বাড়ি উচ্চশিক্ষা আমাদের উচ্চশিক্ষা ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ব্যর্থতা

আমাদের উচ্চশিক্ষা ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ব্যর্থতা

উচ্চশিক্ষা ও মস্তিষ্কের গঠন

বিজ্ঞানের শিক্ষার্থী হিসাবে অল্প বয়সেই আমার অনেক বন্ধু ও বিশিষ্টজনের সাথে পরিচয় হয়, যারা মার্কসবাদী রাজনীতির সাথে যুক্ত ছিলেন। মার্কসবাদে অনেক আকর্ষণীয় ধারণা থাকলেও সবসময়ই আমার মার্কসবাদকে একধরনের কৃত্রিম বা নিউরোটিক (শুধুই আদর্শ চিন্তাগত ধারণা থেকে সৃষ্ট) কনসেপ্ট মনে হয়েছে।

মানুষের জীবনের যে আবেগগত দিক, জীবনের বাস্তবতার যে দৈব ও দলগত আচরণ – সেগুলো যেন এই তত্ত্বে অনেকটাই উপেক্ষিত বা অবহেলিত। আমার কাছে সবসময়ই মনে হয়েছে, মার্কসের দুই কাঁধে দুটো ভুত আছে। একটি হল নিউটন আর একটি হল যিশু। মার্কসবাদ হল যিশুর (ইব্রাহিমিয় ধর্মের) যান্ত্রিক আদর্শবাদ নিউটনের যান্ত্রিক বলবিদ্যার মাধ্যমে আবেগে নরম, আদর্শে দুর্বল মানবজাতির ওপর চাপানোর চেষ্টা। মানব বিবর্তনের যে ইতিহাস ও মানব মনের বিজ্ঞানের যে অযৌক্তিক আচরণ, সেটি এই যান্ত্রিক তত্ত্বের সাথে একেবারেই যায় না।

আমার সবসময় মনে প্রশ্ন ছিলো, মার্কস কেন মানুষকে এমন যান্ত্রিক ভাবলেন। যদিও মার্কস নিজেই বলে গেছেন যে তিনি মার্কসবাদী নন। কথা সত্য। তিনি শুধু একটি অর্থনীতির দ্বান্দ্বিক তত্ত্ব হাজির করেছেন। সেটি নিয়ে রাজনীতি করতে তিনি বলেননি। এটা করেছেন অন্য যন্ত্রমস্তিষ্ক পণ্ডিতেরা।

কিন্তু অর্থনীতিকেই মার্কস এমন চোখে দেখেছেন কেন? যেখানে যেন মনে হয় মানুষ একটি যান্ত্রিক অপরিবর্তনীয় আচরণনির্ভর জন্তু (behavioral animal)? এর কারণ হয়তো পাভলভীয় চিন্তাভাবনা। যারা জীবজগতকে একটি যান্ত্রিক অপরিবর্তনীয় আচরণ জন্তু হিসাবে হাজির করেছেন। কিন্তু পাভলভেরা কেন এমন চিন্তা করেছেন? এর কারণ নিশ্চই নিউটন।

যন্ত্রসভ্যতার অর্থনৈতিক উত্থানের সময় আমরা যে যেমনই হোক তাকে যন্ত্রসম দেখেছি। এমনকি মধ্যযুগের ধর্মগুলোও তাদের শরীর থেকে অধিবিদ্যা ও অধ্যাত্মবাদের মেদ-মাংস ঝরিয়ে ফেলেছে। ঝরিয়ে ফেলেছে মানবীয় আবেগ এবং দৈবপ্রভাবের চীরন্তন সত্যকে। ধর্মকে করেছে যান্ত্রিক হিসাবনিকাশ ও লস অ্যান্ড প্রফিট বিজনেস। চিন্তা নয়, প্রেম নয়, আচরণ ভালো হলে গুড পয়েন্ট ও স্বর্গ এবং আচরণ মন্দ হলে নরক।

সেই যুগে বিশ্ববিক্ষাবিদ নিউটন ও পরবর্তিতে অর্থনীতিবিদ মার্কস দুজনেই একটি বিষয় মিস করে গেছেন। সেটি হলো, তারা যাকে স্থির (কনস্টান্ট) ও ভিত্তি হিসাবে ধরে তাদের তত্ত্বগুলো হাজির করেছেন, সেই মানুষের মস্তিস্ক, সেগুলো আসলে স্থির (কনস্টান্ট) ও ভিত্তি নয়। সেগুলো মানুষের যে চিন্তা, তত্ত্ব ধারণা – তথা অর্থনীতি বা বিশ্ববীক্ষার ওপর ভিত্তি করে পরিবর্তনশীল।

সহজ করে বললে এটা এমন যে, আমরা যদি একটি যান্ত্রিক বিশ্বের ধারণা মেনে নেই, তাহলে আমাদের নিজেদের মগজ সবকিছু যান্ত্রিক দেখবে। আমরা যদি মার্কসবাদকে সর্বত্র প্রয়োগ করি, আমাদের মগজগুলো পরিণত হবে অর্থনীতির সমীকরণের সংকেতে চালিত রোবটে। তার মানে আমরা যেমন চিন্তা মেনে নেব, আমাদের মগজ তেমন হয়ে যাবে।

বর্তমানে যারা মস্তিস্কের কার্যপদ্ধতি সংক্রান্ত মনোবিজ্ঞান তথা নিউরোসাইকোজি নিয়ে কাজ করছেন, তারা বলছেন কী বোকাই না আমরা ছিলাম‍! আমরা ভাবতাম মানুষের হার্ট, লাং বা কিডনির মতো মগজও বোধহয় একটি যন্ত্র যার নির্দিষ্ট একটি কার্যপদ্ধতি বা ফাংশনাল প্রপার্টি আছে।

কিন্তু হায়! মানুষের মগজ কোনো দেহযন্ত্রের মতো নয়, এটি নিজেই একটি জীবন্ত প্রাণী – লিভিং অর্গ্যানিজমের মতো। নিজের ভেতরের চাপ, প্রেষণা অনুভব (ইনার ড্রাইভ) এবং বাইরের পরিবেশ অভিজ্ঞতা এবং অনুপ্রেরণা (সোশ্যাল ড্রাইভ) – এগুলো থেকে সে নিজেকে প্রয়োজনমত নির্মাণ করে চলে। এই নির্মাণ মগজের ভৌতিক গঠনে ততোটা নয় যতোটা তার অভ্যন্তরের সংযোগগুলোর ধরণ, বিস্তৃতি ও সংখ্যায় (নিউরাল কানেক্টিভিটি)। এই খাপ খাওয়ানোকেই বলা হয় নিউরো প্লাসটিসিটি।

এই বিষয়টি আধুনিক পণ্ডিতেরা মিস করে গেলেও আমাদের ভারতবর্ষের বেদ উপনিষদের যে পণ্ডিতেরা, তারা মিস করে যাননি। এই বিষয়টি প্রাচীন অর্থাৎ বেদিক ভারতীয় পণ্ডিতরা জানতেন সেই চার হাজার বছর আগেই। এই কারণে তাঁরা মানুষকে পেশাভিত্তিক চারটি ভাগে ভাগ করেছিলেন।

সেখানে ব্রা‏‏হ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য ও শূদ্র অর্থাৎ এই চারটি কর্মসংস্কৃতির বিভাজন ছিলো, যেখানে একজনের কাজ, একজনের চিন্তা আর একজনকে দিয়ে হবে না বলেই তারা ঠিক করেছিলেন। যেখানে ব্রা‏‏হ্মণের কাজ ছিলো ধর্মগুরু বা শিক্ষকের, ক্ষত্রিয়রা ছিলো যোদ্ধা বা শাসনকর্তা, বৈশ্যরা ছিলো কৃষিবিদ বা ব্যবসায়ী এবং শূদ্র হলো যারা কায়িক শ্রম দিয়ে থাকে।

বেদ-উপনিষদে বা রামায়ণ-মহাভারতেও সমাজ পরিচালনায় পেশাগত বিভাজন থাকলেও জন্মভিত্তিক কাস্ট সিস্টেম বা বর্ণপ্রথা ছিল না, ছিলো পেশা সংস্কৃতির বিভাজন। জন্মভিত্তিক বর্ণপ্রথার প্রচলন হয়েছিল হিন্দু পুরোহিতেরা যখন বৌদ্ধধর্ম দ্বারা হিন্দুত্বের বিলোপের ভয়ে ভীত এবং নিজেদের পেশা হারানোর শঙ্কায় তখন। সেটি ২০০ থেকে ৩০০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে হয়েছিল যখন তারা রাষ্ট্রীয় আইনের অনুকরণে মনুসংহিতা নামে ধর্মীয় আইনের একটি গ্রন্থ রচনা করে, সেই থেকে।

এখানে ‘ব্রা‏‏হ্মণ’ শব্দটির গুরুত্ব বুঝতে হবে। বৃহদারণ্যক উপনিষদে (৩/৮/১০) বলা হয়েছে:

“যো বা এতদক্ষরং গার্গি বিদিত্বাস্মাল্লোকাৎ প্রৈতি স ব্রাহ্মণঃ”

যার অর্থ হলো, “যিনি জীবনের মূল সমস্যার (জন্ম, মৃত্যু, জরা ও ব্যাধির) সমাধান সম্পর্কে অবগত হয়ে দেহত্যাগ করেন, তিনিই ব্রাহ্মণ”। এখানে ব্রাহ্মণ বলতে পুজারী নয়, জ্ঞানী, শিক্ষক অর্থাৎ ব্রহ্মজ্ঞানের অধিকারীদের বলা হয়েছে যিনি ব্রহ্ম সম্পর্কে জানেন। ব্রহ্ম বলতে মহাবিশ্বে বিদ্যমান চূড়ান্ত ও অখণ্ড সত্যের ধারণাকে বোঝায়।

একই শ্লোকে আরও বলা হয়েছে:

“যো বা এতদক্ষরং গার্গ্যবিদিত্বাস্মাল্লোকাৎ প্রৈতি স কৃপণঃ”

যার অর্থ, “যে মানুষ আত্মতত্ত্ব-বিজ্ঞান উপলব্ধি না করে, কুকুর বিড়ালের মতো এই জগৎ ত্যাগ করে এবং মনুষ্য দেহ লাভ করেও জীবনের সমস্যার সমাধান করে না, সে একজন কৃপণ”। এখানে সংস্কৃত ‘কৃপণ’ শব্দটি হচ্ছে ‘ব্রাহ্মণ’ এর বিপরীত শব্দ, অর্থাৎ ব্রহ্মজ্ঞানে কৃপণ, অর্থে কৃপণ নয়।

প্রাচীন ভারতীয় বেদিক সমাজব্যবস্থায় মহাবিশ্বে বিদ্যমান চূড়ান্ত ও অখণ্ড সত্যের ধারণাকে অর্জন করতে গেলে শিক্ষাব্যবস্থা ও শিক্ষকদের অর্থনীতি বা অন্যান্য জাগতিক কর্ম থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে শিক্ষা সংস্কৃতির মধ্যে বেড়ে ওঠার উপদেশ দেওয়া হয়েছে।

এর কারণ হলো, আধুনিক নিউরোসাইকোলজিস্টরা যা বলছেন, যে ‘মগজ’ নামক আমাদের যে লিভিং অর্গ্যানিজমটি শিশু থেকে বেড়ে উঠছে, তাকে শিক্ষাসহায় পরিবেশে মুক্তভাবে বেড়ে উঠতে দেওয়া। 

বর্তমানে প্রমাণিত হয়েছে যে, শুধু মহাবিশ্ব সম্পর্কে তত্ত্বগত জ্ঞান নয়, সকল উচ্চশিক্ষায় চূড়ান্ত ও অখণ্ড সত্যের ধারণা যদি শিক্ষার্থীর লক্ষ্য না হয়, তাহলে অর্জিত জ্ঞান জীবন বাস্তবতার জটিল সব সমস্যার সমাধান দিতে পারে না। বিশেষ করে স্থানীয় সমস্যার।

উচ্চশিক্ষা ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলো যদি এতে ব্যর্থতার পরিচয় দেয়, তাহলে শুধু তত্ত্ব জ্ঞানের সমাজ নয়, সমাজ ও রাষ্ট্রের প্রতিটি অঙ্গ ক্রমেই অন্তহীন সমস্যার চোরাবালিতে ডুবতে থাকবে যার নিদর্শন আমাদের সমাজের প্রতিটি ক্ষেত্রে এখন দৃশ্যমান। 

আমাদের মস্তিষ্কের গঠন উচ্চশিক্ষা গ্রহণে উপযুক্ত হিসাবে সমৃদ্ধ হবে কি না সেটি নির্ভর করবে আমাদের সমাজের সংস্কৃতি সেটার সহায় কি না। আবার প্রকৃত উচ্চশিক্ষাকে না বুঝলে বা সত্যিকারের শিক্ষাকে সর্বোচ্চ মূল্য না দিলে সমাজের সংস্কৃতি উচ্চশিক্ষার সহায়ে পরিবর্তিত হবে না।

এটি একটি আবদ্ধ কু-চক্র। এই কু-চক্রকে ভাংতে পারে শুধুই বিশ্ববিদ্যালয়ের শুদ্ধ জ্ঞানচর্চার সংস্কৃতি। বিশ্ববিদ্যালয়গুলো যদি এটিকে হারিয়ে ফেলে তাহলে সেই কু-চক্র থেকে মুক্তির আর কোনো আশা নেই। অশিক্ষার কু-চক্র তখন ছেয়ে ফেলবে সমাজ রাষ্ট্রের প্রতিটি অংশকে।

কোন মন্তব্য নেই

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Exit mobile version