রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর শিক্ষাচিন্তা একদিকে ভাববাদী চিন্তাধারায় প্রভাবিত, অপরদিকে প্রয়োগের সময় প্রকৃতিবাদী আদর্শে গড়া। তিনি তাঁর লেখায় কুসংস্কারাচ্ছন্ন শিক্ষা-বিবর্জিত মানুষদের জেগে ওঠার আহবান জানিয়েছেন।

মিহির হালদার রবীন্দ্রনাথের শিক্ষাভাবনা নিয়ে লিখেছেন

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বাঙালির অতি কাছের, অতি আপন একজন মানুষ বলে মনে হয় সবসময়। কারণ তাঁর কীর্তির অক্ষয় স্বাক্ষর তিনি রেখে গেছেন বাঙালি জাতিসত্বার মানসপটে। জ্ঞানজগতের এক উজ্জ্বল নক্ষত্র হয়ে প্রাত্য আলোকসঞ্চার করে আমাদেরকে করেছেন আলোকিত। কী অপূর্ব তাঁর সকল সৃষ্টি! বাংলা সাহিত্যের সকল পথে তাঁর অবাধ বিচরণ এবং সেই পথ আমাদের চিন্তাজগতের স্বর্ণদুয়ার উন্মুক্ত করেছে। একাধারে তিনি কবি, গল্পকার, ঔপন্যাসিক, নাট্যকার, গীতিকবি, গায়ক, সুরকার, চিত্রকর, শিক্ষা-সংষ্কারক ও প্রাবন্ধিক। এতোকিছু অর্জনের পরও তিনি জীবনের শেষ প্রান্তে এসে বলেছেন, ‘আমার কীর্তিরে আমি করি না বিশ্বাস’ অর্থাৎ অতৃপ্তি তাঁকে সর্বদা তাড়না দিতো। কিন্তু সকলে যে তাঁকে তাঁর কর্মের জন্য স্মরণ করবে, সেই বিশ্বাস কিছুটা ছিলো তাঁর মনে। তাই তিনি বলতেন, ‘আমি জানি, যাব যবে/ সংসারের রঙ্গভূমি ছাড়ি/ সাক্ষ্য দেবে পুষ্পবন ঋতুতে ঋতুতে/ এ বিশ্বরে ভালোবাসিয়াছি’। আমাদেরকে রবীন্দ্রনাথ বিশ্বের দরবারে যেমন পরিচয় করিয়ে গেছেন, তেমনি বিশ্বকে হাজির করেছেন আমাদের কাছে।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর শুধু লেখনির মধ্যদিয়ে আমাদের নির্মল আনন্দ ও বিশ্বজ্ঞান প্রদান করেছেন তা নয়; সাথে সাথে সমাজ সংষ্কার করেছেন হাতেকলমে লেগে থেকে। এক্ষেত্রে সমাজ সংষ্কার করতে প্রথমেই শিক্ষাব্যবস্থাকে আধুনিককরণের দিকেই তাঁর সর্বোচ্চ দৃষ্টি ছিলো। আধুনিক বিশ্বে বাঙালি মাথা উঁচু করে যেনো দাঁড়াতে পারে, সেজন্য তিনি কাজ করেছেন আজীবন। শিক্ষার প্রভাবে সমাজ যেমন আধুনিক ধ্যানধারণা লাভ করে, তেমনি আধুনিক বিশ্বের চলমান শিক্ষাক্রম ও নবতর ধারণা একটি দেশের শিক্ষাব্যবস্থায় গতি সঞ্চার করে। আমরা দেখেছি আধুনিকতার প্রভাবে আমাদের সামাজিক প্রতিষ্ঠানগুলোর পরিবর্তন হয়েছে। শিক্ষাক্ষেত্রে আধুনিক ভাবধারা বিশ্লেষণ করলে আমরা কিছু পরিবর্তন লক্ষ্য করতে পারি।

শিক্ষার আধুনিকায়নে দরকার— প্রথমত, জীবন সম্পর্কে উদার দৃষ্টিভঙ্গী অর্জন। রবীন্দ্রনাথ সেক্ষেত্রে বলেছেন, ‘যতটুকু অত্যাবশ্যক কেবল তাহারই মধ্যে কারারুদ্ধ হইয়া থাকা মানবজীবনের ধর্ম নহে। আমাদের দেহ সাড়ে তিন হাতের মধ্যে বদ্ধ, কিন্তু তাই বলিয়া ঠিক সেই সাড়ে তিন হাত পরিমাণ গৃহ নির্মাণ করিলে চলে না’। অর্থাৎ, তিনি সুশিক্ষা বলতে বুঝিয়েছেন তাই, যা মানুষের হৃদয়ের বিকাশ তথা সামগ্রিক সত্তার বিকাশ ঘটায়। শিক্ষাকে তিনি মনে করেন জীবন বিকাশের প্রক্রিয়া।

দ্বিতীয়ত, আধুনিক শিক্ষার জন্য শিক্ষার উদ্দেশ্যগত পরিবর্তন দরকার। প্রাচীন মিশরীয় সভ্যতায় শিক্ষার উদ্দেশ্য ছিলো প্রত্যেক শিশুকে তার সামাজিক শ্রেণি (social class) অনুযায়ী বৃত্তিমুখী প্রশিক্ষণ দেওয়া। প্রাচীন চীন দেশে শিক্ষার উদ্দেশ্য ছিলো প্রাচীন রীতিনীতি ও বিধানগুলো অনুশীলন করা। প্রাচীন গ্রিসের শিক্ষার উদ্দেশ্য ছিলো নগর-রাষ্ট্র রক্ষার উপযোগী সৈনিক তৈরি করা। প্রাচীন রোমান শিক্ষার উদ্দেশ্য ছিলো কৃষিভিত্তিক উন্নয়ন। অর্থাৎ পূর্বে জীবনে বেঁচে থাকার জন্য প্রয়োজনীয় জ্ঞান ও দক্ষতা অর্জনকেই শিক্ষার লক্ষ্য মনে করা হতো। রবীন্দ্রনাথ শিক্ষার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য নির্ণয় করতে গিয়ে ভাববাদী দর্শনের সাথে বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গীর সংযোগ স্থাপন করেছেন। তিনি ব্যক্তিত্বের পরিপূর্ণ বিকাশের ওপর গুরুত্ব দিয়েছেন। তিনি প্রকৃতি ও সমাজের সঙ্গে সংযোগ রেখে শিক্ষাদানের কথা বলেছেন। তিনি বলেছেন, ‘Children have their active sub-conscious mind which like a tree, has the power to gather its food from the surrounding atmosphere. For them atmosphere is a great deal more important than rules and methods, buildings, appliances, class teaching and text books’. এক্ষেত্রে শিক্ষার লক্ষ্য হিসেবে তিনি শিক্ষার্থীর ১. জীবনবিকাশ, ২.বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি জাগ্রত করা, যার সাহায্যে তারা বিশ্বের রহস্য উদঘাটনের চেষ্টা করবে, ৩. ধর্মীয় মনোভাব জাগানো, এবং ৪.সামাজিক গুণের বিকাশ সাধনের ওপর গুরুত্ব আরোপ করেছেন। তাঁর মতে, শিক্ষার উদ্দেশ্য হবে মানুষকে তার শ্রেষ্ঠত্বের অধিকারী করে গোড়ে তোলা, প্রকৃত জীবনাদর্শ গঠনে সাহায্য করা, প্রকাশভঙ্গীকে ছন্দোময় করে তোলা এবং চরিত্রের বলিষ্ঠতা এনে দেওয়া।

তৃতীয়ত, আধুনিকতার জন্য শিক্ষাক্রম পরিবর্তন করা দরকার। রবীন্দ্রনাথ শিক্ষাক্রমকে বলেছেন সংস্কৃতির বাহক। পাঠ্যপুস্তক সম্পর্কে বলেছেন, ‘মানবাত্মার অমর আলোক কালো অক্ষরের শৃঙ্খলে কাগজের কারাগারে বাঁধা পড়িয়াছে’। বিদ্যালয়কে তিনি মানবসংস্কৃতির অনুশীলনের ক্ষেত্র হিসেবে বিবেচনা করেছেন। তিনি শিক্ষাক্রমের ভেতর ভাষা, সাহিত্য, দর্শন, বিজ্ঞান, শিল্পকলা, সংগীত, নৃত্য, পল্লী-উন্নয়নমূলক কাজ এবং অন্যান্য সামাজিক কাজকে অন্তর্ভুক্ত করতে চেয়েছেন। তবে ইংরেজি থেকে তিনি মাতৃভাষায় শিক্ষালাভের প্রতি বেশি গুরুত্ব দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, ‘আমরা অল্প বয়সে যে ইংরেজিটুকু শিখি তাহা এত যৎসামান্য এবং এত ভুল যে, তাহার ভেতর হইতে কোনো প্রকারের রস আকর্ষণ করিয়া লওয়া বালকদের পক্ষে অসম্ভব হয়’। তিনি ইংরেজি মাধ্যমে শিক্ষালাভকে বিদেশি কারাগারে শৃঙ্খলাবদ্ধ হওয়ার সাথে তুলনা করেছেন। অপরদিকে শিক্ষণপদ্ধতি সম্পর্কে তিনি তিনটি মূলনীতির কথা বলেছেন: ১. স্বাধীনতা (freedom), ২. সৃজনশীলতার মাধ্যমে আত্মপ্রকাশ (creative self expression), ও ৩. প্রকৃতির সঙ্গে সক্রিয় সংযোগ (active communication with nature and man)।

রবীন্দ্রনাথ সাধারণ শিক্ষার পরিগণ্ডিকে অস্বীকার করে তাঁর শিক্ষাচিন্তাকে প্রয়োগমুখী করার প্রত্যেয়ে ১৯০১ সালে শান্তিনিকেতন নামে একটি বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন যা পরবর্তীতে ১৯২১ সালে বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে পূর্ণতা লাভ করে। তিনি বলেছেন, ‘প্রথমে আমি শান্তিনিকেতনে বিদ্যালয় স্থাপন করে এই উদ্দেশ্যে ছেলেদের এখানে এনেছিলুম যে, বিশ্বপ্রকৃতির উদারক্ষেত্রে আমি এদের মুক্তি দেব’। রবীন্দ্রনাথ বিদ্যালয়কে উন্মুক্ত প্রান্তর করে প্রকৃতির সাথে মনের চর্চার প্রতি নজর দিতে বলেছেন। এক্ষত্রে শিশুরা যেন যথেষ্ট সৃজনশীল কাজ ও সহপাঠ্যক্রমিক কাজ করে তার দিকে গুরুত্ব আরোপ করেছেন। তাঁর মতে, শিক্ষক-শিক্ষার্থীর সম্পর্ক হবে অনেক সহজ। পারস্পরিক ভাবের আদান প্রদান থাকবে সেখানে।

চতুর্থত, আধুনিক হতে গেলে বিজ্ঞানের যে বিকল্প নেই সে কথা তিনি স্বীকার করেছেন বহুবার। তাঁর বিশ্বপরিচয় প্রবন্ধের ভূমিকায় তিনি জ্যোতির্বিজ্ঞান ও প্রাণবিজ্ঞানের প্রতি তাঁর অনুরক্ততার কথা জানিয়েছেন। আবার নব্যপ্রাকৃততত্ত্ব-বৈজ্ঞানিক মায়াবাদে তাঁর মন অভিভূত হলেও বিষয়টি তিনি সব বোঝেন না স্বীকার করেছেন অকপটে। তাঁর অনুসন্ধিৎসু মন অত্যন্ত সুখপাঠ্য করে আধুনিক পদার্থবিজ্ঞানের নানা বিষয় যেমন, পরমাণু, নক্ষত্র, সৌরজগত, গ্রহ ইত্যাদি ব্যাখ্যা করেছেন এবং শিক্ষার্থীদেরকেও জানতে বলেছেন যাতে বিজ্ঞানের প্রক্রিয়ার সাথে পরিচিত হয়ে সকল শিক্ষার্থী সৃজনশীল হতে পারে।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর আশি বছরের জীবনে বিচিত্র অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করেছেন। তাই তাঁর শিক্ষাচিন্তা একদিকে ভাববাদী চিন্তাধারায় প্রভাবিত, অপরদিকে প্রয়োগের সময় প্রকৃতিবাদী আদর্শে গড়া। তিনি তাঁর লেখায় কুসংস্কারাচ্ছন্ন শিক্ষা-বিবর্জিত মানুষদের জেগে ওঠার আহবান জানিয়েছেন। নবশিক্ষার্থীদের সমাজের প্রয়োজনে এগিয়ে আসার কথা বলেছেন। বলাকা কাব্যে এক জায়গায় তিনি বলেছেন, ‘ওরে সবুজ ওরে আমার কাঁচা আধমরাদের ঘা মেরে তুই বাঁচা’। ১৯৪৮ সালে জাতিসংঘ কর্তৃক ঘোষিত মানবাধিকারের সার্বজনীন ঘোষণাপত্রের ২৬ নং অনুচ্ছেদে বলা হয়— মানুষের শিক্ষার উদ্দেশ্য হবে ব্যক্তিত্বের পূর্ণ বিকাশ। এ ঘোষণার বহু আগেই দূরদৃষ্টিসম্পন্ন কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন একই কথা। তিনি তাঁর কাব্যে বলেছেন, ‘চিত্ত যেথা ভয়শূন্য উচ্চ যেথা শির/ জ্ঞান যেথা মুক্ত সেথা গৃহের প্রাচীর’। এখানে মুক্তজ্ঞানের আদর্শে মানুষকে তিনি অনুপ্রাণিত করেছেন। পরিশেষে বলা যায়, একটি রাষ্ট্রের সকল নাগরিকের মানবিক, বৌদ্ধিক ও মনুষ্যত্বের উদ্বোধন ঘটাতে তাই রবীন্দ্রনাথের আধুনিক শিক্ষাভাবনার আদর্শ অনুসরণের বিকল্প নেই।

মিহির হালদার: প্রাথমিক শিক্ষক প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট খুলনাতে ইনস্ট্রাক্টর হিসেবে কর্মরত।

Sending
User Review
4 (1 vote)

লেখক সম্পর্কে

সম্পাদক বাংলাদেশের শিক্ষা

এই লেখাটি সম্পাদক কর্তৃক প্রকাশিত। মূল লেখার পরিচিত লেখার নিচে দেওয়া হয়েছে।

মন্তব্য লিখুন

একটি মন্তব্য