আল্পনা শিরিন লিখেছেন পাবলিক পরীক্ষার ফল নিয়ে
এবছর আমার ছোট বোনের মাধ্যমিক পরীক্ষার ফল প্রকাশের দিন ছিলো। সকাল থেকে সবার মধ্যে উৎকণ্ঠা। কারো মুখে কথা নেই। আমি সকাল থেকে ছোট বোনকে সব ধরনের ফলাফলের জন্য মানসিকভাবে প্রস্তুত করছিলাম।
এবার ফলাফল মোবাইলে চলে আসবে। বিদ্যালয়ে যাওয়া নেই, প্রতিবেশীর মুখ দেখা নেই, তবুও মানুষজন কেন যেন তাদের আগ্রহ দমিয়ে রাখতে পারছিলো না। যে আত্মীয় গত দশ বছরেও ওর কোনো খোঁজ নেয়নি, সেও সকাল থেকে দুইবার ফোন দিয়েছে। ফলাফল খারাপ হলে সেই আত্মীয়কে কী জবাব দেবে তা ভেবে আমার বাবা-মায়েরও ঘাম ঝড়ে যাচ্ছিলো। এরকম ঘটনা তো আর নতুন না!
এক যুগ আগে যখন আমার ফলাফলের দিন ছিলো, তখনও বাসার পরিস্থিতি ঠিক একইরকম ছিলো! শুধু আমি আজ যে ভূমিকা পালন করছি, সেই জায়গাটিতে কেউ ছিলো না। কী বিভীষিকাময় একটি দিন ছিলো! এর আগে সমস্ত পাবলিক পরীক্ষায় সর্বোচ্চ ফলাফল লাভ করা আমার বিষয়ে বাসার সবাই তথা সমস্ত আত্মীয়ের অগাধ বিশ্বাস ছিলো যে এ+ আমাদের দরজার নাগালে। মনে মনে অনেক চিন্তা উঁকি মারলেও মন থেকে আমি নিজেও কখনো ভাবিনি যে, সেবারের মতো এ+টা দরজার ওপাশেই থেকে যাবে! এ+ আমার দরজায় কড়া না নাড়লেও, কড়া নাড়তে ভুল করেনি প্রতিবেশী, আত্মীয় বা সকল শুভাকাঙ্ক্ষী।
আমার পাশের বাসায় আমার যে বান্ধবীর এ+ এসেছিলো, তাদের মনে হয় সেদিন বাসার ভেতর ফোনের নেটওয়ার্ক ছিলো না। আমাদের দরজার সামনে দাঁড়িয়েই সবাইকে তাদের খুশির সংবাদ আর খুব আফসোস করে আমার দুঃখের সংবাদটা দেশ-বিদেশে পৌঁছে দিচ্ছিলো। ওই এলাকায় একটাই কলেজ থাকায় বিকেল হতে হতে কারোরই আর ফল জানতে বাকি ছিলো না। তবু সবাই কীসের আশায় আমার বা আমার বাবা-মায়ের কাছ থেকেই ফল শুনতে বা একটূ হা-হুতাশ করতে আসছিলো আমার জানা নেই।
শুধু ওইদিন নয়, এরপর আমার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পাওয়ার আগের দিন পর্যন্ত আমার পরিবারের কেউ আমার সাথে ভালোভাবে কথা বলেছে বলে আমার মনে পড়ে না। উৎসাহ দেয়া তো অনেক দূরের ব্যাপার! আজ আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন গ্রাজুয়েট। চাকরির বাজারে কোন সার্টিফিকেটের কী মূল্য তা আমার জানার আর বাকি নেই। আমার স্নাতকোত্তর এডুকেশনাল সাইকোলজি বিষয়ে। আজ পত্রিকার শিরোনামের যে, “১০ এসএসসি পরীক্ষার্থীর আশানূরূপ ফল না পাওয়ায় আত্মহত্যা” – এই সাইকোলজি বুঝতে আমার তাই বেশি দূর যেতে হয় না।
প্রকৃতপক্ষে, যেকোনো পাবলিক পরীক্ষার ফল যাদের খারাপ হয় তাদের কারোরই সেটি বুঝতে কষ্ট হওয়ার কথা নয়। কারণ এক যুগ আগে এই একইরকম চিন্তা যে আমার মাথায় আসেনি তা নয়। সবার কাছ থেকে লাঞ্ছনা পাওয়া, নিজেকে খুব একা আর অপরাধী মনে করা, জীবনের আর কোনো মূল্য বুঝতে না পারা— এসব কোনো চিন্তাই তখন অমূলক মনে হয় না। পরিবারের সকলের সর্বক্ষণ তীক্ষ্ণবাণ-সম্বলিত কথা, কারো সাথে মনের দুঃখ ভাগ করতে না পারা, আমাকে দিয়ে জীবনে আর কিছুই হবে না— এসব কথা বারবার কানে বাজানোই জীবন অতিষ্ট করতে যথেষ্ট ছিলো।
মনে হচ্ছিলো, জীবনে যদি কিছু করতেই না পারি তাহলে আর বেঁচে থেকেই বা লাভ কি! তারপর আবার নিজেই ভাবলাম, মরে গেলে তো আমি যে অযোগ্য সেটাই প্রমাণ করে দেয়া হবে। তার চেয়ে বরং বেঁচে থেকে দেখিয়ে দিলে কেমন হয়? কিন্তু এই উৎসাহটুকু দেয়ার মতোও কাউকে তখন পাওয়া যায়নি।
তাহলে সেটি কিসের অভাব? কাউন্সেলিং? গাইডেন্স? সাপোর্ট?
প্রতিদিন সকালে যে দৃশ্যটি আমাদের সবার প্রথম দৃষ্টিগোচর হয় তা হচ্ছে, ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের মেশিনের মতো বই-খাতা কাঁধে নিয়ে অভিভাবকের সাথে বিদ্যালয়ের দিকে ছোটে। অসুস্থ এক প্রতিযোগিতায় লিপ্ত সবাই। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত ছাত্র-ছাত্রীদের পড়ালেখার রুটিন তৈরি— তাদের জীবনের যেন একটাই উদ্দেশ্য। সেটি হচ্ছে, পরীক্ষায় প্রথম হতে হবে। অভিভাবকদের আড্ডার বিষয়েও প্রাধান্য পায় কীভাবে তার সন্তানের ফল ভালো করা সম্ভব। অথচ খুব কম অভিভাবককেই শিশুর মানসিক বিকাশ নিয়ে চিন্তা করতে দেখা যায়।
লেখাপড়ার পাশাপাশি শিশুর বড় হওয়ার জন্য যে একটি সুনির্দিষ্ট গাইডেন্স দরকার, তা অভিভাবকেরা ভুলে যান। ভুলে যান শিশুর কোনো পরীক্ষার ফল খারাপ হলে তার মনের অবস্থাও অভিভাবকের তুলনায় কোনো অংশে কম খারাপ হয় না। তেমন সময় কীভাবে মন খারাপ বা হতাশাকে অতিক্রম করা যায়— এটুকু কাউন্সেলিং শিশুর মানসিক অবস্থাকে অনেক বেশি শক্তিশালী করে দিতে পারে। আত্মীয়-স্বজন বা প্রতিবেশীরা কটু কথার পরিবর্তে যদি ভবিষ্যতে কীভাবে আরো ভালো করা সম্ভব সে বিষয়ে পরামর্শ দেন, তা ওই শিক্ষার্থীর চলার পথে উত্তম পাথেয় হতে পারে। পরীক্ষায় ভালো ফলের চেয়ে যে শিক্ষার্থীর শেখাটা বেশি জরুরি। এই চিন্তাই আমাদের চলমান ব্যবস্থাকে পালটে দিতে পারে।
তবে আসলে কারা দায়ী? শিক্ষার্থী? পরিবার? সমাজ? শিক্ষাব্যবস্থা?
অনেকগুলো প্রশ্ন। এই প্রশ্নের উত্তরগুলো এখনো মেলাতে না পারাতেই আজ এক যুগ পরেও পত্রিকায় এসএসসি পরীক্ষার্থীর আত্মহত্যার শিরোনাম আসে। মানসিকভাবে পঙ্গু করে দেয় আরো অগণিত শিক্ষার্থীকে। বর্তমানে আমরা উচ্চশিক্ষাস্তরে এডুকেশনাল সাইকোলজি ও গাইডেন্স পড়াই। অনেক স্কুল-কলেজে কাউন্সেলর রাখা হয়। শিশুদেরকে বিভিন্ন মাধ্যমে মোটিভেশন দেয়া হয়। আরো নানাবিধ প্রচেষ্টা থাকে শিশুদেরকে মানসিকভাবে প্রস্তুত করার। কিন্তু দেশের শিক্ষাব্যবস্থার সর্বস্তরে এখনো এডুকেশনাল সাইকোলজিকে গুরুত্বপূর্ণ মনে করা হয় না। সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এখনো কাউন্সেলর রাখা বাধ্যতামূলক করা হয়নি।
হ্যাঁ, আমার বোনের আমার মতো অবস্থা হয়নি, তার পরীক্ষার ফল খারাপ হয়নি। সে সফলভাবে এ+ পেয়ে উত্তীর্ণ হয়েছে। কিন্তু আমি জানি, সে সকল ধরনের ফলাফলের জন্যই প্রস্তুত ছিলো। তবে এখনো যারা প্রস্তুত ছিলেন না তারা হলেন আমার সেইসব আত্মীয়, প্রতিবেশী; কখনো কখনো মনে হয় আমার বাবা-মাও। কারণ আমাদের সমাজ এখনো মেনে নিতে শেখেনি যে, ফলাফল যাই হোক শিক্ষাটাই বড়। বেশিরভাগ অভিভাবকদের কাছে পড়ালেখা মানে এখনো শুধু একটি ভালো ফলাফল। তাই আমি মনে করি, মোটিভেশন এবং কাউন্সেলিং শিশুদের সাথে সাথে অভিভাবকেদেরও প্রয়োজন।
একটি নির্দিষ্ট সূচি অনুসরণ করে শিশুদের সাথে অভিভাবকদেরও বিদ্যালয়ে কাউন্সলিং সেশনের আয়োজন করা যেতে পারে। শিশুর যেকোন সমস্যা কীভাবে মোকাবিলা করবে তা শেখানোর পাশাপাশি একই পরিস্থিতে তার পরিবারের ভূমিকা কী হবে সেই গাইডেন্সটুকু বিদ্যলয়ে অভিভাবক সমাবেশে তুলে ধরা যেতে পারে। আজ যে সমাজ ও শিক্ষাব্যবস্থা আমাদের ছোটকাল থেকে শেখাচ্ছে একটি পাবলিক পরীক্ষায় ফল খারাপ মানেই সারা জীবনের কলঙ্ক, সেই একই সমাজ আর শিক্ষাব্যবস্থাই কয়েক বছর বাদে আমাদেরকে দেখিয়ে দেয় শত শত বেকারের মুখে প্রশ্নরূপে সেই সার্টিফিকেটের কী মূল্য! তাহলে এই শিক্ষাব্যবস্থাকে ঢেলে সাজানোই কি মুখ্য বিষয় নয়?
একটি পরীক্ষা ও তার ফলাফলনির্ভর শিক্ষাব্যবস্থাই যখন শিক্ষার্থীর সহজাত বিকাশের অন্তরায়, শিশুর জীবনকে ঠেলে দিচ্ছে হুমকির মুখে, তখন এই পরীক্ষানির্ভর শিক্ষা একটি দেশের শিক্ষাব্যবস্থায় কতটা ভূমিকা পালন করতে পারে তা প্রশ্ন থেকে যায়!
অথচ বহির্বিশ্বের দিকে একটু লক্ষ্য করলেই দেখা যায়, ফিনল্যান্ড, জাপানের মতো দেশগুলো কীভাবে তাদের শিক্ষাব্যবস্থা থেকে পরীক্ষাভীতি দূর করে শিখনকে করে তুলেছে আনন্দময়। শিক্ষা যখন বিবেচিত হয় আচরণের কাঙ্ক্ষিত ও ধনাত্মক পরিবর্তন হিসেবে, তখন এই পাবলিক পরীক্ষা নামক পুলসিরাতই হয়ে ওঠে সকল নিরানন্দের যোগান।
আগামীর প্রত্যাশা হোক এমন এক শিক্ষা যে শিখনে আত্মীয়-স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশীর কোনো প্রশ্নবিদ্ধ কৌতূহল থাকবে না। পরীক্ষা বা সার্টিফিকিটের চেয়ে মূল শিখনটাই হবে গুরুত্বপূর্ণ! শিশুরা খেলাচ্ছলে শিখবে, মূল্যায়ন হবে গঠনমূলক মূল্যায়ন। শিশুর বয়স বাড়ার সাথে সাথে বিভিন্ন গাঠনিক ও সামষ্টিক মূল্যায়নের মাধ্যমে তাদের পরীক্ষাভীতি দূর হবে। যথযথ শিখণের মাধ্যমে সে পর্যায়ক্রমে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে পারবে। প্রেষণা তখন সর্বস্তরেই থাকবে তার স্বীয় অবস্থান গ্রহণে তৎপর। একেকটা পাবলিক পরীক্ষা আর বিঁধবে না হয়ে পুলসিরাত!
লেখক পরিচিতি
সম্পাদক বাংলাদেশের শিক্ষা
এই লেখাটি সম্পাদক কর্তৃক প্রকাশিত। মূল লেখার পরিচিত লেখার নিচে দেওয়া হয়েছে।