মোরশেদ হাসান লিখেছেন ক্রিয়াপদের অন্তে ও-কারের ব্যবহার নিয়ে
– লিমন ভাই, ক্রিয়াপদে ও-কার কোথায় দেব আর কোথায় দেব না, বলো তো? এ কী বিচ্ছিরি সমস্যা, বাবা।
: হা হা হা।
– হাসছ কেন?
: বারে হাসতেও পারব না?
– পারবে না কেন? কিন্তু হাসছ কেন, তা তো বলবে?
: হাসছি, কারণ তুই অকারণে ও-কার না দিয়েই তো সুন্দরভাবে এবং নিয়মমাফিক কথা বলছিস এতক্ষণ।
– মানে?
: মানে আবার কী! তুই এতক্ষণ ধরে যে কথাগুলো বললি সেখানে তো ও-কার দিসনি। যেমন, তুই বললি, ‘দেব’, ‘হাসছ’। ও-কার দিসনি তো ক্রিয়াপদে। তুই তো বলিসনি, ‘দেবো’, ‘হাসছো’। এটাই তো ভাষার স্মার্ট ও ইকনোমিক বহিঃপ্রকাশ।
এর মধ্য ক্রিয়াপদের অতীত ও ভবিষ্যৎ রূপে শেষ বর্ণে ও-কার বর্জনীয়। ‘বললো’-‘বলতো’-‘বলবো’ নয়, লিখতে হবে ‘বলল’-‘বলত’-‘বলব’।
– কোনটা ঠিক, সেটা ঠিকঠাক বলো?
: ‘দেব’, ‘হাসছ’ ঠিক। ক্রিয়াপদের অন্তে অযথা ও-কার যোগ করে শব্দকে মেদবহুল করা এখনকার নিয়মে বর্জনীয়, নীলা।
– আচ্ছা কোনো নিয়ম থাকলে আমাকে বলো, লিমন ভাই?
: বলছি। এজন্য আগে ক্রিয়ার কাল, যাকে তোরা ইংরেজিতে ‘Tense’ বলিস, আর পুরুষ, ইংরেজিতে বলে ‘Person’ সে সম্পর্কেও সুস্পষ্ট ধারণা থাকতে হবে।
– সে তো আছে বাপু। ‘Tense’ আর ‘Person’ জানে না, এমন কেউ আছে নাকি এখন!
: বেশ। তবে এবার আয়। ক্রিয়ার কাল কয়টি বল?
– বর্তমান কাল, অতীত কাল ও ভবিষ্যৎ কাল।
: গুড। এর মধ্য ক্রিয়াপদের অতীত ও ভবিষ্যৎ রূপে শেষ বর্ণে ও-কার বর্জনীয়। ‘বললো’-‘বলতো’-‘বলবো’ নয়, লিখতে হবে ‘বলল’-‘বলত’-‘বলব’।
– বুঝিয়ে বলো, লিমন ভাই।
: যেমন, আমি বলব (বলবো নয়), সে বলল (বললো নয়), সে বলত (বলতো নয়)। ক্লিয়ার, নীলা।
– আমি যাব অথবা যাবো, তুমি খাচ্ছ অথবা খাচ্ছো, তুমি খেয়েছ অথবা খেয়েছো— কী হবে?
: বস্তা বেঁধে সব ও-কার পানিতে ফেলে দাও।
– নিয়ম কী?
: নিয়ম হল, ঘটমান বর্তমান (Present continuous) ও পুরাঘটিত বর্তমান (Present perfect) রূপে শেষ বর্ণে ও-কার বর্জনীয়। ‘করছো’-‘বলছো’-‘খাচ্ছো’-‘যাচ্ছো’ নয়, লিখতে হবে ‘করছ’, ‘বলছ’, ‘খাচ্ছ’, ‘যাচ্ছ’। ‘করেছো’-‘বলেছো’-‘খেয়েছো’-‘গিয়েছো’ নয়, লিখতে হবে ‘করেছ’-‘বলেছ’-‘খেয়েছ’-‘গিয়েছ’।
– আচ্ছা ও-কার কোথায় দেব তা হলে?
: দ্যাখ, ক্রিয়াপদের সঙ্গে ও-কার দেব, বা দেব না এই দ্বিধায় বুক কাঁপে না এমন বীরপুরুষ খুব কমই আছে। তবে নিয়মমাফিক কথা বললে ক্রিয়াপদে ও-কার দেব আমরা শুধু সাধারণ বর্তমান কাল, বর্তমান অনুজ্ঞা ও ভবিষ্যৎ অনুজ্ঞাতে মধ্যম পুরুষ কর্তা হলে।
– লিমন ভাই, একটু ভয় করছে তোমাকে জিজ্ঞেস করতে। বর্তমান অনুজ্ঞা ও ভবিষ্যৎ অনুজ্ঞা কাকে বলে, বলো না?
: নীলা, এই যে তুই বললি, “বলো না”— এই যে অনুরোধ বা মিনতি করে বললি, “বলো না”—এটাকেই বলে অনুজ্ঞা। এজন্যই তুই ও-কার যোগ করে ‘বলো’ বলেছিস। তুই বলিসনি, ‘বল’।
– বর্তমান অনুজ্ঞা ও ভবিষ্যৎ অনুজ্ঞার সংজ্ঞা ও উদাহরণসহ বলো, লিমন ভাই।
: বেশ, বলছি।
বর্তমান অনুজ্ঞা: বর্তমান কালের আদেশ, অনুরোধ, উপদেশ প্রভৃতি বোঝাতে যে ক্রিয়ার রূপ ব্যবহৃত হয় তাকে বর্তমান অনুজ্ঞা বলে। যেমন: এখনই এ কাজটি করো। এখন তুমি যাও।
ভবিষ্যৎ অনুজ্ঞা: ভবিষ্যৎ কালের আদেশ, অনুরোধ, উপদেশ, আশীর্বাদ, প্রার্থনা প্রভৃতি বোঝাতে যে ক্রিয়ার রূপ ব্যবহৃত হয় তাকে ভবিষ্যৎ অনুজ্ঞা বলে। যেমন: কাল সকালে একবার এসো। বিকালের ট্রেন ধরে যেয়ো।
ভবিষ্যৎ অনুজ্ঞায় (কর্তা তুমি হলে) ক্রিয়াপদে ‘-য়ো’ বসে। যেমন: যেয়ো, খেয়ো, চেয়ো, দিয়ো। বর্তমান অনুজ্ঞার ক্ষেত্রে (কর্তা তুমি হলে) ক্রিয়াপদে ‘-ও’ বসে। যেমন: যাও, খাও, চাও, দাও।
বাক্যে উদাহরণ: চিঠি দাও (বর্তমান অনুজ্ঞা)। চিঠি দিয়ো (ভবিষ্যৎ অনুজ্ঞা)।
– লিমন ভাই, ভবিষ্যৎ অনুজ্ঞার ক্রিয়াপদে সংযুক্ত ও-কার বুঝলাম। কিন্তু বর্তমান অনুজ্ঞাতে যাও, খাও, চাও, দাও– তে তো ও-কার নেই।
: আহা, কথা তো একই। ‘ও’ হল স্বরবর্ণ। আর স্বরবর্ণ সংক্ষিপ্ত আকারে ব্যঞ্জনবর্ণের সঙ্গে যুক্ত হলে তাকে বলে ‘কার’। যেমন, আ স্বরবর্ণের কার চিহ্ন আ-কার; তেমনি ও স্বরবর্ণের কার চিহ্ন ও-কার।
– আচ্ছা বুঝলাম। তবে বর্তমান অনুজ্ঞাতে, তুমি করো, তুমি পড়ো— একে ভবিষ্যৎ অনুজ্ঞাতে কীভাবে বলব?
: ভবিষ্যৎ অনুজ্ঞাতে বলবি— তুমি কোরো, তুমি পোড়ো। এভাবে বর্তমান অনুজ্ঞাতে— ‘বসো’, ‘আসো’, ‘ভাবো’, ‘দ্যাখো’ হলে ভবিষ্যৎ অনুজ্ঞাতে হবে ‘বোসো’, ‘এসো’, ‘ভেবো’, ‘দেখো’।
– আচ্ছা বুঝলাম, লিমন ভাই। এখানেই শেষ তা হলে।
: না, আর একটু আছে।
– আচ্ছা শুনি।
: আ-কারান্ত প্রযোজক (ণিজন্ত) ধাতুর পরে ‘আন’ প্রত্যয় যুক্ত হলে ‘আনো’ হয়। যেমন: জানা+আন=জানানো। এরূপ: শোনানো, ভাসানো, খাওয়ানো, দেখানো, থামানো, চালানো, ভাজানো, বানানো ইত্যাদি।
– বুঝলাম না, লিমন ভাই।
: বুঝিয়েই তো বললাম। যেমন, গতকালের ‘দেখানো’ পথে পথ চলবে। গাড়ি চালানো অবস্থায় ড্রাইভারের সঙ্গে অকারণে কথা বলবে না।
– আর?
: দ্বি-দল ধাতুর কোনো রূপের দ্বিতীয় ধ্বনিদলে যদি ব্যঞ্জন থাকে, সেই ব্যঞ্জনে ও-কার দিতে হবে। যেমন— এগোবে, পিছোবে, ঘুমোল, ফুরোল ইত্যাদি।
– হুম।
: হতাশ হলে হবে, নীলা? যা এবার সুন্দর করে চা বানিয়ে আন। সকালের বানানো চা আবার দিস না।
– সকালের বানানো চা এখন দেব কেন?
: বুঝিসনি, নীলা? একটু আগে যে পড়ালাম ‘বানানো’!
– ও আচ্ছা। একেবারে হাতে-কলমে পড়ানো। হা হা হা। বোসো, চা নিয়ে আসছি।
: এই নীলা, বসো হবে না কি বোসো হবে?
– তুমি তো বসেই আছ, তবে আবার বসতে বলব কেন? চা বানাতে সময় তো দিতে হবে, চুলায় পানি চড়াতে হবে। অতএব, ধৈর্য ধরে ‘বোসো’।
লেখক পরিচিতি
সম্পাদক বাংলাদেশের শিক্ষা
এই লেখাটি সম্পাদক কর্তৃক প্রকাশিত। মূল লেখার পরিচিত লেখার নিচে দেওয়া হয়েছে।