ক্যাডেটসমূহ বাংলাদেশের শিক্ষাঙ্গনে এক গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে আছে। ১৯৫৮ সালে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে ফৌজদারহাট ক্যাডেট কলেজ প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে আমাদের দেশে ক্যাডেট কলেজ শিক্ষার যাত্রা শুরু। ক্যাডেট কলেজগুলোর অভাবনীয় সাফল্য এবং সামরিক ও বেসামরিক পর্যায়ে উপযুক্ত নাগরিক ও মানবসম্পদ তৈরির ক্ষেত্রে যে অনন্য অবদান রেখেছে, তারই ফলশ্রুতিতে আজ অমাদের দেশে ১২টি কলেজ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। ১২টির মধ্যে ৯টি ছেলেদের এবং ৩টি মেয়েদের।
আমাদের দেশে শিক্ষার যে মান এবং স্কুল ও কলেজের যে পরিবেশ তাতে খুব কম অভিভাবকই সন্তানকে স্কুল কিংবা কলেজে পাঠিয়ে নিশ্চিন্ত থাকতে পারেন। ইংরেজি মাধ্যম বিদ্যালয়গুলো বড় বড় শহরে সীমাবদ্ধ আর এখানে যারা ভর্তি করান তারা সাধারণত অবস্থাপন্ন। তারপরেও তারা হিমশিম খান ইংরেজি মাধ্যমের খরচ বহন করতে। কারণ প্রতিটি বিষয়ই প্রাইভেট শিক্ষকের কাছে পড়তে হয়। বাংলা মাধ্যমে নামীদামী কয়েকটি স্কুল ও কলেজ দেশে গড়ে উঠেছে সেগুলো সবই প্রাইভেট সেক্টরে। এসব স্কুল ও কলেজে ভর্তি হওয়া মরনপণ অবস্থা। ভর্তির পরে শুরু হয় প্রাইভেট বাণিজ্য। তাছাড়া এসব স্কুল কলেজে কোচিং সেন্টারের মত শুধু বিষয় নিয়েই আলোচনা ও পড়াশুনা হয়। সহপাঠক্রমিক কোনো বিষয় তেমন একটা গুরুত্ব পায় না। যেখানে সহপাঠক্রমিক কার্যাবলী আছে তাতে সকল ছাত্রছাত্রী অংশগ্রহণ করতে পারে না। এই দিকে দিয়ে ক্যাডেট কলেজের শিক্ষা মোটামুটি আদর্শ শিক্ষা। আর তাই শিক্ষিত,চাকুরীজিবি এবং মধ্যবিত্ত শ্রেণীর অভিভাবকগন চান ছেলে ও মেয়েকে কোন ক্যাডেট কলেজে ভর্তি করাবেন। উচ্চ শিক্ষায় প্রবেশ করার পূর্ব পর্যন্ত মোটামুটি নিশ্চিন্ত। তাছাড়া স্কুলে নিয়ে যাওয়া,নিয়ে আসার ঝামেলা নেই। নিরাপত্তার বিষয়টিও মোটামুটি ভালো। কিন্তু ক্যাডেট কলেজে ভর্তি হওয়ার জন্য কিছু নিয়মকানুন রয়েছে। ক্যাডেট কলেজের সাবেক শিক্ষক হিসেবে অনেক অভিভাবকই প্রশ্ন করেন কিভাবে ভর্তি করাবেন তাদের সন্তানদের। আমি নিজেও অনেক পরিচিত কিংবা হঠাৎ পরিচয় হওয়া অনেক অভিভাবকদের অনুরোধ করি তাদের সন্তানদের ক্যাডেট কলেজে ভর্তি করাতে। এসকল অভিভাবকদের এবং ক্যাডেট কলেজে ভর্তিচ্ছু ছাত্রছাত্রীদের মোটামুটি একটি ধারণা দেয়ার জন্যই এই লেখা ।
ক্যাডেট কলেজে ভর্তি হওয়ার ক্ষেত্রে বেশ কিছু নতুন নিয়ম সংযোজন ও পরিমার্জন করা হয়েছে। প্রার্থী এবং অভিভাবকদের জন্য বিষয়গুলো ভালোভাবে জানা দরকার। আমি ক্যাডেট কলেজে থাকাকালীন কিছু বিষয় নিয়ে কর্তৃপক্ষকে অনুরোধ করেছিলাম ঐ বিষয়গুলোতে কিছু পরিবর্তন নিয়ে আসতে। বর্তমানে ব্র্যাক প্রধান কার্যালয়ে শিক্ষা কর্মসূচিতে কর্মরত আছি কিন্তু ক্যাডেট কলেজের প্রতি দুর্বলতা এবং আগ্রহ দুটোই এখনও আছে। ক্যাডেট কলেজে ভর্তিসহ বিষয়ে বেশ কিছু পরিবর্তন আনা হয়েছে। যথাযথ কর্তৃপক্ষের সাথে আলাপ করে বেশ ভালই লেগেছে।
আমরা জানি ক্যাডেট কলেজ আমাদের দেশে এক ভিন্ন ধরনের এক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। এখানে প্রতি বছর সপ্তম শ্রেণীতে ছাত্র/ছাত্রী ভর্তি করা হয়। আমাদের দেশের কোনো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সপ্তম শ্রেণী থেকে ভর্তি শুরু হয় না। জাতীয় ইংরেজি ও বাংলা সংবাদপত্রে বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে ভর্তির আবেদনপত্র আহবান করা হয়ে থাকে। সাধারণত নভেম্বর–ডিসেম্বর মাসে আবেদনপত্র বিতরন শেষে জানুয়ারি মাসে লিখিত পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়। লিখিত, মৌখিক পরীক্ষা ও ডাক্তারি পরীক্ষার ভিত্তিতে সম্মিলিত মেধাতালিকা প্রণয়ন করে চুড়ান্ত প্রার্থী নির্বাচন করা হয়। লিখিত পরীক্ষায় মোট ২০০ নম্বরের হয়। নম্বর বন্টন এভাবে– ইংরেজিতে ৮০, গণিতে ৬০, বাংলা ৪০ ও সাধারণ জ্ঞানে ২০ নম্বরের পরীক্ষা দিতে হবে ভর্তিচ্ছু ছাত্রছাত্রীদের। দেখা যাচ্ছে ইংরেজিতে সবচেয়ে বেশি নম্বরে পরীক্ষা দিতে হয় কারণ ক্যাডেট কলেজে সর্বদাই ইংরেজির উপর জোর দেয়া হতো আর বর্তমানে প্রতিটি কলেজে শিক্ষার মাধ্যম ইংরেজি (ইংরেজি ভার্শন)। সাধারণত ৬ষ্ঠ শ্রেণীর অথবা সমমানের পাঠ্যক্রম অনুসরনে প্রশ্নপত্র প্রণীত হয়। উল্লেখ্য যে ক্যাডেট কলেজসমূহে শিক্ষা মাধ্যম ইংরেজি, তবে প্রার্থী ইচেছ করলে ভর্তি পরীক্ষা বাংলা ও ইংরেজি উভয় মাধ্যমে দিতে পারবে। প্রার্থী তার আবেদনপত্রে ভর্তি পরীক্ষার মাধ্যম উল্লেখ করবে। চুড়ান্তভাবে নির্বাচিত প্রার্থীকে ক্যাডেট কলেজের চাহিদা মোতাবেক প্রয়োজনীয় সকল তথ্য ও সনদপত্রাদি সরবরাহ করতে হয়, অন্যথায় প্রার্থীর নির্বাচন বাতিল বলে গণ্য হয়।
ভর্তিইচছুক প্রার্থী নির্দিস্ট ফি পরিশোধ করে বিজ্ঞাপনে উল্লিখিত কলেজে আবেদনপত্র জমা দিবে। আবেদনকারীকে বাংলাদেশের নাগরিক হতে হবে। ভর্তি বছরের ০১ জানুয়ারি তারিখে বয়স সর্বনিম্ন ১২ বছর ও সর্বোচ্চ ১৪ বছর হতে হবে। কোনো প্রার্থী পূর্বে একবার ক্যাডেট কলেজ ভর্তি পরীক্ষার অবতীর্ণ হলে এবং ক্যাডেট কলেজে অধ্যয়নরত অবস্থায় যদি তা প্রকাশ পায়, সেক্ষেত্রে পূর্ণ ক্ষতিপূরণ আদায় সাপেক্ষে তাকে বহিস্কার করা হয় এবং প্রয়োজনে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়। অতএব অভিভাবক এবং প্রার্থী সকলের উদ্দেশ্যে বলছি কেউ যাদে দ্বিতীয়বার পরীক্ষায় অংশগ্রহন না করে। প্রতি বছর ভর্তি পরীক্ষার যাবতীয় তথ্য অত্যন্ত উন্নত ও আধুনিক পদ্ধতিতে আর্মি হেডকোয়ার্টারসে (ক্যাডেট কলেজ ব্রাঞ্চে) সংরক্ষণ করা হয়। দ্বিতীয়বার পরীক্ষায় অংশগ্রহণকারী প্রার্থীকে সহজেই সনাক্ত করার ব্যবস্থা আছে।
পূর্বে দেখা যেত একজন প্রার্থী একটিমাত্র কলেজে ভার্ত হওয়ার জন্য পছন্দ দিতে পারতো, কোনো পছন্দক্রম ছিল না। ফলে দেখা যেত, একজন প্রার্থী ঢাকার কাছাকাছি কলেজ যেমন মির্জপুর কিংবা কুমিল্লা ক্যাডেট কলেজ ভর্তির জন্য ফরম পুরণ করেছে এবং ৭৮ শতাংশ নম্বর পেয়েছে অথচ চান্স পায় নি। কারন এই দুই কলেজের প্রতিটিতে ঢাকার প্রার্থীরা বেশি ভিড় করে এবং তাদের মধ্য তীব্র প্রতিযোগিতা হয়। আর ঢাকার প্রার্থী বলে তাদের পরীক্ষাও ভালো হয়। আবার রংপুর কিংবা রাজশাহীতে দেখা যায় একজন প্রার্থী ৭৪ শতাংশ নম্বর পেয়েও সহজেই ভর্তি হতে পারতো। একই প্রশ্নপত্রে পুরো দেশে ভর্তি পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়। বর্তমান নিয়মানুযায়ী একজন প্রার্থী দুটো কলেজে তার পছন্দক্রম দিতে পারবে এবং তৃতীয় আর একটি ঘর আছে সেখানেও সে পছন্দক্রম দিতে পারবে। এই ঘর পূরণ করার অর্থ হচ্ছে কোনো প্রার্থী যদি তার বাছাইকৃত কলেজে ভর্তি হতে ব্যর্থ হয়, তাহলে কতৃপক্ষ কর্তৃক বাছাইকৃত কোনো কলেজে ভর্তি হওয়ার সুযোগ থাকবে। এটি একটি চমৎকার পদ্ধতি। কারণ একজন প্রার্থী তার পছন্দের কলেজে ভর্তি হতে না পারলে ক্যাডেট কলেজে পড়ার স্বপ্ন ভেঙ্গে যেত, এখন তা থেকে অনেকটাই আশার পথ তারা দেখবে। ভর্তির সুযোগ থেকে একেবাবে বঞ্চিত হবে না।
ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্নপত্রেও আনা হয়েছে বেশ কিছু পরিবর্তন। যেমন, পূর্বে সাধারন জ্ঞান প্রশ্নে কোনো এক অখ্যাত দেশের মুদ্রার নাম কি তা একজন প্রার্থীকে জানতে হতো। আর এই সুযোগে বিভিন্ন কোচিং সেন্টারগুলো কচি ছেলেমেয়েদের অনেক অদ্ভুত তথ্য মুখস্থ করিয়ে মাথা ভর্তি করে ফেলত, অথচ এই তথ্য জানা বা না জানা দিয়ে একজন প্রার্থীর মেধা যাচাই যেমন হয় না, তেমন এগুলো তার কলেজ জীবনেও তেমন কোন কাজে আসে না। বর্তমান পদ্ধতিতে সাধারন জ্ঞানের প্রশ্ন সাধারনত ৬ষ্ঠ শ্রেণীর সামাজিক বিজ্ঞান, ইতিহাস, ভুগোল ও বিজ্ঞান বই থেকে আসবে অর্থাৎ প্রার্থীদের অযথা হয়রানি বা আজেবাজে তথ্য নিয়ে ব্যস্ত থাকতে হবে না। সাম্প্রতিক দেশে ঘটে যাওয়া কোনো ঘটনা তাকে জানতে হবে। অন্যকোন মহাদেশে বা অখ্যাত কোনো দেশে কিছু ঘটেছে কিনা তা জানার তেমন আর প্রয়োজন নেই। পূর্ববর্তী পরীক্ষগুলোতে কোনো সিলেবাস দেয়া হতো না। প্রার্থীর মোটামুটি সাগরে পড়ে যাওয়ার মতো অবস্থা হতো। ৬ষ্ঠ, ৭ম এমনি ৮ম শ্রেণীর বই থেকেও অনেক সময় প্রশ্ন প্রণয়ন করা হতো। এখন ভর্তি ফরম নেয়ার সাথে সাথে প্রার্থীকে একটি সিলেবাস ও প্রসপেক্টাস দেয়া হয় সেখানে মোটামুটি সকল তথ্যাদি সন্নিবেশ করা থাকে।
ভর্তি পরীক্ষার প্রবেশপত্র আগে ডাকযোগে পাঠানো হতো, ফলে অনেক প্রবেশপত্র মিস হতো। প্রার্থী ও অভিভাবক অত্যন্ত টেনশনে থাকতেন। বর্তমান পদ্ধতিতে ফরম নেয়ার সাথে সাথে প্রার্থী বা অভিভাবকদের হাতে প্রবেশপত্র দিয়ে দেয়া হয়। এটি একটি সময়োপোযোগী পদক্ষেপ। বর্তমানে দেশে ১২টি ক্যাডেট কলেজে ৬০০ ক্যাডেট ভর্তি করা হয় প্রতি বছর। ৬০০ সিটের জন্য দ্বিগুণ প্রার্থী মৌখিক পরীক্ষার জন্য রাখা হয়। ভর্তির পর ৭ম এবং ৮ম শ্রেণীকে ফাউন্ডেশন লেভেল ধরা হয়। এই ফাউন্ডেশন লেভেলে কলেজের সমস্ত কর্মকাণ্ড যেগুলো তাদের কাছে নতুন সেগুলোর পরিচয় করিয়ে দেয়া হয় এবং ইংরেজির ভিত শক্ত করা হয়। উল্লেখ্য ক্যাডেট কলেজের হাউসে (যেখানে অবস্থান করে) কোনো বাংলা পত্রিকা দেয়া হয় না, সবগুলো ইংরেজি পত্রিকা দেয়া হয়। বাধ্য হয়েই তাদের ইংরেজি চর্চা করতে হয়। এই নিয়মটিও আগে ছিল না।
কেউ কেউ ভর্তি প্রক্রিয়ার যথার্থতা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। একদল সুচতুর, বিচক্ষণ এবং অভিজ্ঞ শিক্ষকমণ্ডলীর সমন্বয়ে প্রশ্নপত্র তৈরির জন্য বোর্ড গঠন করা হয়। তারা প্রশ্নপত্র তৈরি করেন। একই প্রশ্নপত্রে সকল কলেজের পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়। পরীক্ষা শেষে পরীক্ষার খাতা কোডিং করা হয় যাতে পরীক্ষকগণ বুঝতে না পারেন কার খাতা। খাতায় কোনো প্রার্থীর নাম কিংবা রোল নম্বর থাকে না। এক কলেজের শিক্ষকগণ অন্য কলেজের খাতা পরীক্ষণ করে থাকেন। তারপর মৌখিক পরীক্ষা গ্রহণ করার সময় বোর্ডের চেয়ারম্যান (কোনো এক কলেজের অধ্যক্ষ) বোর্ড শুরু হওয়ার এক ঘণ্টা পূর্বেও জানেন না উনি কোন বোর্ডে পরীক্ষা নিতে যাচ্ছেন। কেউ যদি বোর্ড সদস্যদের কিংবা বোর্ড চেয়ারম্যানকে প্রভাবিত করতে চান তাহলে তাকে ১২ জন চেয়ারম্যানের সাথেই কথা বলতে হবে। বাস্তবে তা সম্ভব নয়। আর তাই বলা যায় ক্যাডেট কলেজের ভর্তি পরীক্ষায় যথেস্ট স্বচ্ছতা বজায় রাখা হয়। এ নিয়ে কারুর মনে কোনো সংশয় বা প্রশ্ন থাকার কথা নয় ।
লেখক পরিচিতি
মাছুম বিল্লাহ বাংলাদেশে ইংলিশ টিচার্স অ্যাসেসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ইট্যাব)-এর সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। তিনি পূর্বে ক্যাডেট কলেজ ও রাজউক কলেজের শিক্ষক হিসেবে কাজ করেছেন। কাজ করেছেন ব্র্যাকের শিক্ষা কর্মসূচিতে বিশেষজ্ঞ হিসেবে। তিনি ভাব বাংলাদেশের কান্ট্রি ডিরেক্টর হিসেবেও কর্মরত রয়েছেন। তিনি নিয়মিত শিক্ষাবিষয়ে নানা প্রবন্ধ লিখছেন।