জাতীয় শিক্ষানীতি ২০১০: কতটুকু বাস্তবায়ন হলো?

মিরন কুমার ভৌমিক লিখেছেন শিক্ষানীতি ২০১০ প্রসঙ্গে

চাকরিসূত্রে যখন জাতীয় শিক্ষানীতি ২০১০ প্রণয়ন কমিটির কয়েকজন সদস্যের সাথে স্বল্পসময়ের জন্য কাজ করার সুযোগ হয়েছিলো, তখন শিক্ষা নিয়ে তাদের বিভিন্ন পরিকল্পনার কথা শুনে খুবই আনন্দিত হয়েছিলাম। যদিও পরবর্তীকালে মূল শিক্ষানীতি ডকুমেন্টে অনেক কিছুই খুঁজে না পেয়ে একইসাথে বিস্মিত ও হতাশ হয়েছিলাম। সেগুলো নিয়ে অন্য আরেকটি লিখা লিখব বলে আশা করছি। যাই হোক, এই শিক্ষানীতি সম্পন্ন করার প্রক্রিয়া হিসেবে তখন শিক্ষা মন্ত্রণালয় যে তাদের ওয়েবসাইট এ শিক্ষানীতি ডকুমেন্টটি আপলোড করে সংশ্লিষ্ট সবার কাছ থেকে মতামত চেয়েছিল, এটা অত্যন্ত যুগান্তকারী পদক্ষেপ ছিল। বিষয়টি পরিপূর্ণতা পেতো যদি শিক্ষা মন্ত্রণালয় পরবর্তীতে ওই মতামতগুলোর একটি সারসংক্ষেপ প্রকাশ করত।

বর্তমান সরকারের অন্যতম সাফল্য হিসেবে এই শিক্ষানীতির কথা সর্বত্র উল্লেখ করা হয়ে থাকে, যেটা হয়ত কিছুক্ষেত্রে সত্যি। কিন্তু এখন বোধহয় সময় হয়েছে একটু ফিরে দেখার, আমরা এই শিক্ষানীতির আসলে কতটুকু বাস্তবায়ন করতে পেরেছি। দুর্ভাগ্যজনকভাবে, শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে এই সংক্রান্ত কোনো ডকুমেন্ট পাওয়া যায় নি। তথ্য অধিকার আইনের সুফল হিসেবে যে দুইটা ডকুমেন্ট পাওয়া গেছে, তার মধ্যে একটা হচ্ছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের বুলেটিন এবং অন্যটাতে মন্ত্রনালয়ের দুই বছরের কার্যক্রমের বিবরণ দেওয়া আছে। কিন্তু শিক্ষানীতির বাস্তবায়নের অগ্রগতির ব্যাপারে উল্লিখিত দুইটা ডকুমেন্টের কোথাও তেমন কিছু খুঁজে পাই নি।

প্রস্তাবিত শিক্ষানীতিতে প্রাথমিক শিক্ষাকে আট বছর মেয়াদী করার সুপারিশ করা হয়েছিল, যদিও এর প্রাসঙ্গিকতা নিয়ে তেমন কিছু উল্লেখ করা ছিল না। তৎকালীন বিভিন্ন দৈনিক পত্রিকায় প্রকাশিত শিক্ষা কমিটির বিভিন্ন সদস্যের লেখা থেকে জানতে পারি যে- মূলত দুটি কারণে এই সুপারিশটা করা হয়েছিল। প্রথমত, এই আট বছর মেয়াদী প্রাথমিক শিক্ষা বাধ্যতামূলক হলে সকল শিক্ষার্থী বেশি সময় ধরে বিদ্যালয়ে থাকবে। দ্বিতীয়ত, একটা বড় অংশ শিক্ষার্থী যদি কর্মক্ষেত্রে প্রবেশ করতে চায়, তাহলে যাতে তারা প্রয়োজনীয় দক্ষতা ওই আট বছরের মধ্যে পেয়ে যায়। কিন্তু তখনও যেটা বুঝতে পারি নি এবং এখন পারি না, তা হচ্ছে, আমরা যদি শিক্ষার্থীদের আট বছর মেয়াদী বাধ্যতামূলক শিক্ষা দিতেই চাই তাহলে সেটা কেন প্রাথমিক শিক্ষাকে পাঁচ বছর থেকে বাড়িয়ে আট বছর করতে হবে? আগের নিয়মানুযায়ী পাঁচ বছরের প্রাথমিক শিক্ষাতো বাধ্যতামূলক ছিলই, তার সাথে শুধু তিন বছরের নিম্নমাধ্যমিক শিক্ষাকেও বাধ্যতামূলক করলেই চলতো না? শিক্ষাক্ষেত্রে ‘প্রাথমিক শিক্ষা’ ও ‘মৌলিক শিক্ষা’ নামে যে দুটি ধারণা আছে তা আমাদের শিক্ষাক্ষেত্রের কর্তাব্যক্তিরা বোধহয় একটু গুলিয়ে ফেলেছেন। পৃথিবীর মোটামুটি সব দেশেই প্রাথমিক শিক্ষা সাধারণত পাঁচ অথবা ছয় বছর মেয়াদী হয়ে থাকে। আর মৌলিক শিক্ষা নিম্নমাধ্যমিক বা মাধ্যমিক পর্যায় পর্যন্ত বিস্তৃত হয়ে থাকে। রাষ্ট্র আশা করে তার মৌলিক শিক্ষাকে যতটুকু পর্যন্ত বাড়ানো যায় যাতে করে শিক্ষার্থীরা একটা মোটামুটি দক্ষতা অর্জন করে, হয় মৌলিক শিক্ষা শেষে শিক্ষার্থীরা কর্মক্ষেত্রে প্রবেশ করবে অথবা পরবর্তী স্তরের পড়াশুনা চালিয়ে যেতে পারে।

রাষ্ট্র কতবছর পর্যন্ত শিক্ষাকে বাধ্যতামূলক ও অবৈতনিক করবে তা সাধারণত রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক সক্ষমতার উপর নির্ভর করে। তবে ‘সংবিধান’, ‘জাতিসংঘ শিশু অধিকার সনদ’ অথবা ‘সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্য’ অনুযায়ী প্রত্যেক রাষ্ট্রই মোটামুটি নিদেনপক্ষে প্রাথমিক শিক্ষাকে বাধ্যতামূলক ও অবৈতনিক করে থাকে। বেশিরভাগ উন্নত ও উন্নয়নশীল দেশ এখন তাদের বাধ্যতামূলক ও অবৈতনিক শিক্ষা মৌলিক শিক্ষাস্তর পর্যন্ত নিয়ে গেছে। অনেক দেশ ও আছে যারা উচ্চমাধ্যমিক স্তর পর্যন্ত অবৈতনিক শিক্ষা দিয়ে থাকে। যাই হোক, আমাদের অর্থনৈতিক বিবেচনায় আট বছরমেয়াদী পরিকল্পনা অবশ্যই সরকারের শিক্ষা বিষয়ে সুবিবেচনা ও ভালো করার ইচ্ছেকেই প্রমাণ করে। কিন্তু আবারও আগের প্রশ্নটাতে যেতে হয়- এর জন্য প্রাথমিক শিক্ষাকে আট বছর করতে হবে কেন? এই প্রশ্নটা বার বার নিয়ে আসছি কারণ আমার মনে হচ্ছে আমাদের প্রস্তাবিত শিক্ষানীতি ২০১০ বাস্তবায়নের যে স্থবিরতা দেখা যাচ্ছে তা মূলত এই আট বছরমেয়াদি প্রাথমিক শিক্ষা বাস্তবায়নকেন্দ্রিক সমস্যা।

আমরা এর আগে পত্র-পত্রিকায় বিশিষ্ট শিক্ষাবিদদের অনেক বিশ্লেষণ দেখেছি, কিভাবে এই আট বছরমেয়াদি প্রাথমিক শিক্ষাকে বাস্তবায়ন করা যাবে। আমি সেগুলোর বাস্তবায়নযোগ্যতা নিয়ে এখানে বিশদ আলোচনায় যাব না; তবে আমরা পরিষ্কার বুঝতে পারছিলাম যে এটা বাস্তবায়নের মূল প্রতিবন্ধকতা হলো আমাদের প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোর অবকাঠামোগত সীমাবদ্ধতা এবং শিক্ষকের অপ্রতুলতা। দুটি বিষয়ের জন্যই প্রচুর অর্থের ও সময়ের প্রয়োজন। পাশাপাশি আমাদের শিক্ষার দায়িত্বে থাকা দুই মন্ত্রণালয়ের সমন্বিত পদক্ষেপও দরকার এই ধরনের একটা বিশাল কাঠামোগত পরিবর্তনের জন্য। আমি ঠিক নিশ্চিত না আসলে দুই মন্ত্রণালয় কতটুকু সমন্বিতভাবে কাজ এগিয়ে নিতে পেরেছে কারণ আমরা প্রায়ই আন্তঃমন্ত্রণালয়ের সমন্বয়হীনতার কারণে কর্মকাণ্ড বাস্তবায়নের শ্লথগতির কথা শুনতে পাই এবং আমার গত কয়েকবছরের কাজের অভিজ্ঞতা থেকেও তাই দেখেছি।

পরিশেষে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কাছে একটি আরজি দিয়ে লেখাটা শেষ করছি। যতটুকু জেনেছি, এডিবির অর্থায়নে একটা দেশি-বিদেশি বিশেষজ্ঞ গ্রুপ কাজ করছে এই শিক্ষানীতি ২০১০ বাস্তবায়নের বিভিন্ন কৌশল নির্ধারণের জন্য, যেটা শুনে খুবই ভাল লেগেছে, দেরিতে হলেও সরকার আসলে সঠিকভাবে কাজটা এখনো করতে চাচ্ছে। কিন্তু একইসাথে এটা ভেবে খারাপ লাগছে যে, আমরা আর কতকাল এইরকম জোড়াতালি দিয়ে শিক্ষাবিষয়ক কাজগুলো যারা শিক্ষাবিষয়ে বিশেষজ্ঞ নয় তাদেরকে দিয়েই করিয়ে যাব, ফলাফল যাই হোক না কেন? অনুগ্রহ করে আপনারা যতটুকুই কাজ করছেন আমাদেরকে একটু নিয়মিতভাবে আপনাদের ওয়েবসাইটের মাধ্যমে জানান, যারা বাংলাদেশ এর শিক্ষা নিয়ে ভাবে এবং এর জন্য ভাল কিছু করতে চায়, তারা খুবই খুশি হবে।

মিরন কুমার ভৌমিক: পিএইচডি গবেষক, দি হংকং ইনস্টিটিউট অফ এডুকেশন, হংকং।

জনপ্রিয় নিবন্ধ

প্রাথমিক স্তরে ভাষা শেখা : বিষয় – বাংলা

ভাষার দক্ষতা চারটি— শোনা, বলা, পড়া, লেখা। আর ভাষা...

আগে ইংরেজি গ্রামার শিখবো, নাকি ভাষা শিখবো?

কোন ভাষার গ্রামার হলো ঐ ভাষার গঠন প্রকৃতি যার...

শিক্ষাব্যবস্থার হালচাল

অর্থনীতিবিদদের মতে, শিক্ষা খাতে বিনিয়োগ সবচেয়ে লাভজনক এবং নিরাপদ রাষ্ট্রীয় বিনিয়োগ। অর্থনীতিবিদ এডাম স্মিথ, ডেভিড রিকার্ডো এবং মার্শালের মতে, শিক্ষা এমন একটি খাত যার কাজ হলো দক্ষ জনশক্তি গড়ে তুলে পুঁজির সঞ্চালন ঘটানো। শিক্ষার অর্থনীতি নিয়ে মৌলিক গবেষণায় অর্থনীতিবদ আর্থার শুল্জ ও রবার্ট সলো দেখিয়েছেন যে, প্রাথমিক শিক্ষায় বিনিয়োগ করলে সম্পদের সুফল ফেরত আসে ৩৫ শতাংশ, মাধ্যমিক শিক্ষায় ২০ শতাংশ, এবং উচ্চ শিক্ষায় ১১ শতাংশ।

আমেরিকায় উচ্চশিক্ষা : পিএইচডির পর কী?

আমেরিকায় উচ্চশিক্ষা নিয়ে প্রচুর লেখালেখি হয়, আমি নিজেও এ-নিয়ে...

ক্যাডেট কলেজে ভর্তি পরীক্ষা নিয়ে কিছু কথা

ক্যাডেটসমূহ বাংলাদেশের শিক্ষাঙ্গনে এক গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে আছে।...

আরও কিছু লেখা

অধিক

    প্রয়োজনভিত্তিক শিক্ষা: নিচুস্তরের শিক্ষাদর্শন দিয়ে উচ্চশিক্ষা-সমস্যার সমাধান অসম্ভব

    আর রাজী লিখেছেন প্রয়োজনভিত্তিক শিক্ষা ও শিক্ষাদর্শন প্রসঙ্গে এই পৃথিবীর...

    বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা ও গবেষণা: পর্ব ৭

    বাংলাদেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল সমস্যা হলো এর নিয়োগ প্রক্রিয়া,...

    বিজ্ঞান অনুষদে ফলাফল বিড়ম্বনা

    আমাদের প্রাণপ্রিয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আর কিছুদিন পরেই ১০০ বছরে...

    জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি) এবং আমাদের নতুন বই

    আগামী বছরের প্রাথমিকের বই থেকে কমানো হয়েছে ৫৮০ পৃষ্ঠা। তবে দুই স্তরে কতো পৃষ্ঠা কমানো হয়েছে তার পরিসংখ্যান এখনও বোর্ড বের করতে পারেনি। এক্ষেত্রে বইয়ের অপ্রয়োজনীয় অধ্যায় বাদ দেওয়া হয়েছে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, এই অপ্রয়োজনীয় অধ্যায় পূর্বে কীভাবে সংযোজিত হয়েছিলো আর এখন বাদ দেওয়ার ক্ষেত্রে শিক্ষা বিশেষজ্ঞদের মতামত নেওয়া হয়েছে কিনা তা বোর্ড এখনও সেভাবে প্রকাশ করেনি।

    শিক্ষার্থী-মূল্যায়নে খাঁটি কষ্টিপাথরের তত্ত্বতালাশ

    নাঈমুল হক লিখেছেন শিক্ষার্থী-মূল্যায়নে কী করণীয় সেই বিষয়ে আমার এক...

    প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষা নিয়ে প্রাসঙ্গিক কিছু কথা

    সরকার কর্তৃক গৃহীত বিভিন্ন পদক্ষেপ, দেশের আর্থসামজিক উন্নয়ন এবং...

    প্রাসঙ্গিক নিবন্ধসমূহ

    নতুন লেখার খবর পান ইমেইলে
    বাংলাদেশের শিক্ষা প্রসঙ্গে নতুন লেখা প্রকাশিত হলে সেই খবর পৌঁছে যাবে আপনার ইমেইলে।