যৌথশিক্ষাকে ফ্রান্সিসকো গার্দিয়া ফেরার খুবই গুরুত্বপূর্ণ দর্শন হিসেবে মনে করতেন। কারণ তাঁর মতে, “নর ও নারী মানবিক সত্ত্বা হিসেবে পরস্পরের পরিপূরক”। তিনি প্রাকৃতিক বিজ্ঞান, দর্শন ও ইতিহাসের আলোকে বিষয়টি ব্যাখ্যা করতে ভালোবাসতেন যেখানে এই যুথবদ্ধতা না থাকলে কী ধরনের বিপর্যয় ঘটতে পারে সে সম্পর্কে সচেতনতাগুলো তুলে ধরতেন। তিনি একই সাথে মনোবিজ্ঞানী ও সমাজবিজ্ঞানীদের দৃষ্টিভঙ্গি বিশ্লেষণ করেও একই ধারণায় উপনীত হয়েছিলেন। তবে বিভিন্ন ধরনের ব্যাখ্যার সীমাবদ্ধতাগুলো সম্পর্কেও তিনি ওয়াকিবহাল থাকায় সেগুলোকে পাশ কাটিয়ে যেটুকু তাঁর প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থার কাজে লাগবে, সেগুলোর প্রতিই মূল গুরুত্বারোপ করেছিলেন। অবশ্যই সব ধরনের ব্যাখ্যা তিনি অভিভাবকদের সামনে তুলে ধরতেন না, কেবল যেগুলো মানুষ হিসেবে তাঁদের সন্তানদের কাজে লাগবে, সেগুলোর ওপর জোর দিতেন বেশি। কৌশলটি আধুনিক বিদ্যালয়কে সফল হওয়ার পেছনে অনেক কাজে লেগেছে।
যৌথশিক্ষা-সম্পর্কিত তাঁর ধারণা শুধু জেন্ডারেই সীমাবদ্ধ থাকেনি; তিনি সেটির পরিধিকে বিশ্লেষণ করেছেন সামাজিক শ্রেণির (social class)-এর আওতায়ও। যেহেতু সমাজে একাধিক শ্রেণি বিরাজমান, তাই বিভিন্ন শ্রেণির শিশুরাও একসঙ্গে শিক্ষাগ্রহণ করবে—সে ভাবনা তাঁর শিক্ষাদর্শনে নিহিত ছিল। এদিক দিয়ে তৎকালীন নৈরাজ্যবাদীদের চিন্তাভাবনার সঙ্গে তার কিছুটা অমিল পাওয়া যায়। নৈরাজ্যবাদীরা যেখানে আমূল পরিবর্তনের বিষয়টি নিয়ে উচ্চকিত ছিল, সেখানে তাঁর সুর কিছুটা নরম বলে দেখা যায়।
বিশেষত ফ্রান্সিসকো গার্দিয়া ফেরার যখন মনে করেন, মানুষ যতোদিন না পর্যন্ত স্বাধীনতার স্বাদ পুরোপুরি উপভোগ করতে পারছে, ততোদিন বঞ্চিত ও দলিতদের তাদের অধিকার আদায়ের বিষয়ে উচ্চকিত হওয়ার প্রয়োজন আছে—তখন একই সঙ্গে প্রশ্ন জাগে, একসঙ্গে পারস্পরিক সহমর্মিত আদায়ের মাধ্যমে বিপ্লবের মাধ্যমে অধিকার আদায়ের সুযোগ কি তৈরি হয় আসলেই? তিনি যদিও তাঁর বিদ্যালয়ে মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্তদের জন্য তৈরি করেছিলেন, কিন্তু উচ্চবিত্তদেরও সেখানে প্রবেশাধিকার ছিল। প্রশ্ন হলো—তিনটি ভিন্ন ধরনের বিত্তের মানুষকে একসঙ্গে রেখে সেখানে তিনি কোন ধরনের শিক্ষাপ্রদান করবেন? যে নৈরাজ্যবাদীদের সংস্পর্শের কারণে তাঁকে প্রাণ দিতে হলো, সেই আদর্শের সঙ্গে তাঁর বিদ্যালয়চর্চার প্রতিফলন দেখা যায় কি?
যাই হোক, এসব বিতর্ককে পাশে রেখেও যদি বলা হয়—যে সহাবস্থান ফ্রান্সিসকো গার্দিয়া ফেরার তৈরি করতে চেয়েছিলেন বিভিন্ন সামাজিক শ্রেণির মধ্যে, সেটি কিন্তু জনপ্রিয় হয়েছিল মধ্যবিত্ত মহলে। জনপ্রিয় হওয়ার বড় কারণ হচ্ছে, সবাইকে নিয়ে একসঙ্গে চলার একটি বোধ তিনি তৈরি করতে পেরেছিলেন যা তখন সহজে দৃশ্যমান ছিল না। আগেই উল্লেখ করা হয়েছে, এসব ক্ষেত্রে তিনি কিছুটা কৌশল অবলম্বন করতেন; ফলে পিতামাতাদেরকে পরিবর্তিত পরিস্থিতির সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেয়ার ক্ষেত্রে তিনি কুশলতার পরিচয় দেন।
ফ্রান্সিসকো গার্দিয়া ফেরার কিছু সংস্কারমূলক কাজের মাধ্যমে বিদ্যালয়ের লেখাপড়ার পরিবেশকে উন্নত করে তোলেন যা উচ্চ-মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্তদেরকে তাঁর বিদ্যালয়ের প্রতি যেমন আকৃষ্ট করে, তেমনি নিম্নবিত্তরাও তুলনামূলক ভালো পরিবেশ পেয়ে ভিন্নার্থে কিন্তু একই দিকে আকৃষ্ট হয়। এগুলোর একটি হচ্ছে বিদ্যালয়ের স্বাস্থ্যবিধি-সংক্রান্ত চর্চা (hygiene)।
এগুলোর পাশাপাশি ফ্রান্সিসকো গার্দিয়া ফেরার কিছু সংস্কারমূলক কাজের মাধ্যমে বিদ্যালয়ের লেখাপড়ার পরিবেশকে উন্নত করে তোলেন যা উচ্চ-মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্তদেরকে তাঁর বিদ্যালয়ের প্রতি যেমন আকৃষ্ট করে, তেমনি নিম্নবিত্তরাও তুলনামূলক ভালো পরিবেশ পেয়ে ভিন্নার্থে কিন্তু একই দিকে আকৃষ্ট হয়। এগুলোর একটি হচ্ছে বিদ্যালয়ের স্বাস্থ্যবিধি-সংক্রান্ত চর্চা (hygiene)। এ-ধরনের চর্চার আয়োজন আমাদের বিদ্যালয়গুলোতে সাম্প্রতিক সময়ে দেখতে পেলেও ফেরার শুরু করেছিলেন আজ থেকে একশ বছরেরও বেশি সময় আগে। তিনি সচেতনভাবেই পরিচ্ছন্নতাকে গুরুত্ব দিতেন, সৌন্দর্যের অন্যতম ক্ষেত্র হিসেবে বিবেচনা করতেন।
অন্যদিকে অপরিচ্ছন্নতাকে তিনি কুৎসিত অবস্থার নির্দশন হিসেবেই মনে করতেন। তিনি বিদ্যালয়ের পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা নিয়ে যেমন উচ্চকিত ছিলেন, তেমনি শিশুদের ব্যক্তিগত যত্নের প্রতিও গুরুত্ব দিতেন। সন্দেহ নেই, তৎকালীন বিদ্যালয়-ব্যবস্থায় যেমন কর্মকাণ্ড প্রচলিত ছিল, সেগুলোতে তিনি ভিন্নমাত্রা আনতে পেরেছিলেন। এগুলো যে তাঁর মস্তিষ্কজাত তা নয়, কিন্তু বিদ্যালয়-ব্যবস্থায় এসব বিষয়কেও যে গুরুত্ব দিতে হয়, তা তিনিই প্রথম স্পেনের বিদ্যালয়ে প্রয়োগ করতে পেরেছিলেন।
একটি বিদ্যালয়-ব্যবস্থাকে যে কয়টি বিষয় সাফল্যের দিকে নিয়ে যেতে পারে, তার অন্যতম হচ্ছে শিক্ষক। ফ্রান্সিসকো গার্দিয়া ফেরার স্বীকার করেন, যথাযথ শিক্ষক তৈরি করতে পারা ও শিক্ষককে দিয়ে স্বাধীনচেতা শিক্ষাপ্রদানের কাজটি যথাযথভাবে করানো অন্যতম কঠিন বিষয়। বিশেষ করে এমন এক সময়ে যখন স্পেনে শিক্ষকতা পেশা মোটেই আকর্ষণীয় কিছু ছিল না; বরং আমরা আজকে শিক্ষকদেরকে যে কঠিন বাস্তবতার মুখোমুখি দেখি, শিক্ষকতা তখনও তেমনই ছিল। “তিনি একজন শিক্ষকের তুলনায় ক্ষুধার্ত” জনপ্রিয় প্রবাদকে বাস্তবতার মুখোমুখি হতে হয়েছে স্পেনের শিক্ষকদের এবং এরকম সময়ে ফেরার যে ধরনের শিক্ষক চেয়েছেন, তা পাওয়া মোটেই সহজ কাজ ছিল না। তবে তিনি তাঁর মতো করে একটি কৌশল তৈরি করতে পেরেছিলেন যেখানে তিনি অভিজ্ঞ শিক্ষকদের দ্বারা তরুণ শিক্ষকদের তৈরি করতে পেরেছিলেন।
যারা বিদ্যালয় ব্যবস্থা বদলাতে চায় তারা সেটা দুভাবে করতে পারে। এক, প্রচলিত বিদ্যালয় ব্যবস্থাকে সংস্কারের মাধ্যমে তারা সেটিকে বদলাতে পারে এবং দুই, নতুন বিদ্যালয় বা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান তৈরি করে সেখানে নতুন নতনু আইডিয়ার বাস্তবায়ন করতে পারে। প্রথমটির অনেক সুবিধা আছে। সবচেয়ে বড় সুবিধা হলো সময় নিয়ে প্রচলিত পদ্ধতিতে আঘাত না করেই কাজটি করা যায়; কিন্তু দ্বিতীয়টি করতে গেলে সমাজের ভেতর থেকেই বাধা আসার প্রবল সম্ভাবনা থাকে।
ফ্রান্সিসকো গার্দিয়া ফেরার কী কৌশলে কাজ করেছিলেন? তিনি ভালোভাবেই জানতেন, বড় আঘাতেই সব দূর করা যায় না, ফলে, যেটি আগেই বলা হয়েছে, তিনি কিছু কিছু ক্ষেত্রে কৌশলের আশ্রয় নিয়েছিলেন। এক্ষেত্রেও তিনি আধুনিক বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করলেও সেখানে মূলত তিনি বিদ্যালয় সংস্কারের নানা কৌশল অবলম্বন করেছিলেন। বিশেষত বিদ্যালয় যেখানে পরিচালিত হয় সমাজের অন্তর্নিহিত দর্শন, চালিকাশক্তি এবং অন্যান্য বলের দ্বারা। যে পরিবেশ তিনি বিদ্যালয়ে স্থাপন করতে চেয়েছিলেন, সেটিই শেষ পর্যন্ত বাস্তবায়িত হয় কিনা তা নির্ধারণ ও নির্ণয় করা ছিল ফেরারের অন্যতম লক্ষ্য।
আমাদের লেখাপড়া সাধারণত অসাম্যে ভরা। আলাদা করা হয় ছেলেদের আর মেয়েদের। যৌথশিক্ষাকার্যক্রম থাকলেও ছেলে ও মেয়েদের আলাদাভাবে বসানো হয়। দিনে দিনে এই জেন্ডার বৈষম্য যেন বাড়ছেই। অন্যদিকে ধনী-গরীবের ব্যবধান তো বিদিত। এ অবস্থায় চিরন্তন! অন্তত ফেরারের যুগেও বিদ্যমান ছিল। তাই তিনি ভাবলেন এমন এক বিদ্যালয়ের কথা যেখানে ছেলে ও মেয়েরা একসঙ্গে পড়বে, পড়বে ধনী ও গরীবের সন্তান। এটুকুতে কিছুটা অসাম্য হয়তো থাকবে কিন্তু নতুন অসাম্য তিনি তৈরি করতে চান না।
এরই পদক্ষেপ হিসেবে আধুনিক বিদ্যালয়ে একদিকে যেমন কোনোধরনের পুরষ্কারের ব্যবস্থা থাকবে না, তেমনি থাকবে না শাস্তির ব্যবস্থাও। পুরষ্কার ও শাস্তি—উভয়েই শিক্ষার্থীদের পৃথক করে ফেলে। আর একইভাবে তাদেরকে পৃথক করে পরীক্ষা ব্যবস্থাও। পরীক্ষাব্যবস্থায় কাউকে ভালো বলে চিহ্নিত করা হয়, কেউ হয়ে যায় ব্যর্থ; কাউকে করা হয় চরম সুখী, কাউকে বা অসুখী। বলা যেতে পারে, এই ব্যবস্থা শিশুদের স্বর্গরাজ্যের লেখাপড়ার মতো!
অবশ্য ফেরারের পক্ষে ব্যবস্থাটি চালু করা সম্ভব হয়েছে দুটো বিশেষ কারণে। এক, তাঁর প্রতিষ্ঠিত বিদ্যালয়ে কোনো বিশেষায়িত বিদ্যালয়ের মতো ডিগ্রি বা ডিপ্লোমা দেয়া হতো না। দুই, অন্য বিদ্যালয়গুলোর মতো আধুনিক বিদ্যালয় শিশুদের চাকুরি বা এরকম কোনো কাজের জন্য তৈরি করা হতো না। ফলে ফ্রান্সিসকো গার্দিয়া ফেরার যেভাবে আধুনিক বিদ্যালয়ের এ-ধারণাটি প্রতিষ্ঠাটি করতে পেরেছিলেন, সেটি মূলধারার বিদ্যালয়ে কতোটুকু কার্যকর হতো তা নিয়ে প্রশ্ন আছে। বিশেষত এই ফেরারই যখন নানা সময়ে অভিভাবকদের কাছ থেকে তাদের সন্তান পড়ালেখা না করলে শাস্তিপ্রদানের কথা বলতেন কিংবা আধুনিক বিদ্যালয়ের অনেক শিক্ষকই যখন শিশুদের প্রশংসা করার মতো বিষয়গুলো প্রয়োজনীয় বলে উল্লেখ করতেন, তখন ফেরার নিশ্চয়ই কিছুটা হলেও প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হতেন।
মনোবিজ্ঞানীরা হামেশাই শিশুদের উৎসাহ প্রদানের কথা বলে থাকেন আর উৎসাহ প্রদানের একটি বড় উপাদান হচ্ছে সাফল্যের জন্য পুরষ্কৃত করা। ফেরারের কার্যক্রম মনোবিজ্ঞানের বিপরীতে যায়। তিনি যে চিন্তা থেকেই আধুনিক বিদ্যালয়ে এই ধারণাটি প্রতিষ্ঠিত করুন না কেন, আধুনিক যুগের ক্ষেত্রে তা কি মানানসই হতো? আধুনিক যুগ কি আধুনিক বিদ্যালয়ের এ ধারণাটি গ্রহণ করতো? মনে হয় না। তাছাড়া প্রতিযোগিতামূলক সময়ে এবং বিশেষ করে জনবহুল শ্রেণিকক্ষে পুরষ্কার ও শাস্তিপ্রদান প্রচলিত চর্চা; সেখানে ফেরার ব্রাত্য হতেন কি?
একটি বিদ্যালয়ের চরিত্র কেমন তা মুহূর্তের মধ্যে বলা সম্ভব যদি বিদ্যালয় একটি গ্রন্থাগার থাকে এবং সেখানে কিছু বই থাকে। ওই বইগুলো দেখেই বলা যেতে পারে বিদ্যালয়-পরিচালনাকারীরা কোন মানসিকতার এবং তাঁরা তাঁদের শিক্ষার্থীদের কীভাবে গড়ে তুলতে চান। ফ্রান্সিসকো গার্দিয়া ফেরার ঠিক এই জায়গাটিতেও গুরুত্ব দিয়েছিলেন। বিদ্যালয় গড়ে তোলার প্রাক্কালে শিশুদের কী বই পড়তে দেয়া হবে তা নিয়ে তিনি আলোচনা করেছিলেন—যাঁকে তার যোগ্য মনে হয়েছিল, তাঁদের সঙ্গে। তিনি যে স্বাধীনতায় বিশ্বাসী ছিলেন, সেই স্বাধীনতার আলোকে বই বাছাই থেকে শুরু করে আধুনিক বিদ্যালয়ের যে দর্শন তিনি ব্যক্ত করেছিলেন, সে দর্শন প্রতিফলিত করতে চেয়েছিলেন তাঁর লাইব্রেরিতে। আধুনিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা এক ধরনের বইতে আবদ্ধ ছিল না, অন্তত ফেরারের কথায়। যে বই শিক্ষার্থীদের যুক্তিবুদ্ধিতে বেড়ে তুলবে, যেখানে শিক্ষার্থীরা বেড়ে উঠবে স্বাধীনভাবে বেঁচে থাকার প্রয়াস নিয়ে, সে-সব একাধিক বই রাখার যুক্তি ছিল তাঁর।
ফ্রান্সিসকো গার্দিয়া ফেরার শিক্ষা নিয়ে বিপ্লব করতে চাননি, একদিনে সব কিছু বদলে ফেলতে চাননি; কারণ তিনি জানতেন তাঁর যুক্তিবাদী ও স্বাধীনচেতা শিক্ষাকে স্থায়ী করতে গেলে আপাত বড় আঘাত যেমন সফল হতে পারে, তেমনি ব্যর্থও হতে পারে। যে কারণে, নানাক্ষেত্রেই তিনি কৌশলের আশ্রয় নিয়েছেন এবং সফলও হয়েছেন।
মূলত উপরের বিষয়গুলো নিয়েই ফেরারের The Origin and Ideals of the Modern School বইটি লেখা। বইটি পড়তে হবে তৎকালীন সমাজ ও রাষ্ট্রব্যবস্থার কথা মাথায় রেখে এবং ফেরারের দর্শনকে বিবেচনা করতে হবে সে সময়কার শিক্ষার দর্শনকে বিবেচনায় নিয়ে। বর্তমানের সঙ্গে তুলনা করলে ফেরারকে কিছু কিছু ক্ষেত্রে রক্ষণশীলও মনে হতে পারে, কিন্তু এও বিবেচনায় নেয়া প্রয়োজন, যে বিষয়গুলো তখন একেবারেই অনালোচিত ছিল, যেমন, বিদ্যালয়ে স্বাস্থ্যবিধি, ফেরার কিন্তু সেই সময়েই সেগুলো নিয়ে কাজ করেছিলেন, তাঁর নিজস্ব চিন্তাকে প্রকাশ করেছিলেন এবং বিদ্যালয়ে সেগুলোর প্রয়োগ ঘটিয়েছিলেন।
কোনো সন্দেহ নেই, ফ্রান্সিসকো গার্দিয়া ফেরার যদি বেঁচে থাকতেন, আধুনিক বিদ্যালয়ের আন্দোলন আরও দ্রুতগতি লাভ করতো এবং যেহেতু অপরাপর সমসাময়িক মনীষীরা ফেরারে চিন্তাকে গ্রহণ করেছিলেন, ফেরারও তাঁদের সংস্পর্শে আধুনিক বিদ্যালয়কে প্রতিনিয়তই আপগ্রেডেশন প্রক্রিয়ার মধ্যে রাখতেন। এদিক দিয়ে নিশ্চিতভাবেই বলা যায় যে, নতুন কিছু গ্রহণ করতে ফেরার কখনোই পিছপা হননি, বুলেটিনে প্রকাশিত ফেরারের বিভিন্ন বক্তব্য থেকেই এর প্রমাণ পাওয়া যায়। তবে তাঁর যে পিছুটানগুলো ছিল, তা মূলত বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে—যা রক্ষণশীল সমাজের একটি বড় বৈশিষ্ট্য।
ফ্রান্সিসকো গার্দিয়া ফেরার শিক্ষা নিয়ে বিপ্লব করতে চাননি, একদিনে সব কিছু বদলে ফেলতে চাননি; কারণ তিনি জানতেন তাঁর যুক্তিবাদী ও স্বাধীনচেতা শিক্ষাকে স্থায়ী করতে গেলে আপাত বড় আঘাত যেমন সফল হতে পারে, তেমনি ব্যর্থও হতে পারে। যে কারণে, নানাক্ষেত্রেই তিনি কৌশলের আশ্রয় নিয়েছেন এবং সফলও হয়েছেন। ফেরারের এই সফলতাই কিন্তু অন্য শিক্ষাচিন্তুককে আগ্রহী করেছে ফেরারের শিক্ষাদর্শনের প্রতি, আধুনিক বিদ্যালয়ের প্রতি। ফেরারের অকালমৃত্যু এবং অযৌক্তিক-মৃত্যু আধুনিক বিদ্যালয়ের চর্চাকে বাধাগ্রস্ত করতে পারলেও এর ধারণাটিকে রুখতে পারেনি। (সমাপ্ত)
লেখক পরিচিতি
গৌতম রায় রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটে সহযোগী অধ্যাপক হিসেবে কর্মরত রয়েছেন।