মুখস্থনির্ভর শিক্ষা ও স্মরণশক্তিকে মেধা বলে চালিয়ে দেওয়ার মানসিকতা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে বলে মন্তব্য করেছেন মাননীয় শিক্ষামন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী।
তিনি বলেছেন, “বর্তমান কারিকুলামে শিখন পদ্ধতি ভিন্ন। গতানুগতিক শিক্ষার ধারণা থেকে এ পদ্ধতি পুরোপুরি আলাদা। এটা অভিজ্ঞতানির্ভর শিক্ষা। গতানুগতিক শিক্ষাকে যেভাবে দেখা হয় যে, শুধু কিছু তথ্য মুখস্থ করবো, মানে মেমোরি ড্রাইভেন প্রসেস, সেখান থেকে বের হয়ে আসতে হবে। তাহলেই স্মার্ট বাংলাদেশ গড়তে পারবো।
মাননীয় মন্ত্রী আরও বলেন, “নলেজ, ভ্যালুজ ও স্কিলস— এই তিনটির সমন্বয়ে হবে আমাদের শিক্ষা। সাম্প্রদায়িকতামুক্ত, সমতা, জাতীয়তাবোধ, কর্মমুখী শিক্ষা ও দক্ষতা নিশ্চিত করতে হবে। নলেজ দেওয়ার জায়গায় এবং মূল্যবোধের জায়গায় শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ দিতে হবে”।
তিনি মুখস্থনির্ভর শিক্ষা বিষয়ে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কিছু উক্তি সেখানে উল্লেখ করেছেন যে, শিক্ষার্থীদের বিশাল একটি অংশ যদি খুব কম বয়সে ঝরে পড়ে, তাহলে তো আমরা স্মার্ট প্রজন্ম তৈরি করতে পারব না।
প্রধানমন্ত্রী মুখস্থনির্ভর শিক্ষা বিষয়ে আরও বলেছেন, আমাদের লক্ষ্য হচ্ছে, শিশুরা শুধু মুখস্থবিদ্যা শিখবে না, একটা শিশুর ভেতর যে মেধা ও মনন থাকে, সেটাকে বিকশিত হওয়ার সুযোগ দেয়া। তার ওই মেধা দিযেই যেন সে এগিয়ে যায, সেদিকে লক্ষ্য রেখে আমাদের শিক্ষাক্রম এবং শিক্ষা দেওয়ার পদ্ধতিতে পরিবর্তন আনা হচ্ছে।
মাননীয় শিক্ষামন্ত্রী নিজে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর মুখস্থনির্ভর শিক্ষা বিষয়ে এই উক্তিগুলো উল্লেখ করেছেন ১৪ মে রাজধানীর একটি হোটেলে ‘লার্নিং এক্সিলারেশন ইন সেকেন্ডারি এডুকেশন প্রজেক্টে’র উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে। বিশ্বব্যাংকের সহায়তায় এ প্রজেক্ট বাস্তবায়ন করছে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তর।
আমাদের শিক্ষার্থীদের প্রকৃত মেধার বিকাশে উক্ত কথাগুলো অত্যন্ত মূল্যাবান বলে আমরা মনে করছি। তাঁরা দু’জনই প্রকৃত শিক্ষাগ্রহণ ও শিক্ষাদানের পদ্ধতির দিকেই ইঙ্গিত করেছেন।
প্রশ্ন হচ্ছে, কোনোকিছু মুখস্থ করা এবং শিক্ষার্থীর অন্তর্নিহিত মেধার বিকাশ কি একই জিনিস, নাকি একে অপরের পরিপূরক? নাকি এ দুটো বিষয়ের মধ্যে পার্থক্য রয়েছে? পার্থক্য থেকে থাকলে সেটি কতটুকু?
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষক, কোচিং সেন্টারের শিক্ষক কিংবা গৃহশিক্ষক কর্তৃক সরবরাহকৃত কোনো তথ্য বা উত্তর যখন কোনো শিক্ষার্থী আত্মস্থ করে হুবহু পরীক্ষায় খাতায় লিখে, সেটি এক ধরনের নকল বা মুখস্থনির্ভর শিক্ষা, যেটিকে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন, মাথায় নকল নিয়ে যাওয়ার মতো বিষয়টি।
হুবহু অন্যের তথ্য মাথায় নিয়ে নির্দিষ্ট সময় পরে খাতায় ঢেলে দেয়া এক ধরনের এক শক্তি, তবে তাকে ঠিক মেধা বলা যায় না। বাস্তব জীবনে কিছু বিষয় প্রাকৃতিকভাবে আমাদের মজ্জাগত হয়ে যায়, আত্মস্থ হয়ে যায় বার বার অনুশীলন, ব্যবহার এবং চর্চা করার ফলে।
কিন্তু নির্দিষ্ট প্রশ্নোত্তর বা বিষয় যখন মেমোরিতে ধরে রাখার জন্য আমরা বার বার পড়ি, হয়তো সে বিষয়টির সবকিছু বুঝি না কিংবা আংশিক বুঝি কিংবা অনেকটাই বুঝি না, সেটি হচ্ছে মেমোরাইজেশন বা মুখস্থবিদ্যা বা মুখস্থনির্ভর শিক্ষা। এই বিষয়টিকে সকল শিক্ষাবিদ নিরুৎসাহিত করেন, নিষেধ করেন। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ও শিক্ষামন্ত্রী সেই কথাগুলোই আবারও স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন।
কোনোকিছু শুনে বা পড়ে মেমোরিতে দীর্ঘদিন ধরে রাখতে পারা বা মুখস্থনির্ভর শিক্ষা এক ধরনের শক্তি, তবে মুখস্থনির্ভর শিক্ষা ইতিবাচকভাবে ব্যবহার করতে পারলে মেধার পরিস্ফূরণেও সহায়ক হয়, অনেক বিষয়ের ব্যাপ্তি আরও বৃহত্তর করা যায়।
আমার মনে আছে, ব্র্যাক শিক্ষা কর্মসূচিতে আমাদের এক সহকর্মী ছিলেন (বর্তমানে তিনি অবসরে গেছেন), যিনি ব্র্যাক শিক্ষা কর্মসূচির পুরো দেশের ব্র্যাক পাঠাগারগুলো তিনি দেখতেন।
একবার ইউরোপের কয়েকটি দেশে তাঁকে যেতে হয়েছিল আন্তর্জাতিক পাঠাগার বিষয়ক কোনো সেমিনারে। কিন্তু তিনি ইংরেজি সেভাবে জানতেন না। কিন্তু তাঁর সাহস আছে যেকোনো পরিস্থিতি তিনি মোকাবিলা করে আসতে পারবেন। তিনি আমাদের কাছ থেকে লিখে নিলেন কী কী ধরনের প্রশ্ন তাঁকে করা হতে পারে, উত্তরে তিনি কী কী বলতে পারেন।
সেই লিখে নেয়া পুরো বিষয়গুলো তিনি একেবারে মুখস্থ করে ফেলেছেন এবং সেভাবেই তিনি উপস্থাপন করে, দর্শকদের উত্তর দিয়ে দেশে চলে এসেছেন। সেই থেকে মুখস্থনির্ভর শিক্ষা বিষয়কে আমি এক ধরনের শক্তি বলে থাকি।
ব্র্যাকে আমি আরও একজন সহকর্মী দেখেছি, যিনি বর্তমানে ভারতে বসবাস করছেন। তাঁকে ব্র্যাক শিক্ষা কর্মসূচিতে বলা হতো ‘তথ্যভান্ডার’। আমি প্রথম যোগদান করার পর সমস্ত বিভাগ ও এরিয়ার সব ধরনের কর্মকর্তাদের নামের তালিকা চাইলাম। তিনি আমাকে হুবহ সবার কথা বলে দিলেন। তাঁর কাছে প্রকৃত অর্থে লিখিত নেই, তিনি সব মুখস্থ রাখতেন।
যেমনটি ব্রিটিশরা যখন আমাদের পাক-ভারত উপমহাদেশ শাসন করতো, তখন তাদের সুবিধার জন্য মানুষরূপী কিছু কম্পিউটার তারা ব্যবহার করতেন। অর্থাৎ ওই যুগে তো কম্পিউটার অবিষ্কার হয়নি, অথচ অনেক তথ্য তাঁদের তৎক্ষণাৎ প্রয়োজন হতো যা কিছু কর্মকর্তা-কর্মচারীদের নিকট থেকে পাবার ব্যবস্থা করেছিলেন।
তারা ওসব তথ্যের গভীর রহস্য বুঝতেন না বা তাদের বুঝতে দিতেন না, তবে প্রয়োজনে তথ্য বলে দিতে পারতেন। সেই থেকেই মুলত মুখস্থবিদ্যাকে ঠিক ইতিবাচকভাবে নেওয়া হয় না এবং কবিগুরু রবিন্দ্রনাথ ঠাকুরও ওই বিষয়টিকেও ইঙ্গিত করেছিলেন। উঠতি বয়সের শিক্ষার্থীরা এ কাজটি করলে তাদের নিজস্ব রিজনিং ফ্যাকাল্টি, সৃজনশীল বিষয় পরিস্ফুটনে বাধাগ্রস্ত হয়। ধীরে ধীরে নিজস্বতা হারিয়ে ফেলে। তাই মুখস্থনির্ভর শিক্ষা বিষয়টিকে এখনও নিরুৎসাহিত করা হয়।
এর উল্টোটি হচ্ছে মেধার প্রসার। সেটিকে আমার এভাবে বলতে পারি— কোনো যুক্তিপ্রদর্শনমূলক লেখা, যেমন আমি এই বিদ্যালয়ে কেন ভর্তি হয়েছি, যদিও বিদ্যালয়টি স্বনামধন্য নয়। তার যৌক্তিক কিছু কারণ থাকতে পারে। যেমন বিদ্যালয়টি আমার বাসার কাছে, এখানে আমি হেঁটে আসতে পারি, আমার সময় কম খরচ হয়, ট্রান্সপোর্টের কোনো চিন্তা করতে হয় না, শ্রেণিতে শিক্ষার্থীসংখ্যা কম, তাই শিক্ষকগণ সকল শিক্ষার্থীর দিকে প্রায় সমান দৃষ্টি দিতে পারেন ইত্যাদি।
এ প্রশ্নগুলো আামি ঢাকার অভিজাত এলাকার একটি বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের জিজ্ঞেস করেছিলাম। খুব সন্তোষজনক উত্তর কেউ দিতে পারেনি, যদিও তাদের মেধা আছে কিন্তু নিজস্ব চিন্তাভাবনা করার চর্চা, অভ্যাস এবং শক্তি হারিয়ে ফেলেছেন শিক্ষকদের দেয়া নোট আর গাইড পড়ে আর প্রাইভেট পড়ে।
আমি অবাক হয়ে গিয়েছিলাম যে, একজন শিক্ষার্থীও আমি উপরে যে কথাগুলো বলেছি, তার একটিও বলেনি। এই বিষয়টিকেই নিরুৎসাহিত করা হচ্ছে। শিক্ষার্থীদের একটি সমস্যা দেয়া হবে, সেটি তারা সীমিত সম্পদ দিয়ে কোনো কোনো উপায়ে সমাধান করতে পারে সেটি হচ্ছে মেধা। এই ধরনের চর্চা আমাদের শিক্ষার্থীদের হচ্ছেনা। মন্ত্রী মহোদয় সেটিই বলেছেন।
মুখস্থনির্ভর শিক্ষা বা না বুঝে মুখস্থ করার ফল কী? আমি যখন রাজউক কলেজে শিক্ষকতা করি, তখন শিক্ষার্থীদের একদিন পরীক্ষা করার জন্য হঠাৎ লিখতে দিয়েছিলাম ‘ট্রাফিক জ্যামে তাদের অভিজ্ঞতা’। ওখানকার সকল শিক্ষার্থীই বাছাই করে নেয়া হয়, সব ধরনের চর্চাও করানো হয় কিন্তু দেখলাম সঠিক যুক্তিসহ কোনো শিক্ষার্থীই সন্তোষজনক লেখা লিখতে পারেনি।
আমি বলে দিলাম কয়েকটি পয়েন্ট, তারপরও সেভাবে কেউই লিখতে পারেনি। কিন্তু তাদের যদি বলা হতো আগামীকাল এটির ওপর একটি প্যারাপ্রাফ লিখতে হবে, তাহলে দেখা যেতো ক্লাসের সবাই সুন্দর করে লিখতে পারতেন, কারণ সবাই সেটি বুঝে কিংবা না বুঝে কিংবা চিন্তা না করে মুখস্থ করে আসতেন। এটাই মুখস্থনির্ভর শিক্ষা।
আবৃত্তিকার, ছড়াকার, গায়ক, হাফেজ দর্শকদের মাতিয়ে রাখেন। তাঁরা বিষয়টির গভীরে না গেলেও তাদের মুখস্থশক্তির বা মুখস্থনির্ভর শিক্ষা দ্বারা কিন্তু দর্শকদের অভিভুত করে ফেলেন। এখন যে গান তারা গাইলেন, যে কবিতা পাঠ করলেন, তার নিগূঢ় রহস্য, বিভিন্ন ধরনের ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণ করতে পারলেন, কোন ধরনের কবিতা ও গান সেটিও ভালোভাবে আবিষ্কার করতে পারলেন, বৈশিষ্টাবলী বুঝলেন।
একইভাবে যিনি কোরানের আয়াত শুধু মুখস্থ না তার অর্থ, ব্যাখ্যা সুন্দরভাবে করলেন এবং নিজের জীবনেও বাস্তবায়ন করছেন, সেটি হচ্ছে বাস্তব প্রয়োগ। সেটি তিনি অন্য মানুষদেরও শেখাতে পারেন, বুঝাতে পারেন, সেই অনুযায়ী অন্যদের জীবনযাপনে উদ্ধুদ্ধ করতে পারেন। এখানেই শুধু মুখস্থ করা আর মুখস্থের সাথে ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ ও প্রয়োগ করতে পারার মধ্যে তফাৎ।
এখানেই শুধু মুখস্থবিদ্যা ও মেধার মধ্যে পার্থক্য বুঝা যায়। তাছাড়া ব্লুম ট্যাক্সোনমির প্রথম স্তরটিও কিন্তু স্মরণ রাখা অর্থাৎ তথ্য মুখস্থ রাখার বিষয়। মুখস্থ রাখা তথ্যের ওপর নির্ভর করেই আস্তে আস্তে সামনে আগাতে হয়, এবং তখন তথ্যের ব্যাখ্যা, বিশ্লেষণ ও প্রয়োগের বিষয় চলে আসে। অতএব কিছু তথ্য মুখস্থ রাখা প্রয়োজন।
স্মৃতিশক্তি মানুষের একটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। কোনোকিছু পাঠ করে যদি কিছুই মনে না থাকে তবে তা পড়ে লাভ কী? তাছাড়া কিছু বিষয় মুখস্থ না করলে তা আত্মস্থ হয় না। তাই যা আত্মস্থ করা প্রয়োজন, তা কিছু মুখস্থ করাও আবশ্যক। কিন্তু আমাদের পরীক্ষা পাসের জন্য যেসব তথ্য মুখস্থ করা হয়, তা অপ্রয়োজনীয়।
মুখস্থ করা সব তথ্যের মাঝে সম্পর্ক না বুঝলে তা মাথায় রাখা আর কম্পিউটারের মেমরি চিপসে থাকা একই কথা। আমরা যদি কেবল ইন্টিলিজেন্স কোশেন্ট-এর চর্চা করি ইমোশনাল ইন্টিলিজেন্সকে বাদ দিয়ে, তার মানে হচ্ছে, রোবটিক বুদ্ধিমত্তারই একমাত্র মূল্যায়ন করা, আবেগিত বুদ্ধিমত্তার নয়। ফলে শিক্ষার্থীর সততা, ন্যায়বোধ, দেশগ্রেম, সমাজবোধ, কল্যাণচিন্তা, সৃষ্টিশীলতা, মানবিকতা ইত্যাদি মানবিক গুণাবলী বিচার চরম অবহেলিত থেকে যায়। তাই-ই হচ্ছে এবং এজন্যই অনেকে না বুঝে কিছু মুখস্থ করাকে দায়ী করেছেন।
লেখক পরিচিতি
মাছুম বিল্লাহ বাংলাদেশে ইংলিশ টিচার্স অ্যাসেসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ইট্যাব)-এর সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। তিনি পূর্বে ক্যাডেট কলেজ ও রাজউক কলেজের শিক্ষক হিসেবে কাজ করেছেন। কাজ করেছেন ব্র্যাকের শিক্ষা কর্মসূচিতে বিশেষজ্ঞ হিসেবে। তিনি ভাব বাংলাদেশের কান্ট্রি ডিরেক্টর হিসেবেও কর্মরত রয়েছেন। তিনি নিয়মিত শিক্ষাবিষয়ে নানা প্রবন্ধ লিখছেন।