গবেষক মন ও বুদ্ধিগত মূল্য সংযোজন
পূর্বের অংশগুলো পড়ে অনেকের হয়তো মনে হতে পারে যে, আমি অতি আদর্শবাদীদের মতো কথা বলছি। বর্তমান দুনিয়ায় সবকিছুই যখন লেনদেন এবং অর্থমূল্যে নির্ধারিত, তখন বিশ্ববিদ্যালয়কে আলাদা করে আদর্শ ভাবা অবাস্তব চিন্তা।
হ্যাঁ, বর্তমান দুনিয়ায় একটি অর্থনৈতিক মূল্য ছাড়া কোনোকিছুই চলে না এটিই বাস্তবতা। কিন্তু সেক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রোডাক্ট বা পণ্য কী হবে? সেটি কি সবাই মিলে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষাকে মণিমুক্তার মতো একটি পরম মূল্যবান আরাধ্য বানিয়ে সার্টিফিকেটটাই পণ্য হবে? নাকি বিশ্ববিদ্যালয় সেই মণিমুক্তার খনি হিসাবে অর্থ উপার্জনের কেন্দ্র হবে? নাকি বিশ্ববিদ্যালয় হবে শেয়ার বাজারের মতো, যেখানে শেয়ারের ডেরিভেটিভের মতো সার্টিফিকেটের দাম হবে?
নাকি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্জিত জ্ঞান নতুন চিন্তা ও গবেষণায় সাফল্যের মাধ্যমে প্রতিটি বিষয়ে একটি বুদ্ধিগত মূল্য সংযোজন করবে? যেখানে নতুন জ্ঞান, সমস্যা সমাধান ও উদ্ভাবনই হবে পণ্য? সার্টিফিকেট নয়, নতুন চিন্তা করার ক্ষমতা, সমস্যা সমাধান ও উদ্ভাবনী ক্ষমতা হবে মূল্য সংযোজন?
বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণার কথা উঠলেই যে কথাটি সবার আগে প্রতিধ্বনিত হয়, সেটি হলো বরাদ্দ নেই। সম্প্রতি নিউজ রিপোর্টগুলো বলছে যে, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে গবেষণার জন্য যে বরাদ্দ আছে তার অর্ধেকও খরচ হয় না। এমনও প্রতিবেদন এসেছে যে, গবেষণায় বরাদ্দকৃত অর্থ শিক্ষকেরা ভাগাভাগি করে নিয়ে নিয়েছেন।
আমার ব্যক্তিগত ধারণা হচ্ছে, গবেষণা প্রাথমিকভাবে সবসময়ই একটি ব্যক্তিগত উদ্যোগ। এর জন্য প্রথম প্রয়োজন গবেষক মন।
আলবার্ট আইনস্টাইনের মহাবিশ্ব নিয়ে গবেষণার উপকরণ ছিলো পুরোনো চিঠির খাম। কারণ নতুন একটি চিন্তা আসলেই তিনি ছোট্ট একটি নোট বা একটি সমীকরণ লিখে সমাধান করতেন। সেই আমলে চিঠিপত্রের যুগে টেবিলের ওপর হাতের কাছে থাকতো পুরোনো চিঠির খাম।
বেশিরভাগ তত্ত্বগত গবেষণায় অর্থ লাগে না। সেটির তত্ত্ব প্রমাণে হয়তো কখনও কখনও লাগে। আমাদের অর্থ না থাকলে আমরা তত্ত্বগত গবেষণায় মনোনিবেশ করি না কেন?
বর্তমানে অনলাইন যুগে বই পড়তে টাকা লাগে না, কাগজও কিনতে হয় না। গবেষণার কখা উঠলেই অর্থের প্রশ্ন তোলেন যারা তাদের গবেষণার বিস্তার সম্পর্কে কোনো ধারণা নেই। গবেষক মন গবেষণা না করে থাকতে পারে না। এর জন্য জীবিত থাকতে হয় কগনিটিভ ডিজোনেন্স। প্রচলিত চিন্তা বা ধারণার ত্রুটি তাদের মনে খচখচ করতে থাকে।
যাঁরা একই সাথে জেনেসিসের আদম-হাওয়াতে বিশ্বাস করেন, আবার জেনেটিক্স ও কোয়ান্টাম রসায়নে পণ্ডিত, তাঁদের কগনিটিভ ডিজনেন্স মৃত। তাঁদের গবেষক মনও মৃত। হাজার কোটি টাকা তাদের পেছনে গবেষণায় খরচ করলেও ফল কিছু হবে না।
পিথাগোরাসের সাথে আমরা সবাই পরিচিত। খ্রিস্টপূর্বাব্দ ৫৭২– ৪৯৭ সময়ের তিনি ছিলেন একজন আয়োনীয় গ্রিক দার্শনিক, গণিতবিদ এবং পিথাগোরাসবাদী ধর্মীয় কাল্টের জনক। পিথাগোরীয়রা মনে করতেন, জ্যামিতি পবিত্র স্বর্গীয় বিষয় এবং যেটির কাগজে (বা মাটিতে) আঁকাআকি গোনাহর কাজ। পিথাগোরীয়রা জ্যামিতি কষত মনে মনে।
গণিতে পিথাগোরাসের উপপাদ্য বিদ্যালয়ের পাঠ্য। এটি ইউক্লিডীয় জ্যামিতির অন্তর্ভুক্ত সমকোণী ত্রিভুজের তিনটি বাহু সম্পর্কিত একটি সম্পর্ক। যেটি তিনটি সংখ্যার একটি সেট তৈরি করে যাকে বলে পিথাগোরিয় ত্রয়ী (Pythagorean Triplets)। এই পিথাগোরিয় ত্রয়ী হলো A, B ও C তিনটি সংখ্যার সেট যেখানে A²+B²=C² এমন সম্পর্ক বিদ্যমান।
বর্তমানের ইরাক ও সিরিয়া এলাকার প্রাচীন নাম ছিল মোসোপটেমিয়া এবং সেখানে ছিল ব্যাবিলন রাজ্য। সেই ব্যাবিলন রাজ্যে মানে বর্তমান ইরাকে প্রত্নতত্ত্ববিদেরা ৩,৮০০ বছর আগের একটি ট্যাবলেট (পোড়া মাটির উপর লেখা স্ক্রিপ্ট) পান যেটাকে বলা হয় Plimpton 322। সেই ট্যাবলেটে একটি সংখ্যার টেবিল দেখা যায় যে সংখ্যাগুলো পিথাগোরীয় সম্পর্ক মেনে চলে।
২০১৭ সালে এটি নিয়ে বিদ্যান মহলে আলোড়ন ওঠে যে পিথাগোরাসের জন্মের দেড় হাজার বছর আগে ব্যবিলনিয়রা পিথাগোরাসের জ্যামিতি সম্পর্কে জানতো। এটির বিরোধিতায় সাইন্টিফিক আমেরিকানের মত পত্রিকাও নেমে পড়ে কারণ এতে জ্ঞানচর্চায় ইউরোপ বা পশ্চিমাদের যে খ্যাতি সেটি খর্বিত হয়। তারা বলতে থাকে কিছু সংখ্যা যা পিথাগোরিয় ত্রয়ীর সাথে মিলে যায়, কিন্তু এটি যে জ্যামিতিক ত্রিকোণমাতির থেকে এসেছে তার প্রমাণ কী?
২০২১ সালের সেপ্টেম্বরে এক অস্ট্রেলিয় গণিতবিদ নিউ সাউথ ওয়েলস বিশ্ববিদ্যালয়ের ড্যানিয়েল ম্যানসফিল্ড Si.427 নামে আর একটি ট্যাবলেটের মর্ম উদ্ধার করেন। যে ট্যাবলেটিটিতে স্পষ্ট আঁকা যে, তখনকার ভূমি জরিপে ব্যবহৃত হতো পিথাগোরিয় ত্রিভুজের ধারণা ও পিথাগোরিয় ত্রয়ীর সারণি। এবং আগে পাওয়া ট্যাবলেট Plimpton 322 দৈব কোোকিছু নয়। এটি নিশ্চিত যে, প্রায় ৪,০০০ বছর আগে ব্যাবেলনিয়রা বা বর্তমানের ইরাক সিরিয়া এলাকার লোকেরা পিথাগোরীয় জ্যামাতি শুধু জানতই না, তারা সেটার ব্যাবহারিক প্রয়োগও করতো। ট্যাবলেট Plimpton 322 ও ট্যাবলেট Si.427 আদি মধ্যপ্রাচ্য এলাকার মানুষদের সভ্যতার পরিচয় বহন করে।
এই লেখায় এই প্রসঙ্গ আনার কারণ হলো, এই ট্যাবলেট Si.427, প্রাচীন সিপার শহরের এক ব্যাবিলনিয় মন্দিরে আবিষ্কার হয় ১৮৯৪ সালে। যেটি বর্তমানে ইরাকে এবং আবিষ্কারটি হয়েছিল ফরাসিদের দ্বারা। এরপর ১০০ বছরের বেশি এই ট্যাবলেটটি দর্শনীয় বস্তু হিসাবে পড়ে থাকে তুরষ্কের ইস্তাম্বুল জাদুঘরে। কোনো তুর্কী, ইরাকি, মুসলিম গবেষক আগ্রহী হননি নিজেদের অতীতের এই মহাসম্মানজনক বিষয়টি আবিষ্কারে।
পশ্চিমা অস্ট্রেলিয় গবেষকেরা অনেক কষ্টে বছরের পর বছর চেষ্টায় এর একটি ছবি সংগ্রহ করেন তুরষ্ক কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে।
এই আবিষ্কারের দুটি বড় অর্জন আছে। একটি হলো, পিথাগরীয়ানদের যে মত, যে গণিত ইশ্বরের সৃষ্টি এটা সেই ধারণা ভেঙ্গে দেয় এবং প্রমাণ করে যে গণিত পার্থিব প্রয়োজনে সৃষ্টি। দ্বিতীয়টি আরও গুরুত্বপূর্ণ। সেটি হলো, ইতিহাস বলে ওই সময়ে দ্রুত শহরীকরণের ফলে জমির ব্যক্তিগত অধিকার প্রতিষ্ঠিত হতে শুরু করে। সেই কারণে জমির মাপজোক ও সার্ভে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। সেই কারণে গবেষণা ও উদ্ভাবন ছাড়া পথ থাকে না।
এর অর্থ হলো, গবেষণা হতে হবে সমস্যা সমাধানের এবং স্থানীয়। সেটি না হলে তা হালে পানি পাবে না। আমাদের বাংলাদেশের কি স্থানীয় সমস্যার কোনো অভাব আছে? তবুও কেন মানুষ এতে যুক্ত হয় না?
আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা ও উচ্চশিক্ষার মানের নিম্নগামীতাই কি একটি বিশাল সমস্যা নয়? কিন্তু এটি নিয়ে গবেষণা কই?
আমাদের চিত্রকলা শিল্পীদের দিকে তাকিয়ে দেখলে দেখা যাবে, জয়নুল আবেদিন প্রজন্মের পর সবাই বিদেশিদের দিকে তাকিয়ে শিল্পকর্ম করেন। সাধারণ মানুষের দুঃখ-কষ্ট-যাতনার চেয়ে তারা উন্নত দেশের রাষ্ট্রদূতদের দুঃখ-কষ্ট-যাতনায় বেশি উদ্বিগ্ন।
আমাদের উচ্চশিক্ষিতরা এবং গবেষকেরাও তাই। তাঁরা চিন্তা ভাবনা করেন কোন বিষয়ে গবেষণা করলে আন্তর্জাতিক জার্নালে গবেষণাপত্রটি প্রকাশ হবার সম্ভাবনা বেশি, নিজেদের সমস্যা নিয়ে নয়।
২০১৩ সালের ৩০ ডিসেম্বর ভারতের টাইমস অব ইন্ডিয়া একটি সাক্ষাৎকার প্রকাশ করে শ্রীনাথ রাঘবন নামে এক গবেষক ও গ্রন্থকারের। তিনি অশোকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস ও আন্তর্জাতিক সম্পর্কের অধ্যাপক এবং লন্ডনের কিংস কলেজের সিনিয়র রিসার্চ ফেলো।
শ্রীনাথ রাঘবন বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে একটি বই লিখেছেন এবং তিনি প্রমাণ করতে চেয়েছেন বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতা আসলে একটি বিশ্ব ঘটনা (গ্লোবাল অ্যাফেয়ার)। তিনি এও লিখেছেন ১৯৭১ পর্যন্ত আওয়ামী লীগ স্বাধীনতা চায়নি।
অবশ্যই বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের একটি গ্লোবাল পার্সপেকটিভ আছে। তিনি হয়তো সঠিকভাবে জানেন না যে, ৫২ থেকে বাংলাদেশের মানুষের মনোজগতে কী ঘটেছিলো। ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধের গ্লোবাল পার্সপেকটিভ যাই হোক না কেন, সেটির লক্ষ্য আমাদের কাছে স্বাধীনতা অর্জনই ছিলো।
গণতান্ত্রিক আন্দোলনে খোলামেলা স্বাধীনতা চাওয়া যায় না, সেটি রাষ্ট্রদ্রোহীতা ও বেআইনি হয়ে যায় এবং যার অর্থ গণতান্ত্রিক আন্দোলনের মৃত্যু।
একজন বিদেশি হিসাবে তাঁর সেটি জানার কথা নয় যদি না তিনি গণতান্ত্রিক আন্দোলন সম্পর্কে বিশেষ জ্ঞান না রাখেন। বর্তমান দুনিয়াতে বড় ধরনের গণতান্ত্রিক আন্দোলনের ঘটনা খুব বেশি নয়। এই কারণে গ্লোবাল পার্সপেকটিভ তথা কোল্ড ওয়ারের টানটান সময়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলন একটি বিস্ময়কর ঘটনা।
সারা দুনিয়ায় সামরিকতা ও জিয়োপলিটিক্সের দাপটের সময়ে জনগণের শক্তিতে একটি শান্তিপূর্ণ আন্দোলনের মাধ্যমে একটি দেশ স্বাধীন হওয়া একটি বিস্ময় এবং গণমানুষের শক্তির এক বিশাল প্রমাণ। কিন্তু এটিকে অনেকে দেখেও দেখেনি কেন? কারণ আমাদের উচ্চ শিক্ষিতরা এটা দেখেননি। তাই সারা দুনিয়া দেখেনি।
ওই একই প্রবন্ধের মন্তব্য সেকশনে ভারতের বিশাখাপট্টম থেকে সমুদ্রালা কৃষ্ণমূর্তি নামে এক ব্যক্তির মন্তব্যে এটি পরিষ্কার হয়। সমুদ্রালা কৃষ্ণমূর্তি লেখেন:
“আমার মনে আছে, প্রায় ৪০ বছর আগে ইতালিতে, আমি বাংলাদেশের একজন নিউক্লিয়ার ফিজিসিস্টের সাথে কাজ করছিলাম যেটি (বাংলাদেশ) ঠিক তখনই গঠিত হয়েছিল। আমাদের গবেষণা বিষয়ে আলাপ-আলোচনা ছাড়াও আমরা দুপুরের খাবারের সময় ধর্ম, রাজনীতি এবং এই জাতীয় অন্যান্য বিষয় নিয়ে আলোচনা করতাম।
তার নাম ছিল ‘নূর’ কিছু একটা। তিনি পূর্ব বাংলা বা পূর্ব পাকিস্তানের স্বাধীনতাকে ‘তথাকথিত’ বলতেন এবং সেটাতে ভারতের ভূমিকাকে দায়ী করতেন।
তিনি এবং তার বেশ কয়েকজন সহকর্মী পূর্ব পাকিস্তান বিষয়ে ভারতের হস্তক্ষেপ অপ্রয়োজনীয় এবং শেখ মুজিব ছিলেন একজন বিশ্বাসঘাতক এবং তিনি ইসলামের জন্যও ছিলেন বিশ্বাসঘাতক এগুলোই বলতেন।
মনে রাখবেন তারা সবাই আমেরিকা থেকে পিএইচডি অর্জন করেছে। তখন তারা কেউই পূর্ব পাকিস্তানে থাকে না।
এটাই ছিল সেই সময়ের বেশিরভাগ শিক্ষিত মানুষের সেন্টিমেন্ট। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে কর্মরত তাদের অনেকেই নিশ্চিত ছিলেন যে, সেক্যুলার (স্বাধীন) বাংলাদেশ একটি ননসেন্স পরিকল্পনা এবং যেটা মুজিবের মুখের উপর বিস্ফোরিত হবে এবং ভারতকে উচিৎ শিক্ষা দেবে।”
বিশাখাপট্টমের সমুদ্রালা কৃষ্ণমূর্তি কী লিখলেন সেটির কোনোই মূল্য থাকতো না যদি বাংলাদেশে বসে চোখের সামনে বাংলাদেশের জন্ম আমরা পর্যবেক্ষণ না করতাম। সমুদ্রালা কৃষ্ণমূর্তি যেন আমার মনে যে ধারণা সেটিই তুলে ধরেছেন।
এর প্রমাণ হল স্বাধীনতার পরে স্বাধীন দেশে আমরা যে গণতান্ত্রিক আন্দোলন দেশকে স্বাধীন করেছে সেটি সম্পর্কে আমাদের বেশিরভাগ শিক্ষিত মানুষ এবং স্কলাররা কী মনোভাব রাখেন সেটির দিকে তাকাই।
ক্যারল ক্রিস্টিন ফেয়ার নামে জর্জটাউন বিশ্ববিদ্যালয়ের এক আমেরিকান গবেষক দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতি ও সন্ত্রাস নিয়ে কাজ করেছেন। আমি তাঁর কাজের খুবই উৎসাহী পাঠক কারণ আমাদের উপমহাদেশে বিশেষ করে পাকিস্তানের রাজনীতিতে সামরিক বাহিনীর প্রভাব নিয়ে তাঁর মতো সাহসী এবং পরিশ্রমের কাজ খুব কম গবেষকই করেছে।
পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর ভেতরে মানসিক অবস্থা বোঝার জন্য তিনি তাঁদের অভ্যন্তরীণ যে ডক্যুমেন্টস এবং সেনাবাহিনীর যে ক্যাজ্যুয়াল ডিসকাশন সেগুলোও বিশ্লেষণ করেছে। এরপর তাঁর বইতে পাকিস্তানের রাজনীতিতে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর যে প্রভাব তুলে ধরেছেন যা বিস্ময়কর রকমের সঠিক। এবং এর ফল যে আমেরিকার আফগান নীতিতে পড়বে সেটা তিনি তখনই (২০১৫) ভবিষ্যদ্বাণী করেছেন যা ২০২১-এর আফগানিস্তানে আমেরিকার পরাজয়ের মাধ্যমে সত্য প্রমাণিত হয়েছে।
আমি উৎসাহী ছিলাম বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে তার মনোভাব কী সেটি জানতে। হতাশ হলাম এটি দেখে যে, ক্রিস্টিন ফেয়ার সেই ভাবধারা ধারণ করেন যা বংলাদেশের স্বাধীনতাবিরোধী এলিট স্কলারেরা ধারণ করে। সেটি হলো, এক রেবেল নেতার লোক খেপানো কিছু দাবির প্রতি ভারতের সমর্থনে এবং পাকিস্তানী রাজনীতিবীদদের ভুলের কারণে বাংলাদেশের সৃষ্টি।
এই ন্যারেটিভে ৫২ থেকে আমাদের গণতান্ত্রিক আন্দোলন, নীতি ন্যায়বিচার এবং মানবাধিকারের জন্য শান্তিপূর্ণ যে ক্রমবিকাশমান গণবিদ্রোহ – তার কোনো মূল্যায়ন নেই। হতাশ হলেও থেমে থাকলাম না কারণ তিনি বিদেশী মানুষ। খুঁজতে শুরু করলাম বাংলাদেশ সম্পর্কে তাঁর জ্ঞানের উৎসগুলো কী কী।
অবাক হলাম এটি জেনে যে বাংলাদেশ সম্পর্কে তার জ্ঞানের প্রধান এবং অনেকটা একমাত্র উৎস ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক প্রাক্তন অধ্যাপক যিনি আমেরিকায় বসে আমাদের এখন নিয়মিত গণতন্ত্র শেখান। ঢাকা বিশ্ববিদ্যলয়ের এই প্রাক্তন অধ্যাপকের অনেক গবেষণাই আমাদের দেশে মাদ্রাসা এবং সন্ত্রাসবাদ নিয়ে।
আমি নিজে সন্ত্রাসবাদ নিয়ে গবেষণা করার সময় দেখেছি তাঁর প্রায় সব গবেষণাই ভুল যেখানে সন্ত্রাসবাদের জন্য মাদ্রাসা এবং রাজনীতিবিদেদের দায়ী করা হয়েছে। হোলি আর্টিজানে হামলার পর হাতেকলমে প্রমাণ হয়েছে যে, এসব গবেষণা ভুল এবং বিদেশী হাইপোথিসিসের কষ্টকল্প প্রসূত।
গবেষণাকে অবশ্যই গবেষক মন যাদের আছে তাদের নিজেদের সমস্যা হতে হবে এবং সেটিকে স্থানীয় হতে হবে। গবেষকের পদ ও সুযোগ যারা নিয়ে নিচ্ছেন, তাঁরা যদি অন্যের স্বপ্নের রূপকার হন, তাহলে তাদের গবেষণা কোনো কাজে তো লাগবেই না বরং জ্ঞানকে ভুল পথে নিয়ে যাবে।
প্রশ্ন উঠতে পারে, অস্ট্রেলিয় গণিতবিদ ড্যানিয়েল ম্যানসফিল্ডের ৩৮০০ বছর আগের Si.427 ট্যাবলেট নিয়ে গবেষণা কীভাবে তাঁর নিজের সমস্যা হতে পারে? কীভাবে সেটি তিনি নিজেই বলেছেন। তিনি প্রমাণ করতে চেয়েছেন, গণিত ঐশ্বরিক তত্ত্বচিন্তা থেকে নয়, জীবনের প্রয়োজনে সৃষ্ট। তার গবেষণা গণিতবিদ হিসাবে তাঁকে নিজেকে তাঁর কাজের যৌক্তিকতায় তাঁকে আরও প্রতিষ্ঠিত করেছে।
আমাদের স্কলারেরা যদি তাঁদের নিজেদের মতো মেধাবীকে ফেলে রাস্তার রাজনৈতিক নেতা রাতারাতি প্রধানমন্ত্রী হয়ে গেল এই হীনমন্যতায় না ভুগতেন। তাঁরা যদি কোন প্রেরণা, কোন মেধা শেখ মুজিবকে শান্তিপূর্ণ আন্দোলনের মাধ্যমে বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনের পথে নিয়ে গেল, সেটি নিয়ে গবেষণা করতেন।
একটি গরীব, প্রায় নিরক্ষর জনগোষ্ঠী যাদের রাতের খাবারের নিশ্চয়তা নেই, তারা কীভাবে উদ্যমের সাথে রাজনৈতিক আন্দোলনে জড়িয়ে পড়ে এটি নিয়ে গবেষণা করতেন। কীভাবে সাধারণ মানুষ খালি হাতে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর মতো একটি আধুনিক সশস্ত্র প্রশিক্ষিত বাহিনীর সাথে লড়াইয়ে নেমে পড়ে, সেটি নিয়ে গবেষণা করতেন। তাহলে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো হয়ে উঠতো রাজনীতি ও রাষ্ট্রবিজ্ঞান শেখার মক্কা। সেক্ষেত্রে দুনিয়ার সকল দেশ থেকে আমাদের দেশে আসতো তারা গণতন্ত্র শিখতে। হতো না ৭৫ এর মতো ঘটনা।
বর্তমানে সারা দুনিয়ায় গণতন্ত্রের যে ক্রান্তিকাল, সেখানে আমাদের জ্ঞান ও গবেষণা পথ দেখাতে পারতো সারা দুনিয়াকে। বিশ্ববিদ্যালয়কে তাই চিন্তা ও গবেষণার মাধ্যমে বুদ্ধিগত মূল্য সংযোজন (intellectual value addition) করতে হবে। যার ফলে বাড়বে বুদ্ধিবৃত্তিক সম্পদ (intellectual capital)। এই বুদ্ধিবৃত্তিক সম্পদ বাড়িয়ে তোলে অর্থনৈতিক সম্পদ ও জাতীয় সক্ষমতা বা ক্যাপাসিটি।
আমাদের মেধা দিয়ে যদি অন্য মানুষের সমস্যার সমাধান করি, তাহলে আমরা ব্যক্তিগতভাবে হয়তো লাভবান হই। আর আমাদের মেধা প্রয়োগ করে যদি আমরা নিজেদের সমস্যার সমাধান করি, তাহলে পুরো জাতি লাভবান হয়। এই হিসাবটি আমাদের শিক্ষিত সমাজ ধরতে পারছে না। তার ফলে তারা পড়ে যাচ্ছে উচ্চশিক্ষার ক্যাচ -২২ এর গোলকধাঁধায়। যেটি থেকে বের হবার পথ তাদের অজানা।