মোঃ আশরাফুজ্জামান লিখেছেন যৌনকর্মীর ছেলেমেয়ের শিক্ষা নিয়ে
তিন বছর আগের কথা, তখন আমি জানতাম না বাংলাদেশে এরকম একটি স্কুল আছে যেখানে যৌনকর্মীর সন্তানরা সমাজের অন্য বাচ্চাদের সাথে একই স্কুলে পড়ালেখা করছে। তিন বছর আগে যেমন অবাক হয়েছিলাম, এবারও দৌলতদিয়া পতিতালয়ে গিয়ে অবাক না হয়ে পারলাম না। বিস্ময়ের সাথে দেখলাম আর ভাবলাম পুরো পৃথিবীটা যদি এমন হতো যেখানে সমাজে কোন ভেদাভেদ নেই। ২০০৯ সালে টাঙ্গাইল পতিতালয়ের পাশ দিয়ে আমি যখন কোরবানির গরু কেনার জন্য হাটে যাচ্ছিলাম, তখন আমি তাদের আকুতি শুনতে পেয়েছিলাম। সেদিন আমি ফেসবুকে নোট লিখেছিলাম: ‘ভাই আসেন, আসেন না, মুখ উচু করে তাকাই’। কতো সরলতা, নিজেকে প্রশ্ন করি-এমন কেন হয়? লিখতে ইচ্ছা হয় না, কী লিখব? ভালো লাগছে না, তবুও লিখছি, কেন জানি না। কী অসহায় আর্তনাদ, জীবনের কি নির্মম পরিহাস! কোরবানির হাটে যেমন গরু, ছাগল, বেচার জন্য ডাক দেয়, তেমনি এই মানুষগুলো নিজেকে বিলিয়ে (বেচে) দেয় জীবন বাঁচানোর জন্য। তাদের কোনো দোষ নেই। সমাজ তাদের এই বৃত্তে বন্দি করে দিয়েছে। কতো নিষ্পাপ তাদের চোখ, কতো কোমলতা তাদের ডাকে।
কোনো এক পাষণ্ড মানুষের হাত ধরে সুখের সাগর পারি দেয়ার আশায় নয়তো পেট বাঁচানোর তাগিদে এই শহরে এসেছিলো একজন নারী। সে কি জানতো, তাকে এনে পাষণ্ড মানুষটা মেলে ধরবে কোরবানির হাটের পশুর মতো? টাকার জন্য সে এই পেশায় আসেনি। জোর করে তাকে আসতে বাধ্য করা হয়েছে। সমাজের ভয়ে সে আর বের হতে পারেনি। আর তারপর অত্যাচার, নির্যাতন, আর এক সময় বেঁচে থাকার তাগিদে মানিয়ে চলা। কিন্তু তারপর, পরবর্তী প্রজন্ম, তাদের কী হচ্ছে? ঘৃণা, লাঞ্ছনার মধ্যে বেড়ে উঠা, নিজেকে বিসর্জন করা। তাদের না পারি;তাদের পরবর্তী প্রজন্মকে কি আমরা শিক্ষার আলো দিয়ে এই বৃত্ত থেকে বার করে আনতে পারি না?
আমরা সমাজের ভালো মানুষ– যাদের নিয়ে অন্ধকারে ফুর্তি করি, দিনের আলোয় তারাই হয়ে উঠে ঘৃণার বস্তু। মানুষ হিসেবে তাদেরকে কল্পনা করতে পারি না, আমাদের বিবেক, মনুষ্যত্ব যেন থমকে যায় তখন। জীবনের উপহাস, যৌনকর্মীদের পরিণতিতে আমাদের বিবেক এভাবেই কি থমকে দাঁড়ায়? হয়তো বা তাই! একদিন পূর্ণিমার আলো হয়ত তাদেরকেও স্পর্শ করবে, একই চাঁদের আলোয় হাতে হাত রেখে আমরা নতুন পৃথিবী সাজাবো। স্বপ্ন দেখতে বড্ড বেশি ভালোবাসি।
তারপর ২০১২ সালে যৌনকর্মীদের ছেলে-মেয়েদের সম্পর্কে বিশেষভাবে জানার সুযোগ পাই। যেখানে একটি স্কুলে সমাজের অন্য বাচ্চাদের সাথে যৌনকর্মীদের সন্তানরা পড়ালেখা করছে। শুধু তাই না, তারা স্বপ্ন দেখছে ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, শিক্ষক, সাকিব আল হাসানের মতো ক্রিকেটার এবং জয়া আহসানের মতো অভিনেতা হওয়ার। এলাকার মানুষ, সরকারি ও বেসরকারি সংস্থাগুলোও তাদের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। সব শিশু একসাথে পড়ছে, খেলাধুলা করছে, ভবিষ্যতের স্বপ্নের জাল বুনছে। যদিও এখনো কিছু প্রতিবন্ধকতা রয়েছে, তবু এগিয়ে চলেছে তাদের নতুন দিনের স্বপ্নে এগিয়ে চল। এখনো যেমন কিছু সহপাঠী ছেলেমেয়ে ঝগড়া হলে তাদেরকে পতিতার বাচ্চা বলে বকা দেয়। সাধারণ বাচ্চাদের সাথে কারো ঝগড়া হলে বিচারে শিক্ষকরা যৌনকর্মীদের বাচ্চাদেরই দোষী সাব্যস্ত করে।
আশার কথা তবুও এই সুবিধাবঞ্চিত যৌনকর্মীর ছেলে-মেয়েরা শিক্ষার আলোয় নিজেদেরকে আলোকিত করতে সংগ্রাম করছে, একই বিদ্যালয়ে সমাজের অন্যান্য শিশু-কিশোরদের সাথে তারা শিক্ষাগ্রহণ করছে, তারা তাদের সহপাঠীদের বাসায় যাচ্ছে। স্কুল থেকে তারা বিনামূল্যে বই পাচ্ছে, ড্রেস পাচ্ছে যার ফলে অন্যরা উৎসাহিত হচ্ছে তাদের ছেলে-মেয়েদেরকেও স্কুলে ভর্তি করতে। যে স্কুলটি পরিদর্শনের সুযোগ হয়েছিল, সেটা কেকেএস প্রাথমিক বিদ্যালয় নামে পরিচিত, এটা ১৯৯৭ সালে যাত্রা শুরু করেছিল। এখন আমি স্বপ্ন দেখি বাংলাদেশের সব স্কুলে, সমাজের সব মানুষের ছেলে মেয়েরা এভাবে মিলে মিশে একসাথে পড়ালেখা করবে।
মোঃ আশরাফুজ্জামান: রিসার্চ ফেলো, শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা, বাংলাদেশ।
লেখক পরিচিতি
সম্পাদক বাংলাদেশের শিক্ষা
এই লেখাটি সম্পাদক কর্তৃক প্রকাশিত। মূল লেখার পরিচিত লেখার নিচে দেওয়া হয়েছে।