দি প্রডিজি ট্র্যাপ
সদ্য কৈশোর পেরোনো আমি যখন আনুষ্ঠানিক পড়াশোনা শিকায় তুলো পুরোদমে আমার স্টার্টআপ কোম্পানিতে যুক্ত, তখন বিশ্ববিদ্যালয়ের সাথে আমার সংযোগ অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ ছিলো। বুয়েট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের সাথে ছিলো নিয়মিত যোগাযোগ। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ল্যাবে ওয়ার্কশপে ছিলো আমার অবাধ যাতায়াত। এমনকি আমার স্টার্টআপ শুরুর পরেও বুয়েট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা তাদের থিসিস বা গবেষণার জন্য আমার প্রতিষ্ঠানের সথে সংযুক্ত থাকতো।
সেই সময় গল্প শুনতাম, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি বিভাগে নাকি এক ছাত্র ভর্তি হয়েছে সে নিশ্চিত নোবেল পুরস্কার পাবে। প্রথম বর্ষে ভর্তি হয়েই সে নাকি বাঘা বাঘা সব প্রফেসরকে অঙ্কে হারিয়ে দেয়। তার তত্ত্ব সমীকরণের প্যাঁচে নাকি আকাশ-বাতাস কাঁপে। একজন দুজন বাঘা প্রফেসর ছাড়া নাকি সে আর কাউকে সময়ই দেয় না। আমি ভাবলাম হবে হয়ত। গবেষণায় এই বিশ্ববিদ্যালয়ের বন্ধ্যাযুগ এবার হয়ত কাটবে।
সম্প্রতি সুবর্ণ আইজ্যাক নামে এক বাংলাদেশী আমেরিকানের খবর ভিডিও ফেসবুক ইউটিউবে ভাইরাল হয়েছে। তার সম্পর্কে খবর হচ্ছে, “সুবর্ণ আইজাকের এই বিস্ময়কর প্রতিভার কথা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লে নজর কাড়ে গোটা বিশ্বের। নজরে আসে হোয়াইট হাউসেরও। এই বিস্ময় বালকের প্রতিভা যাচাইয়ের জন্য নেওয়া হয় একের পর এক পরীক্ষা। যুক্তরাষ্ট্রের নামকরা সব বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞান ও গণিত বিষয়ের বিশেষজ্ঞদের মুখোমুখি হয় সুবর্ণ। কোনো জটিল পরীক্ষাই আটকাতে পারেনি এই খুদে বিজ্ঞানীকে। তার সাক্ষাৎকার নেয় নামকরা গণমাধ্যমও।
সুবর্ণকে ‘আমাদের সময়ের আইনস্টাইন’ আখ্যা দিয়েছেন দ্য সিটি কলেজ অব নিউ ইয়র্কের প্রেসিডেন্ট লিসা এস কোইকো। তিনি গণিত, রসায়ন ও পদার্থবিজ্ঞান-সংক্রান্ত নানা প্রশ্ন করলে সুবর্ণ সব সঠিক উত্তর দেয়ায় বিস্মিত লিসা জানান, ‘সে বড় হয়ে নতুন ইতিহাস গড়বে।’ বিখ্যাত হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয় ২০১৮ সালে তাকে বিজ্ঞানী হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। ২০২০ সালে ওই বিশ্ববিদ্যালয় তাকে অধ্যাপক ঘোষণা করে। ভারতের মুম্বাই বিশ্ববিদ্যালয়েও ভিসিটিং প্রফেসর করা হয় সুবর্ণকে। এরপর নোবেল জয়ী কৈলাস সত্যার্থী তাকে ‘চাইল্ড প্রডিজি’ অর্থাৎ, ‘বিস্ময় বালক’ পুরস্কারে ভূষিত করে। [সময় টিভি]”
২৬ মার্চ ১৯৯৮ সালে আমেরিকার ইন্ডিয়ানাপোলিসে জন্ম নেয় জ্যাকব বার্নেট নামে একটি ফুটফুটে ছেলে। দশ বছর বয়সে পঞ্চম গ্রেডে উঠেই সে স্কুলের সব পড়ালেখা শেষ করে ফেলে এবং তখন সে কলেজে পড়ার জন্য প্রস্তুত। মাত্র দুই সপ্তাহে সে উচ্চ-বিদ্যালয়ের সব গণিতের সমস্যার সমাধান করে ফেলে। মাত্র এগারো বছর বয়সে সে ইন্ডিয়ানা বিশ্ববিদ্যালয়ে অ্যাস্ট্রোফিজিকসে অনার্স শুরু করে। মাত্র পনেরো বছর বয়সে সে কানাডার পেরিমিটার ইন্সটিটিউট অব থিয়োরোটিক্যাল ফিজিক্স থেকে অ্যাস্ট্রোফিজিক্সে মাস্টার্স শেষ করে এবং বিভিন্ন নামকরা বিশ্ববিদ্যালয়ে পেইড রিসার্চার হিসাবে যোগ দেয়।
গণিতে জ্যাকব বার্নেটের আইকিউ ছিল ১৭০ যা আইনস্টাইনের চাইতে বেশি। অনেকেই ভবিষ্যদ্বাণী করতে থাকে যে, তাঁর নোবেল পুরস্কার নিশ্চিত। এও বলতে থাকে পৃথিবী পেয়ে গেছে আরেকজন নিউটন বা আইনস্টাইন।
২০১৩-১৫ সাল পর্যন্ত জ্যাকব নিয়মিত ছিলো টেলিভিশন স্টার। তাঁকে নিয়ে টক শোতে থাকতো বড় বড় অধ্যাপকেরা। বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুষ্ঠানে তিনি বক্তৃতা দিতেন, করেছেন অনেকগুলো টেডটক। কিন্তু তারপর তিনি হঠাৎ করেই হারিয়ে যান। এমনকি তাঁর ব্যক্তিগত পেজ, উইকি পেজও উধাও হয়ে যায়।
পনেরো বছর ধরে চাইল্ড প্রডিজি অর্থাৎ, বিস্ময় শিশুদের নিয়ে কাজ করছেন ডাঃ রুথস্যাটজ যিনি জ্যাকব বার্নেটকে নিয়েও কাজ করেছেন। আসলে শিশুকাল থেকেই জ্যাকব বার্নেট ছিল অটিস্টিক। বর্তমানে চাইল্ড প্রডিজিদের নিয়ে বেশ কিছু গবেষণা হয়েছে বিশেষ করে পেট স্ক্যান (PET Scan, Positron emission tomography) প্রযুক্তি ব্যবহার করে যেখানে দেখা গেছে প্রডিজিদের মস্তিষ্ক কাজ করে অনেকটাই দৃশ্যস্মৃতিনির্ভর (Visual-Spatial long-term working memory – LTWM) প্রক্রিয়ায়।
ভ্যান্ডারভার্ট এবং অন্যান্যদের গবেষণায় এটিও দেখা গেছে যে, প্রডিজিদের মানসিক তাড়না বা প্রেষণা আবেগনির্ভর। নিজেকে প্রতিষ্ঠার প্রচণ্ড আবেগ থেকে তারা ভিজ্যুয়াল-স্পেটিয়াল দীর্ঘস্থায়ী কার্যকর স্মৃতিকে কাজে লাগানো শেখে (LTWM)।
এই প্রডিজিদের পরবর্তী জীবনের সমস্যা হলো প্রেরণার অভাব। ছোটবেলায় যেমন বাবা-মা-পরিবার নিরাপত্তা দিতো, তার কাজ হতো কোনোকিছু মনে রেখে তাদের অভিভূত করা। মানুষ যতো বড় হয়, শিশুজীবনের চাইতে অনেক জটিল জীবনে প্রবেশ করে। তার আত্মপ্রতিষ্ঠায় তখন মানুষকে স্মৃতিবিষ্ময়ে অভিভূত করা আর ততোটা কাজ করে না। তার সামনে তখন বাস্তব জগতকে বোঝা ও সেখানে আত্মপ্রতিষ্ঠা করা, প্রতিটি বিষয়ে সঠিক পর্যবেক্ষণ ও সঠিক সিদ্ধান্ত নেবার বিশাল চ্যালেঞ্জ। যে চ্যালেঞ্জগুলোর সমাধানের ক্লু কোনো সমীকরণ বা বইয়ের পাতায় থাকে না।
আমাদের দেশের স্কুল-কলেজের যে পাঠদান ও পরীক্ষা পদ্ধতি এবং বিশ্বাবিদ্যালয়গুলোর যে ভর্তি প্রক্রিয়া, আমার বিশ্বাস সেই প্রক্রিয়া ১৬ কোটি জনগণ থেকে কমবেশি চাইল্ড প্রডিজিদের বাছাই করে আনে। আমাদের উচ্চশিক্ষা যেন পড়ে গেছে সেই এডোলেসেন্ট প্রডিজিদের ফাঁদে। এখানে শিক্ষার্থী, শিক্ষক এমনকি প্রতিষ্ঠানেরও কোর বিলিফ ও কোর মেন্টাল প্রসেস হলো ভিজ্যুয়াল-স্পেটিয়াল দীর্ঘস্থায়ী কার্যকর স্মৃতিকে কাজে লাগিয়ে (LTWM) পরীক্ষার খাতায় চমক দেখানো।
এই পদ্ধতিতে ভালো নম্বর পেয়ে তারাই শিক্ষক হয়ে পুরো বিশ্ববিদ্যালয়ব্যবস্থা চলে গেছে বয়স্ক চাইল্ড প্রডিজিদের সংস্কৃতিতে। যারা হতাশ দিকভ্রান্ত এবং মনস্তাত্বিকভাবে পরমুখাপেক্ষী। এই সংস্কৃতি থেকে যারা মোল্ডেড হয়ে বের হচ্ছে, পরবর্তীতে বাস্তবতা ও পেশাগত জীবনের সমস্যা তাদের কাছে হয়ে যাচ্ছে অটিস্টিক শিশুদের স্বাভাবিক থাকার মতো চ্যালেঞ্জিং।
মেধা বা জ্ঞান স্মৃতিসর্বস্ব নয়। মেধা বা জ্ঞান কম্পিউটেশনও নয়। আপনি যখন আর্থিক সমস্যায় পড়বেন বা অন্য জীবনের বাস্তবতার অন্য কোনো সমস্যায় পড়বেন, তখন এনসাইক্লোপিডিয়া ব্রিটেনিকা আপনাকে আপনার সমস্যার সমাধান দিতে পারবে না। পৃথিবীর সবচেয়ে শক্তিশালী কম্পিউটারও আপনাকে কোনো সাহায্য করতে পরবে না।
এর জন্য প্রয়োজন চিন্তাপ্রক্রিয়ার উন্নয়ন। জ্ঞানজগতে প্রতিটি ধারণা, প্রতিটি তত্ত্ব একটি বহুমাত্রিক মেন্টাল মডেল। সেটি যখন বইতে লেখা হয় বা গণিতের ফর্মুলায় রুপান্তরিত হয়, তখন সেটি সেই মেন্টাল মডেলের একটি কোডেড ফর্ম মাত্র। এই কোডেড ফর্ম স্মৃতিবদ্ধ করতে পারা মানেই সেই বহুমাত্রিক মেন্টাল মডেলগুলোর আন্তসংযোজিত অবকাঠামো সম্পর্কে অবগত হওয়া নয়। পরমাণু ও কোয়ান্টাম পদার্থবিজ্ঞানের জনক নিলস বোর বলেছিলেন, “যারা প্রথম কোয়ান্টাম তত্ত্বের মুখোমুখি হবার সময় হতবাক হননি, তারা সম্ভবত সেটি বুঝতে পারেননি”।
প্রকৃত জ্ঞান অর্জনের সাথে নিলস বোরের এই “হতবাক” হবার একটি সম্পর্ক আছে। আমাদের উচ্চশিক্ষা সংস্কৃতিতে হতবাক এখন কেউ হয় না। তাই কোরআন বিজ্ঞান একসাথেই এক মস্তিষ্কেই শান্তিতে বসবাস করে। এটাই প্রডিজি মন।