শিক্ষক শিক্ষা বলতে আমরা ঠিক কী বুঝি? শিক্ষকদের জন্য শিক্ষা-হ্যাঁ সেটাই। আমাদের দেশে প্রচলিত শিক্ষক শিক্ষা অনেকটাই প্রশিক্ষণনির্ভর। কিন্তু প্রকৃত অর্থে শিক্ষক শিক্ষার পরিসর অনেক অনেক ব্যাপক। সত্যিকারের শিক্ষক হয়ে ওঠার জন্য অনেক দক্ষতা ও যোগ্যতার প্রয়োজন হয় যা সম্পর্কে আমাদের দেশের অধিকাংশ শিক্ষকই সচেতন নন। এসব দক্ষতা অর্জনের জন্য সবচেয়ে বেশি যেটি দরকার তা হল সচেতনতা এবং নিরন্তর চেষ্টা। আমাদের দেশে যারা শুধু চাকরির জন্য শিক্ষকতা করেন তাদেরকে বলার মত একটি কথাই আমার আছে এবং তা হল- ‘আপনারা আপনাদের ইন্দ্রিয়গুলো অকার্যকর করে রেখেছেন,তাই শিক্ষকতা পেশাটা উপভোগ করছেন না’।
শিক্ষকতার মত সৃজনশীল পেশা খুব কমই আছে পৃথিবীতে। পেশাগত জীবনের প্রতি পরতে পরতে আপনি যতটা ভালোবাসা, মমতা ও সৃজনশীলতা ঢেলে দেবেন, তা হাজার গুণ বৃদ্ধি পেয়ে আপনার কাছেই ফিরে আসবে আপনার জীবনের সারাটা সময় জুড়ে, এমনকি মৃত্যুর পরেও। স্কুল শিক্ষকদের আর দোষ কি, বিশ্ববিদ্যালয়ের মত বুদ্ধিবৃত্তি-সমৃদ্ধ প্রতিষ্ঠানেও অনেক শ্রদ্ধেয় শিক্ষক মহোদয়ের যে দশা তাতে লজ্জাই পাই। প্রথম আলোর মত দৈনিকের শিরোনাম হয় বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের শিক্ষকতা দক্ষতা ও যোগ্যতা নিয়ে অথচ শিক্ষকগণ তাদের পারফরমেন্স ভালো করার ন্যূনতম চেষ্টাও করেন না- এর চেয়ে দুর্ভাগ্য আর কী হতে পারে! যা হোক বিশ্ববিদ্যালয়, কলেজ বা স্কুল শিক্ষকতার জন্য যে সকল যোগ্যতা ও দক্ষতার প্রয়োজন হয় তার দুটি দিক রয়েছে-
ক. বিষয়ভিত্তিক দক্ষতা ও যোগ্যতা: কোন শিক্ষক যে বিষয় পড়াবেন তা যে শ্রেণীতে পড়াবেন সেই শ্রেণীর শিক্ষার্থীদের মানসিক বয়স অনুপাতে যথার্থভাবে উপস্থাপন করার জন্য যেসব দক্ষতার প্রয়োজন হয়,সেগুলো এর আওতাভুক্ত।
খ.পেশাগত দক্ষতা ও যোগ্যতা: শিক্ষকতা পেশায় যেমন ভালো উপস্থাপন দক্ষতার প্রয়োজন, তেমনি প্রয়োজন শিক্ষার্থীদের বন্ধু হয়ে যাওয়ার ক্ষমতা; আবার শাসন করতে ভুলে গেলেও চলবে না। তাছাড়া প্রতিষ্ঠানিক প্রশাসন, উপকরণ ইত্যাদি ব্যবস্থাপনার সাথে সাথে শিক্ষার্থীদের প্রয়োজনীয় কাউন্সেলিং করাটাও গুরুত্বপূর্ণ। পেশাগত জীবনের নানা দিক বিবেচনায় যে দক্ষতা ও যোগ্যতাগুলোর প্রয়োজন সেগুলো এর আওতাভুক্ত।
তাহলে ‘নিয়মিত বই পড়ার অভ্যেস’ কোন শিরোনামের আওতায় পড়বে? যে স্তরেই শিক্ষকতা করা হোক না কেন, নিয়মিত বই পড়ার অভ্যেস না থাকলে ভালো শিক্ষক হওয়া সম্ভব নয়। শিক্ষকতা মানেই আপনাকে অনেক বই পড়তে হবে, যে বিষয় পড়াবেন এবং যাদেরকে পড়াবেন তার সাথে নতুন জ্ঞানকে যথাযথভাবে সমন্বয় করতে হবে। কাজেই আমি ব্যক্তিগতভাবে নিয়মিত বই পড়ার অভ্যেসকে পেশাগত যোগ্যতার আওতায় ফেলবো। ব্যানবেইসের দেওয়া তথ্য (২০০৯) অনুযায়ী, বিদ্যালয় পর্যায়ে শিক্ষক সংখ্যা ২,১৩,৪৮২, কলেজ পর্যায়ে ৮৯,০১৪, কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষায় ১৩,৮৭৯, মাদ্রাসা সমূহে ১,০৬,৪৫৭ এবং ইউজিসির দেওয়া তথ্য (২০১১) অনুযায়ী, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ৯,৭২২ ও প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে ৯,৬১০; সবমিলিয়ে শিক্ষক সংখ্যা ৫,৪৯,১৮৯ জন। এই সাড়ে পাঁচ লাখ শিক্ষক যদি নিয়মিত বই পড়তেন তাহলে আমাদের বইয়ের বাজার কতটা চাঙ্গা হত, কত কত নিত্যনতুন বই বেরোত,কত নতুন জ্ঞানের সৃষ্টি হত! হায় পোড়া কপাল আমাদের, ভালো শিক্ষার্থীরা আজ টাকার পেছনে ঘুরে। টাকার পেছনে যারা ঘুরে, তারা যে সুখ-শান্তির জন্য ঘুরে তা কি শেষ পর্যন্ত পেয়ে মৃত্যবরণ করে, নাকি সেই সুখ সারাজীবন অধরাই থেকে যায়? ভোগে সুখ নেই, ত্যাগেই সুখ- একথার সত্যতার মূল্য ৩৫ হাজার বছর। কাজেই যারা মেধাবী তাদের শিক্ষকতা পেশায় আসা উচিত। শিক্ষকতা পেশায় আসার জন্য যারা পড়াশোনা শুরু করতে চান, তাদের জন্য পড়াশোনাটা তাত্ত্বিকভাবে অনেকটাই এরকম- ৪ বছরের অনার্স ডিগ্রি + ১ বছর মেয়াদী শিক্ষণ বিষয়ক ডিগ্রি। আবার যারা শিক্ষকতা শুরু করেছেন শিক্ষা ছাড়া অন্য কোন বিষয়ে অনার্স, মাস্টার্স ইত্যাদি করে, তারা পেশাগত জীবনের চলমান শিক্ষার আওতায় বিভিন্ন শিক্ষণ বিষয়ক ডিগ্রি নিতে পারেন অথবা বিভিন্ন দীর্ঘমেয়াদি প্রশিক্ষণের মাধ্যমে নিজেদের যোগ্যতা ও দক্ষতার উন্নয়ন ঘটিয়ে একজন ভালো শিক্ষক হতে পারেন। শিক্ষকতা বিষয়ে শিক্ষাগ্রহণের জন্য বাংলাদেশে মোট ১৮২টি প্রতিষ্ঠান রয়েছে (সুত্র: ব্যানব্যাইস) যেখানে শিক্ষকতা পেশার জন্য উপযুক্ত শিক্ষাগ্রহণের সুযোগ রয়েছে। এছাড়াও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউট এ বিষয়ে অগ্রণী ভূমিকা রেখে চলেছে। তবে বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে একটি শিক্ষা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা এখন সময়ের দাবি। তাছাড়া আমরা আমদের তৃণমূল পর্যায়ে বিদ্যমান বর্তমান অবকাঠামো ও পরিকাঠামো কীভাবে শিক্ষক শিক্ষায় ব্যবহার করতে পারি তাও ভেবে দেখা দরকার।
লেখক পরিচিতি
রিদওয়ানুল মসরুর বাংলাদেশের সেভ দ্যা চিলড্রেন-এর কমিউনিকেশনস অ্যান্ড রিসোর্স মবিলাইজেশন বিভাগে সহকারী কর্মকর্তা হিসেবে কর্মরত।
নতুন শিক্ষা লাভ হল । এই পাঠটি পড়ে ।