ওমর শেহাবের ‘নতুন শিক্ষাক্রমে দুটি বড় ভুল’ : একটি ‘ব্যক্তিগত’ প্রতিক্রিয়া

ওমর শেহাব জানিয়েছেন, তিনি নতুন শিক্ষাক্রম বাস্তবায়নের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। সেই অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে সম্প্রতি তিনি প্রথম আলোয় ‘নতুন শিক্ষাক্রমে দুটি বড় ভুল’ শিরোনামে তাঁর মতামত জানিয়েছেন। তাঁর বর্ণিত এই দুটো ভুল যে আসলেই বড় ভুল এবং এর চেয়েও বড় বা সমপরিমাণ আরও কয়েকটি ভুল নিয়ে আলোচনা করতে চাই এই লেখায়।

প্রতিক্রিয়া সবসময়ই ব্যক্তিগত হয়, কিন্তু শিরোনামে ব্যক্তিগত শব্দটিতে জোর দেওয়ার বড় কারণ হচ্ছে, ওমর শেহাবের বর্ণিত দুটো ভুল এবং আরও কিছু ভুল নিয়ে যে আলোচনাটি করতে চাই, সেটি বাংলাদশের শিক্ষা সেক্টরে আমার অনেকদিনের কাজের অভিজ্ঞতার আলোকে প্রাপ্ত অনুধাবন ও উপলব্ধিকে কেন্দ্র করে।

এটি কোনো আনুষ্ঠানিক আলোচনা নয়; বরং তাঁর লেখাকে কেন্দ্র করে আমি শুধু আমার ব্যক্তিগত অনুভূতি ও প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করতে চাইছি। এই আলোচনা হয়তো এও অনুধাবন করা সম্ভব হবে যে, কীভাবে আমরা প্রাতিষ্ঠানিকভাবে দিনের পর দিন বড় বড় ভুল করে যাচ্ছি।

ওমর শেহাবের দুটি ভুল নিয়ে আলোচনার আগে নতুন শিক্ষাক্রম প্রণয়নের ভিত্তিতে যে সবচেয়ে বড় ভুলটি পরিলক্ষিত হয়, সেটি প্রথমে আলোচনা করা দরকার। নতুন শিক্ষাক্রম প্রণয়নের সময়, ২০২০ সালে, তৎকালীন শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি জানিয়েছিলেন, সরকার শিক্ষানীতি ২০১০ সংশোধনের উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। এর কারণ হিসেবে তিনি বলেছিলেন, “প্রায় ১০ বছর আগে শিক্ষানীতি প্রণয়ন করা হয়েছে। এ দীর্ঘ সময়ে অনেক পরিবর্তন সাধিত হয়েছে। তাই এখন সময় এসেছে শিক্ষানীতিকে সংশোধন করা, পরিমার্জন ও সংযোজন করার”।

শিক্ষানীতিকে সংশোধন করার কারণ হিসেবে ডা. দীপু মনি যা উল্লেখ করেছেন, সেটি গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রচুর শিক্ষা কমিশন ও শিক্ষা কমিটি গঠন করা হলেও তাদের প্রতিবেদনকে শিক্ষানীতি হিসেবে গ্রহণ করার ইতিহাস খুবই খারাপ। প্রায়ই রাজনৈতিক বিবেচনায় অধিকাংশ শিক্ষা কমিশনের প্রতিবেদন শিক্ষানীতি হিসেবে গৃহীত হয়নি। ১৯৭২ সাল থেকে শুরু করে ২০০৯ পর্যন্ত সর্বমোট ১০টি শিক্ষা কমিশন ও কমিটি গঠিত হলেও মাত্র দুটো কমিশন বা কমিটির প্রতিবেদন শেষ পর্যন্ত নীতি হিসেবে গৃহীত হয়েছে।

১৯৯৭ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য মুহাম্মাদ শামসুল হককে প্রধান করে যে কমিটি গঠন করা হয়, তাদের প্রতিবেদনকে কেন্দ্র করে ২০০০ সালে বাংলাদেশে সর্বপ্রথম শিক্ষানীতি গ্রহণ করা হয়; কিন্তু সেটি বাস্তবায়িত হয়নি। এরপর ২০০৯ সালে জাতীয় অধ্যাপক কবির চৌধুরীকে প্রধান করে যে কমিটি গঠিত হয়, তাদের প্রতিবেদনকে ভিত্তি ধরে ২০১০ সালে দেশের দ্বিতীয় ও বর্তমান শিক্ষানীতি গৃহীত হয়। কিন্তু, সেই শিক্ষানীতির অধিকাংশ বিষয় অবাস্তবায়িত থেকে গেছে।

বাংলাদেশের শিক্ষানীতির ইতিহাসে দেখা যায়, এক সরকার শিক্ষা কমিশন বা কমিটি গঠন করে, পরবর্তীতে সরকার পরিবর্তন হলে পূর্বের কমিশন বা কমিটির প্রতিবেদন নতুন সরকারের কাছে উপেক্ষিত হয়। কিন্তু ২০১০ সালে যারা শিক্ষানীতি গ্রহণ করে, পরবর্তী সময়ে তারাই দীর্ঘদিন সরকারের সিদ্ধান্তগ্রহণ প্রক্রিয়ায় থাকলেও কোনো এক অদৃশ্য কারণে তারা সেই শিক্ষানীতি বাস্তবায়নে অনীহা দেখায়। কিন্তু, শিক্ষানীতি বাস্তবায়ন না করে ১০ বছর পর কেন সরকার তা সংশোধন করার উদ্যোগ গ্রহণ করেছিলো, সেটিও অজানা।

বাংলাদেশের শিক্ষার পরিপ্রেক্ষিত বিবেচনায় শিক্ষাক্রম তৈরি হওয়ার কথা শিক্ষানীতিকে কেন্দ্র করে। ২০১০ সালে বর্তমান শিক্ষানীতি গৃহীত হওয়ার পর ২০১২ সালে শিক্ষাক্রমে যে পরির্বতন আনা হয়েছিলো, সেটির ভিত্তি ছিলো এই শিক্ষানীতি। কিন্তু, বর্তমান এই নতুন শিক্ষাক্রম তৈরির সময় শিক্ষানীতিকে উপেক্ষা করা হয়েছে। একদিকে নতুন শিক্ষাক্রমের কাজ চলমান, অন্যদিকে শিক্ষামন্ত্রী জানাচ্ছিলেন শিক্ষানীতি সংশোধনের কথা।

তার মানে, নতুন শিক্ষাক্রম তৈরিতে বর্তমান শিক্ষানীতিকে সম্পূর্ণভাবে উপেক্ষা করা হয়েছে, যা হওয়ার কথা নয়। তৎকালীন শিক্ষামন্ত্রীর বক্তব্য অনুসারে যদি শিক্ষানীতি সংশোধিত হতো, এবং তার সাথে শিক্ষাক্রমের সামঞ্জস্য না থাকতো, তাহলে কি আবার নতুন করে শিক্ষাক্রম তৈরি করা হতো? সুতরাং, দেখা যাচ্ছে, শিক্ষাক্রমের যে ভিত্তি থাকা উচিত, অর্থাৎ শিক্ষানীতি, নতুন শিক্ষাক্রমে সেটিকে শুরু থেকেই উপেক্ষা করেছে। সে হিসেবে নতুন শিক্ষাক্রমের আপাতত কোনো ভিত্তি নেই। ওমর শেহাবের বর্ণিত ভুলগুলোর চেয়েও আমার এটিকে বড় ভুল মনে হয়।

ওমর শেহাবের বর্ণিত দুটো বড় ভুলের একটি হচ্ছে, তাঁর ভাষায়, “নতুন শিক্ষাক্রম বাস্তবায়নে জড়িত আমাদের শ্রদ্ধেয় শিক্ষকদের মনে হয়েছে যে আমরা তাদের গাছে তুলে দিয়ে মইটি কেড়ে নিয়েছি”। আমি তাঁর সাথে একমত। নতুন শিক্ষাক্রমের নানা প্রসঙ্গে আমি বিভিন্ন জায়গায় সমালোচনা করেছি যে, এই শিক্ষাক্রম যেসব বিষয় শিক্ষায় আনতে চেয়েছে, সেগুলোর জন্য প্রথমে শিক্ষকদের তৈরি করতে হবে। তাঁদেরকে তৈরি না করে নতুন শিক্ষাক্রম বাস্তবায়ন আত্মঘাতী হবে।

যারা শিক্ষাক্রম বাস্তবায়নের সম্মুখভাবে থাকবেন, তাদেরকে তৈরি না করে নতুন শিক্ষাক্রম বাস্তবায়ন করার দুটো অর্থ। প্রথমত, এতে তাদেরকে বিপদে ফেলে দেওয়া। দ্বিতীয়ত, কোনো কারণে শিক্ষাক্রম ব্যর্থ হলে তাদের ওপর দোষ চাপানোর ক্ষেত্র তৈরি করা। তখন বলা হবে যে, আমরা ‘ভালো ভালো’ বিষয় তৈরি করে দিয়েছিলাম, কিন্তু শিক্ষকরা সেটি বাস্তবায়নে ব্যর্থ হয়েছেন।

শিক্ষকদের কীভাবে এই ধরনের বিপদে ফেলা হয়, তার ভিন্ন একটি উদাহরণও আমি এখানে উল্লেখ করতে চাই, যা থেকে বুঝা যাবে, এই সংস্কৃতি আমাদের নতুন নয়। ২০১৩ সালে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর Reaching Out of School Children (ROSC) প্রকল্প ২-এ Training Resource Person-এর প্রশিক্ষণ গ্রহণের জন্য আমাকে বিবেচিত করা হয়। এই প্রশিক্ষণ যারা গ্রহণ করবেন, তাঁরা মূলত সারা দেশে নতুন রিসোর্স পার্সন তৈরি করবেন এবং শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ দেবেন। প্রশিক্ষণ চলাকালীন আমি অনুধাবন করতে পারি, এই প্রকল্পটি এমনভাবে তৈরি হয়েছে যা রস্ক শিক্ষকরা আদতে বাস্তবায়ন করতে পারবেন না এবং একপর্যায়ে বাস্তবায়ন না করতে পারার দায়ভার তাদের গ্রহণ করতে হবে।

প্রশিক্ষণের দ্বিতীয় বা তৃতীয় দিন বিকেলের সেশনে অধিদপ্তর ও মন্ত্রণালয় থেকে ঊর্ধ্বতন ব্যক্তিরা প্রশিক্ষণ কেমন চলছে দেখতে আসায় আমি সেখানে প্রসঙ্গটি উত্থাপন করি। ঠিক কী কী কারণে আমি তেমনটি ভাবছি, সেটিও প্রশিক্ষণার্থী ও প্রশিক্ষক সবার সামনে উত্থাপন করি। ডায়াসে বসে থাকা অধিদপ্তর ও মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিগণ আমার সাথে সেটি নিয়ে প্রচণ্ড বাহাস করেন এবং তাদের মতো করে কাজ না করলে চলে যেতে বলেন। আমি চলে যেতে চেয়েছিলাম, কিন্তু ব্র্যাক আইইডির প্রশিক্ষকবৃন্দ ও আয়োজকবৃন্দের অনুরোধে পরদিনও প্রশিক্ষণে অংশগ্রহণ করি।

প্রশিক্ষণ সম্পন্ন করার পর আমার কাছে রাজশাহীতে কয়েকটি ওয়ার্কশপে প্রশিক্ষক হিসেবে অংশগ্রহণের সুযোগ আসলেও আমি সেখানে পরে আর অংশগ্রহণ করিনি। সে সময়ের তুলনায় সম্মানী বেশ আকর্ষণীয় ছিলো। কিন্তু, যে প্রশিক্ষণ একপর্যায়ে শিক্ষকদের বিপদে ফেলে দিবে, সেখানে আমি অংশগ্রহণ না করার বিষয়টিতে অটল থাকি। পরবর্তী সময়ে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর আয়োজিত কোনো কর্মকাণ্ডে আমাকে যুক্ত করা হয়নি।

ওমর শেহাব দ্বিতীয় যে ভুলটি উল্লেখ করেছেন, সেটি হচ্ছে, তাঁর ভাষায়, “আমাদের অভিভাবকদের মনে হয়েছে, তাঁদের উৎকণ্ঠার কোনো মূল্য আমাদের কাছে নেই, তাঁদের কথা শোনার কেউ নেই”। আমিও এর সঙ্গে একমত।

২০১৫ সালে বাংলাদেশে ফোরাম ফর এডুকেশনাল ডেভলপমেন্ট (বাফেড) কর্তৃক প্রকাশিত ‘বাংলাদেশ শিক্ষা সাময়িকী’ জার্নালে আমার একটি প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছিলো। সেটির শিরোনাম ছিলো, “শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কমিউনিটির কার্যকর অংশগ্রহণ: একটি পর্যালোচনা”।

এই প্রবন্ধে বাংলাদেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে কমিউনিটির দৃশ্যমান অংশগ্রহণ থাকলেও সেটি আসলেই কার্যকর অংশগ্রহণ নিশ্চিত করে কি না, সে বিষয়ে প্রশ্ন উত্থাপন করেছিলাম। আমার বিশ্লেষণ অনুসারে, নানা নিয়ম ও প্রাতিষ্ঠানিক বাধ্যবাধতকার কারণে কমিউনিটি অংশগ্রহণের একটি আনুষ্ঠানিক প্রক্রিয়া আমাদের বিদ্যালয়গুলোতে সম্পন্ন করা হয় বটে, কিন্তু সিদ্ধান্তগ্রহণ প্রক্রিয়া বা নতুন সিদ্ধান্তে কমিউনিটির মানুষদের কার্যকর অংশগ্রহণের কাজটি প্রকৃতপক্ষে উপেক্ষা করা হয়। ফলে, শিক্ষার নানা প্রসঙ্গে কমিউনিটি একাত্মবোধ করে না। প্রবন্ধে আমি কমিউনিটির কার্যকর অংশগ্রহণ বিষয়ে কয়েকটি সুপারিশ পেশ করেছিলাম।

যেকোনো নতুন উদ্যোগ বাস্তবায়নে স্টেইকহোল্ডারদের সম্পৃক্ত করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। যাদের জন্য কাজটি করা, তারা যদি সেটিকে গ্রহণ না করতে পারেন বা সেটির সঙ্গে একাত্ম না হতে পারেন, তাহলে সেই উদ্যোগ যতোই ভালো হোক না কেন, একসময় না একসময় সেটি ব্যর্থ হতে বাধ্য। নতুন শিক্ষাক্রম তৈরির সময় অন্যতম স্টেইকহোল্ডার শিক্ষার্থীদের পিতামাতা বা অভিভাবকদের সম্পৃক্ত করা হয়নি। এমনকি, নতুন শিক্ষাক্রমে কী কী পরিবর্তন আসতে যাচ্ছে, এই পরিবর্তন কীভাবে তাদের সহায়ক হবে বা এই পরিবর্তনে তাদের ভূমিকা কী ইত্যাদি বিষয়গুলো তাদের কাছে, বলা যায়, পুরোপুরি উপেক্ষা করা হয়েছে।

একদিকে জনমানুষের সম্পৃক্ততার কথা বলা হয় নানা সময়ে, অন্যদিকে উপর থেকে চাপানো নতুন শিক্ষাক্রম যে শিক্ষার্থীদের পিতামাতা বা অভিভাবকদের কাছে যে জোরজবরদস্তি হয়ে যাচ্ছে, সেটিকে উপেক্ষা করা হয়েছে। যারা এই নতুন শিক্ষাক্রম তৈরির সাথে যুক্ত ছিলেন, তাঁরা যে এই বিষয়গুলো সম্পর্কে অবগত নন, তা নয়; কিন্তু তাঁরা অভিভাবক ও পিতামাতাকে উপেক্ষা করে তাঁদের মতো সবকিছু চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেছেন। ওমর শেহাব দ্বিতীয় ভুলটি তুলে এনেছেন তাঁর লেখায়, সেটিও আসলে নতুন কিছু নয়; বরং আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় এটি দীর্ঘদিন ধরে প্রচলিত।

ওমর শেহাবের বর্ণিত দুটো ভুল নিয়ে আলোচনার পর আমি আরেকটি বিষয় নিয়ে আলোচনা করতে যাই, যেটিকে ভুল হিসেবে মনে করা যেতে পারে এবং এটি অনেকটা দ্বিতীয়টির সঙ্গে সম্পর্কিত। বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থায় কোনো নতুন সংযোজনের পর মাঝেমধ্যেই সেটির খসড়া সবার সাথে শেয়ার করা হয় যাতে সরকার এ থেকে জনমানুষের মতামত পেতে পারে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, খসড়া শিক্ষা আইন ২০১৩ ওয়েবসাইটে প্রকাশ করে সরকার মানুষের মতামত আহ্বান করেছিলো।

এটি একটি চমৎকার প্রক্রিয়া। ধারণা করা যেতে পারে, মানুষের মতামত পাওয়ার পর সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ এসব মতামত বিশ্লেষণ করবে এবং প্রয়োজনীয় সংযোজন-বিয়োজন করবে। খসড়া শিক্ষা আইন ২০১৩-এ মতামত নেওয়ার পর সেগুলো নিয়ে কী করা হয়েছে, তা এখনও অজানা।

নতুন জাতীয় শিক্ষাক্রম রূপরেখার খসড়া তৈরির পর এনসিটিবি থেকে আমাকে জানানো হয় যে, এর ওপর তারা আমার মতামত চায় এবং সেজন্য তারা একটি জুম মিটিঙে আমার সাথে কথা বলতে চান।

আমি সম্মতি দেবার পর এনসিটিবি একটি জুম মিটিঙে আমার এবং অন্য দুটো বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষাবিজ্ঞানের দু’জন শিক্ষকের সঙ্গে একত্রে কথা বলেন। এই খসড়া শিক্ষাক্রম রূপরেখা নিয়ে আমি ও অন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকর্মীরা মতামত দেওয়ার পর এসব মতামত কতোটুকু গৃহীত হলো, যা গৃহীত হলো, সেগুলো কেন গৃহীত হলো এবং যা গৃহীত হলো না, তা কেন গৃহীত হলো না, সে সম্পর্কে পরবর্তীতে আমাদের আপডেট করার অনুরোধ করি। কিন্তু, এই নতুন শিক্ষাক্রম রূপরেখা গৃহীত হওয়ার পর বিস্ময়সহকারে লক্ষ্য করি, যে আলোচনা করেছিলাম, সেগুলো সেখানে অ্যাড্রেস করা হয়নি, বরং মূলত আগে যা ছিলো, পরবর্তীতে কমবেশি তা-ই রাখা হয়েছে।

আমি দাবি করছি না যে, আমি যা বলেছি তার সবগুলো সঠিক বা সবগুলো বিবেচনা করতে হবে; কিন্তু আমার যে মতামতগুলো নেয়া হয়েছে সেগুলো নিয়ে আদৌ কোনো কাজ করা হয়েছে কি না সেটি জানার অধিকার রাখি বোধহয়। যিনি এনসিটিবি থেকে আমার সাথে যোগাযোগ করেছিলেন, তাঁকে পরবর্তীতে ফোন দিয়ে আমি যেসব মতামত দিয়েছিলাম, সে সম্পর্কে এনসিটিবি কী ভেবেছে, তা জানানোর জন্য পুনরায় অনুরোধ করি, কিন্তু তা আমাকে কখনোই জানানো হয়নি। আমি ধারণা করি, অনেকক্ষেত্রেই কোনো একটি খসড়ার ওপর মতামত নেয়া হয় শুধুই মতামত নেওয়ার খাতিরে বা অন্তত এই প্রক্রিয়াটিতে তারা যে অন্যদের মতামত নিয়েছেন, শুধু এই কথাটিকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য। কিন্তু বাস্তবক্ষেত্রে অন্যদের মতামতে তাদের কিছু যায় আসে না, কেবল প্রক্রিয়া রক্ষার খাতিরে তারা একটি আনুষ্ঠানিকতার আয়োজন করেন মাত্র।

সর্বশেষ যে ভুলটি নিয়ে আলোচনা করতে চাই তা হচ্ছে, আমার অভিজ্ঞতার পরিপ্রেক্ষিতে মনে হয়েছে, এনসিটিবি বা এরকম প্রতিষ্ঠানগুলো যখন কোনো কাজের আয়োজন করে, তখন তারা উক্ত কার্যক্রমে তাঁদেরকে অন্তর্ভুক্ত করেন না যারা কার্যক্রম চলাকালে নানা সিদ্ধান্তকে প্রশ্ন করেন। নতুন শিক্ষাক্রম প্রণয়নে এরকম নানা কথা কানে এসেছে। ২০২১ সালে প্রথম আলোয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ড. এস এম হাফিজুর রহমান সরাসরিই বলেছেন, “এই শিক্ষাক্রম নিয়ে খুব কম আলোচনা হয়েছে। যাঁরা কথা বলেছেন, যুক্তি তুলে ধরেছেন, তাঁদের কাউকে কাউকে দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে।”

শিক্ষা-প্রসঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে প্রথম আলো আবুল মোমেনকে জিজ্ঞাসা করেছিলো, “২০১০ সালের শিক্ষানীতি নিয়ে এত কথা হলো, কোনো পরিবর্তন এসেছে কি?” আবুল মোমেন বলেছিলেন, “আসেনি। তারও কারণ নীতিনির্ধারকেরা চাননি। তাঁরা তাঁদেরই ডেকেছেন, পরামর্শ নিয়েছেন, যাঁরা সরকারের চাওয়াকে গুরুত্ব দেন।”

সুতরাং দেখা যাচ্ছে, এই প্রক্রিয়াটিও আসলে নতুন কিছু নয়। আমি এখানে এনসিটিবিরই আরেকটি উদাহরণ দিতে চাই।

২০১৩ সালে এনসিটিবি National Students Assessment Tools তৈরির জন্য তিন সিরিজের একটি ওয়ার্কশপের আয়োজন করে। এনসিটিবির পক্ষ থেকে যিনি আমার সাথে যোগাযোগ করেন, তিনি জানান ওয়ার্কশপের প্রথম পর্যায়ে অন্য একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষাবিজ্ঞানের একজন শিক্ষক এক্সপার্ট হিসেবে থাকবেন, দ্বিতীয় পর্যায়ে আমি থাকবো, এবং তৃতীয় পর্যায়ে আমরা দুজনেই অংশগ্রহণ করবে। নির্ধারিত ওয়ার্কশপে আমি অংশগ্রহণ করি এবং একাধিক দিন কাজ করে আমাদের গ্রুপ নির্দিষ্ট আউটপুট শেষদিন বিকেলে সবার সামনে উত্থাপন করি।

শেষদিনে সর্বশেষ সেশনে সচিবালয় থেকে একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা উপস্থিত হন এবং গ্রুপের পক্ষ থেকে আমাদের কাজের ওপর আমি প্রেজেন্টেশন দিই। প্রেজেন্টেশন শোনার পর তিনি সরোষে যা বলেন তা মোটামুটি এরকম: “আপনাদের কাজ কিছু্ই হয়নি। এটা ফেলে দেন আপনারা। আপনারা সারা বছর স্কুলে না গিয়ে টেবিলে বসে একটা কিছু বানিয়ে ফেললেই হলো? কিছুই হয়নি আপনাদের একটা। একটা বাতিল জিনিস বানিয়েছেন আপনারা”।

তাঁর বক্তব্য শুনে সবাই স্তম্ভিত; কিন্তু আমি তাঁকে চ্যালেঞ্জ করি। প্রথমত, তাঁকে প্রথমেই দুঃখপ্রকাশ করতে হবে এভাবে বলার জন্য। তিনি ওয়ার্কশপে না থেকে, কী আলোচনা হয়েছে, কীসের ওপর ভিত্তি করে এটি তৈরি করা হয়েছে সেসব কোনো কিছু না জেনে এটা বলতে পারেন না, এর মাধ্যমে তিনি আমাদের সবাইকে অপমানিত করেছেন। দ্বিতীয়ত, যেহেতু কিছুই হয়নি, তাঁকে সুনির্দিষ্টভাবে বলতে হবে কোথায় কী হয়নি, এবং তাঁকে সাজেস্ট করতে হবে সেখানে কী হলে ভালো হতো। তৃতীয়ত, এই গ্রুপে যারা কাজ করেছেন, তাদের মধ্যে তিন জন সরাসরি বিদ্যালয়ের শিক্ষক। সুতরাং, তাঁরা নিয়মিত বিদ্যালয়ে যান। বাকি দুজনের সম্পর্কে আমি ওয়াকিবহাল ছিলাম যে তাঁরা কেন প্রতিনিয়তই বিদ্যালয়ে যান। যেমন, একজন ছিলেন পিটিআইয়ের প্রশিক্ষক। আমি সেই ব্যাখ্যাও দিলাম।

বাকি থাকি আমি। আমি গত এক বছরে আমার গবেষণার তথ্য সংগ্রহের জন্য এবং অন্যান্য কারণে আনুমানিক কতোদিন বিভিন্ন বিদ্যালয়ে সময় কাটিয়েছি সেটি বলি। বলার পর আমি তাঁকে জিজ্ঞাসা করি, আমি জানতে চাই আপনি গত এক বছরে কতোদিন বিদ্যালয়ে গিয়েছেন এবং সেখানে শিক্ষাসংশ্লিষ্ট কী কার্যক্রমের অংশগ্রহণ করেছেন যাতে আপনি আমাদের এভাবে বলতে পারেন। আমি এও বলি, তিনি যদি আমার বক্তব্যের সুস্পষ্ট জবাব না দিতে পারেন, তাহলে তাকে সবার সামনে দুঃখপ্রকাশ করতে হবে।

তিনি কোনো উত্তর দেননি। কিন্তু, যেটি ঘটলো, তৃতীয় ও সর্বশেষ ওয়ার্কশপে আমাদের দুজনের থাকার কথা থাকলেও আমাকে শেষ পর্যন্ত আমন্ত্রণ জানানো হয়নি। যদিও পরে জেনেছিলাম যে, ওইদিন আমরা যেটি উপস্থাপন করেছিলাম, সেটিই শেষ পর্যন্ত রাখা হয়েছে। শুধু তা-ই নয়, এরপর থেকে এনসিটিবি তাদের কোনো কর্মকাণ্ডে আমাকে সরাসরি অংশগ্রহণের জন্য যোগ্য বলে বিবেচনা করেনি।

সুতরাং, দেখা যাচ্ছে, শিক্ষার গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে কাজ করার সময় এনসিটিবি তাদেরকে উপেক্ষা করতে পছন্দ করে, যাদের সমালোচনা নিয়ে তারা স্বচ্ছন্দ নয়। নতুন শিক্ষাক্রম তৈরির সময়, ধারণা করি, এমন অনেক ঘটনা ঘটতে পারে, কারণ এমন ঘটনা আসলে আমাদের পরিপ্রেক্ষিতে নতুন কিছু নয়।

নতুন শিক্ষাক্রমে আরও কিছু ভুল নিয়ে প্রকাশ্যেই আলোচনা হওয়া দরকার। এক. আগের শিক্ষাক্রমে কী ভুল ছিলো, সেটি নিয়ে গবেষণা করা দরকার এবং সেই গবেষণার আলোকেই পরবর্তী পদক্ষেপ গ্রহণ করা দরকার। কিন্তু, যদিও অনেক জায়গায় বলা হয়েছে যে, এ বিষয়ে নাকি গবেষণা হয়েছে, কিন্তু কী গবেষণা হয়েছে, কী পাওয়া গেছে, সেগুলো জানা যায় না। গবেষণার ফলাফল তো প্রকাশের বিষয়, প্রকাশ না করে গবেষণার রেফারেন্স দেওয়াটা সঠিক কি না, সেটাও আলোচনা হতে পারে। দুই. শিক্ষাক্রম হতে হবে একেবারে শিশু শ্রেণি থেকে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত, একত্রে, যাতে প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত সমন্বয় থাকে; কিন্তু দুই মন্ত্রণালয়ের কারণ এনসিটিবি হিমশিম খায়। শিক্ষার যেকোনো সিদ্ধান্ত দুই মন্ত্রণালয়ের যৌথ প্রয়াসে হওয়া উচিত, সেই আলোচনাটাও বেশি বেশি জরুরি।

ওমর শেহাব দুটো ভুল নিয়ে লিখেছেন। আমি মনে করি, নতুন শিক্ষাক্রম তৈরির সময় এ ধরনের ভুলগুলো এই শিক্ষাক্রম তৈরির প্রক্রিয়াকেই প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। পাঠ্যপুস্তক তৈরি প্রক্রিয়া থেকে শিক্ষার নানা বিষয় নিয়ে যে প্রক্রিয়ায় এই প্রতিষ্ঠানটি কাজ করে, সেখানে মনে হয় সংশোধন আনার বিষয়টি ভাবা যেতে পারে। পছন্দসই সিদ্ধান্ত পূর্বেই নিয়ে সে মোতাবেক পছন্দসই মানুষকে নিয়ে কাজ করার সংস্কৃতি থেকে বের হয়ে আসা যেমন দরকার, তেমনই সুস্পষ্ট প্রক্রিয়া নির্ধারণ করে আনুষ্ঠানিক ও প্রয়োজনীয় সমস্ত ধাপ স্বচ্ছতার সঙ্গে সম্পন্ন করার বিষয়টি প্রতিষ্ঠা করা দরকার।

ডিসক্লেইমার: ১. নিজস্ব অভিজ্ঞতার আলোকে এটি একটি ব্যক্তিগত উপলব্ধি বা প্রতিক্রিয়া। ফলে, এখানে কারোর নাম উল্লেখ করা অপ্রয়োজনীয়। ২. আমার উপরে বর্ণিত অভিজ্ঞতা মূলত জাতীয় শিক্ষাক্রম রূপরেখা নিয়ে। যেহেতু মূল বিষয়টিকে সবাই ‘নতুন শিক্ষাক্রম’ হিসেবে আলোচনা করছে এবং এটিই এখন প্রতিষ্ঠিত, তাই আমিও এই লেখায় নতুন শিক্ষাক্রম শব্দটি ব্যবহার করেছি।

ধন্যবাদ: খসড়া লেখাটি পড়ে মূল্যবান মতামত দেওয়ায় নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক জি এম রাকিবুল ইসলামের প্রতি কৃতজ্ঞতা।

জনপ্রিয় নিবন্ধ

প্রাথমিক স্তরে ভাষা শেখা : বিষয় – বাংলা

ভাষার দক্ষতা চারটি— শোনা, বলা, পড়া, লেখা। আর ভাষা...

আগে ইংরেজি গ্রামার শিখবো, নাকি ভাষা শিখবো?

কোন ভাষার গ্রামার হলো ঐ ভাষার গঠন প্রকৃতি যার...

শিক্ষাব্যবস্থার হালচাল

অর্থনীতিবিদদের মতে, শিক্ষা খাতে বিনিয়োগ সবচেয়ে লাভজনক এবং নিরাপদ রাষ্ট্রীয় বিনিয়োগ। অর্থনীতিবিদ এডাম স্মিথ, ডেভিড রিকার্ডো এবং মার্শালের মতে, শিক্ষা এমন একটি খাত যার কাজ হলো দক্ষ জনশক্তি গড়ে তুলে পুঁজির সঞ্চালন ঘটানো। শিক্ষার অর্থনীতি নিয়ে মৌলিক গবেষণায় অর্থনীতিবদ আর্থার শুল্জ ও রবার্ট সলো দেখিয়েছেন যে, প্রাথমিক শিক্ষায় বিনিয়োগ করলে সম্পদের সুফল ফেরত আসে ৩৫ শতাংশ, মাধ্যমিক শিক্ষায় ২০ শতাংশ, এবং উচ্চ শিক্ষায় ১১ শতাংশ।

আমেরিকায় উচ্চশিক্ষা : পিএইচডির পর কী?

আমেরিকায় উচ্চশিক্ষা নিয়ে প্রচুর লেখালেখি হয়, আমি নিজেও এ-নিয়ে...

ক্যাডেট কলেজে ভর্তি পরীক্ষা নিয়ে কিছু কথা

ক্যাডেটসমূহ বাংলাদেশের শিক্ষাঙ্গনে এক গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে আছে।...

আরও কিছু লেখা

অধিক

    শিক্ষায় বিনিয়োগ: এক এবং একমাত্র ভাবনা

    মিরন কুমার ভৌমিক, আকলিমা শরমিন, আসমা জাহান মুক্তা, তৌফিক...

    মাননীয় শিক্ষামন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ: কেমন হতো যদি এমন শিক্ষাব্যবস্থা হতো?

    শহিদ শাকিল লিখেছেন শিক্ষামন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করে বাংলাদেশের বর্তমান শিক্ষামন্ত্রীর...

    বাংলাদেশের প্রান্তিক নারীদের শিক্ষা : সমস্যা ও উত্তরণের উপায়

    বাংলাদেশের শিক্ষায় পুরুষদের তুলনায় নারীরা নানা দিক দিয়ে পিছিয়ে...

    যত দোষ সান্ধ্য কোর্স? : পর্ব ১

    ড. শিশির ভট্টাচার্য্য লিখেছেন সান্ধ্য কোর্স নিয়ে সম্প্রতি বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি...

    শিক্ষক প্রশিক্ষণ এবং শিক্ষার গাণিতিক উন্নয়ন

    আজকাল বাংলাদেশে প্রশিক্ষণের ধুম পড়েছে। প্রশিক্ষণ প্রদানকারী নানা উন্নয়ন...

    নোংরা প্রতিযোগিতা ও শিক্ষা : বিপ্লব আবশ্যক

    এইচ এম শরীফুল ইসলাম তানজিল লিখেছেন শিক্ষায় নোংরা প্রতিযোগিতা...

    শিক্ষা নিয়ে আতঙ্কের বছরে জেএসসি ও জেডিসির ফল

    হরতালের মধ্যে বিগত পরীক্ষার ফলাফলে নেতিবাচক প্রভাব পড়ায় আমরা বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে এবার তা উত্তরণের পদক্ষেপ নিয়েছি। কিন্তু সেটি কী? সেটি কি বেশি নম্বর দিয়ে দেওয়া? না অন্য কিছু?

    সংবাদপত্রের শিক্ষাপাতা কতোটুকু প্রয়োজনীয়?

    জায়েদ ইবনে আবুল ফজল লিখেছেন সংবাদপত্রের শিক্ষাপাতার প্রয়োজনীয়তা নিয়ে বাংলাদেশে...

    প্রাসঙ্গিক নিবন্ধসমূহ

    নতুন লেখার খবর পান ইমেইলে
    বাংলাদেশের শিক্ষা প্রসঙ্গে নতুন লেখা প্রকাশিত হলে সেই খবর পৌঁছে যাবে আপনার ইমেইলে।