পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে সান্ধ্যকালীন কোর্স চালু থাকুক

মোঃ এলাহী রওশন লিখেছেন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে সান্ধ্যকালীন কোর্স প্রসঙ্গে

৯ ডিসেম্বর ২০১৯ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সদ্য সমাপ্ত ৫২তম সমাবর্তন অনুষ্ঠানে মাননীয় আচার্য মহোদয় তাঁর বক্তৃতায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর নজরদারিবিহীন সান্ধ্যকালীন কোর্স বা স্নাতকোত্তর কার্যক্রমগুলোর ব্যাপারে অসন্তোষ প্রকাশ করেন। এর পরিপ্রেক্ষিতে একদিন পর বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি) সকল পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সান্ধ্যকালীন এ্যাকাডেমিক কার্যক্রম বন্ধের নির্দেশ দেন।

পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে সান্ধ্যকালীন স্নাতকোত্তর কোর্স পরিচালনার বিরোধী আমি নই।

তবে ইউজিসির এই সিদ্ধান্তকে আমি সাধুবাদ জানাই। সাধুবাদ জানাই এ কারণে যে, জনগণের টাকায় পরিচালিত পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে এমন অবাধ আর লাগামহীন শিক্ষাবাণিজ্য কোনো অবস্থাতে গ্রহণযোগ্য হতে পারে না।

সন্ধ্যার পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা সত্যিই ঢাকা নিউ মার্কেটের মতোই রমরমা হয়ে ওঠে। এই কোর্সগুলোতে ভর্তি হতে চাওয়া হয় না যথোপযুক্ত শিক্ষাগত যোগ্যতা। ভর্তি পরীক্ষা তো কেবল আইওয়াশ মাত্র! অথচ এই কোর্সগুলোর জন্যই শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে নেয়া হচ্ছে নিয়মিত কোর্সের তুলনায় অনেকগুণ বেশি অর্থ।


ইউজিসির এই সিদ্ধান্তকে আমি সাধুবাদ জানাই। সাধুবাদ জানাই এ কারণে যে, জনগণের টাকায় পরিচালিত পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে এমন অবাধ আর লাগামহীন শিক্ষাবাণিজ্য কোনো অবস্থাতে গ্রহণযোগ্য হতে পারে না।


বিভাগের সিনিয়র শিক্ষকরাও নিয়মিত কোর্সের চাইতে প্রাধান্য দেন সান্ধ্যকালীন কোর্সের প্রতি। কারণ, তাতে অতিরিক্ত অর্থপ্রাপ্তির হার বেশি। অনেক বিভাগেই প্রভাষক বা সহকারী অধ্যাপকরা সান্ধ্যকালীন কোর্সে ক্লাস নেয়ার সুযোগ পান না কারণ সেখানে তাঁরা সিনিয়রিটিতে বাদ পড়ে যান। নিয়মিত কোর্সের ক্লাসের মান, নিয়মিত পরীক্ষা কিংবা সময়মত ফলাফল প্রকাশ কোনোটিতেই তেমন মনোযোগ থাকে না অধিকাংশ শিক্ষকের। তাই নিয়মিত শিক্ষার্থী ও অনেক শিক্ষার্থী-সংগঠন এসব কোর্স বন্ধের জন্য দীর্ঘদিন ধরে আন্দোলন করে আসছে।

এরপরও আমি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে সান্ধ্যকালীন কোর্স বা স্নাতকোত্তর কর্মসূচি পরিচালনা করার পক্ষে। এই কারণে যে, আমাদের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর স্নাতকোত্তর বা মাস্টার্সের নিয়মিত (দিনের) কোর্সে বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়মিত শিক্ষার্থী ছাড়া কেউ ভর্তি হতে পারে না। এমনকি একই বিশ্ববিদ্যলয়ের এক বিভাগের নিয়মিত শিক্ষার্থীও অন্য বিভাগের নিয়মিত কোর্সে ভর্তি হতে পারে না।

দিনের বেলা সমান্তরালে কোর্স পরিচালনার মতো অবকাঠামোগত কিংবা এ্যাকাডেমিক কোনো ব্যবস্থাই আমাদের নেই। তাহলে যোগ্যতাসম্পন্ন শিক্ষার্থীদের উচ্চশিক্ষা গ্রহণের জায়গাটি কোথায়?

অনেকেই বলবেন প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের কথা। অনেক বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষাসনদ বিক্রি করছে ও নিরূপায় শিক্ষার্থীদের থেকে হাতিয়ে নিচ্ছে লাখ লাখ টাকা। পাল্লা দিয়ে বাড়ছে তাদের সেমিস্টার ফি, আর সাথে সংযোজন হচ্ছে টাকা হাতিয়ে নেয়ার নতুন নতুন নিয়ম।

এসব বিশ্ববিদ্যালয়ের বাণিজ্যমুখী নিয়মের মারপ্যাঁচে কতোটা অসহায় হয়ে পড়ছে হাজারো শিক্ষার্থী তা কেবল তারাই জানে! এমনকি, প্রায়ই তাদের অভিভাবকরাও বুঝে উঠতে পারেন না প্রতি সেমিস্টারে এত অতিরিক্ত টাকা কোন খাতে কেন লাগে। অনেকেই প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতক (ব্যাচেলর) ডিগ্রির এই দুর্বিসহ সময় পার করে স্নাতকোত্তর (মাস্টার্স) করার আগ্রহ হারিয়ে ফেলে। কিন্তু স্নাতকোত্তর না করলে চাকুরি পাওয়া দুঃসাধ্য প্রায় এই বাজারে। তখন তারা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের সান্ধ্যাকালীন কোর্স বেছে নেন। অনেকেই কেবল ভাল ও মানসম্পন্ন শিক্ষার আশায় ভর্তি হতে চান পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের সান্ধ্যকালীন কোর্সে।

যোগ্যতাসম্পন্ন সিনিয়র, বন্ধু ও জুনিয়র অনেকেই প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক সম্মান শেষ করে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেছে, করছে, করার পরিকল্পনা করছে। এই কোর্সগুলো একেবারে বন্ধ হয়ে গেলে এমন হাজারো মেধাবী শিক্ষার্থীর কাছে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে নিজের সর্বস্ব বিসর্জন দেয়া ছাড়া আর কোন উপায় থাকবে না। অন্যদিকে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের সান্ধ্যকালীন স্নাতকোত্তর কার্যক্রম বন্ধ করে দেয়া হলে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর এই দৌরাত্ম্য কোথায় গিয়ে দাড়াবে খুব সহজেই তা অনুমান করা যায়।

আচার্য মহোদয়ের অনুরোধে দ্রুত সাড়া প্রদান করায় ইউজিসির সিদ্ধান্তকে সাধুবাদ জানাই। একইসাথে প্রত্যাশা এই সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনা করা হবে। বিশ্বের প্রায় সকল দেশের বিশ্ববিদ্যালয়েই রয়েছে সান্ধ্যকালীন এ্যাকাডেমিক ও গবেষণাধর্মী কার্যক্রম, যা তাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে আরও সমৃদ্ধ করেছে ও করছে। সেগুলোতে নতুন জ্ঞানের সৃষ্টি হচ্ছে।


সান্ধ্যকালীন কোর্স একটি বিশ্ববিদ্যালয় কিংবা উচ্চশিক্ষার উৎকর্ষ সাধনে কোনোভাবেই কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। তাই আমার প্রত্যাশা, সান্ধ্যকালীন কোর্সগুলোও নিয়মিত কোর্সগুলোর মতোই মানসম্পন্ন হবে।


সান্ধ্যকালীন কোর্স একটি বিশ্ববিদ্যালয় কিংবা উচ্চশিক্ষার উৎকর্ষ সাধনে কোনোভাবেই কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। তাই আমার প্রত্যাশা, সান্ধ্যকালীন কোর্সগুলোও নিয়মিত কোর্সগুলোর মতোই মানসম্পন্ন হবে।

সেখানে ভর্তির জন্য নিয়মিত কোর্সগুলোর মতোই প্রতিযোগিতামূলক ভর্তি প্রক্রিয়া থাকবে। সুনির্দিষ্ট সংখ্যক শিক্ষার্থীকেই এসব কোর্সে ভর্তি করানো হবে এবং থাকবে ইউজিসি ও বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের নজরদারি। কেনোনা, দিনশেষে ওই শিক্ষার্থীরা সংশ্লিষ্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী হিসেবেই পরিচিত হবে।  এসব কোর্সে ক্লাস নেয়া ও এর থেকে অর্থপ্রাপ্তির ব্যাপারেও শিক্ষকদের জন্যও থাকতে হবে সুনির্দিষ্ট নির্দেশনা ও নীতিমালা; যেনো সান্ধ্যকালীন কোর্স থেকে অতিরিক্ত অর্থপ্রাপ্তির আশায় নিয়মিত শিক্ষার্থীরা মানসম্পন্ন শিক্ষা থেকে বঞ্চিত না হয়।

পরিশেষে প্রত্যাশা, রাষ্ট্রপতির নির্দেশনার অপেক্ষায় না থেকে ইউজিসি প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর দিকেও তাদের সুনজর দিবে, যেন তাদের লাগামহীন দুর্বৃত্তায়ন বন্ধ করে সেখানে শিক্ষার্থীবান্ধব পরিবেশ তৈরি করা যায়।

জনপ্রিয় নিবন্ধ

প্রাথমিক স্তরে ভাষা শেখা : বিষয় – বাংলা

ভাষার দক্ষতা চারটি— শোনা, বলা, পড়া, লেখা। আর ভাষা...

আগে ইংরেজি গ্রামার শিখবো, নাকি ভাষা শিখবো?

কোন ভাষার গ্রামার হলো ঐ ভাষার গঠন প্রকৃতি যার...

শিক্ষাব্যবস্থার হালচাল

অর্থনীতিবিদদের মতে, শিক্ষা খাতে বিনিয়োগ সবচেয়ে লাভজনক এবং নিরাপদ রাষ্ট্রীয় বিনিয়োগ। অর্থনীতিবিদ এডাম স্মিথ, ডেভিড রিকার্ডো এবং মার্শালের মতে, শিক্ষা এমন একটি খাত যার কাজ হলো দক্ষ জনশক্তি গড়ে তুলে পুঁজির সঞ্চালন ঘটানো। শিক্ষার অর্থনীতি নিয়ে মৌলিক গবেষণায় অর্থনীতিবদ আর্থার শুল্জ ও রবার্ট সলো দেখিয়েছেন যে, প্রাথমিক শিক্ষায় বিনিয়োগ করলে সম্পদের সুফল ফেরত আসে ৩৫ শতাংশ, মাধ্যমিক শিক্ষায় ২০ শতাংশ, এবং উচ্চ শিক্ষায় ১১ শতাংশ।

আমেরিকায় উচ্চশিক্ষা : পিএইচডির পর কী?

আমেরিকায় উচ্চশিক্ষা নিয়ে প্রচুর লেখালেখি হয়, আমি নিজেও এ-নিয়ে...

ক্যাডেট কলেজে ভর্তি পরীক্ষা নিয়ে কিছু কথা

ক্যাডেটসমূহ বাংলাদেশের শিক্ষাঙ্গনে এক গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে আছে।...

আরও কিছু লেখা

অধিক

    প্রাথমিকে প্যানেল শিক্ষক নিয়োগ: উত্তীর্ণদের কী হবে?

    প্রাথমিক শিক্ষার ভিত্তি দুর্বল হলে শিক্ষার পরবর্তী ধাপগুলো শক্তভাবে...

    মাহতাবের একদিন: একজন শিক্ষার্থীর জীবন থেকে নেওয়া

    মায়ের আদুরে গলার ডাকে ঘুম ভাঙ্গে মাহতাবের। ঘুম ভাঙ্গে...

    ক্যাডেট কলেজ ও ভর্তি পরীক্ষা

    ক্যাডেটসমূহ বাংলাদেশের শিক্ষাঙ্গনে এক গুরুত্বপূর্ন স্থান দখল করে আছে।...

    শিক্ষিত বেকার নিয়ে কিছু কথা

    শিক্ষা মানুষকে দেয় আলো এবং সম্মুখে চলার পথ। শিক্ষা...

    বিদ্যালয়ে ভর্তির কোটা: অপ্রয়োজনীয় ভাবনার প্রতিক্রিয়া

    সংসদ সদস্যদের জন্য কোটা রাখার ব্যবস্থাটি গ্রহণযোগ্য ও বাস্তবসম্মত কিনা, সেটা বুঝার জন্য খুব বেশি চিন্তার প্রয়োজন পড়ে না; কিন্তু তিনি কী কারণে প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য পর্যন্ত মন্ত্রণালয়ের অপেক্ষা করতে হলো তা বুঝা গেল না। গ্রহণযোগ্য ও বাস্তবসম্মত হওয়ার বিষয়টি কি তাহলে শুধু প্রধানমন্ত্রীর উপরই নির্ভর করছে? একটি দেশের প্রধানমন্ত্রীকে বড় বড় অনেক কাজ করতে হয়, অনেক সিদ্ধান্ত নিতে হয়, নানা কিছু নিয়ে ব্যস্ত থাকতে হয়। এরকম একটি আপাত ছোট বিষয়কে 'গ্রহণযোগ্য ও বাস্তবসম্মত' করার জন্য প্রধানমন্ত্রী পর্যন্ত যেতে হলো কেন? দেশের তাবত সিদ্ধান্তের জন্য কি তাহলে প্রধানমন্ত্রীর মুখাপেক্ষী হয়ে থাকতে হবে? অন্য মন্ত্রীরা তাহলে কী জন্য আছেন?

    কেমন বিশ্ববিদ্যালয় চাই? : পর্ব ২

    কেমন বিশ্ববিদ্যালয় আমরা চাই এই প্রশ্নটি খুব গুরুত্বপূর্ণ। বিষয়টি...

    শিক্ষা-নৃবিজ্ঞান: শিক্ষা ও নৃবিজ্ঞানের পারস্পরিক সম্পর্ক

    সৈয়দ সাখাওয়াৎ লিখেছেন শিক্ষা ও নৃবিজ্ঞানের পারস্পরিক সম্পর্ক নিয়ে শিক্ষা-নৃবিজ্ঞান...

    প্রাসঙ্গিক নিবন্ধসমূহ

    নতুন লেখার খবর পান ইমেইলে
    বাংলাদেশের শিক্ষা প্রসঙ্গে নতুন লেখা প্রকাশিত হলে সেই খবর পৌঁছে যাবে আপনার ইমেইলে।
    পূর্ববর্তী নিবন্ধ
    পরবর্তী নিবন্ধ