হোসনে আরা লিখেছেন প্রাথমিক শিক্ষার অপ্রত্যাশিত ব্যয়ভার নিয়ে

আমাদের দেশে সবচেয়ে বেশি সংখ্যক শিক্ষার্থী ভর্তি হয় প্রাথমিক স্তরে। যেহেতু দেশের প্রাথমিক শিক্ষা সবার জন্য বাধ্যতামূলক, তাই বর্তমানে সব স্তরের অভিভাবক তাঁদের সন্তানকে বিদ্যালয়ে পাঠাচ্ছে। কেউবা ভাবেন সন্তানটি পঞ্চম শ্রেণী শেষ করতে পারলে সে সমাজের কোনো একটি আয়মূলক কাজে সহজে নিয়োজিত হতে পারবে, আবার কেউ শিক্ষার পরবর্তী স্তরে যাওয়ার পদক্ষেপ হিসেবে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সন্তানকে পাঠাচ্ছেন। কিন্তু বাস্তবে গ্রামাঞ্চলের বিদ্যালয়গুলোতে অধিকাংশ ক্ষেত্রে একজন শিশুর প্রাথমিক শিক্ষাচক্র অর্থাৎ ৫ম শ্রেণী পর্যন্ত শেষ করতে ৫-৮ বছর পর্যন্ত লেগে যাচ্ছে, যদিও সেখানে তার লাগার কথা কেবল ৫ বছর। এতে করে শিশুর জীবনের অতিরিক্ত সময় ব্যয় হচ্ছে। পাশাপাশি অভিভাবক ও সরকারকে দিতে হচ্ছে অতিরিক্ত সময় ও ব্যয়।

শিক্ষার ব্যয়ের কথা বলতে গেলে দু’ধরনের- এক. সুযোগ ব্যয়; দুই. প্রত্যক্ষ ব্যয়। কোনো অভিভাবক তার শিশুকে বিদ্যালয়ে না পাঠিয়ে যদি কোনো অর্থনৈতিক কাজে নিয়োগ করত, তাহলে ঐ শিশুটি কিছু না কিছু আয় করত। শিশুর এই আয় থেকে অভিভাবকগণের বঞ্চিত হওয়াকে বলা হয় সুযোগ ব্যয়। অন্যদিকে প্রত্যক্ষ ব্যয় হচ্ছে শিশুর শিক্ষালাভের জন্য প্রয়োজনীয় খরচ যেমন- বিদ্যালয় কক্ষ, আসন ব্যবস্থা, শিক্ষকের বেতন, বই খাতা, পেন্সিল, জামাকাপড়, যাতায়াত, কোনো কোনো ক্ষেত্রে প্রাইভেট টিউশন ফি ইত্যাদির জন্য যে ব্যয় তা শিক্ষার প্রত্যক্ষ ব্যয়। প্রাথমিক স্তরের এই প্রত্যক্ষ ব্যয়ের সিংহভাগই ব্যয় করছে সরকার; যেমন- বিদ্যালয় অবকাঠামো নির্মাণ, শিক্ষক নিয়োগ, শিক্ষক প্রশিক্ষণ, পাঠ্যপুস্তক প্রকাশ ও বিতরণ, বিভিন্ন শিক্ষা উপকরণ ক্রয় ও বিতরণ। অন্যদিকে অভিভাবকগণ শিশুর শিক্ষার প্রত্যক্ষ ব্যয় হিসেবে খাতা, কলম, জামা কাপড়, কোনো কোনো ক্ষেত্রে প্রাইভেট টিউশন ফি ইত্যাদি বহন করে থাকেন।

এখন ধরা যাক-প্রথম শ্রেণী শেষ করতে একজন শিশুর জন্য সরকার ও অভিভাবকের একটি শিক্ষাবর্ষ প্রয়োজনীয় ব্যয়ভার বহন করতে হয়। কিন্তু ঐ শিশুটি যদি কোনো কারণে এক বছরে প্রথম শ্রেণীর নির্ধারিত যোগ্যতা অর্জন করতে না পারে অর্থাৎ পাস না করে, তবে ঐ শিশুর জন্য সরকার ও অভিভাবক উভয়কে পুনরায় আরো এক বছর (কোনো কোনোক্ষেত্রে আরো বেশি) ব্যয় বহন করতে হয়। পাশাপাশি ঐ শিশুর অভিভাবককে সমপরিমাণ সময়ের জন্য সুযোগ ব্যয় বহন করতে হয়। এভাবে একজন শিশুর প্রাথমিক স্তরের শিক্ষা শেষ করতে যদি ৫ বছরের স্থলে ৭-৮ বছর সময় লেগে যায়, তাহলে শিক্ষার এই অপ্রত্যাশিত ব্যয়বৃদ্ধির দায়ভার কে নেবে?

এখন আসা যাক, প্রাথমিক শিক্ষার এই অপ্রত্যাশিত ব্যয়বৃদ্ধি এর জন্য দায়ী কে বা কারা? শিক্ষক? শিক্ষার্থী নিজে? শিক্ষার্থীর অভিভাবক? অথবা প্রচলিত শিক্ষা ব্যবস্থা? সত্যিকার অর্থে কে বা কী দায়ী?

এবার একটু ভিন্ন প্রসঙ্গ- প্রাথমিক স্তরে বর্তমানে চালুকৃত সমাপনী পরীক্ষা ব্যবস্থা নিঃসন্দেহে একটি ভালো উদ্যেগ। কেননা এর মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা প্রাথমিক স্তরের প্রান্তিক যোগ্যতাগুলোর কতটুকু অর্জন করে মাধ্যমিক স্তরে প্রবেশ করছে তা যাচাই করা সম্ভব। কিন্তু এই পরীক্ষার অযুহাতে যদি শিক্ষার অপ্রত্যাশিত ব্যয় বেড়ে যায়, তাহলে নিশ্চয়ই তা কারোর নিকট গ্রহণযোগ্য হবে না। বর্তমানে প্রাথমিক স্তরের শিক্ষকগণ সমাপনী পরীক্ষায় পাসের হার শতভাগ করার জন্য যে আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন তা নিশ্চয়ই প্রশংসার দাবিদার। তবে এক্ষেত্রে আমাদের খতিয়ে দেখা উচিত কোন কোন উপায় অবলম্বন করে তাঁরা পাসের হার শতভাগে উন্নীত করার চেষ্টা করছেন। একজন শিক্ষা উন্নয়ন কর্মী হিসেবে কাজ করার সুবাদে গত দুই বছরে গ্রামাঞ্চলের বেশ কিছু প্রাথমিক বিদ্যালয়ে যাওয়ার এবং সে সকল বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকসহ অন্যান্য শিক্ষকগণের সাথে কথা বলার সুযোগ হয়েছে। শিক্ষকগণের সাথে কথা বলা ও বিদ্যালয় মনিটরিং বোর্ড পর্যবেক্ষণের ভিত্তিতে কিছু তথ্য এখানে তুলে ধরা যাক। কোনো একটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ২০০৬ সালে প্রথম শ্রেণীতে ভর্তিকৃত শিশুর সংখ্যা ৪২ জন, যাদের মধ্যে ১২ জন শিক্ষার্থী ২০১০ সালের সমাপনী পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করেছে (তথ্যসূত্র- সংশ্লিষ্ট বিদ্যালয়ের মনিটরিং বোর্ড)। বাকিদের অধিকাংশই নিচের বিভিন্ন শ্রেণীতে পুনরায় পড়ালেখা করছে এবং কেউ কেউ বিদ্যালয় থেকে ঝরে পড়েছে। এমনই তথ্য আরো বেশ কয়েকটি সরকারি ও বেসরকারি বিদ্যালয়ে দেখা গেছে। এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট বিদ্যালয় প্রধানগণের সাথে কথা বলে জানা যায়, সমাপনী পরিক্ষায় শতভাগ পাস নিশ্চিত করার লক্ষ্যে তাঁরা খুব সতর্কতার সাথে পঞ্চম শ্রেণীতে প্রমোশন দিয়ে থাকে। বিষয়টি কতোটা গ্রহণযোগ্য? যদি কোনো শিশু কম পারদর্শী হয়ে থাকে তবে এটা তো তার কোনো নতুন সমস্যা না। আর তাই যদি হয় আমরা কেন শুরু থেকে তার পরিচর্যা না করে পঞ্চম শ্রেণীর প্রমোশনের সময় এসে অতি সতর্কতা অবলম্বন করছি?

শিক্ষকগণের সাথে কথা বলে সমাপনী পরীক্ষায় পাসের হার বৃদ্ধির কয়েকটি উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপের কথা জানতে পারি। প্রথমত- প্রতিটি বিদ্যালয়েরই ৫ম শ্রেণীর শিক্ষার্থীর জন্য রয়েছে বিশেষ ক্লাসের ব্যবস্থা, দ্বিতীয়ত- ৩য় ও ৪র্থ শ্রেণীতে কোনো একটি বিষয়ে অকৃতকার্য হলে তাকে পরবর্তী শ্রেণীতে প্রমোশন না দেওয়া। প্রথম উদ্যেগটি অপেক্ষাকৃত ভালো মনে হলেও দ্বিতীয় উদ্যেগটি নিয়ে ভাববার আছে। কেননা একজন শিক্ষার্থী কোনো বিষয়ে অকৃতকার্য হয় কেন? এ বিষয়ে প্রশ্ন করলে শিক্ষকগণের উত্তর- গ্রামাঞ্চলের অভিভাবকগণ অসচেতন অথবা তাদের মেধা নেই অথবা শিক্ষক-শিক্ষার্থীর অনুপাত বেশি হওয়ায় তাদের পক্ষে সকল শিক্ষার্থীর প্রতি সমান নজর দেওয়া সম্ভব হয় না ইত্যাদি। এসব কারণের পাশাপাশি শিক্ষার্থীদের কোন বিষয়ে অকৃতকার্য হওয়ার প্রকৃত কারণ কী তা খতিয়ে দেখা প্রয়োজন।

এবার আসি প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণীর শিক্ষার্থীদের পুনরাবৃত্তি বিষয়ে, অধিকাংশ বিদ্যালয়ে প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণীতে শিক্ষার্থীর সংখ্যা অন্যান্য শ্রেণীর তুলনায় অনেক বেশি হওয়ায় একজন শিক্ষকের একার পক্ষে সকল শিশুর শিখন নিশ্চিত করা সম্ভব হয় না। এক্ষেত্রে শিক্ষকগণ তুলনামূলক কম পারদর্শী শিশুকে তার মানসিক ক্ষতির কথা বিবেচনা না করেই কখনো কখনো একই শ্রেণীতে একাধিকবার পড়ার বিষয়ে পরামর্শ দিয়ে থাকেন। এর ফলে একদিকে শিশুর একই শ্রেণীতে একাধিকবার থাকার কারণে পড়ালেখার প্রতি আগ্রহ যেমন কমতে থাকে, তেমনি অন্যদিকে শিক্ষাব্যয়ও অপ্রত্যাশিতভাবে বাড়তে থাকে। এর পাশাপাশি পুনরাবৃত্তি শ্রেণীশিক্ষকের জন্য অপ্রত্যাশিত চাপেরও কারণ হয়ে দাঁড়ায়। এ কারণে তিনি সকল শিশুর প্রতি সমান নজর দিতে ব্যর্থ হন, যা পরবর্তীতে আরো পুনরাবৃত্তির কারণ হয়ে থাকে।

তবে যে কারণেই হোক না কেন, প্রাথমিক স্তরের পুনরাবৃত্তির হার উল্লেখযোগ্য সংখ্যক হওয়ায় একইসাথে সরকার ও অভিভাবক উভয়ের শিক্ষা ব্যয় দিন দিন বাড়ছে। উন্নয়নশীল দেশের নাগরিক হিসেবে আমাদের সকলেরই শিক্ষার এই অপ্রত্যাশিত ব্যয়বৃদ্ধি নিয়ে ভাবতে হবে, অবস্থা বিশ্লেষণের পরিপ্রেক্ষিতে গ্রহণ করতে হবে কার্যকর পদক্ষেপ। প্রাথমিক শিক্ষার এই অপ্রত্যাশিত ব্যয় কমানোর ক্ষেত্রে কয়েকটি পদক্ষেপ কাযকরী হতে পারে। যেমন-

১. সকল শিশুকে মানসম্মত প্রাকপ্রাথমিক শিক্ষা প্রদানের পর প্রথম শ্রেণীতে ভর্তি করানো;
২. সকল শিশুর ডাটাবেজ তৈরি, যথাযথভাবে ব্যবহার ও সংরক্ষণ করা;
৩. শ্রেণীকক্ষে শিক্ষক ও শিক্ষার্থী অনুপাত কমিয়ে আনা। প্রয়োজনে একাধিক শাখা চালু করা ও প্রয়োজনীয় অবকাঠামো, প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত শিক্ষক নিশ্চিত করা;
৪. পুনরাবৃত্তির যৌক্তিক কারণ উদঘাটনপূর্বক যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ/ কৌশল অবলম্বন;
৫. শ্রেণীকক্ষের শিখন-শেখানো পদ্ধতি আনন্দায়ক ও শিশুবান্ধব করা। বিশেষ করে শিক্ষকগণের প্রশিক্ষণলব্ধ জ্ঞানকে বাস্তবে কাজে লাগানো অনেক বেশি জরুরী;
৬. বিদ্যালয়কে শিশুর জন্য আকর্ষণীয় করা, যাতে করে সে প্রতিনিয়ত বিদ্যালয়ে আসে।

শিক্ষাখাতে ব্যয়ের দিক থেকে বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে সব থেকে পিছিয়ে, যদিও প্রতি অর্থবছরে শিক্ষাখাতে বাজেটের পরিমাণ বৃদ্ধি পাচ্ছে। উন্নয়নকামী দেশ হিসেবে এই বর্ধিত বাজেট যাতে করে যথাযথ ব্যবহার হয় সেদিকে সকলের দৃষ্টিপাত করা আবশ্যক। প্রাথমিক শিক্ষা ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীদের বয়সসীমার কথা চিন্তা করে যদি সুযোগ ব্যয়ের কথাটি আপাতদৃষ্টিতে বিবেচনায় নাও আনা হয়, তদুপরি প্রত্যক্ষ ব্যয়ের বিষয়টি অনেক গুরুত্বপূর্ণ। প্রাথমিক শিক্ষার মানোন্নয়নের লক্ষ্যে সরকারের গৃহিত পদক্ষেপ কর্মসূচি-৩ নিঃসন্দেহে আশার আলো দেখাবে।

হোসনে আরা: সাবেক শিক্ষার্থী, শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়; ডেপুটি ম্যানেজার-শিক্ষা, সেভ দ্য চিলড্রেন।

Sending
User Review
0 (0 votes)

লেখক সম্পর্কে

সম্পাদক বাংলাদেশের শিক্ষা

এই লেখাটি সম্পাদক কর্তৃক প্রকাশিত। মূল লেখার পরিচিত লেখার নিচে দেওয়া হয়েছে।

মন্তব্য লিখুন