বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর রাজনৈতিক মূর্খতা
বাংলাদেশের যেকোনো শিক্ষাবিদ বা ইনটেলেকচুয়ালকে প্রশ্ন করুন যে, আমাদের উচ্চশিক্ষা ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর এমন করুণ অবস্থা কেন? প্রায় সবাই এক বাক্যে উত্তর দেবেন যে, এটা শিক্ষায় রাজনীতি ঢুকে পড়ার কারণে। অথচ শিক্ষাবিষয়ক বিশেষজ্ঞরা বলছেন, “বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে সমাজের সবচেয়ে রাজনীতিপূর্ণ প্রতিষ্ঠানগুলির মধ্যে বিবেচনা করা যেতে পারে। বিশ্বের প্রথম বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পর থেকে এই প্রতিষ্ঠানগুলোর বিবর্তন যেন রাজনৈতিক দ্বন্দ্বেরই ইতিহাস” (Perkin, Harold, 1984, Perspectives on higher education)।
ইটালি ভ্রমণের সময় এক বান্ধবীর আমন্ত্রণে যখন যখন তোরিনো থেকে সাগর আর বিচের শহর আনকোনাতে যাচ্ছি, তখন ট্রেন থামলো মধ্য ইটালির বোলনিয়াতে। যদিও আর এক ইটালীয় বান্ধবী উপদেশ দিয়েছিলো যে, তার দেশের বাড়ি বোলোনিয়াতে যেন অবশ্যই ঘুরে আসি। কিন্তু সে যেহেতু তখন সেখানে ছিলো না, তাই বোলোনিয়াতে আর নামা হলো না। ট্রেন থেকেই দেখলাম প্রাচীন শহর বোলোনিয়া। এই বোলনিয়াতেই আছে আধুনিক বিশ্বের এখন পর্যন্ত চলমান প্রাচীনতম বিশ্ববিদ্যালয় যার নাম ইউনিভার্সিটি অব বোলোনিয়া। যেটি এখনও ইউরোপ ও সারা বিশ্বের মধ্যে সেরা মানের একটি বিশ্ববিদ্যালয়।
১০৮৮ সালে প্রতিষ্ঠিত এই বিশ্ববিদ্যালয় ছিল খ্রিস্টান চার্চের অধীনে। গত প্রায় এক হাজার বছর এটি সবসময় ইউরোপের এবং সারা বিশ্বের সেরা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে তালিকাবদ্ধ থেকেছে এবং সারা দুনিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে পথ দেখিয়েছে।
১০৮৮ সালে চার্চ কতৃক প্রতিষ্ঠিত হলেও সেই যুগে এর নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নিয়মিত দ্বন্দ্ব ছিল চার্চ ও সম্রাটের তথা রাষ্ট্রের। এটি আধুনিক রূপে পরিণতি লাভ করে ১২ শতকে যখন শিক্ষায় চার্চ ও রাষ্ট্রের রাজনীতি নিয়ে বিভক্ত শিক্ষিত সমাজ এর থেকে বের হবার পথ বের করে। সেটি ছিল শিক্ষার্থী-শিক্ষকদের একটি স্বাধীন সংঘ বা একাডেমিক গিল্ড তৈরি করার মাধ্যমে।
শিক্ষা নিয়ে ধর্ম ও শাসকদের ঠিক একই রকম নিয়ন্ত্রণকারী অবস্থা ছিলো জ্ঞানচর্চার আর দুই কেন্দ্র প্যারিস ও লন্ডনে। একই সময় ফ্রান্সের ইউনিভার্সিটি অব প্যারিস ও লন্ডনের ইউনির্ভার্সিটি অব অক্সফোর্ড একই রকম একাডেমিক গিল্ড তৈরি করে জ্ঞানের স্বাধীনতার রাজনীতি শুরু করে।
বিশ্ববিদ্যালয়গুলো নতুন চিন্তার সূতিকাগার, নতুন ধারণার জন্মস্থান। সেখান থেকে মানব প্রগতির যাবতীয় পথের সূচনা হয়। একটি সমাজ, রাষ্ট্র এবং ব্যক্তি হিসাবে মানুষের ভবিষ্যত কি হবে সেটির নীলনকশা বিশ্ববিদ্যালয়েই হয়। সেই কারণে সূচনা থেকেই ধর্মীয় নেতৃত্ব ও শাসকগণ বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে চেয়েছে। তারা জানতো, এটিকে যদি নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়, তাহলে নিজেদের ভবিষ্যতও নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়।
মধ্যযুগের শুরুতে এটি সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হলেও ক্রমেই প্রকৃত শিক্ষিতরা এবং জ্ঞানের রাজনৈতিক মেধাবীরা বুঝতে পারে যে, তারা নিয়ন্ত্রণের রাজনীতির শিকার। এর থেকেই শিক্ষার্থী-শিক্ষকদের সেই জ্ঞানের স্বাধীনতার আন্দোলন শুরু সেই বোলোনিয়া থেকে।
পৃথিবীর সকল স্বাধীনতা আন্দোলনের মধ্যে প্রাচীনতম হলো নারীর স্বাধীন হবার আন্দোলন। এই আন্দোলন কখনই সফল হবে না নারী যদি লিঙ্গ রাজনীতি না বুঝতে পারে। নারী যদি লিঙ্গ রাজনীতি না বুঝতে পারে, তাহলে সে নিজের অসচেতনতায় নিজেই নিজের স্বাধীনতার বিপক্ষে অবস্থান নিয়ে ফেলে।
অনেক স্বাধীনচেতা নারী মনে করে যে, ব্যক্তিগত দক্ষতা, অর্থ ও ক্ষমতা তাকে স্বাধীনতা দেবে। তাই অর্থ ও ক্ষমতার জন্য যে শক্তিশালী পুরুষের পক্ষে কাজ করে। পরিশেষে যে শক্তির বিরুদ্ধে সে স্বাধীনতা অর্জন করতে চায়, সে তার সহযোগী হিসাবে নিজের অজান্তেই তার ক্ষমতার বৃদ্ধি করে থাকে।
লিঙ্গ রাজনীতি না বুঝতে পারার বা সেটাকে বুঝতে গুরুত্ব না দেবার কারণে প্রাচীনতম এই নারীর স্বাধীন হবার আন্দোলন এখনও সফলতার মুখ দেখেনি। উচ্চশিক্ষার বিষয়টা ঠিক এমনই। উচ্চশিক্ষা সম্পূর্ণ স্বাধীন হয়ে সেটি কি ধর্ম বা রাষ্ট্রের উপরের স্তরে উঠে জাতির পথপ্রদর্শক হবে? না কি উচ্চশিক্ষা ধর্ম বা শাসকদের লেজুড়বৃত্তি করে ধর্ম ও শাসকদের আরও শক্তিশালী করবে?
এই সিদ্ধান্তটি সচেতনে আত্মস্থ করে সমাজে জ্ঞানের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করাই বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজ। সিদ্ধান্তটি রাজনৈতিক এবং এটিকে সফল করতে হলে জ্ঞানের রাজনীতিতে দক্ষ হওয়া প্রয়োজন। প্রয়োজন দৃঢ় রাজনৈতিক প্রজ্ঞা। এই রাজনীতির প্রধান শক্তি মেধাবী শিক্ষার্থী-শিক্ষকদের সঙ্ঘ এরং জ্ঞানের রাজনীতির চর্চা, যার মূল লক্ষ্য হলো জ্ঞানকে নেতৃত্বে নিয়ে যাওয়া।
জ্ঞানকে নেতৃত্বে নিয়ে যাওয়ার জন্য রাষ্ট্রীয় পরিকাঠামোতে বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থান এবং তার আইনগত অধিকার আমাদের ইংরেজ আমল থেকেই প্রতিষ্ঠিত। প্রয়োজন শুধু রাজনৈতিক বোধসম্পন্ন প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কৃতি বজায় রাখা। সুতরাং, কঠিনতম কাজগুলো প্রায় এক হাজার বছর আগের শিক্ষার্থী-শিক্ষক সঙ্ঘই করে গেছে। আমাদের দায়িত্ব ছিলো শুধু নিজেদের মুক্ত সংস্কৃতি বজায় রাখা ও নিজেদের ওপর অর্পিত দায়িত্বটুকু পালন করে যাওয়া। অথচ এদেশে সেটি চরমভাবে ব্যর্থ হয়েছে।
এই ব্যর্থতার কারণ বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর রাজনৈতিক মূর্খতা এবং রাজনীতিবিদদের জ্ঞানীয় মূর্খতা। পূর্বে যেটি লিখেছিলাম যে, দেশ বিভাগের পর আমাদের রাজনৈতিক নেতৃত্ব বিশ্বাস করতো দেশকে জ্ঞান-বিজ্ঞানে এগিয়ে নিয়ে যাবার দরকার নেই, দেশের নিরাপত্তা দরকার, তাই সেনাবাহিনীকে পুষ্ট করা প্রয়োজন। জ্ঞানের প্রসারকে তারা সমৃদ্ধি ও নিরাপত্তা ভিত্তি ভাবেনি।
আশ্চর্য যে, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ইন্টেলেকচুয়াল সমাজও সেটা ভাবেনি। তারা ভেবেছে, তারা যে ব্যক্তিগতভাবে সেরা, সেটাকে ব্যক্তিগত দক্ষতা দিয়ে সমাজের কাছে প্রমাণ করাই বিশ্ববিদ্যালয়ের সফলতা। তাই তারা সমাজ ও রাজনীতি থেকে নিজেদের বিচ্ছিন্ন করে কে কয়টি পেপার পাবলিশ করলেন, কে কোন সেমিনারে অংশগ্রহণে ডাক পেলেন, কোন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী কোন নোবেল পুরস্কার বিজয়ীর সহকারী ছিলো – এগুলোই যেন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান লক্ষ্য হয়ে গেলো।
এর কারণ হলো, শিক্ষিতদের ক্রমেই রাজনৈতিক বিযুক্তি বা রাজনীতি বিচ্ছিন্নতা। এই রাজনীতি বিচ্ছিন্নতার কারণ হলো, যে পরীক্ষা ব্যবস্থা প্রণয়ন করা হয়েছে, সেটিতে যারা সেরা বিবেচিত হবে তারা পদ্ধতিগতভাবেই যেন হবে বিচ্ছিন্ন আত্মকেন্দ্রিক-ব্যক্তিত্ব। নিজের ব্যক্তিগত সফলতা ছাড়া বাকি সবকিছু যেন তাদের কাছে অপ্রয়োজনীয়। ব্যক্তিত্বের এই বিচ্ছিন্নতা ক্রমেই বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কৃতিকে করেছে বিরাজনৈতিক। এর ফলে বিশ্ববিদ্যালয়ে বিরাজ করেছে রাজনৈতিক শুন্যতা।
বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর এই প্রাতিষ্ঠানিক রাজনৈতিক শুন্যতা নবাগত তরুণ শিক্ষার্থীদের করেছে রাজনীতিতে ক্ষুধার্ত। তারা উন্মুখ হয়ে থেকেছে এবং অতি আগ্রহী হয়েছে যেকোনো ইস্যুতে শ্লোগান মিছিল করে ঝাঁপিয়ে পড়তে। নিজ প্রতিষ্ঠানের রাজনীতিশূন্যতা এবং সমাজ বিচ্ছিন্নতায় পিপাসার্ত তারা বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের ডাকে সাড়া দিয়েছে অনেক সময় গভীর কিছু না ভেবেই শুধুই আবেগের বশে, অপ্রয়োজনে।
এটিকেই কাজে লাগিয়েছে আমাদের রাজনৈতিক দলগুলো। ভাষা আন্দোলন থেকে স্বাধীনতা যুদ্ধের আগে এবং ’৭৫-এর পর সামারিক জান্তাবিরোধী সেই সব আন্দোলন যেমন যৌক্তিক এবং জাতির জন্য সাহসী অবদানের ছিলো, অপরদিকে অনেক সময় সেগুলো অপ্রয়োজনীয় এবং ক্ষতিকরও ছিলো। বিশাল সংখ্যক বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীর স্বাধীনতাবিরোধী দলগুলোতে এবং ধর্মীয় মৌলবাদী দলের পক্ষে কাজ করা এই সত্যই প্রমাণ করে যে, রাজনৈতিক আদর্শ নয়, তাদের মনে যে রাজনৈতিক ক্ষুধা, সেটি মেটাতেই তারা যেকোনো একটি দল বেছে নেয়।
বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর জ্ঞানের রাজনীতিকে যদি ফিরিয়ে না আনা যায়, যদি রাজনীতির মাধ্যমে সমাজের সর্বস্তরে জ্ঞানের নেতৃত্বকে প্রতিষ্ঠিত করা না যায়, তাহলে ক্রমেই বিশ্ববিদ্যালয়গুলো হয় রাষ্ট্র, অথবা ধর্মের হুকুম তামিলকারি দাসে পরিণত হবে। যেহেতু বিশ্ববিদ্যালয়গুলো থেকে সনদপ্রাপ্তরা এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কৃতিতে সিক্তরা মাধ্যমিক শিক্ষা এবং প্রাথমিক শিক্ষা থেকে শুরু করে সমাজের সর্বস্তরে নেতৃত্বে থাকে, সেহেতু এই দাস মানসিকতা পুরো সমাজকে গ্রাস করবে, যেখানে জ্ঞানের উন্মেষের পথ চিরতরে বিদায় নেবে। সমাজ ডুবে যাবে নির্বুদ্ধিতায় আর অরাজকতায় যার নমুনা আমরা এর মধ্যই সর্বত্র দেখতে পাচ্ছি।