ডাকসু নির্বাচন এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের দায়িত্বের সীমারেখা

মাহমুদ হাসান

বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজ লেখাপড়া করিয়ে দক্ষ গ্র্যাজুয়েট ও গবেষক তৈরি করা; রাজনীতি করিয়ে ভবিষ্যতের জাতীয় নেতা তৈরি করা নয়। তবু বিশ্বের বিভিন্ন দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্ডারগ্র্যাজুয়েট ও গ্র্যাজুয়েট শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন সংগঠন বা ইউনিয়ন আছে। সেগুলোতে নিয়মিত নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় একটি প্যানেল তৈরিতে, যাদের কাজ হচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয় যেনো ইচ্ছেমতো শিক্ষার্থীদের ওপর টিউশন-ফিসহ অন্যান্য খরচ বৃদ্ধি করতে না পারে এবং শিক্ষার্থীদের কোনো ইস্যুতে সমস্যা হলে সেটি বলার মতো একটি ভয়েস থাকে।


আমি কখনও উন্নত বিশ্বের কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রেসিডেন্ট বা ভাইস চ্যান্সেলরকে দেখিনি এ-ধরনের নির্বাচন নিয়ে জাতীয় মিডিয়ার সামনে বিবৃতি দিতে। জাতীয় মিডিয়াকেও দেখিনি বিশ্ববিদ্যালয় বা কলেজের নির্বাচনকে জাতীয় ইস্যু হিসেবে প্রচার করতে।


সেইসব নির্বাচনে প্রচারণা হয় শুধু ক্যাম্পাসের ভেতরে এবং শিক্ষার্থীদের অনলাইন ফোরামগুলোতে। শিক্ষার্থীদের কেউ কেউ ভোটও দেন, বেশিরভাগ শিক্ষার্থীরই এসব নিয়ে আগ্রহ নেই। আমি কখনও উন্নত বিশ্বের কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রেসিডেন্ট বা ভাইস চ্যান্সেলরকে দেখিনি এ-ধরনের নির্বাচন নিয়ে জাতীয় মিডিয়ার সামনে বিবৃতি দিতে। জাতীয় মিডিয়াকেও দেখিনি বিশ্ববিদ্যালয় বা কলেজের নির্বাচনকে জাতীয় ইস্যু হিসেবে প্রচার করতে।

এসব নির্বাচনের উদ্দেশ্য কখনওই এমন থাকে না যে, যিনি সোসাইটি অফ গ্র্যাজুয়েট স্টুডেন্টস-এর প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হলেন, তাকে ভবিষ্যৎ রাজনৈতিক নেতা হিসেবে তৈরি করার। সিংহভাগ উন্নত দেশেই রাজনৈতিক দলগুলোর শিক্ষার্থী-শাখা নেই। এসব নির্বাচনে যাঁরা প্রার্থী হন, তাদের সঙ্গে দেশের মূলধারার রাজনীতির যোগাযোগ নেই।


শিক্ষার্থী-রাজনীতি ও শিক্ষার্থীদের অধিকার আদায়ের সংগঠন দুটো এক বিষয় নয়। শিক্ষার্থীদের অধিকারের যখন প্রয়োজন হয়, তখন শিক্ষার্থীদের একত্র হতে কোনো সংগঠন বা রাজনৈতিক প্ল্যাটফর্মের প্রয়োজন হয় না। এরকম সময়ে শিক্ষার্থীরা নিজেরাই নিজেদের সময়ের প্রয়োজনে সংগঠিত করে নেন


গতকাল কয়েকজনকে জিজ্ঞেস করলাম যে, ডাকসু নির্বাচন নিয়ে তারা এতো উত্তেজিত বা রোমাঞ্চিত কেনো? মূল কথা এটিই যে, একজন ভবিষ্যৎ নেতা উঠে আসবে এই নির্বাচন থেকে, সেজন্য তারা উত্তেজিত। তার মানে, আমরা একজন নেতার জন্য অপেক্ষায় আছি, এবং শতকোটি টাকা খরচ করে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো চালাচ্ছি নেতা তৈরির জন্যে?

এও সত্য যে, আমাদের অলিতে-গলিতে খুঁজলে শ’খানেক সংগ্রামী সভাপতি বা বিপ্লবী সাধারণ সম্পাদক পাওয়া যায়। অন্যদিকে, সমাজকে এগিয়ে নেয়ার মতো সুশিক্ষিত চিন্তাশীল মানুষ পাওয়া যায় কম। শিক্ষার্থী-রাজনীতি ও শিক্ষার্থীদের অধিকার আদায়ের সংগঠন দুটো এক বিষয় নয়। শিক্ষার্থীদের অধিকারের যখন প্রয়োজন হয়, তখন শিক্ষার্থীদের একত্র হতে কোনো সংগঠন বা রাজনৈতিক প্ল্যাটফর্মের প্রয়োজন হয় না। এরকম সময়ে শিক্ষার্থীরা নিজেরাই নিজেদের সময়ের প্রয়োজনে সংগঠিত করে নেন—ইতিহাস সেটির স্বাক্ষী।

শিক্ষার্থী-রাজনীতি, আরও স্পষ্ট করে বললে, দেশের মূলধারার রাজনৈতিক দলগুলোর শিক্ষার্থী-সংগঠন বা শাখার প্রয়োজন তখনই হয়, যখন বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে লেখাপড়ার বদলে শিক্ষার্থীদের মাথায় একটি রাজনৈতিক আদর্শ পাকাপাকিভাবে বসিয়ে দেয়ার প্রয়োজন হয়। এর ফলাফল এখন দৃশ্যমান। দেশে রাজনৈতিক দলগুলোর কাজকর্মের ব্যাপারে অজ্ঞ এমন একজন গ্র্যাজুয়েটও খুঁজে পাওয়া যাবে না, অথচ কীভাবে উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করা যেতে পারে অথবা যা ইতোমধ্যে শিখে আসা হয়েছে বাস্তব জীবনে সেটার কী প্রয়োগ হতে পারে – এমন প্রশ্ন জিজ্ঞেস করলে সিংহভাগ গ্র্যাজুয়েটের হাঁটু কাঁপাকাঁপি শুরু হয়ে যায়।

রাজনৈতিক দলগুলো নিজেদের ফায়দা লুটতে শিক্ষার্থী-সংগঠন তৈরি করে কি করে না কিংবা স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় শিক্ষার্থী-সংগঠনের কী ভূমিকা ছিলো, এসব বিতর্কে যাব না। শুধু বলতে চাই যে, এগিয়ে যাওয়ার দুটো উপায় আছে। একটি হচ্ছে, অন্যদের তুলনায় সবসময়ই উন্নত চিন্তা করা, আর অপরটি হচ্ছে তেমন চিন্তা করার ক্ষমতা না থাকলে একটি আদর্শ বা মডেল সামনে রেখে সেটিকে অনুসরণ করা। উন্নত বিশ্বের উন্নত বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মতো চিন্তা যদি আমরা নাও করতে পারি, আমাদের উচিত অন্তত তাদেরকে অনুসরণ করে করে আগানো।


একটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের উপাচার্য থেকে শুরু করে প্রভোস্ট, শিক্ষক থেকে শুরু করে শিক্ষার্থী সবাই ডাকসু নির্বাচন নিয়ে উৎকণ্ঠিত। অপরদিকে, লেখাপড়া যে গোল্লায় যাচ্ছে সেটি নিয়ে কারও মাথাব্যথা নাই— বিষয়টি দুশ্চিন্তার।


একটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের উপাচার্য থেকে শুরু করে প্রভোস্ট, শিক্ষক থেকে শুরু করে শিক্ষার্থী সবাই ডাকসু নির্বাচন নিয়ে উৎকণ্ঠিত। অপরদিকে, লেখাপড়া যে গোল্লায় যাচ্ছে সেটি নিয়ে কারও মাথাব্যথা নাই— বিষয়টি দুশ্চিন্তার। উন্নত বিশ্বের দিকে তাকিয়ে দেখুন, এমন কোনো দেশ বা বিশ্ববিদ্যালয় খুঁজে পাওয়া যায় কিনা। হয়তো বলবেন যে, আমাদের বাস্তবতা উন্নত বিশ্বের মতো না। তাহলে আমাদের বাস্তবতা কী? নেতা আর সরকারি আমলা তৈরি করা?

দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে এই নিয়ে নির্বাচন ও জনমত জরিপ হওয়া উচিত যে, আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর আসলে উদ্দেশ্য কী? শিক্ষিত ও দক্ষ জনগোষ্ঠী তৈরি করা? নাকি নেতা ও সরকারি আমলা তৈরি করা? এবং এই নির্বাচনের ফলাফলের ওপর ভিত্তি করে আমাদের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা করা উচিত। যদি নেতা আর সরকারি আমলা তৈরিই মূল উদ্দেশ্য হয়, তাহলে তো আর পরিবর্তনের প্রয়োজন নেই; আমরা উৎকর্ষের শীর্ষে পৌঁছেছি। আর যদি সেটি না হয়, তাহলে আমরা আছি অন্ধকারের অতলে। সেখান থেকে উত্তরণের পথ দেখানোর মানুষের অভাব হয়তো নেই, তবে পথ দেখতে চাওয়ার মত মানুষ আছে কিনা সেটিই প্রশ্ন।

উচ্চশিক্ষা নিয়ে আরও কিছু লেখা

মাহমুদ হাসান: সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার, আইবিএম।

জনপ্রিয় নিবন্ধ

প্রাথমিক স্তরে ভাষা শেখা : বিষয় – বাংলা

ভাষার দক্ষতা চারটি— শোনা, বলা, পড়া, লেখা। আর ভাষা...

আগে ইংরেজি গ্রামার শিখবো, নাকি ভাষা শিখবো?

কোন ভাষার গ্রামার হলো ঐ ভাষার গঠন প্রকৃতি যার...

শিক্ষাব্যবস্থার হালচাল

অর্থনীতিবিদদের মতে, শিক্ষা খাতে বিনিয়োগ সবচেয়ে লাভজনক এবং নিরাপদ রাষ্ট্রীয় বিনিয়োগ। অর্থনীতিবিদ এডাম স্মিথ, ডেভিড রিকার্ডো এবং মার্শালের মতে, শিক্ষা এমন একটি খাত যার কাজ হলো দক্ষ জনশক্তি গড়ে তুলে পুঁজির সঞ্চালন ঘটানো। শিক্ষার অর্থনীতি নিয়ে মৌলিক গবেষণায় অর্থনীতিবদ আর্থার শুল্জ ও রবার্ট সলো দেখিয়েছেন যে, প্রাথমিক শিক্ষায় বিনিয়োগ করলে সম্পদের সুফল ফেরত আসে ৩৫ শতাংশ, মাধ্যমিক শিক্ষায় ২০ শতাংশ, এবং উচ্চ শিক্ষায় ১১ শতাংশ।

আমেরিকায় উচ্চশিক্ষা : পিএইচডির পর কী?

আমেরিকায় উচ্চশিক্ষা নিয়ে প্রচুর লেখালেখি হয়, আমি নিজেও এ-নিয়ে...

ক্যাডেট কলেজে ভর্তি পরীক্ষা নিয়ে কিছু কথা

ক্যাডেটসমূহ বাংলাদেশের শিক্ষাঙ্গনে এক গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে আছে।...

আরও কিছু লেখা

অধিক

    শিক্ষার্থীর স্বাধীনতা

    মানুষের পরিপূর্ণ বিকাশের ক্ষেত্রে স্বশাসন বা স্বনিয়ন্ত্রণ একটি গুরুত্বপূর্ণ...

    উচ্চ শিক্ষা এবং কিছু কথা

    আমাদের বর্তমান সরকার আমাদের শিক্ষার ক্ষেত্রে বেশ কিছু যুগান্তকারী...

    উচ্চ শিক্ষা, জ্ঞান সৃষ্টি ও বিশ্ববিদ্যালয়ের ভবিষ্যৎ

    বিশ্ববিদ্যালয় হলো সেই বিদ্যাপীঠ যেখানে নতুন জ্ঞান সৃষ্টি করা...

    একীভূত শিক্ষা এবং বাংলাদেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের বাস্তবতা

    একীভূত শিক্ষা কাকে বলে? একজন শিক্ষার্থীর বয়স অনুযায়ী তার...

    বোধ

    কেন এই নাম দিলাম ব্যাখ্যা করতে পারবো না। মূল্যবোধ...

    ‘শুদ্ধস্বর-বাংলাদেশের শিক্ষা’ ত্রৈমাসিক সেরা লেখা পুরস্কার: জুলাই-সেপ্টেম্বর ২০১৩ প্রান্তিকের সেরা লেখা- ‘লেখাপড়া সমাচার: ব্যবহারিক রঙ্গ’

    যতদিন আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় নম্বর কম-বেশি পাওয়া পরবর্তীতে কোথায়ও ভর্তি হওয়াতে ভুমিকা রাখবে, ততদিন এই প্র্যাকটিক্যাল অংশটি দারুণভাবে প্রভাব ফেলবে। আর তাই কর্তৃপক্ষকে নতুন করে প্র্যাকটিক্যাল অংশটি নিয়ে ভাবতে হবে।

    শিক্ষা আইন ২০১৩

    জাতীয় শিক্ষানীতি ২০১০-এর সুপারিশের আলোকে শিক্ষা মন্ত্রণালয় কর্তৃক শিক্ষা আইন ২০১৩-এর খসড়া প্রণয়ন করা হয়। খসড়াটি শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে দেয়া হয়েছে সংশ্লিষ্টদের কাছ থেকে ফিডব্যাক নেয়ার জন্য। এটি একটি ভালো উদ্যোগ।

    শিশুদের শৈশব : শবদাহ করছি আমরা

    রাসেল লিখেছেন শৈশব নিয়ে আমার ছেলের শৈশব এখন। বয়েস বাড়ছে,...

    প্রাসঙ্গিক নিবন্ধসমূহ

    নতুন লেখার খবর পান ইমেইলে
    বাংলাদেশের শিক্ষা প্রসঙ্গে নতুন লেখা প্রকাশিত হলে সেই খবর পৌঁছে যাবে আপনার ইমেইলে।