আলোচ্য বিষয়সমূহ
ভালো শিক্ষক ছাড়া ভালো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান অবাস্তব এবং অসম্ভব। এই কথাটা আমরা বুঝিনা কেনো?
“প্রতিভার ঔদ্ধত্যই আমার বেশি গ্রহণীয় মনে হয়। কারণ আত্মপ্রত্যয়ী আত্মমর্যাদাসম্পন্ন না হলে কেউ উদ্ধত হতে পারে না। উদ্ধত মানুষ সহজে চরিত্রহীন হতে পারে না। কৃত্রিম বিনয়ে অনেকেই বিনীত। বিনীত মানুষেরা সুবিধাবাদী হয়।” – ড. আহমদ শরীফ
শিক্ষকদের শিক্ষক
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ছিলেন সত্যেন্দ্রনাথ বোস, ছিলেন অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাক যাকে ‘শিক্ষকদের শিক্ষক’ হিসেবে অভিহিত করা হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একসময়কার শিক্ষক ছিলেন অধ্যাপক ড. কাজী মোতাহার হোসেন, শিক্ষক ছিলেন ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, ছিলেন ড. হুমায়ুন আজাদ, সরদার ফজলুল করিম, ড. সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী (বর্তমানে অবসরপ্রাপ্ত)!
এমন আরও অনেক নাম বলা যাবে। বর্তমানের সাথে অতীতের এই শিক্ষকদের মান একটু মিলিয়ে নিন। এইখানেই শেষ নয়। আমি তো আরও ১০ বছর পরের কথা ভাবছি। গোটা বিশ্ববিদ্যালয় প্রায় ভরে গেছে সুবিধাবাদী মানুষ দিয়ে এবং এই চিত্র যেন পুরো রাষ্ট্রেরই প্রতিফলন।
আমাদের নিয়োগ পদ্ধতি যতোদিন না যুগোপযোগী হবেম ততোদিন এই ধ্বস নামা থেকে রক্ষা নেই। কিন্তু ইউজিসি যে নিয়োগ পদ্ধতি উদ্ভাবন করেছে, সেটি চালু হলে ধ্বস নামা আরও ত্বরান্বিত হবে।
শিক্ষক নিয়োগ পদ্ধতি
বাংলাদেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর উন্নতির পথে সবচেয়ে বড় বাধা শিক্ষকদের নির্বাচন ব্যবস্থা। নির্বাচন থাকায় আমরা শিক্ষকদের শিক্ষক হিসাবে না দেখে ভোটার হিসেবে দেখি। কেউ অন্যায় করলেও ভোট বিবেচনায় মাপ পেয়ে যায়; আবার বিপরীত পারের হলে বিপরীতটাও ঘটে।
সারা পৃথিবীর বিশ্ববিদ্যালয়গুলো জ্ঞানে-বিজ্ঞানে তরতর করে এগিয়ে যাচ্ছে, আর আমরা কেবল পিছিয়েই যাচ্ছি। শিক্ষক নিয়োগের কমিটি এমনভাবে করা হয় যাতে দলীয় ভোটার নিয়োগ দিতে অসুবিধা না হয়।
একটি বিশ্ববিদ্যালয় কেমন ভালো তা নির্ভর করে তার শিক্ষকদের মান কেমন। মানসম্পন্ন শিক্ষক নিয়োগ দিতে চাইলে আমাদের বর্তমান নিয়োগ পদ্ধতি ভেঙে দিয়ে এটিকে যুগোপযোগী করতে হবে। এর জন্য আমাদের গবেষণা করে পদ্ধতি বের করার প্রয়োজন নেই। কাজটি বিশ্বের ভালো ভালো বিশ্ববিদ্যালয় অনেক আগেই করে প্রয়োগ করে এসব পদ্ধতির সফলতাও সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হয়েছে।
শিক্ষকের মানকে যদি বিশ্ববিদ্যালয়ের মানের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হিসাবে মানি, তাহলে কেবল এর নিয়োগ পদ্ধতিই নয়, প্রমোশন পদ্ধতিও অনেক কঠিন করতে হবে। এসব পদ্ধতি যতো কঠিন হবে, আমরা শুধু ভালো মানের শিক্ষকই পাবো না, সমাজে শিক্ষকদের সম্মানও বৃদ্ধি পাবে। এখন এমন শিক্ষকও নিয়োগ পেয়ে যাচ্ছেন যে, বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াকালীন স্বপ্নেও কখনো কল্পনা করেনি একদিন তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হবেন। কিন্তু রাজনীতির সঠিক চেইনটা ধরতে পেরে ঠিকই শিক্ষক বনে যাচ্ছেন। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় বলে কোথাও কোনো জবাবদিহি নেই।
শিক্ষক ও শিক্ষার মান
কিছুদিন আগে পৃথিবীর কয়েকটি সেরা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসিদের প্রোফাইল দেখছিলাম। আশ্চর্য লাগে যে, এমনকি কেমব্রিজ বা অক্সফোর্ডের মতো বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসিরাও এমআইটি, হার্ভার্ড কিংবা UCLA থেকে পড়া। সিঙ্গাপুরের মন্ত্রী প্রধানমন্ত্রীদের অধিকাংশই এমআইটি, হার্ভার্ডে লেখাপড়া করা। তাহলে এমআইটি, হার্ভার্ড পৃথিবীসেরা হওয়াতে সারাবিশ্বে দক্ষ মানুষ তৈরি করে দিচ্ছে।
বাংলাদেশে যদি কয়েকটি সত্যিকারের বিশ্বমানের বিশ্ববিদ্যালয় থাকতো, তাহলে দেশের সর্বক্ষেত্রে এর প্রভাব পড়তো। ভালো বিশ্ববিদ্যালয় না থাকার প্রভাব তো আমরা দেখতেই পারছি। আমরা অশিক্ষিত হওয়ার কারণেই দেশের যানজট নিরসন যে কতো গুরুত্বপূর্ণ সেটি অনুধাবনও করতে পারছি না, আবার সমাধানও করতে পারছি না। সবই ভালোমানের শিক্ষার অভাবের পরিচায়ক। ভালোমানের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থাকলে ব্রেইন ড্রেন থেকে রক্ষা পেতাম।
অধ্যাপক মেসবাহউদ্দিন আহমেদ বলেছেন, “আমাদের দেশের উচ্চশিক্ষার মান দিনকে দিন সার্টিফিকেট মূল্যায়নে পিছিয়ে পরছে। এর মূল কারণ হলো গবেষণাহীন, সেকেলে শিক্ষা, অগভীর ও অগোছালো শিক্ষা পদ্ধতি। শৃঙ্খলা ও এর মানোন্ননে যথাযথ পদক্ষেপ নেয়া দরকার।” উচ্চশিক্ষার মানের দিক থেকে বিশ্বের ১৩৬টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ৮৪তম। এক্ষেত্রে আমরা পাকিস্তান ও নেপাল থেকেও পিছিয়ে। অথচ ভাব দেখানোর ক্ষেত্রে আমাদের অন্ত নাই।
একটি বিশ্ববিদ্যালয় কেমন ভালো তা নির্ভর করে তার শিক্ষকদের মান কেমন। মানসম্পন্ন শিক্ষক নিয়োগ দিতে চাইলে আমাদের বর্তমান নিয়োগ পদ্ধতি ভেঙে দিয়ে এটিকে যুগোপযোগী করতে হবে। এর জন্য আমাদের গবেষণা করে পদ্ধতি বের করার প্রয়োজন নেই। কাজটি বিশ্বের ভালো ভালো বিশ্ববিদ্যালয় অনেক আগেই করে প্রয়োগ করে এসব পদ্ধতির সফলতাও সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হয়েছে।
পাকিস্তান নেপাল থেকে আমাদের কি বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা কম? মোটেও না। ওই দুই দেশ থেকে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা অনেক অনেক বেশি। সমস্যা মানে। আর সমস্যা হলো মান উন্নয়নে কোনো উদ্যোগ না থাকা।
উচ্চশিক্ষায় জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন কলেজগুলোতে আসন সংখ্যা প্রায় সাড়ে ছয় লাখের সামান্য বেশি। পাবলিক ও সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে আসন রয়েছে ৫৩ হাজার ২শটি প্রায়। আর প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে রয়েছে প্রায় লাখ ২৭ হাজার। তাছাড়া প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে বেশকিছু আসন রয়েছে। এতো ছাত্রছাত্রীকে উচ্চশিক্ষা দেওয়ার মতো মানসম্পন্ন শিক্ষক কি এই দেশে যথেষ্ট আছে?
দেশের প্রায় ৯০ ভাগ কলেজে অনার্স-মাস্টার্স পড়ানো হয়। প্রশ্ন হলো, অনার্স-মাস্টার্স পড়ানোর মতো যোগ্য শিক্ষক কি কলেজে আছে বা তাদের উচ্চশিক্ষার জন্য স্কলারশিপ দিয়ে যোগ্য করানোর কোনো উদ্যোগ কি আছে? কিন্তু আমরা তো সার্টিফিকেট বিলিয়েই যাচ্ছি।
ভাইস চ্যান্সেলরদের প্রোফাইল
এম ওমর এজাজ রহমান হলেন ইন্ডিপেন্ডেন্ট ইউনিভার্সিটির ভাইস চ্যান্সেলর। ইন্ডিপেন্ডেন্ট ইউনিভার্সিটিতে যোগ দেওয়ার আগে তিনি হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের Epidemiology and Demography বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ছিলেন। তিনি পড়াশুনা করেছেন যুক্তরাষ্ট্রের হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয় ও নর্থওয়েস্টার্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে। পরবর্তীতে হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে Epidemiology-তে D.Sc. ডিগ্রি লাভ করেন।
কিছুদিন আগে ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভাইস চ্যান্সেলর হিসাবে যোগ দেন অধ্যাপক ভিনসেন্ট চ্যাং। ব্র্যাক ইউনিভার্সিটিতে যোগদানের আগে তিনি চীনের শেনঝেনে অবস্থিত দ্য চায়নিজ ইউনিভার্সিটি অব হংকংয়ে প্র্যাকটিসেজ অব ম্যানেজমেন্ট ইকোনমিকস বিভাগে অধ্যাপক এবং ইনস্টিটিউশনাল ডেভেলপমেন্ট বিভাগের প্রধান ছিলেন। এর আগে তিনি ওমানের মাসকটে ইউনিভার্সিটি অব বিজনেস টেকনোলজিতে প্রতিষ্ঠাকালীন প্রেসিডেন্ট এবং পরিকল্পনা পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। এছাড়া তিনি যুক্তরাষ্ট্রের ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি (এমআইটি) ও যুক্তরাষ্ট্র সরকারের ফেডারেল রিজার্ভ বোর্ডের দায়িত্বপূর্ণ পদে কর্মরত ছিলেন। তিনি ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়া থেকে ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং ও কম্পিউটার সায়েন্সে প্রথম পিএইচডি লাভ করেন। তিনি দ্বিতীয় পিএইচডি করেন অর্থনীতিতে, এমআইটি থেকে। তিনি হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের কেনেডি স্কুল অব গভর্নমেন্ট থেকে লোক প্রশাসনে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেছেন। এ ছাড়া তিনি যুক্তরাষ্ট্রের ইয়েল ইউনিভার্সিটির স্কুল অব ম্যানেজমেন্ট থেকে ব্যবসা প্রশাসনে স্নাতকোত্তর করেন। তিনি তাইওয়ানের ন্যাশনাল তাইওয়ান ইউনিভার্সিটি থেকে ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রিধারী।
এখন বাংলাদেশের কোনো পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলরের সাথে তাঁদের যোগ্যতা মিলিয়ে দেখেন। তুলনা চলে? বাংলাদেশের এমন একজন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলরের নাম বলুন তো যার এ্যাকাডেমিক যোগ্যতা তাঁদেরপাশে যায়? সেদিন ইন্ডিপেন্ডেন্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়েব পেইজে গিয়ে দেখি ওখানে ডাইনামিক ব্রেকিং নিউজ দেখাচ্ছে “IUB is now the number ONE university in Bangladesh”! আপনি এটি বিশ্বাস করেন? সত্য না হলেও খুব শিগগিরই সত্য হবে। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর আজকের মালিক বা জায়ান্ট ট্রাস্টি বোর্ডের সদস্যরা চলে যাওয়ার পর নতুন প্রজন্ম যখন আসবে তখন অনেক কিছুই পরিবর্তন হয়ে যাবে। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্জিত মুনাফা যখন আবার বিশ্ববিদ্যালয়ের কল্যাণে পুনরায় দেয়া হবে, তখন কেউ তাদের রুখতে পারবে না।
লেখক পরিচিতি
ড. কামরুল হাসান মামুন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থ বিজ্ঞান বিভাগে অধ্যাপক হিসেবে কর্মরত রয়েছেন।