জেন্ডার ও জেন্ডার শিক্ষা নিয়ে আলোচনা ও এর ধারণা আজ নতুন নয়। হয়তো আনুষ্ঠানিকভাবে গুটিগুটি পায়ে এগিয়েছে, কিন্তু আশেপাশে, সমাজে, ঘরে সকল জায়গাতেই জেন্ডার ধারণা বিদ্যমান। জেন্ডার ও জেন্ডার শিক্ষা সম্পর্কে ধারণা থাকলে এই বিদ্যমান জায়গাগুলো বুঝে তা সমাজের কল্যাণের জন্য প্রয়োগ করা যায়। প্রয়োগ করা যায় সমাজে প্রত্যেকের অবস্থান সম্মানিত করার জন্য।

বই-পুস্তকে ছোটবেলা থেকে পড়ে আসা একটি সাধারণ বাক্য হচ্ছে, “মানুষ সামাজিক জীব”। অর্থাৎ সংঘবদ্ধ বা একসাথে হয়ে কিছু মানুষ বসবাস করে। ছোটবেলা থেকে পড়ে আসা বাক্যের সাথে বাস্তবচিত্রের মিলও আছে বটে। শুধু ‘সংঘবদ্ধ’ শব্দটিতে গিয়েই চিন্তাগুলো আটকে যায়। একসাথে বাস করলেই কি সংঘবদ্ধ হওয়া যায়? বা আদৌ কি আমরা হয়েছি?

সংঘবদ্ধ হওয়া বা না হওয়ার পেছনে অনেক কারণ কাজ করলেও এটি অনেকটা জেন্ডার-নির্ভরও। তাহলে প্রশ্ন আসে, জেন্ডার-নির্ভর কেনো? বা জেন্ডারটাই বা আসলে কী বুঝাচ্ছে?

জেন্ডার বলতে সমাজে একজন নারী বা পুরুষের পরিচয় বা কাজকে নির্দেশ করে। জেন্ডার এমন একটি মানসিক ধারণা যার সচেতন বাস্তবে প্রয়োগের ফলে সংঘবদ্ধ শব্দটি সবদিক থেকেই পরিপূর্ণতা পেতে পারে। মানসিক ধারণা এজন্যই যে, সমাজে আমরা কাকে কী পরিচয়ে কোন চোখে দেখে তার কাজের জন্য কতোটুকু সম্মান বা মর্যাদা পোষণ করবো সেটি আমাদের চিন্তাধারা এবং দৃষ্টিভঙ্গির মাধ্যমে আসে। এটি একটি মানসিক ব্যাপার। আর সংঘবদ্ধ হওয়া বা না হওয়া অনেকটাই জেন্ডার-নির্ভর।

প্রথমত, বাস্তবিকভাবে আমরা সমাজে বা ঘরে নারী হিসেবে তার কিছু নির্দিষ্ট কাজ এবং পুরুষ হিসেবে কিছু কাজ ঠিক করে দিচ্ছি। আমরা অনেকক্ষেত্রেই দেখতে পাই যে, ঘরের কাজ করা, সন্তান লালনপালন করা বা এ ধরনের যাবতীয় কাজগুলোকে নারীদের জন্য নির্দিষ্ট ধরা হয়। অর্থাৎ, এই কাজগুলো নারীরাই করবে, তাদের পারতে হবে।

এমনও দেখা যায় যে, একজন পুরুষ এবং নারী কর্মস্থলে একই সময় কাজ করে আসার পরও বাসায় এসে ঘরের কাজগুলো নারীকেই করা লাগছে। আবার বাইরের কাজগুলো পুরুষ করবে এই ধারণাও বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই নির্দিষ্ট হয়ে গেছে। আর মানসিকভাবে সেগুলো পালন না হলে উল্টো রেশে উল্টো পথে হাঁটছি।

যেমন, কোনো নারী যদি বাইরের কাজগুলো করে আর ঘরের কাজগুলোতে আগ্রহী না হয়, তাহলে তাকে শুনতে হয় নানা কটু কথা। আবার কোনো পুরুষ যদি ঘরের কাজ করে বা তার ঘরের নারী সদস্যদের ঘরের কাজে সাহায্য করে, তাহলেও তাকে সম্মুখীন হতে হয় আশেপাশের নানা কটু কথার।

দ্বিতীয়ত, সমাজে জেন্ডারভিত্তিক শ্রদ্ধা, সম্মান বা কাজের মর্যাদা আমরা সঠিকভাবে দিতে পারছি না। শ্রমিক শ্রেণিতে অনেকসময়ই দেখা যায়, সমান কাজ করেও নারীকে পুরুষের অর্ধেক বা তুলনামূলক কম পারিশ্রমিক দেয়া হয়। যদিও উঁচু শ্রেণির চাকরিগুলোতে এই দৃশ্য তেমন না থাকলেও সেখানে হ্যারাসমেন্টের ব্যাপারটি থেকেই যায়। নারী কর্মস্থলে প্রবেশ করা মানেই অনেকক্ষেত্রেই তাকে ভোগ্যবস্তু মনে করে যথাযথ সম্মান দেয়া হয় না। আবার একজন বৃহন্নলা (সাধারণ কথায় তৃতীয় লিঙ্গ) যদি রিকশাচালনা, দোকান চালনাসহ কোনো কাজ করেন, তাতেও কিন্তু তাকে তুলনামূলকভাবে শ্রদ্ধা দেয়া হয় না। অর্থাৎ জেন্ডারভিত্তিক শ্রদ্ধা, সম্মান বা কাজের মর্যাদাটা সঠিকভাবে আমরা দিতে পারছি না। হোক তা পারিশ্রমিক কিংবা অন্যান্য দিক থেকে। এটিও মানসিকভাবে জড়িত।

এই যে জেন্ডার-নির্ভর সংঘবদ্ধতা, এর ইতিবাচকতা বা নেতিবাচকতার এদিক-সেদিক নিয়ে ভাববে কারা? আমাদের শিক্ষার্থীরা। একটি সমাজে যেসব পরিবর্তন হয়েছে বা পরিবর্তনের প্রয়োজন, তার অধিকাংশই করেছে শিক্ষার্থীরা। সেক্ষেত্রে একজন শিক্ষার্থী হিসেবে এই জেন্ডার-নির্ভর সংঘবদ্ধতা বা যে দৃষ্টিভঙ্গিগুলো রয়েছে সেগুলো নিয়ে বিশদ ভাবা এখন সময়ের দাবি। কারণ এখন যদি এসব নিয়ে ভাবা না হয়, তবে সমাজে জেন্ডারভিত্তিক যে বৈষম্যগুলো হয়ে আসছে, তা দূর হতে আরও বেশি সময় পার হয়ে যাবে। ততোদিনেও জেন্ডারভিত্তিক এই দুঃখ ভুক্তভোগীদের ঘুচবে না। এখনই যদি হাল না ধরা হয় তাহলে সমাজ বদলাবে না। বদলাবে না জেন্ডারভিত্তিক এসব দৃষ্টিভঙ্গিও। সময়ের এই দাবি পূরণে তাদের সহায়ক হবে জেন্ডার শিক্ষা।

জেন্ডার শিক্ষার কথা বলে সমাজে ঘটে যাওয়া বিভিন্ন জেন্ডারভিত্তিক বৈষম্য নিয়ে। নারী-পুরুষ বৈষম্য নিয়ে, কথা বলে জেন্ডার সমতা নিয়ে, জেন্ডার স্টেরিওটাইপ নিয়ে। হতে পারে সেটি জেন্ডারভিত্তিক রঙ নিয়ে (যেমন, ছেলেদের রঙ নীল আর মেয়েদের রঙ গোলাপি কিংবা লাল মনে করে শিশুদের মধ্যে সেই ধারণাটি প্রবেশ করিয়ে দেয়া), বাচ্চাদের খেলনা নিয়ে (ছেলেদের খেলনা প্লেন, গাড়ি, মোটরসাইকেল আর মেয়েদের খেলনা পুতুল মনে করা ও শিশুদের মধ্যে সেই ধারণা প্রবেশ করানো) কিংবা অন্য কিছুতে।

ঘরের কাজগুলো শুধু মা-বোনই করবে— এমন সব ধারণা জেন্ডার শিক্ষা পরিবর্তন করে। ঘরের কাজগুলো যে নিতান্তই শুধু ঘরের কাজ নয়, বরং সম্মানের এবং শ্রমের, জেন্ডার শিক্ষা সেটিও শেখায়। কিছু নির্দিষ্ট কাজ ছেলেদের জন্য, আর কিছু নির্দিষ্ট কাজ মেয়েদের জন্য, এমন ধারণা থেকে বের হতেও শেখায় জেন্ডার শিক্ষা। যেমন, ঘরের কাজগুলো নারীদের কিংবা শিক্ষকতা পেশা নারীদের জন্য ভালো। প্রশাসন, রাজনীতি বা শক্তি-সামর্থ্যের মতো পেশাগুলো পুরুষদের জন্য ভালো। এসব ধারণা থেকে বের হতে জেন্ডার শিক্ষা সহায়ক হিসেবে কাজ করে।

ছেলে-মেয়ে বা নারী-পুরুষ যেকোনো কাজ করতে পারে। একে অপরকে সহায়তা করতে পারে। এই যে ধারণা সেটি পোষণ করতে শেখায় জেন্ডার শিক্ষা। একইভাবে, সমাজের নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে উঠিয়ে আনতে বৃহন্নলাদের কর্মসংস্থানে নারী-পুরুষ একত্রে সহায়তা করলে জেন্ডার শিক্ষার উদ্দেশ্য সফল হয়।

নারীরাও পুরুষদের মতো সামাজিক, অর্থনৈতিক কিংবা রাজনৈতিক ক্ষেত্রে ক্ষমতায়ন নিশ্চিত করতে পারে। সেটিও শেখায় জেন্ডার শিক্ষা। এখনো আমাদের সমাজে অনেকেই নারীর কর্মস্থলে প্রবেশকে ভালো চোখে দেখে না। মেয়েদের বাইরের দেশে গিয়ে কোনো প্রশিক্ষণ বা কর্মস্থলের কাজটিকেও ভালোভাবে মেনে নিতে পারে না। এখনো অনেক নারী চাকরি করেও তার অর্জিত বেতন ইচ্ছেমতো ব্যয় করতে পারে না। এক্ষেত্রে নারী কর্মস্থলে গেলেও মূল ক্ষমতায়নের অবস্থানে নেই।

বাংলাদেশে নারীদের অবস্থা অনেকটাই নাজুক। এমনও উদাহরণ আছে যে, বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপিকা বিদেশ যাওয়ার সুযোগ পেয়েও যেতে পারেননি শুধু শ্বশুরবাড়ি থেকে বাধার কারণে। উচ্চশিক্ষিত বেশিরভাগ নারীও কর্মস্থলে প্রবেশ করতে পারেন না পারিবারিক বাধার কারণে। বিদেশে উচ্চশিক্ষার সুযোগ পেয়েও যেতে পারেন না পারিবারিক বাধার কারণে। আর এই পারিবারিক বাধার মূল হচ্ছে পুরুষতান্ত্রিক মনোভাব। দুঃখজনক হলেও সত্যি যে, আমাদের দেশের বেশিরভাগ মায়েরাও পুরুষতান্ত্রিক মনোভাবের। এটি একটি বেড়াজালও বটে। কারণ তারাও তাদের সময় পার করেছেন পুরুষতান্ত্রিকতার ভেতর দিয়েই।

দেশের উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রেও বাধার সম্মুখীন হতে হয় নারীদের। উচ্চশিক্ষা গ্রহণকালেও নারীদের সহ্য করতে হয় আশেপাশের নানা কথা, ভীত থাকতে হয় নিজের সম্মান নিয়ে। অনেক নারী আছে যারা উচ্চশিক্ষাটাও ঠিকভাবে সম্পন্ন করতে পারে না। আবার অনেকক্ষেত্রে পরিবার থেকে পড়াশোনা শেষ না করেই মেয়ের অসম্মতিতে বিয়ে দেয়া হয়। বলা হয় বিয়ের পরও পড়াশোনা করাবে; কিন্তু সেটি আর হয়ে ওঠে না। ক্ষমতায়ন থেকে যায় মরিচীকা হিসেবে। তাই নিজে উপার্জন করেও যেন নারী নিজের ক্ষমতায়ন বাস্তবায়ন করতে পারে, জেন্ডার শিক্ষা সেটিই শেখায় আমাদের।

ছোটবেলা থেকেই যেনো শিশুদের শিশু হিসেবে দেখা হয়, ছেলেমেয়ে আলাদা করে প্রথম থেকেই যেন তাদের স্বাধীন চিন্তাধারা বেড়ে ওঠার জায়গাটা খর্ব না করা হয়, সেটিও শেখায় জেন্ডার শিক্ষা। সাধারণত চার বছর বয়সের পর ছেলেমেয়েদের বেশকিছু ব্যাপার আলাদা করে দেয়া হয়। যেমন, মেয়েশিশু পুতুল বা হাঁড়িপাতিল খেলবে, ছেলেশিশু গাড়ি, বাইক এসব নিয়ে খেলবে বা মাঠে গিয়ে ব্যাটবল খেলবে। ছেলেদের তুলনায় মেয়েদের কম বুদ্ধি বা মেধাসম্পন্ন ধারণা পোষণ করানো হয়।

এসব ক্ষেত্রে পরিবারের অনেক বড় ভূমিকা রয়েছে। পরিবারের উচিত একদম ছোটবেলা থেকে সব সন্তানকে একই চোখে দেখা। ছেলেমেয়ে আলাদা করে তাদের মুক্তচিন্তায় বাধা না দেয়া। সন্তানকে তাদের ইচ্ছেমতো খেলতে দিতে হবে। তারা যেটি শিখতে চায় তাতে বাধা প্রদান করা যাবে না। মেয়ে যদি গিটার বাজানো শিখতে চায়, ক্রিকেট খেলতে চায় তবে তাকে সেগুলো শেখার সুযোগ দিতে হবে, সুযোগ দিতে হবে মাঠে ছুট দেয়ার। আবার, ছেলে যদি নাচ শিখতে চায়, তবে সেটিও তাকে শিখতে দিতে হবে।

পরিবারে ছেলে আর মেয়ের কদর আলাদা করা যাবে না। এতে মানসিকভাবে তারা ভালো কিছু শিখে বড় তো হবেই না, গতানুগতিক ধারাতেই থেকে যাবে। মৌলিক চাহিদা পূরণ ও বেড়ে ওঠার সকল ক্ষেত্রে ছেলে এবং মেয়েকে সমানভাবে সুযোগ দিয়ে বেড়ে তুলতে হবে। পরিবার থেকেই যদি একদম শুরু থেকে বাধা দিয়ে ছেলে-মেয়ে আলাদা করে সবকিছু মানসিকভাবে ঠিক করে দেয়া হয়, তাহলে সেই ধারণা থেকে বের হতে সমাজ ও দেশকে বেশ বেগ পেতে হবে। এজন্য এক্ষেত্রে পরিবারের ভূমিকা অনেক গুরুত্বপূর্ণ। ছেলে এবং মেয়েকে ছোটোবেলা থেকেই সমানভাবে বেড়ে ওঠানোর ধারণাও দেয় জেন্ডার শিক্ষা। যেমন, একটি ছেলেকে অনেকসময়ই বেশি সুযোগ-সুবিধা দেয়া হয়। হতে পারে সেটি হাতখরচ, খাওয়া দাওয়া বা অন্যান্য দিক থেকে।

শিক্ষা হোক একসাথে, জেন্ডারভিত্তিক আলাদা না করে। মনের মধ্যে এই ধারণাটি গেঁথে দেয় জেন্ডার শিক্ষা। এই শিক্ষা হতে পারে সবধরনের শিক্ষা— একাডেমিক কিংবা সহশিক্ষা। নারী, পুরুষ, বৃহন্নলারা প্রত্যেকেই সমান সুযোগ যেন পায় ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গিতেই। শিক্ষায় যখন সবাই একসাথে পড়বার সুযোগ পায়, তখন জেন্ডারভিত্তিক বৈষম্য ও নেতিবাচক ধারণা থেকে বের হয়ে আসতে হবে। তখন কারো মানসিক অবস্থা এমন হবে না যে, জেন্ডারভিত্তিক অবস্থান থেকে উঁচু বা নিচু ভাগ করা হবে না।

সামাজিক নিরাপত্তা হোক সকলের জন্যই সমান। এটিও জেন্ডার শিক্ষা জানায় আমাদের। মানুষ হিসেবে নিরাপত্তা না হয়ে জেন্ডারভিত্তিক নিরাপত্তা হলে সমাজে নানা ধরনের অসঙ্গতি চলে আসে। একজন পুরুষ দিনশেষে অফিস থেকে ফেরার সময় যতোটা নির্ভয়ে আসতে পারে, একজন নারী তা পারে না। আবার একজন বৃহন্নলাকেও চলতে ফিরতে সহ্য করতে হয় অসহ্য যন্ত্রণা।

অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে আমাদের সমাজে বৃহন্নলার অবস্থান। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সমাজে প্রথম জেন্ডার ধরা হয় পুরুষকে, দ্বিতীয় জেন্ডার ধরা হয় নারীকে, এবং এর পরবর্তী অবস্থানে থাকে বৃহন্নলা, তৃতীয় জেন্ডার হিসেবে। সমাজভিত্তিক অবস্থান, সম্মান, মর্যাদা, মেনে নেয়া বা না মেনে নেয়া হয় এই ক্রমানুসারে। তাই শুধু নারী-পুরুষই নয়, নারী-পুরুষ-বৃহন্নলার মধ্যে সমতা আনতে হবে— এটিই জেন্ডার শিক্ষা জানায়।

জেন্ডার শিক্ষা শেখায় সাম্য ও সমতা নিয়ে। অর্থাৎ ইংরেজিতে যাকে আমরা বলি Gender Equity (জেন্ডার সাম্যতা) ও Gender Equality (জেন্ডার সমতা)। যার যতোটুকু প্রয়োজন তাকে ততোটুকুই দেয়া হচ্ছে সাম্যতা। যেমন, দুই ভাইবোনের মধ্যে একজনের বই কিনতে প্রয়োজন ১০০ টাকা, আরেকজনের প্রয়োজন ২০০ টাকা। যার ১০০ টাকা প্রয়োজন, তাকে ১০০ টাকা দেয়া, আর যার ২০০ টাকা প্রয়োজন তাকে ২০০ টাকা দেয়াই হচ্ছে সাম্যতা। আর প্রত্যেকেই সমান দেয়া হচ্ছে জেন্ডার সমতা। যেমন, কারোর ১০০ টাকা প্রয়োজন বা কারোর ২০০ টাকা প্রয়োজন। তখন কার প্রয়োজন কতোটুকু তা বিচার না করে প্রত্যেককেই ২০০ টাকা করে সমানভাবে দেয়া। সহজ করে বললে, আমাদের দেশের ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীসহ প্রান্তিক অঞ্চলের শিক্ষার্থীদের, বৃহন্নলা বা বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিক্ষার্থীদের যদি সকল স্বাভাবিক শিক্ষার্থীদের কাতারে আনতে চাই, তবে তাদের কিছু অতিরিক্ত সহযোগিতা করতে হবে। কারণ এটি তাদের প্রয়োজন যা স্বাভাবিকদের প্রয়োজন নেই। এটি হচ্ছে সাম্যতা। আবার, প্রান্তিক শিক্ষার্থী, ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী, বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিক্ষার্থী ও সকল স্বাভাবিক শিক্ষার্থীরই যে শিক্ষার মৌলিক অধিকার আছে, এটি সমতা।

তুলনামূলক যে দৃষ্টিকোণগুলো দেখানো হয়েছে, সেগুলো পূর্বের তুলনায় বাস্তবক্ষেত্রে কিছুটা কমলেও মানসিকতায় অনেকটাই এখনো রয়ে গেছে। সমাজ এখনও পুরুষতান্ত্রিকতায় ডুবে আছে। নারীরা এখন কর্মক্ষেত্রে অংশগ্রহণ করছে। বৃহন্নলারা কাজ করছে, কিন্তু সবটাতে পুরুষতান্ত্রিকতার ছোঁয়া এখনো যায়নি। কীভাবে যেতে পারে এই ছোঁয়া? বদলাতে পারে দৃষ্টিভঙ্গি? কারা ধরবে এই পরিবর্তনের হাল?

সহজ উত্তর হচ্ছে, এ-দেশের শিক্ষিত সমাজের সাথে শিক্ষার্থীরা। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকাটা তাদের পরিচালনা করতে হবে। এই যে এতো কথা আলোচনা হলো, এসবই একজন শিক্ষার্থীর মাধ্যমে হবে। একজন শিক্ষার্থীর তাই জেন্ডার শিক্ষা খুবই প্রয়োজন। একজন শিক্ষার্থী যদি জেন্ডার শিক্ষা জানে বা পড়ে, তবে তার মধ্যে জেন্ডার শিক্ষার এই ধারণাগুলো পরিষ্কার হবে। আর শিক্ষার্থী যখন কোনো বিষয় জেনে সেই সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা মনে রাখে, তখন সে সেই বিষয়গুলোকে কাজে লাগানোর চেষ্টা করে।

আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার সার্বিক স্তরে জেন্ডার শিক্ষা না আসলেও উচ্চশিক্ষাতে যতোটুকু এসেছে তার ফলাফল হিসেবে আমরা দেখেছি, একজন শিক্ষার্থীর জেন্ডার শিক্ষা সম্পর্কে জানার ফলে নারীদের অধিকার নিয়ে কথা ওঠে। কথা ওঠে পুরুষদের অবস্থান প্রাপ্যের চেয়ে নিচে থাকলেও। কথা ওঠে বৃহন্নলাদের কর্মসংস্থান নিয়ে। সমাজের কিছু অসঙ্গতি যখন শিক্ষার্থীরা সঙ্গতিপূর্ণভাবে প্রতিষ্ঠা করবার চেষ্টা করবে, তখন সমাজের উপরিউক্ত দৃষ্টিভঙ্গিসমূহ পাল্টাবে। পাল্টাবে সমাজে জেন্ডারভিত্তিক উঁচুনিচু অবস্থানের। পরিবর্তন হবে প্রত্যেকের আত্মভালোবাসা ও একে অপরের প্রতি শ্রদ্ধা-মর্যাদার জায়গাটি।

একজন শিক্ষার্থীর জেন্ডার শিক্ষা জানা বা পড়ার জন্য প্রয়োজন শিক্ষার একদম মূল থেকেই এ সম্পর্কে শিক্ষা দেওয়া। ছোট থেকেই মানসিকভাবে জেন্ডার শিক্ষার মাধ্যমে গড়ে তোলা। প্রাথমিক, মাধ্যমিক, উচ্চশিক্ষা সকল স্তরেই জেন্ডার শিক্ষার মাধ্যমে শিক্ষাপ্রদান করাটা একজন শিক্ষার্থীর জন্য ভালো। সেইসাথে সমাজের জন্যেও। এজন্য আরও যেটি প্রয়োজন তা হলো শিক্ষকদের জেন্ডার শিক্ষা নিয়ে প্রশিক্ষণ দেয়া। এতে তাঁদের জেন্ডারগত দৃষ্টিভঙ্গির দিক মজবুত থাকবে। পাশাপাশি শিক্ষার্থীরাও ছোট থেকেই জেন্ডার শিক্ষার মধ্যদিয়ে বেড়ে উঠবে। জেন্ডার শিক্ষা জানা ও পড়ার মাধ্যমে সমাজকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারবে।

প্রথমেই যে বিষয়টি উল্লেখ করা ছিলো, মানুষ যে সামাজিক জীব, তার বাস্তব প্রতিফলনও আছে। সাথে দুটো প্রশ্ন ছিলো, “একসাথে বাস করলেই কি সংঘবদ্ধ হওয়া যায়? বা আদৌ কি আমরা হয়েছি?” এতোক্ষণে হয়তো উত্তর এসেছে যে, আমরা শারীরিকভাবে সবাই সংঘবদ্ধ থাকলেও অধিকাংশই মানসিকভাবে সংঘবদ্ধ হতে পারিনি।

উপর্যুক্ত কারণেই জেন্ডার শিক্ষা একজন শিক্ষার্থীর জন্য জানা জরুরি। জেন্ডার শিক্ষা আমাদের যা শেখায়, তা যদি শিক্ষার্থীরা সমাজে কিছুটা হলেও প্রতিফলনের চেষ্টা করে, তবে সকল বৈষম্য ও বাধা ছাড়িয়ে পুরোনো দৃষ্টিভঙ্গি বদলাবেই। তবে রাতারাতি এই পরিবর্তন সম্ভব নয়। শিক্ষার্থীদের নিজের মধ্যে এই ধারণাগুলো ধারণ করতে হবে। তারপর তার প্রতিফলন ঘটাতে হবে। পরিবর্তন আসবে একজন শিক্ষার্থীর হাত ধরে, পরিবর্তন আসবে জেন্ডার শিক্ষার হাত ধরে।

Sending
User Review
4 (1 vote)

লেখক সম্পর্কে

জান্নাতুল ফেরদৌস

জান্নাতুল ফেরদৌস

জান্নাতুল ফেরদৌস বাংলাদেশের রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী।

মন্তব্য লিখুন

একটি মন্তব্য

  • আসলে সমাজে স্থায়ি একটা ব্যধি আছে তা হল নারি পুরুষের বৈষম্য।এটা থেকে বের হতে হলে লাগবে প্রকৃত শিক্ষা যাতে নারি পুরুষ উভয়ই তাদের জায়গা থেকে বৈষম্যটা বা ভুলগুলো বা করনীয় বুঝতে পারে।বর্তমানে নারিরা শিক্ষায় এগিয়েছে তা কেবল পার্সেন্টিস এর দিক থেকে।পড়াশুনা করে গভীর ঞ্জানার্জন তেমন হচ্ছে না যাতে করে সঠিক একটা ইস্যু নিয়ে সকল নারিদের টনক নারাতে পারে।আবার পুরুষেরাও তাদের আধুনিক শিক্ষার তোকমা দিয়ে পূর্ব পুরুষ থেকে পেয়ে বসা হীন চিন্তায় আঘাত হেনে নতুন চিন্তায় মগ্ন হয়ে নতুন বা সঠিক ধারায় কাজ করতে পারছে না। একথাও সত্য যে সরকার এব্যপারে উদাসিন। এব্যাপারে মুখে বুলি আছে কিন্তু গন সচেতনতা তৈরিতে তেমন কোন ভুমিকা নেই। তাই পুরুষের জায়গাটা থেকে বুঝতে হবে আর নারিরাও তাদের অধিকার সম্পর্কে এগিয়ে আসতে হবে।
    ধন্যবাদ যুগোপযোগী লিখনির জন্য।