মাহমুদ হাসান

আন্ডারগ্র্যাড শেষ করার পর বেশিরভাগ শিক্ষার্থীর মতো আমারও ইচ্ছা ছিলো দেশের বাইরে উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করার। বেশিরভাগ শিক্ষার্থীর মতোই আমারও কোনো ধারণা ছিল না বিদেশে উচ্চশিক্ষা বিষয়টি কী, এটি কীভাবে অর্জন করা যেতে পারে আর অর্জন করলে লাভই বা কী? জিআরই না দিলে ভিসা দেয় না – আমার ধারণা মোটামুটি এরকম লেভেলের ছিলো। আরও কিছু হাস্যকর ধারণা ছিলো যেমন, বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকরি না করে অন্য কোথাও চাকরি করলে স্কলারশিপ বা বৃত্তি পাওয়া যায় না, গবেষণা-প্রবন্ধ না থাকলে ভর্তি হওয়া যায় না ইত্যাদি। আসলে এরকম হাস্যকর ধারণাগুলোর জন্যে আমি আমার সেই সময়টাকে, অর্থাৎ বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে সদ্য ব্যাচেলর ডিগ্রি শেষ করা একজন শিক্ষার্থীকে খুব একটা দোষারোপ করি না।

আগে শিক্ষকদের করতাম। মনে হতো, শিক্ষকরাই তো কখনও বুঝিয়ে বলেননি বিষয়টি কেমন। এখন শিক্ষকদেরও আর করি না। বুঝি যে, বেশিরভাগ শিক্ষকের দৌড় তো ছিলো দেশের কোনো একটি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মাস্টার্স বা পিএইচডি করা পর্যন্ত। তাঁদের পক্ষে এ-ধরনের গাইডলাইন দেয়া আসলে অসম্ভব ছিলো। তো, আমরা যারা দেশের বাইরে পড়তে আসতে চাইতাম, নিজেরা নিজেরাই এসব নিয়ে টুকটাক আলোচনা করতাম। ‘প্রকাশনা না থাকলে বিদেশের বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়া যায় না, যতো বেশি প্রকাশনা ততো বেশি ভর্তির চান্স’ – এই ভয় বা ধারণা থেকে তখন আমি বেশ কিছু গবেষণা-প্রবন্ধ প্রকাশের চেষ্টা করি।

যেহেতু সত্যিকার অর্থে আমার কোনো গাইডলাইন ছিল না, আমার আন্ডারগ্র্যাডের থিসিসটি ছাড়া আসলে তখন বলার মতো কোনো ‘রিসার্চ’ ছিল না। তবু স্ট্যামফোর্ডে জয়েন করার পর আমি নিজের চেষ্টায় নিজের কিছু আইডিয়ার প্রোটোটাইপ তৈরির চেষ্টা করি এবং কিছু ফল পাই। সেগুলো খুব উন্নতমানের গবেষণাকর্ম ছিলো তা নয়; তবে তখন আমার মাথার ওপর দেশ ছাড়ার এক্সট্রিম প্রেশার ও দেশের বাইরে পড়তে যাবার তীব্র আকাঙ্ক্ষা থাকায় সেগুলোকেই আমার কাছে আইনস্টাইনের লেভেলের আবিষ্কার বলে মনে হতে থাকে।

এটি ঠিক যে, কাজগুলো একদম ফেলে দেয়ার মতো ছিলো না, আইডিয়াগুলো ভালো ছিলো। হয়তো ফলাফলকে যেভাবে ভ্যালিডেট করতে হয় সেটি জানতাম না দেখে ইচ্ছেমতো প্রাপ্ত ফলাফলকে ব্যাখ্যা করেছিলাম। আমি এখন যখন সেই কাজগুলো আবার দেখি, আমার মনে হয় যে, সেগুলোকে কিছুটা গাইডলাইন পেলে, একটু বুঝতে পারলে সেগুলো অন্তত মাঝারি মানের কিছু কনফারেন্সের উপযোগী করতে পারতাম। যাহোক, লিখে ফেললাম কিছু পেপার সেসব কাজের প্রাপ্ত ফলাফলের ওপর ভিত্তি করে।

এখন প্রকাশ করব কোথায়? হাতে সময় আছে মাস দুয়েক। এই মাসদুয়েকের মাঝেই আমাকে দেশের বাইরে ভর্তির জন্যে আবেদন করতে হবে। যেহেতু মনে দৃঢ় বিশ্বাস যে, প্রকাশনা না থাকলে ভর্তি হওয়া যাবে না, তাই যেকোনো মূল্যে হোক এগুলো মাস দুয়েকের মাঝেই প্রকাশ করতে হবে। প্রকাশিত হলে আমি সেগুলো দিয়ে এডমিশন ও স্কলারশিপের জন্যে নিশ্চিন্তে আবেদন করতে পারি। দ্বিতীয়ত, যেহেতু জানতাম না যে কনফারেন্স কী জিনিস আর জার্নাল কী জিনিস, কোনটি ভালো আর কোনটি মন্দ, কোনটা প্রিডেটরি জার্নাল আর কোনটি সত্যিকারের জার্নাল, কাজেই ইন্টারনেটে খুঁজেপেতে কিছু জার্নাল বের করলাম। শুধু জানতাম যে, জার্নাল ভালো নাকি মন্দ সেটি বুঝার একটি প্যারামিটার হচ্ছে ‘ইমপ্যাক্ট ফ্যাক্টর’। কাজেই যেসব জার্নালের ইমপ্যাক্ট ফ্যাক্টর বেশি, এবং একই সঙ্গে সপ্তাহ দুয়েকের মাঝে পাবলিশ করা যায়, সেগুলোতেই পাবলিশ করার ইচ্ছেপোষণ করলাম।


তখন পর্যন্ত বুঝিনি যে, এগুলোর মধ্যে ৯০ শতাংশই আসলে ভুয়া জার্নাল। এরা মোটেও পেপার রিভিউ করে না, পড়েও দেখে না। আমার মতো যারা বোকা এবং বুঝে না, তাদের আরও বোকা বানিয়ে টাকা কামানোই হচ্ছে এদের মূল ব্যবসা।


আমার কোনো ধারণা ছিল না যে, দুই সপ্তাহের মাঝে আসলে যে একটি পেপার পিয়ার রিভিউ করা সম্ভব না। ইমপ্যাক্ট ফ্যাক্টর কীভাবে হিসাব করতে হয়, এটি যে কেউ মিথ্যা একটি সংখ্যা জাস্ট ওয়েবসাইটে দিয়ে রেখে নিজেদের বিরাট বড় জার্নাল দাবি করতে পারে, এ সম্পর্কেও আমি সম্পূর্ণ অন্ধকারে ছিলাম। হয়তো সময় নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করলে বুঝতাম। তবে একদিকে স্ট্রিক্ট টাইমলাইন, আরেকদিকে এক্সট্রিম প্রেশার, আমার চোখেমুখে অন্ধকার দেখতে দেখতে কী মনে করে আমি বেশ কিছু জার্নালে ও কনফারেন্সে আমার গবেষণাপত্রগুলো পাঠিয়ে দিতে থাকলাম।

সপ্তাহ ঘুরতে না ঘুরতেই তারা উত্তর দিতে থাকলেন যে, আমাদের গবেষণাকর্মগুলো প্রকাশনার জন্যে মনোনীত হয়েছে। এবারে পাবলিকেশন ফি দিলেই গবেষণাকর্মটি জার্নালটির আগামী ইস্যুতে প্রকাশিত হবে। খুশি তো আমার আর ধরে না! যদি খুব খারাপ কাজ হতো, সেটি কি তারা কখনও একসেপ্ট করতেন? নিশ্চয়ই না। পাবলিকশেন ফি চেয়েছে? সেটি তো লাগবেই, প্রকাশনার খরচ আছে না? লিফলেট ছাপাতেও তো টাকা লাগে, আর জার্নাল ছাপাতে লাগবে না?

মানুষ আসলে যা করতে চায় সেভাবেই যুক্তি সাজিয়ে নেয়। তাই নানাবিধ যুক্তিতর্ক নিজের মতো করে সাজিয়ে আমিও সেই জার্নালগুলোতে টাকাপয়সা পাঠিয়ে দিলাম। দেশের বাইরে তখন টাকা পাঠানো যেত না, সম্ভবত এখনও যায় না। আমি দুনিয়ার সব ব্যাংক ঘুরে এর থেকে ওর থেকে খোঁজ নিয়ে কারও পেপালে ব্যালান্স আছে কিনা এমন মানুষ খুঁজে বের করে তাঁকে আগে ক্যাশ দিয়ে তারপরে জার্নালগুলোর পাঠানো পেপাল ঠিকানায় টাকা পাঠিয়ে প্রকাশনার বিষয়গুলো নিশ্চিত করলাম। তখন পর্যন্ত বুঝিনি যে, এগুলোর মধ্যে ৯০ শতাংশই আসলে ভুয়া জার্নাল। এরা মোটেও পেপার রিভিউ করে না, পড়েও দেখে না। আমার মতো যারা বোকা এবং বুঝে না, তাদের আরও বোকা বানিয়ে টাকা কামানোই হচ্ছে এদের মূল ব্যবসা।

যা হোক, পাবলিকেশন হয়ে গেল। দু’মাসের টার্গেট নিয়েছিলাম, আড়াই মাসের মাথায় আমার চারটি জার্নাল (যার মাঝে তিনটি শতভাগ ভুয়া জার্নাল, একটি ভুয়া না হলেও অত্যন্ত নিম্নমানের) এবং দুটো কনফারেন্সে (বুয়েটের একটি ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি) পাবলিকেশন হয়ে গেল। সেই জার্নালগুলোর মান নিয়ে কলিগ ও বন্ধুবান্ধবদের মাঝে কেউ কেউ যে আপত্তি করেননি তা নয়, তবে ওই যে বললাম, মানুষ যা চায় তেমন করেই যুক্তি সাজিয়ে নেয়। কাজেই সেই ভুয়া জার্নালগুলোতে প্রকাশ করা পেপার দিয়েই যখন এডমিশন ও স্কলারশিপ দুটোই পেয়ে গেলাম, তখন সেই আপত্তি করা বন্ধু-কলিগদের গিয়ে বললাম, জার্নাল যদি এতোই খারাপ হতো, তারা কি এডমিশন ও স্কলারশিপ দিতেন? নর্থ আমেরিকার প্রফেসররা কি ঘাস খায়? যা হোক, সেসব দিন চলে গেলো, জিআরইর সঙ্গে যে ভিসার কোনো সম্পর্ক নেই বুঝতে পারলাম, এবং আরও অনেককিছু বুঝেশুনে একদিন দেশ ছেড়ে কানাডায় উচ্চশিক্ষার স্বপ্নপূরণে বিমানে চেপে বসলাম।

দিন কাটছিলো ভালোই। প্রফেসর মুসলিম, তাঁর ছাত্র-ছাত্রীরাও সবাই মুসলিম এবং অ্যারাবিক এথনিসিটির। গেলে খাঁটি আরবি উচ্চারণে ‘সালামে য়ালেকুম’, ‘হ্বামদেল্লা’, ‘ইনশাল্লাহ খায়ের’ ইত্যাদি বলতে বলতে মাঝে মাঝে মনে হতো আরব কোনো দেশে বসবাস করছি হয়তো। আস্তে আস্তে পেপার পড়তে পড়তে, খুঁজতে খুঁজতে, প্রেজেন্ট করতে করতে, অন্যদের উপস্থাপনা দেখতে দেখতে, উপস্থাপকের বক্তব্যকে বাকিরা কীভাবে অ্যাটাক করে সেটি দেখতে দেখতে, গবেষণাপত্রে দাবি করা ফলাফলকে কীভাবে ক্রিটিকালি ইন্টারপ্রেট করা যায় সেটি শিখতে শিখতে একসময় বুঝে গেলাম যে, আসলে গবেষণা এত সোজা বিষয় না।

বুঝে গেলাম ভালো জার্নাল বা কনফারেন্স কীভাবে চিনতে হয়, কোনটি জাস্ট গার্বেজ আর কোনটি সত্যিকারের ভালো কাজ – এই ধারণাটি আস্তে আস্তে হয়ে গেল। সব গ্র্যাজুয়েট শিক্ষার্থীকে বাধ্যতামূলকভাবে রিসার্চ এথিকসের কোর্স করতে হতো, সেখান থেকেও অনেক ধারণা পরিষ্কার হয়ে আসলো।

২০১৪-এর সামারে আমার প্রফেসরের কাছে ট্রান্সফার হয়ে এক সউদি ছাত্রী আসলেন। সউদি ছাত্রীটি প্রতিদিন একটি বিষয়ের ওপর নানাবিধ গবেষণা-প্রবন্ধ পড়ে সেগুলো উপস্থাপন করেন। একদিন দেখি, তিনি আমার সেই ভুয়া জার্নালগুলোতে প্রকাশ করা সেই গবেষণাপত্রগুলো—যেগুলোর কথা আমি ভুলেই গিয়েছিলাম কানাডায় আসার পর—সেখান থেকে একটি পেপার ডাউনলোড করে নিয়ে এসেছেন প্রেজেন্ট করতে! ভয়ের একটি শীতল স্রোত শিড়দাঁড়া বেয়ে নেমে গেল দ্রুত। পালিয়ে যাওয়ার উপায় তো নেই, তাই চোখমুখ শক্ত করে বসে রইলাম।

প্রেজেন্টেশন শুরু হলো। পেপারকে যেভাবে আমরা অ্যাটাক করে অভ্যস্ত সেভাবে সবাই অ্যাটাক করা শুরু করলো। হাসাহাসি শুরু করলো। পার্থক্য এই যে, অন্যদিন আক্রমণে আমিও অংশ নিই, আজ আমি মাথা নিচু করে বসে রইলাম। ধরণী দ্বিধা হওয়া বা লজ্জায় মাটিতে মিশে যাওয়া টাইপ যে প্রবাদটি আছে, সেটির মর্ম একদম ‘মর্মে মর্মে’ উপলব্ধি করলাম সেদিন। মনে হচ্ছিলো, মাটির নিচে মাথা ঢুকিয়ে বসে থাকতে পারলে খারাপ হতো না। যা হোক, সকল অপমানেরই শেষ আছে; একসময় সেই প্রেজেন্টেশন শেষ হল। সবাই ভদ্র ভাষায় জানতে চাইলো, ‘এটি কে লিখেছে?’। দেখা গেলো যে, অথরের নাম আর আমার নাম একই। সেটি নিয়েও একচোট হাসাহাসি হয়ে গেল। তবে কেউ আমাকে সরাসরি বলল না যে, আমিই এই কর্ম করে এসেছি অতীতে।

সেদিন সন্ধ্যায় আমার সুপারভাইজর আমাকে তাঁর অফিসে ডাকলেন। বললেন, দেখো, আজকে যে পেপারটার ওপর আলোচনা করা হয়েছে, সেটির লেখক যে তুমি, সেটি আমি জানি।

আমি চুপ করে রইলাম।

তিনি বললেন, ইটস ওকে। আমি বুঝতে পারছি যে, সেই সময়ে তোমার কোনো ধারণা ছিল না যে, কী করতে হবে, কোথায় করতে হবে, কীভাবে করতে হবে। তুমি একা নও, তোমার মতো এমন শিক্ষার্থী আমরা প্রতি বছরই দেখি। ইউ আর জাস্ট ভিকটিম।

আমি কিছু বললাম না।


ভবিষ্যতে এসব ফালতু জায়গায় নিজের আইডিয়া পাঠিয়ে নিজেকে হাস্যরসের পাত্রে পরিণত করো না। আর এই রেফারেন্সগুলোও কোথাও চাকরিবাকরির জন্যে দিও না। কেউ যদি এটি খুঁজে দেখে, সে তোমার ‘রিসার্চ এথিকস’ নিয়েই প্রশ্ন তুলবে।


তিনি বললেন, যা হোক, তোমাকে হিউমিলিয়েট করা আমার উদ্দেশ্য ছিলো না। আমি চেয়েছিলাম, তুমি যেন একদম ভেতর থেকে বুঝতে পারো যে, আসলে একটি রিসার্চ ওয়ার্ক কীভাবে করতে হয়, জাস্ট এন আইডিয়া ইজ নট এনাফ। একটি আইডিয়ার ওপর সত্যিকার অর্থে কাজ করে এবং সেই কাজটির একটি বাস্তব সমস্যার সমাধান করে এমন অবস্থায় নিয়ে এসে সেটিকে যুক্তিসঙ্গতভাবে উপস্থাপন করতে পারাটাই হচ্ছে গবেষণা।

আমি বললাম, আমি এখন বুঝতে পারছি। আসলে এখানে এসে মাস তিনেকের মাঝেই সেটি বুঝেছি, তবে ততোক্ষণে অনেক দেরি হয়ে গেছে। আমি তো আর সেটা এখন ফেরাতে পারবো না।

প্রফেসর বললেন, সেটি ঠিক আছে। ফেরানোর প্রয়োজন নাই। তবে ভবিষ্যতে এসব ফালতু জায়গায় নিজের আইডিয়া পাঠিয়ে নিজেকে হাস্যরসের পাত্রে পরিণত করো না। আর এই রেফারেন্সগুলোও কোথাও চাকরিবাকরির জন্যে দিও না। কেউ যদি এটি খুঁজে দেখে, সে তোমার ‘রিসার্চ এথিকস’ নিয়েই প্রশ্ন তুলবে।

আমি সেরাতে সবগুলো জার্নালকে ইমেইল করে বললাম যে, আমি আমার পাবলিকেশনগুলো উইথড্র করতে চাই। একটিমাত্র জার্নাল প্রত্যুত্তর দিলো কয়েকদিন পর (যেটি ভুয়া জার্নাল না, তবে নিম্নমানের ছিলো) যে, যেহেতু আমি মনে করছি আমার রেজাল্ট আবার পুনর্বিবেচনা করতে হবে, আমি যতোদিন সেটি না করছি ওরা পাবলিকেশনটা হোল্ড করে রাখবে। বাকিরা কোনো উত্তরই দিলো না। বুঝলাম যে, এরা যে ইমেইল করলে টাকা পাওয়া যাবে না সেই ইমেইলের উত্তর দেয়ারও প্রয়োজন বোধ করে না।

এ ঘটনাটি আমি অনেককে মুখে মুখে বলেছি, ব্যক্তিগতভাবে বলেছি। বুঝানো চেষ্টা করেছি যে, না জানা থাকার কারণে হাই ইমপ্যাক্ট ফ্যাক্টর, ফাস্ট পিয়ার রিভিউড পাবলিকেশন উইদিন টু উইকস, লো পাবলিকেশন ফি এসব কথা যারা বলে, সেগুলো আসলে ভুয়া জার্নাল। কেউ হয়তো বিশ্বাস করেছে, কেউ করেনি। যারা করেনি আমি তাদের মোটেও দোষ দিই না। আসলে আন্ডারগ্র্যাড শেষ করার পর সময়টাই তেমন। বিশ্বাস করার কথা না। তবুও বলেছি।

কাউকে এটিও বলেছি যে, চাকরির আবেদনপত্রে এই ভুয়া কনফারেন্স বা ভুয়া জার্নালে যে প্রকাশনা আছে সেটি না উল্লেখ করতে। তারা ভেবেছেন যে, আমি চাই যেন তাদের চাকরি না হয়। তারা রাগ করে আমার সঙ্গে কথা বলা বন্ধ করে দিয়েছেন। আমি তাদের রাগেও কিছু মনে করিনি। হতেই পারে। তবে আমি যে ঘরভর্তি পুরো ল্যাবের সব সদস্যের সামনে অপমানিত হয়ে পয়তাল্লিশ মিনিট মাথা নিচু করে বসে ছিলাম, যদিও কেউ আমাকে একটি শব্দও বলেনি, তবু যে সব হাসাহাসির মূল লক্ষ্যবস্তু আমিই ছিলাম – সেটি তো আমি ভুলতে পারি না একটা দিনের জন্যও। আমি সত্যিই চাই না যে কেউ আমার মতো এই অপমানটা আর বোধ করুক।

আমার প্রফেসর একজন মহামানব-ধরনের মানুষ ছিলেন। তিনি আমাকে আলাদা করে বুঝিয়ে বলেছেন বিষয়টি, তবে সব প্রফেসর কিন্তু এমন না। এসব কারণে কারও রিসার্চ এথিকস নিয়ে প্রশ্ন উঠাটাও অসম্ভব না, যদিও বিষয়টি জাস্ট ইনফরমেশন গ্যাপের কারণে বা পরিস্থিতির কারণে ‘ভিক্টিম’ হয়ে যাওয়া। তাই আমি দীর্ঘদিন ধরে ভাবছিলাম বিষয়টি লিখে রাখবো যেন শিক্ষার্থীরা সচেতন হন, তাদেরকে এমন লজ্জাজনক ও বিব্রতকর পরিস্থিতির মুখোমুখি না হতে হয়, এবং একই সঙ্গে নিজের করে আসা ভুলেরও একটি কনফেশনের সুযোগ হয়।


একজন আন্ডারগ্র্যাড শিক্ষার্থীর কোনো পাবলিকেশন থাকবে জার্নালে, এটি প্রায় অসম্ভব একটি বিষয়। কাজেই সেটি করে (তাও তিনটা বা চারটা) ভর্তির জন্যে আবেদন করার প্রয়োজন নেই মোটেও। ভর্তির ক্ষেত্রে এসব ভুয়া পাবলিকেশন মোটেও বিবেচ্য বিষয় নয়, বরং কোনো কোনো ক্ষেত্রে এসব ভুয়া প্রকাশনা দিলে ভর্তির অফার পাওয়ার সম্ভাবনাই কমে যায়।


শিক্ষার্থীদেরকে বলতে চাই যে, একজন আন্ডারগ্র্যাড শিক্ষার্থীর কোনো পাবলিকেশন থাকবে জার্নালে, এটি প্রায় অসম্ভব একটি বিষয়। কাজেই সেটি করে (তাও তিনটা বা চারটা) ভর্তির জন্যে আবেদন করার প্রয়োজন নেই মোটেও। ভর্তির ক্ষেত্রে এসব ভুয়া পাবলিকেশন মোটেও বিবেচ্য বিষয় নয়, বরং কোনো কোনো ক্ষেত্রে এসব ভুয়া প্রকাশনা দিলে ভর্তির অফার পাওয়ার সম্ভাবনাই কমে যায়। সলিড আপনার প্রোফাইলে যা কিছু আছে, সেগুলোই দিন এবং সেগুলোই যথেষ্ট। বুয়েটের বা চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের কনফারেন্স দুটো একদম ভুয়া ছিল না, প্রয়োজনে দেশের মাঝে এসব কনফারেন্সে পেপার/আইডিয়া পাঠানোর চেষ্টা করুন। সেগুলো বরং কাজে দিবে।

মাহমুদ হাসান: সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার, আইবিএম।

Sending
User Review
0 (0 votes)

লেখক সম্পর্কে

সম্পাদক বাংলাদেশের শিক্ষা

এই লেখাটি সম্পাদক কর্তৃক প্রকাশিত। মূল লেখার পরিচিত লেখার নিচে দেওয়া হয়েছে।

মন্তব্য লিখুন

2 মন্তব্য

  • “আগে শিক্ষকদের করতাম। মনে হতো, শিক্ষকরাই তো কখনও বুঝিয়ে বলেননি বিষয়টি কেমন। এখন শিক্ষকদেরও আর করি না। বুঝি যে, বেশিরভাগ শিক্ষকের দৌড় তো ছিলো দেশের কোনো একটি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মাস্টার্স বা পিএইচডি করা পর্যন্ত। তাঁদের পক্ষে এ-ধরনের গাইডলাইন দেয়া আসলে অসম্ভব ছিলো।”

    কোন শিক্ষক সম্পর্কে এরকম কথা বলার আগে সাবধান হউয়া উচিত । আমাদের দেশের প্রায় সব শিক্ষক এর উচ্চ ডিগ্রি থাকে । কোনদিন জিজ্ঞাসা করে না দেখে দোষ দেয়া শিক্ষিত হওয়ার লক্ষন না।

  • মাহমুদ হাসান দেশছাড়ার আগে পর্যন্ত একটা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়েরই শিক্ষক ছিলেন। এইরকম আউল ফাউল তৈলাক্ত মন্তব্যে আর কয়দিন তথাকথিত ডিগ্রিধারীদের সম্মান রক্ষা পাবে?