একটি বিকারগ্রস্থ সংস্কৃতি
পূর্বের অংশ শেষ করেছিলাম এই বলে যে, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর জ্ঞানের রাজনীতিকে যদি ফিরিয়ে না আনা যায়, যদি রাজনীতির মাধ্যমে সমাজের সর্বস্তরে জ্ঞানের নেতৃত্বকে প্রতিষ্ঠিত করা না যায়, তাহলে ক্রমেই বিশ্ববিদ্যালয়গুলো হয় রাষ্ট্র, অথবা ধর্মের হুকুম তামিলকারি দাসে পরিণত হবে। এখন প্রশ্ন হলো, আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো জ্ঞানের রাজনীতির চর্চায় ব্যর্থ কেন?
রাজনীতি মানে কিন্তু একটি, দুটি বা কয়েকটি দল গঠন করে দলাদলির মাধ্যমে দাবি বা সুবিধা আদায় নয়। এগুলো রাজনীতির প্রায়োগিক অস্ত্র মাত্র। রাজনীতির ভিত্তি হচ্ছে ভিশনারি বা দূর ভবিষ্যত সম্পর্কে অর্ন্তদৃষ্টি। রাজনীতি হচ্ছে ভবিষ্যতকে অর্থপূর্ণ করার লক্ষ্যে মানুষের প্রজ্ঞায়, বাসনায় ও কর্মে সংগঠিত হওয়া। ভিশনারি বা দূর ভবিষ্যত সম্পর্কে অর্ন্তদৃষ্টি না থাকলে রাজনীতি ব্যক্তিগত সুবিধা অর্জনের দলাদলিতে পরিণত হয়। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে রাজনীতি দলাদলি হলে সেটি জাতীয় রাজনীতিকে কলুষিত করে, উল্টোটা কখনোই নয়।
ভিশনারি ও দলাদলির একটি চমৎকার উদাহরণ আমরা খুঁজে পাই জীবনানন্দ দাশের ‘অদ্ভুত আঁধার এক’ আর হুমায়ুন আজাদের ‘সব কিছু নষ্টদের অধিকারে যাবে’-এর মর্মকথা বিশ্লষণে। উভয় লেখকই মহত্ সত্য, রীতি, শিল্প, সাধনা সৌন্দর্য, প্রতিভা, মেধা ইত্যাদি চলে যাবে যাদের হৃদয়ে কোনো প্রেম নেই, প্রীতি নেই, করুণার আলোড়ন নেই তাদের হাতে এটা নিয়ে হতাশা প্রকাশ করেছেন।
তফাৎ এটাই যে, জীবনানন্দ এই পতনকে দেখেছেন সামগ্রিক, সুন্দরী নারী, কিশোরী, প্রেমিকারা আর সৌন্দর্যের দেবীরা এই পতনের বাইরে নয়। অথচ হুমায়ুন আজাদের দৃষ্টিতে সুন্দরী নারী, কিশোরী, প্রেমিকারা আর সৌন্দর্যের দেবীরা আদর্শ ও উপভোগ্যই আছে। তবে তাঁরা যে বিশ্ববিদ্যালযের শিক্ষকদের শারীরিক ভোগের কাছে নিজেকে সমর্পণ না করে চ’লে যাচ্ছে নষ্টদের কাছে মানে ব্যবসায়ী, রাজনীতিবিদ এদের কাছে, সেটাই যেন আক্ষেপ।
ভবিষ্যত কল্পনায় জীবনানন্দ দেখেছেন এক অদ্ভুত আঁধার। আর হুমায়ুন দেখছেন তিনি বঞ্চিত, অন্যরা ভোগ করে ফেলছে তাঁকে না দিয়ে। হুমায়ুন আজাদ ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের চেয়ারম্যান, পেয়েছেন একুশে পদক। আমরা ধরে নিতে পারি তিনি এই প্রতিষ্ঠানগুলোর সংস্কৃতি নিশ্চই ধারণ করতেন।
দুনিয়ার সকল সমস্যাকে সামগ্রিকভাবে না দেখে মুনোষকে দুটো দলে ফেলে ভাগ করে দেখা, এটাই দলাদলি। এবং এর মুলে সবসময় রয়েছে ব্যক্তিচিন্তা, ব্যক্তিস্বার্থ এবং ব্যক্তিগত উপভোগ। দুনিয়া ঠিকই আছে, চারিদিকে কতো মজার মজার উপভোগের হাতছানি কিন্তু আমি পাচ্ছি না – তাই সব নষ্ট। এর থেকেই সৃষ্টি সকল নষ্ট মানসিকতার, সকল নষ্ট দুনিয়ার। ভবিষ্যত চিন্তায় ব্যক্তি না সমগ্র – এটিই এই দুজনের তফাৎ।
এখন প্রশ্ন হলো– কেন এমন হচ্ছে? কেন আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শিক্ষার্থী-শিক্ষকেরা তাদের নিজের ব্যক্তিগত আকাঙ্ক্ষা-প্রাপ্তির ঊর্ধ্বে উঠতে পারছে না? এর কারণ হলো এক বিকারগ্রস্থ একাডেমিক সংস্কৃতি।
এখানে বিকারগ্রস্থ সংস্কৃতি বলতে কী বোঝায় সেটি একটু বোঝা দরকার। জীবনানন্দ আক্ষেপ করেছেন, সবকিছু চলে যাচ্ছে যাদের হৃদয়ে কোনো প্রেম নেই, প্রীতি নেই, করুণার আলোড়ন নেই তাদের হাতে। যদি আমরা সারা দুনিয়ার সামরিক ব্যারাকগুলোর দিকে তাকাই, তাহলে দেখব প্রেম, প্রীতি, করুণা, মহত্ সত্য, রীতি, শিল্প, সাধনা সৌন্দর্য, প্রতিভা, মেধা এগুলো সামরিক সংস্কৃতিতে উপহাসের বিষয়।
কোনো সৈনিকের উপরোক্ত বিষয়গুলোতে সংযুক্তি প্রকাশ হওয়া মানেই সে দুর্বল, সে মেয়েলি, সে প্রকৃত সৈনিক নয় এই মুল্যবোধ। প্রকৃত সৈনিকের থাকবে দৃঢ়তা, কঠোরতা, নির্দেশ পালনে অবিচলতা এবং সবার উপরে শৃঙ্খলা– এটিই সামরিক সংস্কৃতির আদর্শ। সুতরাং দেখা যাচ্ছে, সামরিক ব্যারাকগুলোর সংস্কৃতি হচ্ছে জীবনানন্দের সেই অদ্ভুত আঁধারের জগত।
আরেকটি সমাজ যেমন বিনোদন শিল্পের জগতের দিকে তাকানো যেতে পারে। যেমন হলিউডকে বলা হয় প্ল্যানেট সাইকোপ্যাথ। মিথ্যা, ছলনা, ইগো, দাপট, প্রদর্শনবাদ, গর্ব এবং ইমেজ যেখানে সফলতার নিয়ামক। এখানে তারাই নেতৃত্বে যাদের হৃদয়ে কোনো প্রেম নেই, প্রীতি নেই, করুণার আলোড়ন নেই – এটাই সেই নার্সিসিস্টিক সংস্কৃতি।
কোনো প্রতিষ্ঠানের প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কৃতি কী হবে তা নির্ভর করে ওই প্রতিষ্ঠানের সফলতা ও প্রোডাকটিভিটির ওপর। শিল্পী, কবি বা দার্শনিকের সংস্কৃতি-সমৃদ্ধ একটি সেনাবাহিনী তৈরি করলে সেটি যুদ্ধে অসফল হবে তা নিশ্চিত। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে, যদি এমন একটি সেনাবাহিনী তৈরি হয় যারা কখনও যুদ্ধ করেনি বা তাদের আদৌ কখনও যুদ্ধ করতে হবে না (যেমন সুইজারল্যান্ড বা ভুটান) তখন সেই সেনাবাহিনীর সংস্কৃতি যেকোনো রকমই হতে পারে। অর্থাৎ, যেকোনো প্রতিষ্ঠানকে টিকে থাকতে যদি তার দক্ষতা বা সফলতা (উৎপাদনশীলতা) না হলেও চলে, তাহলে সেই প্রতিষ্ঠানের সংস্কৃতি অনুৎপাদনশীল সংস্কৃতিতে রুপান্তরিত হয়ে যেতে পারে।
আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শুরু থেকেই জ্ঞানের সংস্কৃতিকে মাড়িয়ে, তাকে দাবিয়ে বেড়ে উঠেছে পোশাকি ডিগ্রির সংস্কৃতি। আম জাম কাঁঠাল কেটে ফেলে দিয়ে বানানো হয়েছে দ্রুত বৃদ্ধির আকাশিয়া ইউক্যালিপটাসের মনোকালচার। এখন দেখা যাচ্ছে যে, সেগুলো দিয়ে আসবাবপত্র তৈরি হয় না, এমনকি এগুলো পরিবেশের জন্যও ক্ষতিকর।
সামরিক বাহিনী, হলিউড এগুলো সবই বিকারগ্রস্থ সংস্কৃতি। বিকারগ্রস্থ বলেই সামরিক ব্যারাকগুলো শহরের বাইরে জনগণের আবাস থেকে বিচ্ছিন্ন করে স্থাপিত হয়। হলিউডও সাধারণের সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন। এই বিচ্ছিন্নতার কারণ হলো এসব প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কৃতি বিশেষ পার্সোনালিটি ডিসঅর্ডারকে উৎসাহিত করে, সেটিকে লালন করে, কারণ এতে প্রাতিষ্ঠানিক সফলতা আসে। যেমন নার্সিসিস্টিক পার্সোনালিটি ডিসঅর্ডার বা অ্যান্টিসোশাল পার্সোনালিটি ডিসঅর্ডার এগুলোর সাবক্লিনিক্যাল ফর্ম ওই সব পেশায় সফলতা আনতে পারে।
ওসিপিডি বা অবসেসিভ কম্পালসিভ পার্সোনালিটি ডিসঅর্ডার এমন একটি ব্যক্তিত্বের সমস্যা যার ফলে মানুষ পরীক্ষায় অসম্ভব ভালো ফল করতে পারে। ওসিপিডি গড়ে ওঠার মেকানিজমটা হলো মায়ের অতি নিয়ন্ত্রণ (যেটি খোলামেলা বা প্রচ্ছন্ন হতে পারে যেমন হেলিকপ্টার প্যারেন্টিং)। অবচেতনে ভীতি ও অতি নিয়ন্ত্রণে মনের ভাব প্রকাশ করতে না পারার ফলে তার মনে তৈরি হয় অতিরিক্ত ক্ষোভ এবং বিধ্বংসী মনোভাব। এর ফলে তার মধ্যে তৈরি হয় ক্ষুব্ধ সমাজবিরোধী ও সমাজবিচ্ছিন্ন মনোভাব।
এই ক্ষুব্ধ সমাজবিরোধী ও সমাজবিচ্ছিন্ন মনোভাবসম্পন্ন শিশু দুটি পথের যেকোনো একটি বেছে নিতে পারে। একটি হলো খোলামেলা সমাজবিরোধী আচরণ। যেমন তারা অভিভাবকের নির্দেশ, সামাজিক নিয়মকানুন, পরিস্থিতি বিচার ও অন্যের অনুভবকে অবজ্ঞা অবহেলা করতে থাকে অনেকটা যা খুশি তাই করা তার আচরণে পরিণত হয়। এদের বলা হয় অ্যান্টিশোস্যাল আচরণ।
একই পরিস্থিতিতে কোনো কোনো একই রকম ক্ষুব্ধ, সমাজবিরোধী ও সমাজবিচ্ছিন্ন মনোভাবসম্পন্ন শিশু বেছে নেয় আত্মশাসনের পথ। অবচেতনে সে নিজেই তার নিয়ন্ত্রক মায়ের চরিত্র ধারণ করে এবং নিজের কাছেই প্রমাণ করতে চায় সে কতো আদর্শ ও সফল! এর ফলে সে একটি অভ্যন্তরীণভাবে (নিজের মনের ভেতরে) সফল হবার চক্রে আবদ্ধ হয়ে যায়। এই চক্র তাকে কোনো কাজে অবসেসিভ করে (যেমন পরীক্ষার ভালো ফল করা, কারণ মা সেটা চাইত), আবার সেটি করতে কম্পালসিভ হয়ে যায় (যেমন পরিক্ষার ভালো ফলের জন্য সবকিছু বাদ দিয়ে পড়াশোনা করা)।
এই ওসিপিডি বা অবসেসিভ কম্পালসিভ পার্সোনালিটির লক্ষণগুলো হলো:
১। নিকট দৃষ্টিসম্পন্ন (দূরদৃষ্টির মারাত্মক অভাব) তাই রাজনীতি বুঝতে অক্ষম।
২। এরা মানসিকভাবেই কৃপণ, তাই অর্থ ও বিশ্বাসেও কৃপণ। তাই এরা নতুন বিনিয়োগ, নতুন চিন্তা ও উদ্ভাবনে বাধা দিয়ে থাকে কারণ এরা সফলতার চেয়ে সেটাকে অপচয়ই মনে করে।
৩। এদের থাকে বিশ্লেষণাত্মক মন। যুক্তি ও হিসাবের বাইরে সামগ্রিকতা বা বিগ পিকচার দেখতে অক্ষম।
৪। অনমনীয়, আবদ্ধ ও কঠোর আচরণ।
৫। অযাচিত রকমের খুঁতখুঁতে এবং নিয়মতান্ত্রিক।
৬। নৈতিকতা ও ধর্মে কঠোর।
৭। এরা সমতা, টিমওয়ার্কে বিশ্বাসী নয়, বরং বিশ্বাস করে ও অনুসরণ করে মনিব-ভৃত্য সম্পর্ক।
৮। নিজের সমকক্ষদের সাথে সামাজিকতায় অস্বস্তি প্রকাশ করে। পছন্দ করে যাদের প্রভু ভাবে অথবা যারা অনেক নিম্নস্তরের অনুগামী (যেমন অনুগত ছাত্র – মিনিয়নস)।
৯। অতি নিয়মতান্ত্রিক এবং সেই নিয়ম রক্ষায় অপ্রয়োজনীয় রকম কঠোর ও অবিচল।
১০। কাজপাগল (ওয়ার্কোহলিক)।
ওসিপিডি বা অবসেসিভ কম্পালসিভ পার্সোনালিটির সাবক্লিনিক্যাল ফর্ম যখন কোনো প্রতিষ্ঠানের উচ্চপর্যায়ে মেজরিটি হয়ে যায়, তখন সেখানে ওসিপিডি কালচার প্রতিষ্ঠিত হয়ে যায়। ওসিপিডি একটি বিকারগ্রস্থ সংস্কৃতি কারণ ওসিপিডিরা ক্ষুদ্র অর্থে সফল হলেও যেহেতু তারা বিগ পিকচারে অন্ধ তাই তারা সর্বত্রই পরাজিত হয়। তারা অসম্ভব মেধা ও সফলতার স্ফুলিংগ তৈরি করে কিন্তু তারপর নিজের চক্রেই ঘুরতে থাকে।
ওসিপিডি কালচার প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেলে সেই প্রতিষ্ঠান উন্নয়ন, উদ্ভাবন ও সামগ্রিকতায় পিছিয়ে পড়ে এবং অর্থহীন আত্মমগ্নতায় খেটে মরতে থাকে। যার সকল মানের অবনতি হতে থাকে কারণ তাদের কোনো দূরদৃষ্টি থাকে না এবং রাজনৈতিক বোধ থাকে না। তারা পরিণতি হয় গ্লোরিয়াস ক্ষমতাশালীদের অনুচরে পরিণত হওয়া। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এর চমৎকার উদাহরণ।