প্রাইড এন্ড প্রেজ্যুডিস
বিখ্যাত পদার্থবিদ রিচার্ড ফাইনম্যান ছোটবেলায় একবার স্কুলের সহপাঠীদের সাথে এক বন্য এলাকায় বেড়াতে গিয়েছিলেন। সেখানে একটি লেকের ধারে তারা কিছু পাখি দেখে। একটি ছেলে ফাইনম্যানকে প্রশ্ন করে, তুমি কী জান এই পাখিটি সম্পর্কে? ফাইনম্যান জবাবে কিছু বলতে পারেন না। ছেলেটি তখন বলতে থাকে, এটি হলো ব্রাউন থ্রোটেড থ্রাশ। তারপর ছেলেটি বলে, তোমার বাবা তো তোমাকে পাখি সম্পর্কে কিছুই শেখায়নি তাহলে? আমার বাবা শিখিয়েছে।
ফাইনম্যান বলেন, আসলে আমার বাবা আমাকে পাখি সম্পর্কে শেখাননি, তবে জ্ঞান বা জানা সম্পর্কে শিখিয়েছিলেন। তিনি আমাকে ওই পাখিটি দেখিয়ে একদিন বলেছিলেন, এটির ইংরেজি নাম ব্রাউন থ্রোটেড থ্রাশ, এটির জার্মান নাম এটা, এটির জাপানি নাম এটা, এটির চাইনিজ নাম এটা – কিন্তু সবগুলো ভাষায় এই পাখির নাম জানলেও পাখিটি সম্পর্কে আসলে তুমি কিছুই জানো না।
এখানে ফাইনম্যান দেখিয়েছেন, হস্তান্তরযোগ্য জ্ঞান (transferable knowledge)। যে জ্ঞান এক ব্যক্তি থেকে অপর ব্যক্তির মধ্যে সঞ্চারিত করা যায়, সেটি করতে গেলে জ্ঞান সঞ্চারণের জন্য ভাষা তৈরি করতে হয়। কিন্তু সেই ভাষায় দক্ষতা অর্জনই বিষয়টি সম্পর্কে জ্ঞান নয়।
এর চমৎকার উদাহরণ হচ্ছে গণিত। জাগতিক সমস্যাগুলোকে যদি আমরা গণিতের সংকেতে অনুবাদ করতে পারি এবং সেটির চালকগুলোকে যদি একটা সমীকরণের সম্পর্কে নিয়ে আসতে পারি, তাহলে সেই সমীকরণের সমাধানগুলো আমাদের জাগতিক সমস্যাটির সমাধানের পথ দেখায়।
কিন্তু জাগতিক সমস্যাগুলোকে গণিতের ভাষায় অনুবাদ করতে গেলে সমস্যাগুলো সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা থাকতে হয়। সেই ধারণা না থাকলে গণিতের অসাধারণ মেধাও সমস্যা সমাধানে কোনো কাজে আসে না। উপযুক্ত সফটওয়ার সহযোগে যেকোনো কম্পিউটারের এখন অসাধারণ গাণিতিক দক্ষতা বিদ্যমান, কিন্তু সেই অনুবাদ ছাড়া সেটি কোনো সমস্যার সমাধানে কাজে আসে না।
এই প্রক্রিয়া অনুসরণ করে সারা দুনিয়াতেই প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাকে ১৬ বছরের একটি শিক্ষাক্রম ধরে নেওয়া হয়। একে প্রধানত তিন ভাগে ভাগ করা হয়। যেমন, এলিমেন্টারি (প্রথম ৮ বছর), সেকেন্ডারি (পরবর্তী ৪ বছর) ও টারশিয়ারি (তার পরের ৪ বছর)। যদিও আমাদের এলাকায় সেকেন্ডারিকে ভেঙে দুইভাগে ভাগ (সেকেন্ডারি ও হায়ার সেকেন্ডারি) করা হয় যেটি বাকি বিশ্বে কোথাও নেই।
টারশিয়ারি আবার দুই ভাবে হয়। এক. দুই বছরের একটি জেনারেল কোর্স (যেমন বিএ) অথবা চার বছরের একটি আন্ডারগ্রাড কোর্স (আমরা যাকে অনার্স বলি)। এরপর হলো মাস্টার্স কোর্স এবং যারা গবেষণা করতে চায় তাদের জন্য পিএইচডি।
এলিমেন্টারি সময়টাতে শিক্ষার্থীদের যেটি পড়ানো হয়, সেটি হলো ভাষা। শুধু কথা বলার ভাষা নয়, গণিত, বিজ্ঞান ও জীবনযাপনের প্রয়োজনীয় সব ভাষা ও তার ব্যাকরণ। তাদের পড়ানো হয় প্রচলিত নিয়মগুলো। যেখানে তার কাজ হলো, যা পড়ানো হবে সেটিই শিখতে হবে যেহেতু তাকে যা পড়ানো হচ্ছে সেটি জ্ঞান নয়; নিয়মকানুন বা পদ্ধতি।
তার শিক্ষার উদ্দেশ্য বিষয়টা শেখা ততোটা নয়, জ্ঞানবিষয়ক সাধারণ ভাবের আদান-প্রদানের পদ্ধতি শেখা যতোটা। এই কারণেই তার পাঠ্যক্রমে থাকে সকল অবিতর্কিত ধারণা, অর্থাৎ কোনো দ্বিমত নেই এমন বিষয়গুলো যাতে বিষয়টির ধারণাগত বিতর্কে শিক্ষার্থী বিভ্রান্ত না হয়।
সেকেন্ডারি স্কুলে তাকে পরিচয় করিয়ে দেওয়া হয় বিষয়ভিত্তিক নিশ্চিত জ্ঞানগুলোর সাথে। এখানেও তাকে শেখানো হয় অবিতর্কিত অর্থাৎ কোনো দ্বিমত নেই এমন বিষয়গুলো, কিন্তু নির্দিষ্ট ডিসিপ্লিনে আলাদা করে যেমন গণিত, পদার্থবিজ্ঞান, রসায়ন ইত্যাদি।
এই বিষয়গুলোর কোনো প্রায়গিক পদ্ধতি নিয়ে সে যদি পেশাগত প্রশিক্ষণ নিতে চায়, তবে সেটি পরবর্তী দুই, তিন বা চার বছর পর্যন্ত যেতে পারে, যেটিকে স্কুলই বলে অথবা কলেজ।
ইন্জিনিয়ার, ডাক্তার, ম্যানেজমেন্ট বা অর্থনীতি নিয়ে যারা পেশাগত কাজ করবেন, তাদের আসলে সবচেয়ে বেশি গৃহীত সর্বোৎকৃষ্ট পদ্ধতিটি সম্পর্কে ট্রেনিং দেওয়া হয়।
বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজ কিন্তু সম্পূর্ণ উল্টো। সেখানে শিক্ষার্থীরা যেন কোনো নির্দিষ্ট পদ্ধতি বা পথ ধরে চিন্তা না করে, যতোরকম পথ আছে সবগুলো সম্পর্কে চিন্তা করতে পারে সেই শিক্ষা দেওয়া হয়।
পৃথিবীর সকল প্রায়োগিক জ্ঞান কনভার্জিং। অর্থাৎ সেটি দিনে দিনে এক বিন্দুতে কেন্দ্রীভূত হয়। হার্টে বাইপাস কীভাবে করতে হবে সেই জ্ঞান দিনে দিনে সুনির্দিষ্ট হচ্ছে। সর্বোৎকৃষ্ট পদ্ধতিটি তাই একজন নবীন শল্যচিৎসার শিক্ষার্থীকে শেখানো হয়। বা, একটি এক’শ তলা দালানের স্ট্রাকচারাল ডিজাইন কীভাবে করতে হবে সেটিও একজন শিক্ষার্থীকে সেভাবেই শেখানো হয়। এক্ষেত্রে জানা জ্ঞানটিই শিক্ষার্থীকে দেওয়া হয় যাতে সে প্রয়োগ করতে পারে।
কিন্তু তত্বগত জ্ঞান ডাইভারজেন্ট। যতো গভীরে যাওয়া যায়, সেটি আরও বিস্তৃত হয় নানারকম শাখা-প্রশাখায়। উদাহরণস্বরুপ যদি প্রশ্ন করা হয়, এই যে পরিবেশ বিপর্যয় নিয়ে দুনিয়াব্যপী যে এতো আন্দোলন প্রতি-আন্দোলন চলছে, এই পরিবেশ বিপর্যয়ের আসল কারণ কী? এই বিষয়টি বুঝতে গেলে তাকে বিশ্বের শ্রেষ্ঠ পরিবেশ বিজ্ঞানী কী মনে করেন সেটি মুখস্থ করলে কোনো ফল হবে না।
কারণ, সেটি একটি মতবাদমাত্র। তাকে জানতে হবে এই বিষয়ে প্রধান মতবাদগুলো কী কী। এটি করতে গিয়ে প্রথম তাকে যেটি করতে হবে সেটি হলো তার নিজের যে ধারণা বা বায়াস, সেটি থেকে বের হয়ে আসা। তারপর তার কাজ হবে প্রতিটি প্রধান ধারণা কী বলতে চাইছে, সেগুলো সম্পর্কে নিরপেক্ষ থেকে প্রত্যেকের দৃষ্টিভঙ্গীকে ধারণ করার চেষ্টা করা। তারপর তার কাজ হবে সেসব তত্ত্ব বা সংকল্পগুলোর মধ্যে অসংগতিগুলোকে প্রশ্ন করতে শুরু করা।
বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজ তাই শিক্ষার্থীদের জ্ঞান দেওয়া নয়। শিক্ষার্থীরা তাদের শিক্ষাজীবনের প্রথম বারো বছর যেমন জ্ঞানের ভাষা পরিচয় শিখেছে, বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্ডারগ্র্যাডের কাজ হলো তাদের ভিন্নমতে অভ্যস্ত হয়ে নিজের বায়াসকে কাটিয়ে উঠে প্রশ্ন করতে শেখানো।
প্রচলিত জ্ঞান শেখানো তাই বিশ্ববিদ্যালয়ের আসল কাজ নয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজ তাকে ভেঙে ফেলা। তাই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের প্রধান কাজ প্রশ্ন করা ও তার মাধ্যমে দুনিয়া সম্পর্কে তাদের যে পূর্বজ্ঞান বা প্রেজ্যুডিস বা সংস্কার আছে তাকে চ্যালেঞ্জ করা।
উচ্চশিক্ষার উদ্দেশ্য নতুন সমস্যার সমাধান। তার কাজ তাই প্রচলিত জ্ঞান সংগ্রহ করে মগজে রাখা নয়। মস্তিস্কে যে পূর্বজ্ঞান বা প্রেজ্যুডিস বা সংস্কার আছে, সেগুলোকে সরিয়ে ফেলে মগজকে প্রস্তুত করা যাতে নতুন চিন্তা সেখানে গজাতে পারে। আমাদের পূর্বজ্ঞান বা প্রেজ্যুডিস সেটাতে বাধা দেয়।
আলবার্ট আইনস্টাইন বলেছিলেন, “কমনসেন্স হলো আঠার বছর বয়স পর্যন্ত অর্জিত সংস্কারগুলোর সংগ্রহ”, অথচ আমাদের সবচেয়ে নামকরা এক বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক বলেছেন, “আমার গত ৫৯ বছরের অভিজ্ঞতায় একটা জিনিস শিখেছি, সেটা হচ্ছে পৃথিবীর জটিল থেকে জটিলতম বিষয়টিও কমনসেন্স দিয়ে প্রায় ৯০ ভাগ বুঝে ফেলা যায়”। এই উক্তিতেই পরিষ্কার আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ব্যর্থ কেন।
ফাইনম্যান বলেছেন, আমার বাবা যদি আমাকে কোনটা জ্ঞান নয় সেই শিক্ষাটা ছোটবেলায় না দিতেন, তাহলে হয়ত ভাষা বা টুলকে জ্ঞান ভেবে আমি অনেক সময় ও মেধা নষ্ট করে ফেলতাম। ফাইনম্যানের বাবা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ছিলেন না, তিনি ছিলেন একজন কাপড়বিক্রেতা। কিন্তু তিনি ছিলেন উচ্চশিক্ষিত।
বাইবেল নিয়ে যারা গবেষণা করেছেন, তারা দেখেছেন পুরো বাইবেলের মূল উদ্দেশ্য মানুষকে একটি বিশেষ আদর্শ বা দর্শন সম্পর্কে নৈতিক শিক্ষাদান। তাঁরা দেখেছেন, এই নৈতিক শিক্ষা যদি নির্দেশনা আকারে দেওয়া হয় যেমন একটি আইন পুস্তকের মত, তাহলে সেটি মানুষের আচরণে তেমন একটা প্রভাব ফেলে না।
সে তখন জানে এক, ভাবে আরেক, আর করে ভিন্ন কিছু। সেটি মানুষের মনে শক্ত মূল্যবোধ তৈরি করে না। সেই কারণে বাইবেলের শিক্ষা বর্ণিত হয়েছে গল্পের আকারে।
নির্দেশনা আকারে দেওয়া শিক্ষা মানুষের মস্তিস্কের যে স্থানে কাজ করে, গল্পের আকারে প্রদত্ত শিক্ষা মস্তিস্কের ভিন্ন স্থানে কার্যকর হয়। কারণ গল্পগুলো মানুষের মনে একটি দৃশ্যকল্প (visualization) তৈরি করে।
ফাইনম্যান ও আইনস্টাইন, বর্তমান দুনিয়ার দুই সেরা উদ্ভাবনী মস্তিস্ক ও দুই সেরা শিক্ষক, জোর দিয়ে বলেছেন আমাদের মস্তিষ্কে এই দৃশ্যকল্প তৈরি না করতে পারলে সেই জ্ঞান কোনো কাজে আসে না। আমরা যা দেখিনি সেটা যেমন আমরা স্বপ্নে দেখি না। এই দৃশ্যকল্প শুন্য থেকে বা বই পড়ে তৈরি করা যায় না। এর জন্য মগজকে প্রস্তুত করতে হয়। নতুন দৃশ্যকল্পের জন্য মগজের প্রস্তুতির অন্তরায় হল পূর্বজ্ঞান বা প্রেজ্যুডিস।
সামরিক বাহিনীতে যারা কাজ করেন, তাদের অপরের নির্দেশে মানুষ হত্যার মত কঠিন শিক্ষা নিতে হয়। সেই কাজটি সহজ নয়। তার জন্য অন্তরায় হল তার পূর্বজ্ঞান বা প্রেজ্যুডিস। সামরিক বাহিনীর প্রশিক্ষণে তাই প্রথম কাজই হল সেই পূর্বজ্ঞান বা প্রেজ্যুডিস ভেঙে ফেলা। এর জন্য তাদের করতে হয় ডিসোশ্যালাইজেশন ও রিসোশ্যালাইজেশন।
উচ্চশিক্ষা আহরণে প্রথম কাজ হলো চিন্তার ক্ষেত্রে এই পূর্বজ্ঞান বা প্রেজ্যুডিস ভেঙে ফেলা। সেই পূর্বজ্ঞান বা প্রেজ্যুডিস ভেঙে ফেলার কাজটাই করতে হবে বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কৃতিকে। সেটি না করলে শিক্ষার্থীরা যতো বেশি নম্বরই পাক না কেনো, বা যতো প্রতিযোগিতায়ই তারা প্রথম হোক না কেনো, তারা ধরা পরে যাবে উচ্চশিক্ষার ক্যাচ-২২ বা গোলকধাঁধায়। শিক্ষা নিয়ে তাদের যথেষ্ট প্রাইড থাকলেও নতুন সমস্যা সমাধানে তাদের অবদান হবে শুন্য।