সরকারের জন্য বাজেট প্রণয়ন রুটিন কাজ হলেও প্রতি বছরই এতে ছোটবড় চমক থাকে। শিক্ষাবাজেট নিয়েও চমক থাকে। বাজেট পেশের আগে সভা-সেমিনার করে সবাই অর্থমন্ত্রীর কাছে দাবিদাওয়া তুলে ধরে। দাবির প্রতিফলন বাজেটে না থাকলে সে অনুযায়ী সমালোচনার ধারও বাড়ে। সব ধরনের ব্যবসায়ী এবং তাদের সংগঠন নিয়ম করে প্রতিবছর অর্থমন্ত্রীর কাছে বাজেটে নানা সুবিধা চান। সুবিধা চান আরো অনেকে। প্রায় সবাই নিজের সুবিধাটাই আগে তুলে ধরেন। কিছু সংগঠন অবশ্য জনগুরুত্বসম্পন্ন বিষয়ও তুলে ধরে। এবার যেমন একটি সংগঠন সব ধরনের তামাকজাত পণ্যে শুল্ক বাড়ানোর দাবি করেছে। এতে বিড়ি-সিগারেট-গুল ইত্যাদি তামাকজাত পণ্যের দাম বাড়বে। ফলে মানুষ এসব ক্ষতিকর পণ্য কম ব্যবহার করবে বলে তারা মনে করছে। অর্থমন্ত্রী অবশ্য সবার কথা রাখেন না, রাখা সম্ভবও না।
এখন সেই বাজেট-মওসুম চলছে। ইতোমধ্যে অনেক দাবিদাওয়া চলে এসেছে। অসংখ্য দাবির মধ্যে প্রতিদিন পত্রিকায় নিয়ম করে কিছু নির্দিষ্ট বিষয়ে কেউ কোনো দাবি করলো কিনা খুঁজি। হতাশ হই। এ বিষয়গুলোর একটি হলো শিক্ষা। প্রতিবার বাজেট পেশের পর শিক্ষার জন্য সর্বাধিক অর্থ রাখার দাবি করেন অর্থমন্ত্রীরা। কোনো কোনো বছর ব্যতিক্রম হয় বটে; কিন্তু শিক্ষাকে সবার উপরে বা উপরের সারিতে রাখার কৃতিত্বটা দাবি করতে চান সব অর্থমন্ত্রী। তবে উপরের সারিতে থাকলেও এতে বড়সড় একটা ফাঁকি সবসময় থেকেই যায়।
মোট বাজেটের কত শতাংশ শিক্ষার জন্য থাকা দরকার- এ নিয়ে নানা মত থাকলেও বলা হয়, উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে বাংলাদেশের শিক্ষাখাতে কমপক্ষে জাতীয় বাজেটের ২৫ শতাংশ এবং জাতীয় আয়ের ৬-৮ শতাংশ রাখা দরকার। বর্তমানে দেশে শিক্ষাখাতে জাতীয় বাজেটের ১৩-১৪ শতাংশ এবং জাতীয় আয়ের মাত্র ২ শতাংশের কিছু বেশি বরাদ্দ রাখা হয়। এই ক্ষুদ্র বরাদ্দের সাথে প্রযুক্তি বা অন্য সেক্টরের বরাদ্দ ঢুকিয়ে শিক্ষাখাতে সর্বোচ্চ বরাদ্দের দাবি করা হয়। এতে শিক্ষাখাতে মোট বরাদ্দ অনেকটাই কমে আসে। ২০০৭-০৮ অর্থবছরে শিক্ষার সাথে প্রযুক্তি-বাজেট জুড়ে দেওয়া হয়েছিল। ২০০৯-১০ অর্থবছরে শিক্ষা, প্রযুক্তির সাথে জুড়ে দেওয়া হয়েছিল স্বাস্থ্যখাতকেও। শিক্ষাখাতে বাজেট বাড়লে সাধারণ মানুষ নানা কারণে খুশি হয়, কিন্তু এই ফাঁকিটা অনেকেই ধরতে পারেন না।
এবারো বাজেটপূর্ব নানা আলোচনায় এসব বিষয় উঠে এসেছে। বিস্ময়ের সাথে শুনছি- এবার নাকি শিক্ষাখাতের সাথে ধর্মখাতকে জুড়ে দেওয়ার পরিকল্পনা রয়েছে। তাছাড়া অর্থমন্ত্রী এক আলোচনায় বাজেটে শিক্ষা ও যোগাযোগ খাতের অগুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পগুলোকে বাদ দিয়ে সংকুচিত বাজেটের কথা জানিয়েছেন। যে কোনো সেক্টরেই অগুরুত্বপূর্ণ প্রকল্প বাদ দেওয়া জরুরি কাজে মধ্যে একটি; কিন্তু এর সাথে সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ খাতটির বাজেট কমানোর সম্পর্ক কী? সরকারেরই শরিক দলের নেতৃবৃন্দ অর্থমন্ত্রীর এ বক্তব্যের বিরোধিতা করেছেন। শিক্ষা-সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা হতাশ হয়েছেন। বিশেষত অর্থমন্ত্রী এমন সময়ে বক্তব্যটি দিলেন যখন শিক্ষাখাতে অর্থবরাদ্দ বাড়ানো নানাভাবে গুরুত্বপূর্ণ।
কিছুদিন আগেই আমাদের শিক্ষামন্ত্রী নতুন শিক্ষানীতি উপহার দিলেন। নতুন এই শিক্ষানীতি বাস্তবায়িত হলে দেশের শিক্ষাসেক্টরে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ এবং গুণগত পরিবর্তন আসবে বলে আশা করা যায়। শিক্ষানীতি সংসদে পাশ হওয়ার আগে ও পরে নানা জায়গায় এর বাস্তবায়ন কৌশল নিয়ে প্রচুর আলোচনা হয়েছে। অনেক আলোচনায় অর্থমন্ত্রী নিজেও উপস্থিত ছিলেন। প্রায় ঢেলে সাজানো নতুন শিক্ষাব্যবস্থার জন্য কী পরিমাণ অর্থ লাগবে অর্থমন্ত্রীর তা অজানা নয়। শিক্ষানীতি বাস্তবায়ন কৌশলপত্রে কোন বছরের জন্য কী পরিমাণ অর্থ লাগবে তা অর্থমন্ত্রী বা অর্থ মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করেই চূড়ান্ত করার কথা। এ অবস্থায় শিক্ষাখাতে বাজেট বাড়ানোর বদলে তা সংকুচিত করার কথা অর্থমন্ত্রী কীভাবে বলেন তা বোধগম্য নয়। পাশাপাশি শিক্ষাখাতের সাথে ধর্মখাতকে জুড়ে দেওয়ার কৌশলটিও যথাযথ নয়। অর্থমন্ত্রী অবশ্যই অগুরুত্বপূর্ণ প্রকল্প নিয়ে কথা বলতে পারেন, কিন্তু অগুরুত্বপূর্ণ প্রকল্প বাদ দেওয়ার সাথে সার্বিক শিক্ষাবাজেট বাড়ার কোনো বিরোধ নেই।
বর্তমান সরকার যে কয়টি ভালো কাজ করেছে, তার একটি নতুন শিক্ষানীতি। দেশের শিক্ষার হাল সম্পর্কে সবাই অবগত। নতুন শিক্ষানীতি যথাযথভাবে বাস্তবায়ন করা গেলে দেশের শিক্ষাসেক্টরে গুণগত পরিবর্তন আসবে বলে আশা করা যায়। শিক্ষামন্ত্রী যখন নানা সভা-সেমিনারে নতুন শিক্ষানীতি নিয়ে কথা বলেন, শিক্ষানীতি বাস্তবায়িত হলে গুণগত কী পরিবর্তন আসতে পারে সেই আশাবাদ শোনান, তখন স্বভাবতই আশাবাদী ও উজ্জীবিত হই। শিক্ষামন্ত্রীর একনিষ্ঠ তৎপরতা ও বক্তব্য আমাদের অন্তত এটুকু আশ্বস্ত করে যে, দেশের শিক্ষা নিয়ে ভাবার মতো কর্তাব্যক্তি অন্তত একজন হলেও আছেন। এর আগে অনেকেই শিক্ষামন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন; কিন্তু রুটিন কাজের বাইরে তারা তেমন কিছু করেননি। তাঁদের কর্মকাণ্ড দেখে মনেও হয় নি যে শিক্ষার প্রতি তারা একনিষ্ঠ। বর্তমান শিক্ষামন্ত্রী সেই ধারণাটুকুতেও পরিবর্তন এনেছেন। কিন্তু শিক্ষামন্ত্রীর সমস্ত তৎপরতা এবং মানুষের সমস্ত আশাবাদ বন্ধ হয়ে যাবে যদি শিক্ষাখাতে পর্যাপ্ত অর্থ বরাদ্দ না করা হয়।
শুধু শিক্ষানীতিই নয়, বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর মাধ্যমিক ও মাদ্রাসায় শিক্ষার্থীদের বিনামূল্যে বই দেয়া শুরু করেছে। শিক্ষকদের জন্য স্বতন্ত্র পে কমিশন গঠন করার বিষয়টি আলোচনায় রয়েছে। শিক্ষাপ্রশাসন ঢেলে সাজানো ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ভৌত সুবিধা বাড়ানোর বিষয়টি সময়ের দাবি। নতুন শিক্ষানীতি অনুসারে প্রাথমিক শিক্ষা অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত বর্ধিত হবে; পাশাপাশি প্রতিটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রাক-প্রাথমিক শাখা খোলা হবে। প্রচুর দক্ষ শিক্ষকের প্রয়োজন হবে। সবকিছুর জন্য দরকার প্রচুর অর্থ। মাধ্যমিক শিক্ষার মান বাড়াতে হবে। উচ্চশিক্ষার জন্য প্রচুর প্রতিষ্ঠান স্থাপন ও বর্তমান প্রতিষ্ঠানগুলোর গুণগত মান বাড়ানোর বিকল্প নেই। মোট কথা, দেশের শিক্ষা এখন এমন অবস্থায় রয়েছে যেখানে প্রতিটি সেক্টরেই প্রচুর কাজ করা দরকার। এ অবস্থায়, অর্থমন্ত্রী কী করে শিক্ষার বাজেট কমানোর কথা ভাবেন?
পাশের রাষ্ট্র ভারত প্রতি বছরই শিক্ষায় বরাদ্দ বাড়িয়ে চলেছে। সম্প্রতি তারা শিক্ষাবাজেট ৪ থেকে ৬ শতাংশে উন্নীত করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। শ্রীলংকা তাদের বাজেট ২.১ থেকে ৪ শতাংশ করেছে। নেপালের শিক্ষাবাজেট জিডিপির ৩.৪ শতাংশ। দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে মালদ্বীপ ৭.৫ ও ভুটান ৫.২ শতাংশ শিক্ষার পেছনে খরচ করে। দেখা যাচ্ছে, সার্কভুক্ত দেশগুলোতে একমাত্র পাকিস্তানের চেয়ে বাংলাদেশের শিক্ষাবাজেট বেশি। মালদ্বীপ ছাড়া সবগুলো দেশই ইউনিসেফের ৬ শতাংশ এবং ইউনেস্কোর ৮ শতাংশের চেয়ে পেছনে পড়ে আছে। শিক্ষার পেছনে জিডিপির খরচের দিক দিয়ে সূচকে বাংলাদেশর অবস্থান ১১৯তম (সূত্র: http://www.nationmaster.com/graph/edu_edu_spe-education-spending-of-gdp)। সর্বাধিক বাজেট কিউবার (১৮.৭%)। এ চিত্র খুবই হতাশাজনক।
জাতীয় বাজেটের যেটুকু শিক্ষায় খরচ করার কথা, স্বাভাবিক সময়েই সেই বরাদ্দটুকু দেয়া হয় না। জানি, সরকার অপারগতার কথা বলবে। সেক্ষেত্রে অন্য দেশগুলো কীভাবে এই বরাদ্দ দেয়, সেই কৌশল আমাদের জানা দরকার। নিশ্চয়ই এমন কোনো মেকানিজম আছে, যেখানে অর্থমন্ত্রীর উদ্ধৃত ‘অগুরুত্বপূর্ণ প্রকল্প’ বাদ দিয়ে সেই টাকা শিক্ষায় বরাদ্দ করা যায়। নিশ্চয়ই শিক্ষার সাথে অন্য খাত জুড়ে দেওয়ার অপকৌশল বাদ দেওয়া যায়। নিশ্চয়ই অর্থমন্ত্রী ও সরকার চাইলে শিক্ষাখাতকে প্রয়োজন অনুযায়ী বরাদ্দ দেওয়া যায়। তাছাড়া সময়টাও বিবেচনায় নিতে হয়। দেশের শিক্ষা একটি গুণগত পরিবর্তনের বাঁকের মুখে দাঁড়িয়ে আছে। এ সময়ে শিক্ষার বাজেট উল্লেখযোগ্য হারে না বাড়ালে সরকার নিজেই নিজের কৌশল বা নীতি বাস্তবায়নে বাধা হয়ে দাড়াবে। অর্থমন্ত্রী নিশ্চয়ই এসব বিবেচনা করে শিক্ষানীতিকে কেন্দ্র করেই শিক্ষাখাতে বাজেট বরাদ্দ করবেন- এই আশা শুধু শিক্ষামন্ত্রীর নয়; আমাদের সবারই।
লেখক পরিচিতি
গৌতম রায় রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটে সহযোগী অধ্যাপক হিসেবে কর্মরত রয়েছেন।