বাংলাদেশের উচ্চশিক্ষা নিয়ে কথা হচ্ছে বেশ। সাথে যোগ হয়েছে বিসিএস । এর উন্নতির বিষফোঁড়া নিয়ে একটি বিশেষ দিক তুলে ধরতে চাই। আলোচনা উদ্ভট বা নেতিবাচক শোনালেও আমার উদ্দেশ্য প্রবলভাবে ইতিবাচক।
প্রথমে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে বলি; কারণ ওখানে বহুকাল ছিলাম। চার বছরের স্নাতক ডিগ্রি নিতে লেগেছে ছয় বছর।
স্নাতকোত্তরের জন্যে লেগেছে একের বদলে প্রায় দুবছর। জীবনের স্বর্ণসময় থেকে হারিয়ে যাওয়া তিনটে মহামূল্যবান বছর আমাকে কেউ ফিরিয়ে দেবে না।
ফলস্বরূপ, আমি কর্মজীবনে পিছিয়ে পড়েছি তিন বছরের কিছু বেশি সময়। আরও অনেক কিছুতেই পড়েছি, তবে সেসব বলে প্রসঙ্গ বদলাতে চাই না।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হালচাল আমার বেশ জানা। এখানে বহু শিক্ষার্থী বহু বিষয় নিয়ে পড়াশোনা করে। বিষয়গুলো তাদের পছন্দ অনুসারেই বাছাই করে, বিশেষ করে ভর্তি পরীক্ষার মেধাতালিকায় যারা প্রথম দিকে থাকে।
নিজেদের বিষয়ের গভীরে ঢোকার কোনোই দরকার নেই তাদের। কারণ তারা মূলত বিসিএস পরীক্ষার জন্যে নিজেদের তৈরি করে, অবশ্য সবাই নয়।
বিষয় আলাদা হলে কী হবে, এক জায়গাতে সবাই এক। এখন বিশ্ববিদ্যালয়ের বেশিরভাগ ছেলেমেয়ে তাদের নিজ নিজ বিষয় নিয়ে পড়লেও মূলত তারা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক এবং স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভের জন্যেই পড়ে।
নিজেদের বিষয়ের গভীরে ঢোকার কোনোই দরকার নেই তাদের। কারণ তারা মূলত বিসিএস পরীক্ষার জন্যে নিজেদের তৈরি করে, অবশ্য সবাই নয়।
আমরা সবাই জানি, বিসিএস শিক্ষা ক্যাডার অথবা অন্য দুএকটি বিশেষ ক্যাডার ছাড়া বিষয়ভিত্তিক জ্ঞান বিশেষ কোনো কাজে লাগে না।
কাজে লাগে সাধারণ জ্ঞান। সেটিকে প্রকৃত অর্থে উচ্চপর্যায়ের জ্ঞান বলতে আমার বিশেষ আপত্তি আছে। আর কাজে লাগে মুখস্থবিদ্যা।
তাই বলে আমি মেধাবী বিসিএস ক্যাডারদেরকে খাটো করছি না কিন্তু কোনোভাবেই। বরং তাদের জন্যে আমার মায়া হয় কারণ, অনেককেই তুখোর মেধাবী আর সৃজনশীল হওয়া সত্ত্বেও প্রচুর সময় নষ্ট করে সাধারণ জ্ঞান মুখস্থ করতে হয়।
বেশি কষ্ট হয় ডাক্তারদের জন্যে। এমনিতেই তাদের চল্লিশের আগে ভালো ক্যারিয়ার তৈরি হয় না, তার ওপর বিসিএস-এর জন্যে তিন-চার বছর নষ্ট করতে হয় অ-ডাক্তারি এবং মূলত বেদরকারি পড়াশোনা করে।
কথা হচ্ছে, লক্ষ্যই যদি থাকে বিসিএস, তাহলে কেন কোনো একটি বিশেষ বিষয় নিয়ে পড়া আর মেধা ও সময় দুটোরই অপচয় করা?
দর্শন বা মনোবিজ্ঞানের মতো উঁচুমানের বিষয় পড়ে কেউ যদি তা বোঝারই চেষ্টা না করে কেবল ক্যাডার হতে চান, তাহলে বিশ্ববিদ্যালয়ে ওই বিষয় থাকারই কী দরকার?
ফার্মেসিতে উৎকৃষ্ট ফলাফল করে এই শিল্পে কাজের ক্ষেত্র তৈরি না করে, কেন তাহলে একজন পুলিশ বা প্রশাসনে চাকরি করার চিন্তা করছেন? এমনকি ডাক্তারও আজকাল ডাক্তারি না করে প্রশাসক হচ্ছেন।
দর্শন বা মনোবিজ্ঞানের মতো উঁচুমানের বিষয় পড়ে কেউ যদি তা বোঝারই চেষ্টা না করে কেবল ক্যাডার হতে চান, তাহলে বিশ্ববিদ্যালয়ে ওই বিষয় থাকারই কী দরকার?
থাকলেও থাকতে পারে শুধুই তাদের জন্যে, যারা এসব বিষয়ে পাণ্ডিত্য অর্জন করতে চান এবং কর্মজীবনে শিক্ষক বা গবেষক হতে চান।
আমি জানি, বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক ছেলেমেয়ে প্রথম বছর থেকেই বিসিএস-এর পড়া শুরু করে। আর তাদের মূল পাঠের বিষয়টি কোনোরকমে চালিয়ে যায়, যাতে পাশটা জোটে ভালোভাবে।
তারা খুব ভালো করে জানে, স্নাতক বা স্নাতকোত্তর পর্যায়ে যা যা পড়ছে, সেগুলো বিশেষ কোনো কাজেই লাগবে না। কাজে লাগে মূলত বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে হাঁটাচলা করে যে জ্ঞান ও জীবনদক্ষতা অর্জিত হয়।
আমার পরিচিত এক মেয়ে মাত্র দ্বিতীয় বর্ষে পড়ে একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে। কদিন আগে আমাকে জিজ্ঞেস করছে, সে বিসিএস-এর কোচিং শুরু করবে কিনা।
শুনেই মাথাটা গরম হয়ে গেল এবং দিলাম একটু বকা। পরে মনে হলো, যুগের হাওয়ার বিপরীতে গিয়ে সেই বা টিকে থাকবে কী করে? পরে আবার বলে দিলাম, তার ইচ্ছে হলে করতেও পারে।
শুধু বললাম, তার বিষয়টি যেন ভালো করে বুঝে পড়ে, তাতে বিসিএস-এর পাশাপাশি তার বিষয় নিয়ে কাজ করা বা শিক্ষাবৃত্তি নিয়ে বিদেশে গিয়ে আরও উন্নতমানের শিক্ষাগ্রহণ করতে পারে।
শিক্ষা নিয়ে পড়াশোনা করে যদি কেউ শিক্ষা নিয়ে কাজ না করে ব্যাংকের চাকরি করে বা বিসিএস দিয়ে ভিন্নতর কোনো কাজ করে, তাহলে তার শিক্ষাটা বড় অশিক্ষায় পরিণত হয়।
অবাক করা বিষয়, তার শিক্ষকও অনেক সময় গর্ব করে বলেন, “আমার অমুক ছাত্র/ছাত্রী প্রশাসনে/পুলিশে চাকরি করে”।
রসায়ন বা পদার্থবিজ্ঞানের কোনো শিক্ষার্থী যখন পুলিশ বা ওরকম কিছু হয়, তখন দেশ এবং পৃথিবী একজন সম্ভাবনাময় বিজ্ঞানীকে হারায়।
তাদের কাছেও যুক্তি আছে। বলে, দেশে বিষয়ভিত্তিক সেরকম চাকরি নেই আর থাকলেও সেখানে ক্ষমতা নেই। আমি বলি, তাহলে তো ওই বিষয়টি পড়ারই দরকার ছিল না।
আর দেশে কাজ করার সুযোগ নেই বলে কি পৃথিবীর আর কোথাও নেই? বিশ্ববিদ্যালয় কি আমাদের একটু বড় করে দেখবার দৃষ্টি তৈরি করে দেয় না?
বিদেশে গিয়েও তো দেশের শত শত মানুষ দেশের মুখ উজ্জ্বল করছে। মোটা অংকের ডলারও পাঠাচ্ছে দেশে। অথবা যদি কেউ দেশের কোনো খোঁজ নাও রাখে আর যেখানেই থাকুক, তার পরিচয় সে বাংলাদেশের মানুষ। বিশ্বায়নের যুগে এটুকু উদার চিন্তা করা যেতেই পারে।
আমার মাথায় উদ্ভট এক আইডিয়া ঘুরপাক খাচ্ছে অনেকদিন ধরে । তা হলো, দেশে একটি নতুন ধরণের বিশ্ববিদ্যালয় চালু হওয়া। নাম হতে পারে বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিস বিশ্ববিদ্যালয়।
আমার মাথায় উদ্ভট এক আইডিয়া ঘুরপাক খাচ্ছে অনেকদিন ধরে । তা হলো, দেশে একটি নতুন ধরণের বিশ্ববিদ্যালয় চালু হওয়া। নাম হতে পারে বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিস বিশ্ববিদ্যালয়।
ঢাকাতে মূল ক্যাম্পাস এবং কমপক্ষে প্রতিটি বিভাগীয় শহরে একটি করে ক্যাম্পাস থাকবে।
বিসিএস প্রিলিমিনারি পরীক্ষাকে এ-বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষা হিসেবে বিবেচনা করা হবে। উচ্চ মাধ্যমিক পাশের পর এই পরীক্ষায় বসার যোগ্যতা অর্জিত হবে।
প্রথম দুই বছর তারা সাধারণ জ্ঞান অর্জন করবে আমাদের বিএ/বিএসসি/বিকম পাশ কোর্সের সিলেবাসের আদলে।
সাথে নিজ নিজ পছন্দ অনুসারে সঙ্গীত, আবৃত্তি, বিতর্ক, সমাজসেবা, বিজ্ঞান ক্লাবসহ এরকম নানা রকমের সৃজনশীল কাজের কোনো একটির সাথে সম্পৃক্ত থাকবে।
আর সত্যিকারের “সিভিল সার্ভেন্ট” হয়ে ওঠার জন্যে সুন্দর করে কথা বলা থেকে শুরু করে, টেবিল ম্যানার্স, আচার-আচরণ, দৃষ্টিভঙ্গি, মুক্তচিন্তা এসব বিষয়ে হাতেকলমে শেখানো হবে।
তৃতীয় বর্ষে গিয়ে নতুন করে একটি পরীক্ষা নিয়ে ক্যাডার ভাগ করা হবে। পরের দুবছর তাদের নির্ধারিত ক্যাডারের সাথে সংশ্লিষ্ট বিষয় পড়ানো হবে।
শুধু পড়ানো নয়, নির্দিষ্ট কর্মক্ষেত্রের বাস্তব জ্ঞানও তাদের দেওয়া হবে। চার বছর পড়ার পর তারা চূড়ান্ত পরীক্ষায় অংশ নেবে।
প্রথমে লিখিত পরীক্ষা, পরে মৌখিক। এই ডিগ্রির নাম হতে পারে বিসিএস (অনার্স)। পাশ করলেই আসন থাকা সাপেক্ষে সরাসরি ক্যাডার হিসেবে নিয়োগ দিতে হবে।
চাকরিতে যোগদানের কিছুদিন পর যারা স্ব স্ব ক্যাডারে আরও পাণ্ডিত্য অর্জন করতে চায়, তারা দেশে বা বিদেশে নিজের ক্যাডারের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ বিষয়ে মাস্টার্স ডিগ্রি ও পিএইচডি অর্জন করার সুযোগ পেতে পারে।
তবে যারা শিক্ষক, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, বিজ্ঞানী বা এরকম কোনো বিশেষায়িত পেশায় আসতে চান, এ বিশ্ববিদ্যালয় তাদের জন্যে হবে না।
এ-ব্যবস্থার সবচেয়ে বড় সুবিধে হবে, প্রত্যেকেই তার নিজের ক্যাডার সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা নিয়ে কাজ শুরু করবেন।
আইনের “আ”ও না বুঝে কেউ আর তখন পুলিশ বা প্রশাসক হতে পারবেন না। আর সরকারের কোটি কোটি টাকা খরচ করে তাদের আর নতুন করে শেখাতে হবে না।
সবচেয়ে বড় অসুবিধে যেটা হবে, দেশের নাম করা বিশ্ববিদ্যালয়ে তখন আর পড়ার জন্যে বিশেষ কাউকে পাওয়া যাবে না, বিশেষ করে স্নাতক পর্যায়ে।
তাতে কী? বিশ্ববিদ্যালয় মনোনিবেশ করবে উচ্চতর জ্ঞানের চর্চার দিকে। স্নাতকোত্তর, এমফিল, পিএইচডি এসব গবেষণাধর্মী ডিগ্রি প্রদান করবে।
শিক্ষকগণও নিজেরা বড় বড় গবেষক হবেন এবং আন্তর্জাতিক নামকরা জার্নালে তাঁদের গবেষণা প্রকাশ পাবে। শিক্ষকগণ কোনোভাবেই লাল-নীল-বেগুনী জার্সি পরে রাজনীতিতে নাম লেখাবেন না।
তাঁদের বেতন হতে হবে সাধারণ সরকারি কর্মকর্তার চেয়ে কয়েকগুণ বেশি। নইলে বিদেশ তাদের টেনে নিয়ে যাবে আর না হয় টানবে বিসিএস বা দেশের প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় বা কোনো ব্যবসা প্রতিষ্ঠান।
আশা করছি, আমার প্রস্তাবটি হাসির খোড়াক না হয়ে বিজ্ঞজনের সুনজরে আসবে এবং তাদের সিদ্ধান্তগ্রহণে সহায়ক ভূমিকা পালন করবে।
একজন খেটেখাওয়া মানুষ হিসেবে এটি একান্তই আমার ব্যক্তিগত অভিমত। এর সাথে আমার কাজের প্রতিষ্ঠানের কোনো দিক থেকেই কোনো সম্পর্ক নেই।
লেখক পরিচিতি
সুদেব কুমার বিশ্বাস বাংলাদেশে একটি আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানে শিক্ষাবিষয়ক কর্মকর্তা হিসেবে কর্মরত রয়েছেন। তিনি বাংলাদেশের শিক্ষার নানা বিষয় নিয়ে নিয়মিত লেখালেখি করছেন।