্রমে মূল্যায়ন কীভাবে থাকছে তাও ঠিকমতো বলছেন না। যা বলছেন তার অনেক কিছুই বাস্তবের সাথে মিল নেই। দেশের প্রেক্ষাপটের সাথে মিল নেই। আর লক্ষ লক্ষ শিক্ষক তো বুঝতেই পারছেন না, তারা তালগোল পাকিয়ে বসে আছেন।

আন্তর্জাতিক পরীক্ষা ‘ও’ লেভেল এবং ‘এ’ লেভেলে’ লিখিত পরীক্ষা আছে। পিসায় লিখিত পরীক্ষা আছে। আন্তর্জাতিক অন্যান্য পরীক্ষা যেমন আইইএলটিস এগুলোর সবকিছুর উপরে ওঠে আমাদের শিক্ষাক্রম-সংশ্লিষ্টরা বলেই যাচ্ছেন, ওগুলো কোনো পরীক্ষাই নয়, ওগুলো শুধু ব্যবসা।

২০২৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে নতুন শিক্ষাক্রমে মাধ্যমিক পরীক্ষা হওয়ার কথা। কিন্তু নতুন শিক্ষাক্রমে লিখিত পরীক্ষা না থাকায় সেটি কোন পদ্ধতিতে হবে, তার কাঠামো এখনো ঠিক না হওয়ায় শিক্ষার্থী, অভিভাবক এবং শিক্ষাসংশ্লিষ্টরা বুঝতে উঠতে পারছেন না। পরীক্ষা পদ্ধতি ঠিক না হওয়ায় দশম শ্রেণির পাঠ্যবই লেখার কাজও আটকে আছে।

অথচ ২০২৫ সালের জানুয়ারি থেকে এই শ্রেণির শিক্ষার্থীরা নতুন শিক্ষাক্রমে নতুন পাঠ্যবইয়ে পড়াশুনা করবে। সেটিও দেখছি, খুব তাড়াহুড়ো করে করতে হবে। তাড়াহুড়ো করা মানে ভুলের ছড়াছড়ি। এখানে ভালো বা মন্দ নিয়ে কথা নয়, কথা হচ্ছে আমরা হঠাৎ করে পূর্বের শিক্ষাক্রমের পুরোটাই পরিবর্তন কেন করলাম? আমরা কি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, কৃষিবিদ তৈরি করছিলাম না? শিক্ষার্থীরা বিদেশে উচ্চশিক্ষা নিতে যাচ্ছিলেন না? হঠাৎ করে কেন সমস্ত বিল্ডিং ভেঙ্গে দিয়ে নতুন ডিজাইনের বিল্ডিং করতে নেমে গেলাম?

সব বিল্ডিং ভেঙ্গে দিয়ে নতুন বিল্ডিং সেগুলোর চেয়ে অনেক অনেক ভালো হবে, সেটি নিজেরাই অনুমান করে নিজেরাই এর প্রচারে নেমে গেলাম। কিন্তু একটি পলিথিন দিয়ে ঢেকে রাখার চেষ্টাও না করে নতুন বিল্ডিং হওয়ার অপেক্ষায় সবাইকে রেখে দিলাম। পূর্ববর্তী শিক্ষাক্রমে আমাদের প্রয়োজন ছিলো প্রশ্নপত্রের ধরন পরিবর্তন করা, যাতে শিক্ষার্থীরা নিজ থেকে লিখে ফললাভ করে।

আরেকটি দরকার ছিলো, প্রাকটিক্যাল কিছু বিষয় যেগুলো একুশ শতকের স্কিলসের সাথে যায় সে ধরনের কিছু চালু করা। সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন ছিলো শিক্ষকদের প্রণোদনা বাড়ানো, বেতন ভাতা বাড়ানোর দিকে জোর দেয়া এবং যারা ইতিমধ্যে শিক্ষকতায় আছেন, তাদের অ্যাকাডেমিক ও পেডাগজিক্যাল দিকগুলো প্রশিক্ষণ, গবেষণা ও পড়াশুনা করানোর মাধ্যমে উন্নত করার।

আর শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে ধীরে ধীরে যে পদক্ষেপগুলো নেয়া হচ্ছে (যেমন, এনটিআরসি-এর মাধ্যমে নিয়োগ) সেগুলো প্রশংসীয় এবং ধীরে ধীরে আরও উন্নত পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া। শিক্ষার্থীরা শ্রেণিকক্ষে মজা পায় না, সেজন্য শুধু শিক্ষকরাই দায়ী নন। এসব জায়গায় কাজ করার দরকার ছিলো। এগুলোকে পাশ কাটিয়ে হঠাৎ করে নতুন শিক্ষাক্রম নিয়ে এলাম।

যারা নতুন শিক্ষাক্রমে এগুলো বাস্তবায়ন করবেন, যাদের ওপর এগুলো প্রয়োগ করা হবে, তাদের প্রকৃত অবস্থা ঢাকঢোল না পিটিয়ে গভীরভাবে ও নিরপেক্ষভাবে জানার এবং অবলোকন করার দরকার ছিলো। কর্তৃপক্ষ সেদিকে যায়নি। আমরা দেখতে পাচ্ছি, তারা বিষয়টি যেহেতু চালু করেছেন, যেকোনো মূল্যে তার বাস্তবায়ন করতেই হবে। তাতে শিক্ষার্থীদের অবস্থা আর শিক্ষার অবস্থা যাই হোক!

এর ভালো দিকগুলো তুলে ধরার জন্য বিভিন্ন কৌশল অবলম্বন করা হচ্ছে। নতুন শিক্ষাক্রমে সব বিষয়কে তো আমরা খারাপ বলতে পারি না। আমাদের দেখতে হবে অনুমিত সিদ্ধান্ত এবং সেগুলোর কথা চিন্তা করেই আত্মতৃপ্তি লাভ করার মধ্যে ঢুকে যাওয়ার বিষয়টি। ঢাকা থেকে শুরু করে প্রত্যন্ত গ্রাম পর্যন্ত একটি শ্রেণিতে তিন-চার পাঁচজন শিক্ষার্থী পড়তে পারে, পড়ে, লিখে, ক্লাসের কাজ করে। বাকিরা তো শ্রেণি অনুযায়ী অনেক পেছনে পড়ে আছে। তাদের প্রয়োজন রেমিডিয়াল ক্লাস, বহু ব্যাকক্লাস। 

এ বছর যারা নবম শ্রেণিতে পড়াশোনা করছে, তারাই ২০২৬ সালে মাধ্যমিক পরীক্ষায় অংশ নেবে। তারা এই শিক্ষাক্রমে পড়ে কী অর্জন করতে যাচ্ছে? একটি বিষয় বার বার অনুশীলনের মাধ্যমে কিছু অর্জন করা যায়। কিন্তু, সেই অনুশীলন তো হচ্ছে না!

লিখিত পরীক্ষা না থাকায় নতুন শিক্ষাক্রমে থাকা এই বিষয়টি সমালোচনার মুখে পড়ে। অভিভাবকসহ সংশ্লিষ্টরা বিভিন্ন ধরনের প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন। কিন্তু তাদের প্রতিবাদে শিক্ষক ও শিক্ষা কর্মকর্তারা অদ্ভুতভাবে নীরব থাকেন। ফলে শিক্ষাক্রম নিয়ে নেতিবাচক ধারণা তৈরি হয়। অথচ নতুন শিক্ষাক্রমে মূল্যায়ন আছে, পাস-ফেল আছে, প্রতিদিনের পাঠদান আছে, পাঠের পূর্বপ্রস্ততি আছে, আবার শিক্ষককেও ফলাফল দিতে হয়।

অর্থাৎ ঠিক নিয়ম মেনে সন্তানকে পড়িয়ে বিদ্যালয়ে পাঠাতে হবে অভিভাবকদের। সব মিলিয়ে অভিভাবকরা সন্তানের পড়াশোনা সম্পর্কে স্বচ্ছ ধারণা রাখতে পারবেন। মোটকথা, শিক্ষাক্রম নিয়ে সবার ইতিবাচক ভূমিকা তৈরি হবে।

কিন্তু হয়েছে ঠিক উল্টো। অর্থাৎ, মূল্যায়ন নিয়ে নতুন শিক্ষাক্রমে কী আছে তা নিয়ে তালগোল পাকিয়ে আছে। শিক্ষার্থী, শিক্ষক, অভিভাবক ও বিদ্যালয় এখনও অষ্পষ্টতা, ধোঁয়াশা ও অনুমাননির্ভর অনেক কিছুই করছে।

নতুন শিক্ষাক্রমে মূল্যায়নের জন্য আটটি উপকরণ রাখার সিদ্ধান্ত ছিল, যেমন— কুইজ, প্রতিবেদন, উপস্থাপন, প্রশ্নোত্তর, ব্যবহারিক, স্বমূল্যায়ন, সহপাঠী মূল্যায়ন ও প্রতিবেশি মূল্যায়ন। অর্থাৎ প্রশ্নোত্তর পর্বের নাম দিয়ে লিখিত পরীক্ষাও ছিল।

কিন্তু গত দুই বছরে কিছু অতি উৎসাহী কর্মকর্তা সাবেক শিক্ষামন্ত্রীকে খুশি রাখতে গিয়ে মূল্যায়নের আটটি অংশের মধ্যেই মাত্র কুইজ, প্রতিবেদন ও উপস্থাপন রেখে বাকি পাঁচটিকেই বাদ দিয়ে দেন। এর ফলে মূল্যায়ন থেকে হাতে-কলমের পরীক্ষা বাদ পড়ে।

কিছু জাতীয় দৈনিকে দেখলাম, সাংবাদিকগণ বলছেন, এনসিটিবির একজন কর্তাব্যক্তির প্রশ্ন শুনে হতবাক শিক্ষাবোর্ডে কর্মরত ও পাবলিক পরীক্ষা অনুষ্ঠানে শিক্ষা ক্যাডার কর্মকর্তারা। হতবাক হওয়ারই কথা। আমরা ফুটবল খেলা দেখি। সেখানে প্রতিযোগিতা আছে, ক্রিকেট দেখি সেখানে প্রতিযোগিতা আছে। এভাবে সব কাজেই প্রতিযোগিতা আছে।

কিন্তু নতুন শিক্ষাক্রমে আমরা বলছি শিক্ষার্থীরা কোনো প্রতিযোগিতা করবে না। একজন খেলোয়াড় যদি জানে যে, তাকে কোনো গোল করতে হবে না, তাহলে সে কতক্ষন খেলবে? সেই দশা হয়েছে আমাদের শিক্ষার্থীদের। বইয়ে বলা হয়েছে তারা আনন্দচিত্তে সারাদিন বইয়ের কাজ করবে কিন্তু পরীক্ষার চাপ তাদের সইতে হবে না।

একটি বিষয়কে বারবার অনুশীলন করতে হয় বিভিন্নভাবে, লিখে, পড়ে, আলোচনা, উপস্থাপনা, রিপোর্ট রাইর্টং ইত্যাদি করে। কিন্তু এখন যেটি হয়েছে, শিক্ষার্থীরা শ্রেণিকক্ষে অনুশীলন করার সময় পাচ্ছে খুবই কম। একজন শিক্ষককে বিশেষ করে বড় ক্লাসে ডিসিপ্লিন মেনটেইন করতেই সময় চলে যায়, কখন তিনি শিক্ষার্থীদের দিকে ব্যক্তিগতভাবে খেয়াল রাখবেন?

এখানে আরেকটি কথা হচ্ছে, শিক্ষকদের নিজস্ব মূল্যায়ন এক বিদ্যালয় থেকে অন্য বিদ্যালয় শহর থেকে গ্রাম, ছোট শহর থেকে বড় শহর, ভালো প্রতিষ্ঠান থেকে অপেক্ষাকৃত কম মানের প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের মূল্যায়ন কখনোই এক হবে না। আর এটি হবে না বলেই একটি জাতীয় মানদণ্ড থাকতে হয়। বর্তমান শিক্ষাক্রমে যে বিশাল গ্যাপটি রয়েছে, তার বহু প্রমাণের মধ্যে এটি একটি বড় প্রমাণ।

এনসিটিবি থেকে বলা হচ্ছে গতবার অর্থাৎ ২০২৩ সালে আমরা পরীক্ষা নিয়েছি তিন দিনে, নাম ছিলো অ্যাসেসমেন্ট উৎসব। শিক্ষার্থীরা প্রথম দিন ইনস্ট্রাকশন পেয়েছে, দ্বিতীয় দিন ডেটা প্রসেস করেছে, তৃতীয় দিন চূড়ান্ত ফলাফল দিয়েছে।

তিনটি ভাগে কাজটি করেছে। প্রতিদিন ক্লাস রুটিন অনুযায়ী সেগুলে হয়েছে। তবে, পরে আমরা জানতে পারি, একদিনে একাধিক বিষয়ের কাজ করা বেশ কঠিন হয়। তাই এখন আমরা বলেছি, একদিনে একটি বিষয় নিয়ে কাজ হবে। সেদিন আর অন্য বিষয়ে কাজ হবে না। তার মানে হচ্ছে, এটিও বিনা পরিকল্পনায় হয়েছে এবং শিক্ষার্থীদের ওপর শুধু পরীক্ষা-নিরীক্ষাই চালানো হচ্ছে।

নতুন শিক্ষাক্রমে নতুন মূল্যায়ন প্রস্তাবে শিক্ষার্থীদের একটি এক্সপেরিমেন্ট দেয়া হবে। শিক্ষার্থীরা সকাল দশটায় সেটি শুরু করবে। শেষ সময়ে এক ঘণ্টা বা বিষয় অনুযায়ী সোয়া ঘণ্টার একটি লিখিত অংশ থাকবে। বাকি সময় তারা কাজের মধ্যে যাবে। বিষয়টি আগের মতো তিন ঘণ্টার লিখিত পরীক্ষা দেয়ার মতো নয়।

আরও বলা হয়, বিদ্যালয় যেভাবে মূল্যায়ন করে, সেভাবেই করবে। পাবলিক পরীক্ষায় বাইরের মূল্যায়নকারী অর্থাৎ অন্য স্কুলের শিক্ষক থাকবেন। ২০২৩ সালে ফাইনাল পরীক্ষা যেভাবে হয়েছে, আগামীতে সেভাবেই হবে এবং অবজারভেশন চেকলিস্ট অনুযায়ী শিক্ষার্থীদের মূল্যায়ন করা হবে, তারপর তার একটি লিখিত রূপ জমা দেবে।

পাবলিক পরীক্ষা হবে অন্য কেন্দ্রে আর চতুর্থ থেকে নবম শ্রেণির এই পরীক্ষা হবে নিজ নিজ স্কুলে। প্রতিটি শিক্ষার্থীর পাঁচ ঘণ্টায় ছয়টি সেশন হবে। চার ঘণ্টা ব্যবহারিক। প্রথমে ওরিয়েন্টেশন দেয়া হবে। এই সেশনে একজন শিক্ষার্থীর দলগতভাবে কাজ করতে হবে। আবার প্রত্যেককে এককভাবে ব্যবহারিক কাজ করতে হবে। মূল্যায়নকারী বা শিক্ষকদের কাছে তাদের পারদর্শিতা দেখাতে হবে।

শেষ এক ঘণ্টা তত্ত্বীয় পরীক্ষার জন্য নির্ধারিত হবে। তত্ত্বীয় পরীক্ষার উত্তরপত্র মাধ্যমিক স্কুল সার্টিফিকেট এবং উচ্চ মাধ্যমিক সার্টিফিকেট পরীক্ষার মতো পাবলিক পরীক্ষার মূল্যায়নের জন্য সংশ্লিষ্ট বোর্ডে পাঠানো হবে। এ বিষয় দুটোও কিন্তু প্রথমে বলা হয়নি। সাংবাদিকগণ প্রশ্ন করার পর অর্থাৎ বোর্ডের কী কাজ কিংবা বোর্ড থেকে প্রশ্নপত্র তৈরি করা না হলে স্ট্যান্ডার্ড রক্ষা করা যাবে না ইত্যাদি বিষয়ে প্রশ্ন করার পর তখন কর্তৃপক্ষ বোর্ডের কাজের কথা এভাবে ব্যাখ্যা করেছে।

নতুন মূল্যায়ন পদ্ধতিতে মার্কিং (চিহ্নিত) করার নিয়ম থাকবে না। রিপোর্ট ‘ভালো’, ‘অর্জনের পথে’ এবং ‘প্রাথমিক পর্যায়’ এমন তিন ভাগে ফলাফল হবে। চতুর্থ থেকে নবম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের মিডটার্ম ও ফাইনাল পরীক্ষা হবে। এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষার্থীদের মূল্যায়ন হবে চূড়ান্ত পরীক্ষার মাধ্যমে।

খসড়া অনুযায়ী মিডটার্ম ও বার্ষিক পরীক্ষায় সামষ্টিক মূল্যায়ন হবে। ধারাবাহিক মূল্যায়ন হবে নতুন শিক্ষাক্রমের আলোকে। এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষা হবে অন্য কেন্দ্রে। আর চতুর্থ থেকে নবম শ্রেণির পরীক্ষা হবে নিজ বিদ্যালয়ে। ২০২৪ সালে জুন থেকে এ প্রক্রিয়ায় মূল্যায়ন হবে বিদ্যালয়ে। এসব উত্তর যখন সাংবাদিকগণ জিজ্ঞেস করেন, তখন শোনা যায় অর্থাৎ নির্দিষ্ট কোনো সিদ্ধান্ত কিন্তু বিদ্যালয় বা শিক্ষকগণ পাচ্ছেন না।

শিক্ষাক্রম-সংশ্লিষ্টরা এখন বলছেন, নতুন শিক্ষাক্রম অনুযায়ী এসএসসি পরীক্ষার মূল্যায়নে হাতে-কলমে কাজের পাশাপাশি লিখিত পরীক্ষাও থাকছে। তবে লিখিত পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ও উত্তর দেওয়ার ধরন মুখস্থনির্ভর হবে না। শিক্ষার্থীরা শিক্ষাক্রম অনুযায়ী যেসব অভিজ্ঞতা অর্জন করবে, সেগুলো মূলত সৃজনশীল উপায়ে লিখতে হবে।

এটি আবার নতুন কী? আমরা তো তাই বলে আসছিলাম যে, শিক্ষার্থীরা যাতে না বুঝে শুধু মুখস্থ করে পাস না করে পরীক্ষায় সেই পদ্ধতিই থাকা প্রয়োজন। আর শিক্ষাক্রম-সংশ্লিষ্টরা বলে আসছিলেন, লিখিত কোনো পরীক্ষা থাকবে না, কারণ সেটি হলে শিক্ষার্থীদের প্রকৃত মূল্যায়ন নাকি হয় না। তাঁরা বলছেন, বিভিন্ন শ্রেণিতে বছরজুড়ে শিখনকালীন মূল্যায়ন থাকবে। এর পাশাপাশি বছরে দুটি সামগ্রিক মূল্যায়ন হবে। অধিকাংশ শিক্ষক এবং বিদ্যালয় কিন্তু এখনও এই দুই মূল্যায়নের মধ্যে প্রকৃত তফাৎ বুঝতে পারছেন না।

সবশেষে বলা যায় যে, বর্তমান শিক্ষাক্রমটি আদর্শিক, অতি আদর্শিক। আমাদের বর্তমান যে শিক্ষার প্রেক্ষাপট, সেটির আলোকে এটি মানানসই তো নয়ই, বরং অবাস্তব।

চারদিকে কিশোর গ্যাংয়ের দৌরাত্ম্য। বখাটে স্কুল শিক্ষার্থী, স্কুল পালানো, স্কুল ছেড়ে দেয়া ছেলেপেলেরাই কিশোর গ্যাংয়ের নামে পুরো সমাজকে গিলে খাচ্ছে। তারা তো এই সমাজেরই বাসিন্দা। তারা চারদিকে যা দেখছে তাই শিখছে। শিক্ষকদের অবস্থান দুর্বল করতে করতে এমন একটি পর্যায়ে নিয়ে আসা হয়েছে যে, তারা এখন একটি শ্রেণিকক্ষই সামাল দিতে পারছেন না।

শিক্ষার্থীরা পড়তে চায় না, পড়তে পারে না, লিখতে চায় না, লিখতে পারে না। পড়া দিলে, কোনো কাজ করতে দিলে করতে চায় না। বিদ্যালয় ও শিক্ষক স্থানীয় রাজনৈতিক নেতাদের ভয়ে থাকেন, কারণ তাদের ইচ্ছে অনুযায়ীই স্কুল চলে। এই অবস্থায় শিক্ষার্থীরা পাস করছে, ক্লাস পার করছে, বিদ্যালয় পার করছে, মহাবিদ্যালয় পার করছে কিন্তু শিখছে না বিষয়, শিখছে না কোনো আদব-কায়দা, নিয়ম-কানুন।

এই পুরো বিশৃঙ্খল অবস্থাকে কীভাবে কিছুট নিয়মকানুনের মধ্যে, কিছুটা রাষ্ট্রীয় বাধ্যবাধ্যকতার মাধ্যে আনা যায়, সেসব নিয়ে গভীরভাবে চিন্তা করা এবং কাজ করার খুবই প্রয়োজন। এসবের কথা চিন্তা না করে বিশাল এক শিক্ষাক্রম এনে হাজির করেছি। কারা সেটি বাস্তবায়ন করবেন, কাদের ওপর বাস্তবায়ন করা হবে এবং কীভাবে করা হবে, সেসব বিষয় একটুও আমরা ভাবিনি। এসব বিষয় চিন্তা করে কিছু করা হলে শিক্ষকগণ একটি বিষয় শেখানোর জন্য যে প্রচুর অনুশীলন প্রয়োজন, সেই অনুশীলন কিছুটা হলেও করাতে পারতেন।

বর্তমান শিক্ষাক্রম এসে শিক্ষার্থীদের আরও অপার স্বাধীনতা দিলো— কিছুই করতে হবে না, কিছুই পড়তে হবে না শুধু ক্লাস ডিঙ্গাতে হবে। নিজে কিছু লিখে প্রকাশ করার দরকার নেই। কোনোকিছু পারার দরকার নেই। একজন শিক্ষক তাকে যেভাবে মূল্যায়ন করবেন, সেটিই তার আসল মূল্যায়ন।

শিক্ষাক্রমে যা যা লেখা আছে তার অধিকাংশই আদর্শিক কথা, অধিকাংশই ইউটোপিয়ান আইডিয়া।

এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষা : কয়েকটি জাদু অজানাই থেকে যাচ্ছে

এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষায় কয়েকটি জাদু অজানাই থেকে যাচ্ছে
এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষায় কয়েকটি জাদু অজানাই থেকে যাচ্ছে

গত ১৫ ফেব্রুয়ারি সারাদেশে একযোগে এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষা শুরু হয়। লিখিত পরীক্ষা শেষ হয় গত ১২ মার্চ। ১৩ মার্চ থেকে ২০ মার্চের মধ্যে অনুষ্ঠিত হয় ব্যবহারিক পরীক্ষা। বলা যায়, দু’মাসেরও কম সময়ের মধ্যে শিক্ষার্থীদের জীবনের এই গুরুত্বপূর্ণ পরীক্ষার ফল প্রকাশিত হলো ১২ মে।

প্রতি বছরের মতোই এবারও বাংলাদেশের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী প্রথা অনুযায়ী ফল প্রকাশ করেছেন। এটি আমাদের দেশের একটি আলাদা রীতি, যা গুরুত্ব বহন করে। পৃথিবীর সব দেশেই পাবলিক পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়, কিন্তু রাষ্ট্রের প্রধান নির্বাহীকে আমরা এসব বিষয়ে কোনো কথা বলতে সাধারণত দেখি না। কিন্তু, আমাদের দেশের রাষ্ট্রের প্রধান নির্বাহী এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষার ফল প্রকাশ করেন এবং ফলের সার্বিক বিষয়ে খোঁজখবর নেন, পরামর্শ দেন, অনেক বিষয় সংশ্লিষ্টদের কাছে জানতে চান।

এবার এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষা গড় পাস করেছে ৮৩ দশমিক ০৪শতাংশ। এদের মধ্যে ছাত্রদের পাসের হার ৮১ দশমিক ৫৭ শতাংশ, ছাত্রীদের পাসের হার ৮৪ দশমিক ৪৭ শতাংশ। এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষায় পরীক্ষার্থীদের মধ্যে ছেলেদের সংখ্যা কম দেখে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন প্রধানমন্ত্রী। তাদের সংখ্যা কমে যাওয়ার কারণও জানতে চেয়েছেন।

দেশে সাক্ষরতার হার বেড়েছে, শিক্ষায় অংশ নেয়া ছাত্রছাত্রীর সংখ্যাও অনেক বেড়েছে। মেয়েদের হার বেড়েছে অনেক। প্রাথমিকে এক সময় ৫৪ শতাংশ ছাত্রী যেত, এখন ৯৮ শতাংশ যাচ্ছে। এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষায় মাত্র তিনটি বোর্ডে ছাত্রের সংখ্যা একটু বেশি, অধিকাংশ জায়গায় ছাত্রীদের সংখ্যা বেশি। নারী শিক্ষার ওপর জোর দেয়ার ফল হচ্ছে এটি।

এবার ১১টি বোর্ডে এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষায় ছাত্রসংখ্যা ৯ লাখ ৯৯ হাজার ৩৬৪ জন, আর ছাত্রী সংখ্যা ১০ লাখ ৩৮ হাজার ৭৮৬ জন। পাসের হারেও মেয়েরা এগিয়ে। যারা অকৃতকার্য হয়েছে, তাদের প্রতি কোনো ধরনের নেতিবাচক আচরণ না করার জন্যও প্রধানমন্ত্রী  পরামর্শ দিয়েছেন।

মোট ১১টি শিক্ষা বোর্ডের অধীনে এ বছর ২০ লাখ ২৪ হাজার ১৯২ জন পরীক্ষার্থী এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষায় অংশ নিয়েছেন। এর মধ্যে ৯টি সাধারণ শিক্ষা বোর্ডের অধীনে পরীক্ষার্থী ছিলেন ১৬ লাখ ৬ হাজার ৮৭৯ জন। মাদরাসা শিক্ষা বোর্ডের অধীনে দাখিল পরীক্ষা দিয়েছেন মোট ২ লাখ ৪২ হাজার ৩১৪ জন। কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের অধীনে এসএসসি (ভোকেশনাল) ও দাখিল (ভোকেশনাল) পরীক্ষায় অংশ নেন ১ লাখ ২৬ হাজার ৩৭৩ জন।

গত বছর এসএসসি ও সমমান পরীক্ষায় অংশ নিয়েছিলেন মোট ২০ লাখ ৪১ হাজার ৪৫০ জন। গতবার পাসের হার ছিলো ৮০ দশমিক ৩৯ শতাংশ। তার মানে হচ্ছে, ২০২৪ সালের পাসের হার বেড়েছে। ঢাকা বোর্ডে এবার পাসের হার ৮৯ দশমিক ৩২ শতাংশ, রাজশাহী বোর্ডে ৮৯ দশমিক ২৫ শতাংশ, কুমিল্লায় ৭৯ দশমিক ২৩ শতাংশ, চট্টগ্রাম বোর্ডে ৮২ দশমিক ৮০ শতাংশ, বরিশালে ৮৯ দশমিক ১৩ শতাংশ, দিনাজপুরে ৭৮ দশমিক ৪০ শতাংশ ও ময়মনসিংহে ৮৪ দশমিক ৯৭ শতাংশ।

এবার এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষায় যশোর বোর্ডে পাসের হার ৯২ দশমিক ৩২ শতাংশ আর সর্বনিম্ন সিলেট বোর্ডে। সেখানে পাসের হার ৭৩ দশমিক ৩৫ শতাংশ অর্থাৎ সিলেট বোর্ডে ১৮.৯৭ মানে ১৯ শতাংশ শিক্ষার্থী কম পাস করেছে।

এই জাদুর অর্থ আজও জানা গেলো না। একই সিলেবাস, একই সময়ে পরীক্ষা, একই ধরনের শিক্ষকগণ পড়িয়ে থাকেন। তাহলে কী কারণে কিংবা কী কী কারণে এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষায় এক বোর্ডের ফল অন্য বোর্ড থেকে এত বেশি পার্থক্য প্রদর্শন করে? আরও মজার ব্যাপার হচ্ছে, দেখা যাবে, সবচেয়ে পিছিয়ে পড়া বোর্ডটির ফল পরবর্তী বছর হঠাৎ করে সবার উপরে চলে যায়।

আমাদের বোর্ডগুলো কি এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষার এসব বিষয় নিয়ে কোনো আলোচনা করে? ফলাফল পার্থক্যের এসব কারণ অনুসন্ধান করে জাতিকে জানানো কি উচিত নয়? তা না হলে বিষয়টি তো গুরুত্বহীন থেকে যাবে।

এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষায় মেয়েদের চেয়ে ছেলেরা পাস-ফেলে একটু পিছিয়ে থাকে। এ নিয়ে গবেষণা না থাকলেও অনুমিত কিছু কারণ বা আমাদের পর্যবেক্ষণ থেকে আমরা কারণ জানতে পারি। আরেকটি বিষয় প্রতি বছরই দেখা যায় যে, মাদরাসা বোর্ড ফলের দিক থেকে সাধারণ শিক্ষা বোর্ডগুলো থেকে এগিয়ে থাকে। এর পেছনে যৌক্তিক কোনো কারণই নেই। যাই হোক, বিষয়টি এবার সেভাবে ঘটেনি।

এবার মাদরাসা বোর্ডে পাসের হার ৭৯ দশমিক ৬৬ শতাংশ, আর জিপিএ-৫ প্রাপ্তির সংখ্যা ১৪ হাজার ২০৬ জন। কারিগরি বোর্ডে পাসের হার ৮১ দশমিক ৩৮ শতাংশ। কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের পাস-ফেল আমাদের খুব একটা স্পষ্ট মেসেজ দেয় না। এখানে বেশির ভাগই ব্যবহারিক পরীক্ষা হওয়ার কথা, কিন্তু এই ফল আমাদের কী বলে তার ব্যাখ্যা আমরা কোথাও দেখতে পাইনা। তাছাড়া, কারিগরি শিক্ষা যে পরিমাণ গুরুত্ব পাওয়ার কথা, বর্তমান অবস্থা সেটি থেকে অনেক দূরে অবস্থান করছে। 

আরেকটি বিষয় আমরা প্রতিবছরই দেখি যে, এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষায় কিছুসংখ্যক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে একজন শিক্ষার্থীও পাস করে না। গত বছর এই সংখ্যা ছিল ৪৮টি, এবার দেখলাম ৫১টি অর্থাৎ বেড়ে গেছে। প্রথমেই বলা যায়, পাস করার ক্ষেত্রে যথেষ্ট রিল্যাক্সিং অবস্থা থাকে, তারমধ্যেও এই অবস্থা!

এর মানে হচ্ছে, পুরো অকৃতকার্যের বিষয় নিয়ে ফলাফলের পর আর কোনো আলোচনা খুব একটা হয় না। আলোচনা হলে এ বিষয়টি বার বার দেখা যেত না। মিডিয়ার কল্যাণে এবং কিছু শিক্ষা সাংবাদিকদের কারণে আমরা শূন্য পাস প্রতিষ্ঠানগুলোর কিছু কারণ জানতে পারি, কিন্তু বোর্ড কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে খুব একটা যৌক্তিক ব্যাখ্যা আমরা শুনতে পাই না।

এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষার ফল প্রকাশ মানে দেশব্যাপী স্কুল-মাদরাসায় উৎসবমুখর পরিবেশ। ফল প্রকাশের দিন শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর মধ্যে শাসনের গাম্ভীর্যের বেড়াজাল ভেঙ্গে একাকার হয়ে যান সবাই, উপভোগ করেন যৌথপ্রয়াসে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া শিক্ষাকার্যক্রমের মুল্যায়ন।

শিক্ষক ভুলে যান, পাঁচ বছর পরে এই শিক্ষার্থীরা কে কোথায় থাকবে, তাদের ক’জনের সাথে যোগাযোগ থাকবে, কিন্তু সমস্ত সংকীর্ণতার উর্ধ্বে ওঠে শিক্ষকগণ আনন্দে শামিল হন তাদের প্রাণপ্রিয় শিক্ষার্থীদের সাথে। শিক্ষকের বাসায় হয়তো বাজার করার অর্থ নেই, বাসার বহু সমস্যা, কিন্তু সবকিছু ফেলে এই দিনটি তারা ঈদের চেয়েও যেন আনন্দ নিয়ে উদযাপন করেন। শিক্ষকতা জীবনে এইটুকুই তো পাওয়া!

কোন ধরনের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে সর্বোচ্চ সংখ্যক পাস, জিপিএ-৫ প্রাপ্তি ও সহপাঠক্রমিক কার্যবালীর সাথে শিক্ষার্থীদের সংশ্লিষ্টতা ও অংশগ্রহণ ইত্যাদি বিষয় বিবেচনায় নিয়ে সব ধরনের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের র‌্যাংকিং থাকা প্রয়োজন। এবং, এটি  কোনো তৃতীয় পক্ষ করলে ভাল হয়। শিক্ষা মন্ত্রণালয় কিংবা শিক্ষার সাথে সংশ্লিষ্ট সরকারি কোনো বিভাগের করা ঠিক নয়।  

সরকারি, বেসরকারি, এমপিওভুক্ত, নন-এমপিওভুক্ত নির্বিশেষে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান র‌্যাংকিং থাকা প্রয়োজন। দেশে একটি র‌্যাংকিং পদ্ধতি থাকলে আমরা সহজে বুঝতে পারতাম যে, বোর্ডগুলোর ফলাফলের সাথে র‌্যাংকিং কতোটা সাদৃশ্যপূর্ণ। তাছাড়া র‌্যাংকিং বিষয়টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানুগলোর মধ্যে একটি সুস্থ প্রতিযোগিতার সৃষ্টি করে।

শিক্ষার জরুরি অথচ উপেক্ষিত উপদানগুলো যেমন খেলাধুলা, সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড, নৈতিক শিক্ষা, সামাজিক শিক্ষা, আচার আচরণ এগুলোর কোনো প্রতিফলন এসব ফলাফলে দেখা যায় না বা বুঝা যায় না। অথচ, জীবনে চলতে, এগুতে, কাজ করতে, এগুলোর খুব প্রয়োজন।

নতুন কারিকুলামে এগুলো মূল্যায়নের বিষয় উল্লেখ আছে, কিন্তু সেখানেও খুব আশাবাদী হতে পারছি না। কারণ বিষয়গুলো সেভাবে এগুচ্ছে না আর বাস্তবের চেয়ে উচ্চাশার প্রতিফলন বেশি দেখা যাচ্ছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান র‌্যংকিং হলে এসব বিষয় চলে আসে এবং তখন বলা যায় কোন কোন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান শিক্ষার্থীদের সার্বিক শিক্ষা প্রদান করছে।

ইংরেজি ও গণিত মাধ্যমিক পর্যায়ে একটি ক্রিটিক্যাল অবস্থার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। কারণ, এ দুটি বিষয়ে একমাত্র স্বনামধন্য কিছু প্রতিষ্ঠান ছাড়া বাকিগুলোতে বিষয়ভিত্তিক শিক্ষকই নেই। শিক্ষার্থীরা স্বভাবতই এ দুটি বিষয়ের দুর্বলতা নিয়ে উচ্চ-মাধ্যমিক ও উচচশিক্ষা স্তর পার করে।

অথচ পাবলিক পরীক্ষা পাশের হারে কোনো এক জাদুর পরশে দেখা যায়, এ দুটো বিষয়ে পাশের হার আকাশছোঁয়া। এবার ঢাকা বোর্ডে ইংরেজিতে পাসের হার ৯৪ দশমিক ৫৮ শতাংশ, গণিতে ৮৮ শতাংশ। পাসের হারে এগিয়ে থাকে যশোর বোর্ড, ইংরেজিতে পাসের হার সেখানে ৯৬ শতাংশ আর গণিতে ৯৮ দশমিক ৫৫ শতাংশ। এই ফল ও আমাদের শিক্ষার্থীদের ইংরেজি ও গণিতের প্রকৃত দক্ষতা তুলে ধরছে কি না সেটি একটি প্রশ্ন।

আমাদের শিক্ষার্থীরা সৃজনশীল। তারা দেশের বাইরে গিয়ে কিংবা দেশেও বিভিন্নভাবে তাদের মেধার ও সৃজনশীলতার সাক্ষর রেখে চলেছেন। অথচ, তাদেরকে সিস্টেম্যাটিক্যালি দুর্বল মূল্যায়নের দিক দিয়ে যেতে হয় আর তাদের ফল নিয়ে তাই অনেকেই প্রশ্ন তোলেন। বিষয়টিতে নজর দেওয়া একান্তই প্রয়োজন।

শিক্ষাক্ষেত্রে বোর্ডগুলোর ভূমিকা কী দেখি? শুধু পরীক্ষার ফরম পূরণ করা আর পরীক্ষার রেজাল্ট দেওয়ার মধ্যেই তাদের অধিকাংশ সময় চলে যায়। শিক্ষার মানোন্নয়নে বোর্ড কী ধরনের ভূমিকা রাখে বা রেখে চলেছে সে বিষয়ে দৃশ্যমান কোনো পদক্ষেপ নেই।

শিক্ষা বোর্ড কি কখনও বিষয় শিক্ষক কিংবা প্রতিষ্ঠান প্রধানদের নিয়ে শিক্ষা প্রশাসন কিংবা বিষয়ভিত্তিক মানোন্নয়নের জন্য বছরে দু’একটি কার্যকর ওয়ার্কশপ কিংবা সেমিনারের আয়োজন করে যেখানে দেশের শিক্ষাবিদদের সাথে শিক্ষকদের মতবিনিময়ের ব্যবস্থা থাকে? এরকম তো খুব একটা দেখা যায় না।

বোর্ডে খাতা আনার সময় দেখতাম, বিভিন্ন পরীক্ষকদের একটি প্রশ্নের উত্তর কীভাবে লিখতে হবে, কীভাবে লিখলে কত নম্বর দেওয়া হবে এটি নিয়ে মতবিরোধ চলতে থাকত। এখনও নিশ্চয়ই আছে। ফলে, শিক্ষকগণ যার যার মত অনুযায়ী নম্বর দিয়ে থাকেন। ইউনিফর্ম কোনো নিয়ম মেনে অনেক ক্ষেত্রেই তা করা হয় না। এতে শিক্ষার্থীরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

পরীক্ষার ফল বের হলে চেয়ারম্যনাগন অনেক ধরনের ব্যাখ্যা ও আশার কথা শুনিয়ে থাকেন। এটি বাস্তবে কতোটা সম্ভব কিংবা এ ধরনের কালচার আমরা তৈরি করতে পেরেছি কি না, সেটি বিবেচনার বিষয়।