বাংলাদেশের শিক্ষা
বাংলাদেশের শিক্ষা

শিক্ষাবিষয়ক একটি সেমিনারে চা-বিরতিতে বিভিন্ন বিষয়ে কথা হচ্ছিলো কয়েকজন উন্নয়নকর্মীর সঙ্গে। একপর্যায়ে বিভিন্ন প্রাথমিক বিদ্যালয়ে টিফিনে শিশুদের বিস্কুট খাওয়ানো বা এজাতীয় কর্মসূচি নিয়েও আলোচনা শুরু হয়। সেমিনারে যোগ দেওয়া একজন বিদেশি কনসালটেন্ট আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন, বিদ্যালয়ে শিশুদের বিস্কুট খাওয়ানোর কর্মসূচি সম্পর্কে আপনার মন্তব্য কী? এরকম আর কী কর্মসূচি গ্রহণ করলে শিশুদের বিদ্যালয়ে নিয়মিত আসাটা স্থায়ী অভ্যাসে পরিণত হবে?

আমি জবাব দিয়েছিলাম, আপনার প্রশ্নটির উত্তর দিতে আমি অপারগ। কারণ আমি মনে করি না, বিস্কুট প্রদান বা এ ধরনের কোন কর্মসূচির মাধ্যমে শিশুর বিদ্যালয়ে নিয়মিত আসাটা স্থায়ী অভ্যাসে পরিণত করা সম্ভব।

তিনি জিজ্ঞেস করেছিলেন, আপনার এরকম মনে হওয়ার কারণ কী?

আমি বলেছিলাম, শিশুর বিদ্যালয়ে নিয়মিত আসা বা না আসা মূলত তার পরিবারের অর্থনৈতিক স্বচ্ছলতার ওপর নির্ভরশীল। যে শিশুকে পরিবারের বয়স্ক সদস্যদের সঙ্গে কাজ করতে হয় বা লেখাপড়ার খরচ মেটানোর সামর্থ্য যে পরিবারের নেই, সে পরিবারের শিশু বিদ্যালয়ে নিয়মিত হয় না। বিস্কুট প্রদান বা এ ধরনের কর্মসূচির ফলে শিশুরা সাময়িকভাবে বিদ্যালয়ে আসতে উৎসাহ পায় সত্যি, কিন্তু কর্মসূচি বন্ধ হলে বা বিরতি পড়লে আবার অবস্থা আগের মতোই হয়। তাই শিক্ষাপ্রদানের পাশাপাশি পরিবারের অর্থনৈতিক উন্নতির দিকটি না ভাবলে বছরের পর বছর এ ধরনের কর্মসূচি আসবে, কিন্তু অবস্থার পরিবর্তন খুব একটা হবে না।

আমার উত্তর বোধহয় তাঁর ভালোলাগে নি। বলেছিলেন, পরিবারের অর্থনৈতিক অবস্থার বদল নিয়ে আমরা আলোচনা করছি না। এটা যাদের কাজ তারা করবে, আমাদের কাজ আমরা করব।

আমি আবারো বলেছিলাম, শিক্ষাপ্রদান ও দারিদ্র্য দূরীকরণ- দুটো বিষয়কে একসূত্রে না গাঁথলে শিক্ষার্থীদের ঝরে পড়া, বিদ্যালয়ে নিয়মিত না আসা কিংবা মানসম্মত প্রাথমিক শিক্ষা নিশ্চিতকরণ, কোনটিই পূর্ণাঙ্গভাবে অর্জিত হবে না।

প্রাসঙ্গিকভাবে এখানে বলা যায়, এ ধরনের স্কুল ফিডিং কর্মসূচি উন্নত দেশগুলোর অনেক বিদ্যালয়ে চালু আছে। শুধু শিশুদের বিদ্যালয়ে আসাকে নিয়মিত করতে নয়, বাসা থেকে খাবার আনার ঝামেলা নেই, খাবারের পুষ্টিমান রক্ষা করা এবং সব শিশু একই ধরনের খাবার খাওয়ায় এক ধরনের বৈষম্যহীনতা- ইত্যাদি বিষয়ও এ ধরনের কর্মসূচির নানা দিক।

প্রাথমিক শিক্ষা অবৈতনিক হলেও অভিভাবকদের একটি বড় অংকের টাকা খরচ হয় শিক্ষার্থীদের লেখাপড়ার উপকরণ কেনার পেছনে। এই দিকটিকে অনেক সময় উপেক্ষা করা হলেও শিশুদের লেখাপড়া চালিয়ে নেওয়ার ক্ষেত্রে এটি একটি বড় বাধা হিসেবে কাজ করে। দেশের ৪০ শতাংশ শিশু উপবৃত্তির সুবিধা ভোগ করছে সত্যি, কিন্তু যে এলাকার ৮০ ভাগ মানুষই দরিদ্র সেখানে বাকি ৪০ শতাংশ শিশু তো এটা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। তাদের লেখাপড়া চালিয়ে নিতে অভিভাবকদের তো হিমশিম খেতে হচ্ছে। আবার যে পরিমাণ টাকা উপবৃত্তি হিসেবে দেওয়া হয়, সেটি শিক্ষার্থীদের লেখাপড়ার অন্যান্য খরচ মেটানোর মতো যথেষ্ট নয়। অনেক বিদ্যালয়েই এই উপবৃত্তির টাকা বিতরণ করতে গিয়ে শিক্ষকদের নানা অপ্রীতিকর অবস্থারও মোকাবিলা করতে হয়। ‘আমার মাইয়ারে না দিয়া হের মাইয়ারে দিলা কেরে’- অভিভাবকের এ প্রশ্নের জবাব থাকে না শিক্ষকের কাছেও। উপবৃত্তির টাকার পরিমাণ না বাড়িয়ে উপবৃত্তিপ্রাপ্তদের শিক্ষার স্থায়ীত্ব যেমন নিশ্চিত করা যাবে না, তেমনি সারা দেশে ফ্লাট রেটে ৪০ শতাংশ শিশুকে উপবৃত্তি না দিয়ে এলাকাভিত্তিক ও চাহিদানুসারে এই শতাংশের পরিমাণ ঠিক না করলে উপবৃত্তি কর্মসূচির তাৎপর্যপূর্ণ এবং স্থায়ী প্রভাব পাওয়া যাবে কি-না, তা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে।

রাষ্ট্রীয়ভাবে এখনই সব শিশুর শিক্ষার দায়িত্ব নেওয়া সম্ভব হবে না। কিন্তু রাষ্ট্রের চিন্তা থাকতে হবে শিশুর এ মৌলিক অধিকারটি পূরণের লক্ষ্যে রাষ্ট্রকেই মূল ভূমিকা পালন করতে হবে এবং আগামীতে রাষ্ট্র যেনো শিক্ষার সব দায়িত্ব নিতে সম হয়, সে ধরনের পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে। শুধু সাময়িক কিছু পরিকল্পনা নেওয়ার মধ্যে রাষ্ট্রের উদ্যোগ সীমাবদ্ধ থাকলে বছরের পর বছর এ ধরনের আক্ষেপ চিরদিনের মতো থেকেই যাবে।

আরেকটি বিষয়ও এখানে আলোচনা করা দরকার। ১৯৯০ সালে থাইল্যান্ডের জমতিয়েনে বিশ্ব শিক্ষা সম্মেলনে ২০০০ সালের মধ্যে ‘সবার জন্য শিক্ষা’ নিশ্চিত করার জন্য সব দেশের প্রতি আহ্বান জানানো হয়। সেটি যে তখন অর্জিত হয়নি বলাই বাহুল্য। এরপর ২০০০ সালে ডাকারে অনুষ্ঠিত বিশ্ব শিক্ষা ফোরামে সবার জন্য শিক্ষা নিশ্চিত করার জন্য ছয়টি লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়। একই বছরে জাতিসংঘের মিলেনিয়াম সামিট কর্তৃক ঘোষিত সহস্রাব্দের উন্নয়ন লক্ষ্যে ২০১৫ সালের মধ্যে সবার জন্য প্রাথমিক শিক্ষা নিশ্চিত করার কথা বলা হয়। বাংলাদেশও এই আন্দোলনে শামিল এবং যার পরিপ্রেক্ষিতে বিভিন্ন উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। বাংলাদেশে বর্তমানে শিশুদের বিদ্যালয়ে নেট ভর্তি হওয়ার হার ৮৭ শতাংশের বেশি।

অর্থাৎ বাংলাদেশ সবার জন্য শিক্ষা নিশ্চিত করতে সর্বশক্তি ব্যয় করছে সরকারি ও বেসরকারি উভয়ভাবেই। কিন্তু এদিকটির প্রতি জোর দিতে গিয়ে মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করার বিষয়টির একরকম উপো করা হয়েছে। এডুকেশন ওয়াচ ২০০০ সালের গবেষণা রিপোর্টে দেখা গেছে, প্রাথমিক শিক্ষাচক্র সম্পন্ন করার পর কাগজে-কলমে পরিমাপযোগ্য ২৭টি প্রান্তিক যোগ্যতার (মোট ৫০টি প্রান্তিক যোগ্যতা রয়েছে) মধ্যে দুই শতাংশেরও কম শিশু সবকটি যোগ্যতা অর্জন করতে পেরেছে। এটিও দেখা গেছে, পঞ্চম শ্রেণী পাশ করার পরও আমাদের দেশের এক-তৃতীয়াংশ শিক্ষার্থী অ-সাক্ষর বা প্রাক-সাক্ষর স্তরে থেকে যায়। এই দুটো চিত্রই বুঝিয়ে দেয় শিক্ষার গুণগত মানের ক্ষেত্রে আমাদের অবস্থান কোথায়। সন্তোষজনক হারে বিদ্যালয়গামী শিশুর সংখ্যা বাড়ছে এবং সে অনুযায়ী একটি বিরাট সংখ্যক শিশু প্রাথমিক শিক্ষা শেষ করছে বলে যারা তৃপ্ত, সংখ্যাবাচক সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান উর্ধ্বমুখী হচ্ছে বলে যারা পরিতৃপ্ত, তারা কি ভাবছেন এই প্রাথমিক শিক্ষা শেষ করে একটি শিশু সত্যিকার অর্থে কোন উৎপাদনমুখী কাজে জড়াতে পারবে? পারবে আত্মবিশ্বাস নিয়ে সামনে এগিয়ে যেতে?

শিক্ষার সঙ্গে দারিদ্র্য দূরীকরণের বিষয়টি মাথায় রেখে শিশুদের মানসম্মত শিক্ষার বিষয়টি নিয়ে এখন থেকেই জোরেশোরে না ভাবলে আজ থেকে আরো ২০-২৫ বছর পরও এ পুরনো প্রশ্নগুলোই উত্থাপিত হতে থাকবে- এটাই স্বাভাবিক। আর ২০-২৫ বছর ধরে যে জাতি একই প্রশ্ন উত্থাপন করে যায়, তার দিকে বাকি পৃথিবী করুণাভরে তাকাবে, তাও স্বাভাবিক।

(লেখাটি সম্পাদিত হয়ে প্রথম আলোর উপসম্পাদকীয় বিভাগে প্রকাশিত হয়েছিলো। মূল লেখাটি এখানে আংশিক পরিমার্জন করা হয়েছে।)

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে