তৌহিদ টিপু লিখেছেন বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থার হালচাল নিয়ে
তথ্যপ্রযুক্তি, জ্ঞান–বিজ্ঞানে বিশ্ব তীব্র গতিতে এগিয়ে যাচ্ছে। প্রতিযোগিতা চলছে এক দেশের সাথে আরেক দেশের। এই প্রতিযোগিতায় আমাদের প্রিয় মাতৃভূমির অবস্থান কোথায়? কেউ যদি বলেন আমরা তো প্রতিযোগিতায় অংশ নেওয়ারই যোগ্যতা অর্জন করতে পারলাম না। তাহলে খুব একটা ভুল হবে না। এ অবস্থা থেকে উত্তরণের উপায় কি? নিশ্চিতভাবেই উন্নতমানের শিক্ষা ও তার প্রয়োগের মধ্য দিয়েই আমরা শুধু প্রতিযোগিতায় টিকে থাকা নয়, একটি স্বনির্ভর জাতিতে পরিণত হবো। কিন্তু আমাদের কি দুর্ভাগ্য, উন্নতমানের শিক্ষা তো দূরে থাক আমাদের শিক্ষাব্যবস্থাটাই ভঙ্গুর। পুরো চিত্রই যে হতাশাজনক তা নয়। কিন্তু শিক্ষাব্যবস্থার বর্তমান চিত্র দেখে আশাবাদি হওয়াটাও কঠিন। এ শিক্ষাব্যবস্থার আমূল সংস্কার ছাড়া এটি প্রকৃত শিক্ষাদান ও জ্ঞান সৃষ্টি করতে পারবে না। শুরুতে যেটি দরকার তা হচ্ছে এর গলদগুলো খুঁজে বের করা। তারপরই সম্ভব সঠিক সমাধানে পৌঁছা। এই লেখায় শিক্ষাব্যবস্থার স্তরভিত্তিক সমস্যাগুলো কি কি তা দেখানোর চেষ্টা করা হয়েছে।
প্রাথমিক শিক্ষা: সবার জন্য শিক্ষা চাই
আমাদের প্রাথমিক শিক্ষাব্যবস্থা প্রধানত চারটি ধারায় বিভক্ত। সেগুলো হলো সাধারণ শিক্ষা, ইংরেজি মাধ্যম, মাদ্রাসা শিক্ষা ও ক্যাডেট শিক্ষা। সাধারণ শিক্ষার অন্তর্ভুক্ত প্রতিষ্ঠানগুলো হলো সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, নিবন্ধিত বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, অনিবন্ধিত বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, কমিউনিটি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রাথমিক শাখা, ইত্যাদি। ইংরেজি মাধ্যম শিক্ষার প্রতিষ্ঠানগুলো হলো কিন্ডারগার্টেন ও ইংরেজি মাধ্যম স্কুল (ব্রিটিশ কারিকুলাম, এনসিটিবি কারিকুলাম, ইত্যাদি)। মাদ্রাসা শিক্ষার প্রতিষ্ঠানগুলো হলো আলিয়া মাদ্রাসা, কওমী মাদ্রাসা ইত্যাদি।
একটু খেয়াল করলেই বুঝা যায় মূলত আর্থিক দিক থেকেই এতগুলো ভাগ। একটি শিশুকে তার অভিভাবক পাঠদানের জন্য কোন ধারায় নিয়ে যাবেন তা সবসময় ঐ অভিভাবকের আর্থিক অবস্থার উপর নির্ভর করে। অপেক্ষাকৃত বেশি বেতনের স্কুলগুলোতে ভালো মানের শিক্ষা কিনতে পাওয়া যায়। পিতা যদি সামর্থ্যবান না হন সেক্ষেত্রে সন্তানের জন্য অল্প বেতনের স্কুল থেকে সস্তায় নিম্নমানের শিক্ষা ক্রয় করেন।
গত ১০ সেপ্টেম্বর ২০০৮ এ প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় প্রাথমিক বিদ্যালয় না থাকা গ্রামের তালিকা চূড়ান্ত করে। এতে দেখা যায় দেশের ১৬ হাজার ১৪২টি গ্রামে কোনো প্রাথমিক বিদ্যালয় নেই। সরকারের নীতিমালা অনুযায়ী জনসংখ্যার ঘনত্ব বিবেচনা করলে এক হাজার ৯৪৩টি গ্রামে প্রাথমিক বিদ্যালয় থাকা উচিত ছিল। বিশেষত চর, সীমান্ত, হাওর–বাঁওড় ও পাহাড়ি এলাকা এক্ষেত্রে পিছিয়ে।
প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের হিসেবে, প্রাথমিক স্তরে এখন মোট শিক্ষার্থী ১ কোটি ৬৩ লাখ ১২ হাজার ৭ জন। ২০০৮ সালে প্রথম শ্রেণিতে ভর্তি হয়েছিলো ৩৭ লাখের বেশি শিশু। ২৬ লাখের কিছু বেশি শিক্ষার্থী নিবন্ধন করেছে চলতি বছরের (২০১২) পঞ্চম শ্রেণির সমাপনী পরীক্ষায় অংশ নেয়ার উদ্দেশ্যে। এই হিসেবে পঞ্চম শ্রেণিতে আসা পর্যন্ত ঝড়ে পড়েছে প্রায় সাড়ে ১১ লাখেরও বেশি খুদে শিক্ষার্থী। সরকারি হিসাবে প্রাথমিক শিক্ষা শেষ করার আগেই প্রায় ৪০ শতাংশ শিশু বিদ্যালয় থেকে ঝরে পড়ছে। প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর পরিচালিত ২০১১ সালের সর্বশেষ জরিপ অনুযায়ী, ২০০৬ ও ২০০৭ সালে প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে শিশুদের ঝরে পড়ার হার ছিল ৫০.৫ শতাংশ, ২০০৮ সালে ৪৯.৩ এবং ২০০৯ সালে ৪৫.১ শতাংশ। ২০১০ সালে পরিচালিত গবেষণায় দেখা গেছে, ঝরে পড়ার হার ৩৯.৮ শতাংশ। এতো গেলো যারা লেখাপড়া শুরু করেছিল তাদের কথা। ঢাকাসহ শহরগুলোর বস্তিতে নগরবাসীর অন্তত ৪০% গরীব মানুষ বাস করে। তাদের অধিকাংশ শিশু ঝুঁকিপূর্ণ শিশুশ্রমে নিয়োজিত। ৭ থেকে ১৪ বছরের ১ কোটি ৫০ লক্ষ শিশু স্কুলে না গিয়ে পরিবারকে সাহায্য করতে শ্রমে নিয়োজিত।
প্রাথমিক শিক্ষায় প্রধান সমস্যাগুলো হচ্ছে পর্যাপ্ত প্রাথমিক বিদ্যালয়ের অভাব, বিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষকের অপ্রতুলতা, বিদ্যালয়গুলোর মধ্যে আর্থিক বৈষম্য, বিদ্যালয়ের অবকাঠামোগত সুযোগ–সুবিধার অভাব, গ্রাম–শহরের বৈষম্য, বেতন–ফি বাবদ ব্যয় নির্বাহ করতে না পেরে ব্যাপক অংশের ঝরে পড়া, বিদ্যালয়ে শিক্ষার আনন্দদায়ক পরিবেশের অভাব, পঠন–পাঠনে নোটবই নির্ভরতা, ইত্যাদি। এ সমস্যাগুলো বেশি বেতনের স্কুল থেকে কম বেতনের স্কুল ও শহর থেকে গ্রামের দিকের স্কুলে পর্যায়ক্রমে বেশি। ধর্মশিক্ষার নামে সাম্প্রদায়িক বিভাজনের নীতি অনুসৃত হচ্ছে। এছাড়া কোমলমতি শিক্ষার্থীদের মননে প্রাথমিক শিক্ষাতেই ধর্মীয় শিক্ষাদানের মাধ্যমে সাম্প্রদায়িকতার বীজ রোপন করা হচ্ছে।
একটি প্রতিযোগিতার আগে সকল প্রতিযোগির জন্য সমান সুযোগ সুবিধা নিশ্চিত করতে হয়। কিন্তু আমাদের দেশে স্কুল ছাত্র–ছাত্রীদের মধ্যে অসম প্রতিযোগিতা বিদ্যমান। স্কুলগুলোর ভৌত কাঠামো, সুযোগ–সুবিধা, শিক্ষকের মান, ছাত্র বেতন ইত্যাদি মৌলিক বিষয়গুলোতে প্রচন্ড বৈষম্য বিদ্যমান। যেমন, ক্যাডেট কলেজের একজন ছাত্রের জন্য সরকারের বার্ষিক ব্যয় প্রায় ৭৪ হাজার টাকা আর সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ের একজন ছাত্র প্রতি বছরে ব্যয় হয় সর্বোচ্চ ২ হাজার টাকা।
প্রাথমিক শিক্ষায় প্রতিবন্ধীদের অংশগ্রহণ এখন পর্যন্ত সীমিত। অতিদরিদ্র পরিবারের শিশু, প্রতিবন্ধী, দলিত সম্প্রদায় ও যৌনকর্মীদের শিশু এবং প্রত্যন্ত ও দুর্গম অঞ্চলে বসবাসকারী শিশুদের ঝড়ে পড়ার হার বেশি। হাওর অঞ্চলের শিশুদের বিদ্যালয়ে যাওয়াই কঠিন। এছাড়া আদিবাসি জনগোষ্ঠীর শিশুরা দুর্গম যোগাযোগব্যবস্থা এবং ভাষাগত সমস্যার কারণে শেষ পর্যন্ত বিদ্যালয় থেকে ঝড়ে যায়। আদিবাসীদের ভাষায় লেখা পাঠ্যপুস্তক থাকলেও বিদ্যালয়গুলোতে তা পড়ানো হচ্ছে না।
প্রাথমিক স্তরে বিষয় হিসেবে ইংরেজি চালু রয়েছে। এ স্তরে এক প্রকার জোর করেই শিক্ষার্থীদের ইংরেজি শিক্ষা দেয়া হয়। আর ইংরেজি শিক্ষাদান পদ্ধতি পুরোপুরি অবৈজ্ঞানিক। আদিবাসীদের এক্ষেত্রে বাংলা, ইংরেজি ও মাতৃভাষাসহ মোট তিনটি ভাষার ধকল সইতে হয়।
সংশ্লিষ্ট শিক্ষকদের দুর্বলতা, সিলেবাস ও পঠন পাঠন পদ্ধতির কারণে গণিতে শিক্ষার্থীরা পিছিয়ে থাকছে। গণিত কারিকুলাম সেকেলে। শিক্ষার্থীরা অনেক সময় গণিত মুখস্থ করে। প্রত্যন্ত অঞ্চলে গণিত শিক্ষকের ব্যাপক সঙ্কট রয়েছে। অন্য বিষয়ের শিক্ষক দিয়ে সেখানে গণিতের ক্লাস নেয়া হয়। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের এক জরিপে দেখানো হয়েছে, ৪৫ শতাংশ গণিতের শিক্ষকেরই বিএসসি ডিগ্রিতে গণিত বিষয় ছিল না।
প্রাথমিক শিক্ষায় শিক্ষক ও শিক্ষার্থী অনুপাত ১:৩৯। উত্তরাঞ্চলে দরিদ্র এলাকায় ও চরাঞ্চলে বেশকিছু স্কুল রয়েছে যেখানে শুধু একজন শিক্ষক এবং একটি মাত্র রুমে প্রথম থেকে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত পাঠদান করা হয়। আরেকটি বড় সমস্যা হচ্ছে মানুষ তৈরীর কারিগর এই শিক্ষকদের মূল্যায়নে উদাসীনতা। শিক্ষকদের বেতন–ভাতার পরিমাণ অত্যন্ত কম হওয়ায় এ পেশায় মেধাবীদের আকৃষ্ট করা যাচ্ছে না এবং একই কারণে যারা শিক্ষকতা করেন তাঁরা প্রাইভেট টিউশনির দিকে ঝুঁকতে বাধ্য হোন। এছাড়া শিক্ষকদের মানসম্মত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থাও নেই।
কোনো পূর্ব প্রস্তুতি ছাড়াই শিক্ষানীতিতে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত প্রাথমিক শিক্ষাকে বর্ধিত করা হয়েছে। এখন পর্যন্ত প্রাথমিক স্কুলগুলোকে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত বর্ধিত করা, প্রয়োজনীয় সংখ্যক শিক্ষক নিয়োগ, উচ্চ বিদ্যালয়গুলোতে প্রাথমিক শাখা চালু করার ব্যবস্থা, প্রধান শিক্ষকের শিক্ষাগত যোগ্যতা নিরুপণ ইত্যাদি বিষয়ে কোনোরকম অগ্রগতি হয়নি বললেই চলে।
মাধ্যমিক শিক্ষায় হ–য–ব–র–ল
নতুন শিক্ষানীতিতে মাধ্যমিক শিক্ষাকে নবম থেকে দ্বাদশ শ্রেণী পর্যন্ত চিহ্নিত করা হয়েছে। দেশে মাধ্যমিক স্তরে ৬টি সাধারণ শিক্ষা বোর্ড, একটি কারিগরি শিক্ষা বোর্ড ও একটি মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ডসহ মোট ৮টি শিক্ষা বোর্ড রয়েছে। শিক্ষা বোর্ডগুলোর বাইরেও বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে পরিচালিত হয় এসএসসি এবং এইচএসসি প্রোগ্রাম। অথচ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষা অন্যান্য শিক্ষা বোর্ডগুলোর সাথে অনুষ্ঠিত হয় না কিংবা ফলাফলও প্রকাশিত হয় না।
শিক্ষাব্যবস্থার করুণ অবস্থার কারণে ধরে রাখা যাচ্ছে না শিক্ষার্থীদের। গতবার প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষায় অংশ নেয় ২১ লাখ ৮৫ হাজার ৭৪৭ জন। ২০১২ সালে ১৪ লাখ ২০ হাজার ৫৭ জন শিক্ষার্থী এসএসসি পরীক্ষায় অংশ নেয়। অর্থাৎ ৭ লাখ ৬৫ হাজার ৬৯০ জন শিক্ষার্থী মাধ্যমিক শিক্ষা কার্যক্রম শেষ করবার আগেই ঝরে গেছে। এইচএসসি পরীক্ষার্থী ছিলো ৯ লাখ ১৭ হাজার ৬৭৩ জন। অর্থাৎ ৫ লাখ ২ হাজার ৩৮৪ জন শিক্ষার্থী শুধু দশম শ্রেণি ও দ্বাদশ শ্রেণি এই দুই বছরের মধ্যে ঝরে গেছে। কাজেই শুধু মাধ্যমিক স্তরেই ঝরে পড়া মোট শিক্ষার্থীর পরিমাণ ১২ লাখ ৬৮ হাজার ৭৪ জন। এখানে সমাপণী, এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষাগুলোর মধ্যকার সময় পার্থক্যের কারণে পরিসংখ্যানে কিছুটা পরিবর্তন ঘটতে পারে। বিভিন্ন গবেষণায় উঠে এসেছে ঝরে পড়ার মূল কারণটি আর্থিক। এছাড়া আরো কিছু কারণ নিয়ে আলোচনা করছি।
উচ্চ মাধ্যমিক স্তরে ভর্তি সঙ্কট স্থায়ী রুপ নিয়েছে। এ বছর এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ শিক্ষার্থীর সংখ্যা ১২ লাখ ১৯ হাজার ৮৯৪ জন। আর ২০০৯ সালের হিসেব অনুযায়ী সারা দেশের মাদ্রাসা ও কারিগরী মাধ্যম ছাড়া উচ্চ মাধ্যমিক স্তরের কলেজগুলোতে সর্বমোট আসন সংখ্যা ৪ লাখ ৬৩ হাজার। যা এবছর বেড়ে সর্বোচ্চ ৫ লাখের কাছাকাছি হতে পারে। ৫ লাখ আসনের বিপরীতে ভর্তিচ্ছু শিক্ষার্থীদের সংখ্যা ৯ লাখ ৪ হাজার ১৪৪ জন। সে হিসেবে প্রায় সোয়া ৪ লাখ শিক্ষার্থী উচ্চ মাধ্যমিক স্তরে ভর্তি হতে পারবে না। আসন সঙ্কট কাটাতে সরকার কিছু নামি স্কুলে একাদশ–দ্বাদশ শ্রেণি চালু এবং কিছু কলেজে নবম–দশম শ্রেণি চালু করেছে। কিন্তু এসব প্রতিষ্ঠানে অবকাঠামোগত সংস্কার ও নতুন চালু করা শ্রেণির জন্য যথেষ্ট শিক্ষক নিয়োগ দেয়া নিয়ে জটিলতা কমেনি। এ ছাড়া শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে গ্রাম শহর বৈষম্য যেমন রয়েছে তেমনি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোকে ভালো খারাপ চিহ্নিত করে ভালোগুলোতে মেধাবীদের ভর্তি হওয়া নিয়ে চলে যুদ্ধ। অপেক্ষাকৃত কম মেধাবীদের সন্নিবেশ ঘটে প্রান্তস্থিত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোকে এভাবে বিভাজিত করে গ্রাম থেকে শহরমুখী প্রবণতা তৈরী করা হচ্ছে।
প্রাথমিক শিক্ষার মতোই বাংলাদেশের মাধ্যমিক শিক্ষাস্তরে মেধাবী ও প্রশিক্ষিত শিক্ষকের যথেষ্ট অভাব রয়েছে। এক্ষেত্রেও শিক্ষকদের বেতন–ভাতা ও স্বীকৃতির অভাব মেধাবীদের এই পেশায় টানছে না। মাধ্যমিক স্তরে বিশেষ করে ইংরেজী ও গণিত শিক্ষকের অপ্রতুলতাই শিক্ষার্থীদের বেশি করে ভোগাচ্ছে।
বিজ্ঞান শিক্ষায় আগ্রহ হারাচ্ছে শিক্ষার্থীরা। ‘বাংলাদেশে মাধ্যমিক পর্যায়ে বিজ্ঞান শিক্ষা‘ নামক গবেষণামূলক একটি বইয়ে উল্লেখিত এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, গত আট বছরে বিজ্ঞান শিক্ষার্থী কমার হার ৩১.৩৩ শতাংশ। ১৯৮৮ সালে এসএসসি পর্যায়ে মোট শিক্ষার্থীর ৪১.৩৫ শতাংশ ছিল বিজ্ঞানের ছাত্রছাত্রী, ১৯৯৫ সালে এই হার দাঁড়িয়েছিল ২৫.৪০ শতাংশ এবং ২০০৮ সালে ২৩.৭৬ শতাংশ। বিজ্ঞান পড়ছে এমন শতকরা ৫৮ জন শিক্ষার্থী মনে করে, বিজ্ঞান বিষয়ে পড়তে খরচ বেশি। শতকরা ৬৫ জন মনে করে বিজ্ঞানে বিষয়ভিত্তিক প্রয়োজনীয় শিক্ষক নেই, ৬৯ জন মনে করে বিজ্ঞানে পড়লে প্রাইভেট পড়তে হয় এবং ৫৭ জন প্রাইভেট পড়ে, ৬৫ জন মনে করে বিজ্ঞানের জন্য আলাদা গবেষণাগার নেই, ৫৮ জন মনে করে ব্যবহারিক ক্লাসে প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি নেই, ৯৪ জন বলেছে কোনো বিজ্ঞান মেলা হয় না।
আমাদের দেশে প্রচলিত পরীক্ষা পদ্ধতিটি শিক্ষার্থীদের প্রকৃত মেধা মূল্যায়ন করতে পারছে না। কোনো পরীক্ষা পদ্ধতির মাধ্যমেই শিক্ষার্থীর শতভাগ সঠিকভাবে মেধা মূল্যায়ন সম্ভব না হলেও বিজ্ঞানভিত্তিক পরীক্ষা পদ্ধতি অনেকটা সঠিকভাবে এই কাজ করতে সক্ষম। আমাদের পরীক্ষা পদ্ধতির কারণে মুখস্থ করতে যারা পারদর্শী তারাই বেশিরভাগ সময় ভালো ফলাফল করে। অনেক প্রকৃত মেধাবীর শিক্ষা জীবন সঠিক মূল্যায়নের অভাবে খারাপ ফলাফল করে পর্যদুস্ত হচ্ছে। প্রচলিত এই পরীক্ষা পদ্ধতির কারণে ছাত্র–ছাত্রীরা অধিক হারে নোট বই ও কোচিং নির্ভর হচ্ছে। আর কিছু অসাধু কোচিং ব্যবসায়ী এর সুযোগ নিচ্ছে।
পাঠ্যবইগুলো পড়লেই বুঝা যায় কোন সরকার ক্ষমতায়। সরকার বদলের সাথে সাথে সরকারি দলের অনুকূলে বইয়ে ভেজাল মিশ্রণ, তথ্যের বিকৃতি সাধন করা হয় অত্যন্ত নগ্নভাবে।
এসএসসি পরীক্ষার কেন্দ্র যে স্কুলগুলো সেগুলোতে মাত্র ৭০ থেকে ৮০ দিন শিক্ষা কার্যক্রম চলে। আর যে সব উচ্চ বিদ্যালয়ে এসএসসি পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়না সেগুলো বছরের মাত্র ১০০ থেকে ১১০ দিন শিক্ষা কার্যক্রম চলে। মন্ত্রণালয় ঘোষিত ছুটি প্রায় ৮৮ দিন, সাময়িক পরীক্ষাগুলোর জন্য সর্বনিম্ন ১২ দিন করে মোট ৪৮ দিন, সাপ্তাহিক ছুটি ৫২ দিন, নভেম্বরে বার্ষিক পরীক্ষা শেষ হলে পুরো ডিসেম্বর মাসই বন্ধ থাকে। ফল প্রকাশের পর সব শিক্ষার্থীর হাতে বই এসে পৌঁছাতে লাগে আরো দেড় থেকে দুই মাসের মতো। এছাড়া এসএসসি পরীক্ষার কেন্দ্র যেসব স্কুল সেগুলোতে আরো অন্তত ১ মাস ক্লাস বন্ধ থাকে। নানা উপলক্ষে অনেক সময় বিদ্যালয় খোলা থাকলেও ক্লাস চলে না। কলেজগুলোতেও প্রায় একই অবস্থা। যেসব কলেজ জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় অধিভুক্ত সেগুলোর অবস্থা আরো করুন। পরীক্ষার জন্য স্বতন্ত্র হল না থাকায় ক্লাস বন্ধ রেখে কলেজের ২টি বর্ষের পরীক্ষা, এইচএসসি পরীক্ষা, অনার্স ৪টি বর্ষের ফাইনাল, ডিগ্রী ৩টি বর্ষের ফাইনাল, মাস্টার্স ২টি বর্ষের ফাইনালসহ ভর্তি কার্যক্রমের দরুন এসব কলেজে ক্লাস হয় না বললেই চলে।
মাদ্রাসা শিক্ষা: দোহাইটা ধর্মের, কারণটা রাজনৈতিক
দেশে মাদ্রাসা শিক্ষার প্রধান দুটো ধারা হলো – আলিয়া ও কওমী। আরো রয়েছে নূরানী মাদ্রাসা, ফোরকানিয়া মাদ্রাসা ও হাফিজিয়া মাদ্রাসা ইত্যাদি। মাদ্রাসা বোর্ডের ২০১২ সালের দাখিল পরীক্ষায় সারা দেশ থেকে দুই লাখ ৭৩ হাজার ৬৫ জন শিক্ষার্থী অংশ নেয়।
কওমী মাদ্রাসাগুলো স্বীকৃত নয়। যদিও বিশ্বব্যাংকের এক গবেষণায় দেখা গেছে দেশের মাধ্যমিক স্তরে পড়ুয়া শিক্ষার্থীর অন্তত ২.২ শতাংশ কওমী মাদ্রাসায় পড়ালেখা করে। গবেষণায় আরো দেখা যায় এই ধারার মাদ্রাসাগুলো বিভিন্ন কওমী বোর্ড দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। এসকল মাদ্রাসাগুলোর পাঠ্যক্রমে একটির সাথে আরেকটির বিস্তর পার্থক্য রয়েছে। ক্ষেত্র বিশেষে কোনো কোনোটিতে বাংলা, বিজ্ঞান, অংক, ইংরেজি পড়ানো হয় না।
আমাদের দেশের প্রেক্ষিতে মাদ্রাসা শিক্ষার বেলায় যে কথাটি সবাই মানেন সেটি হচ্ছে এ ধারার শিক্ষা পদ্ধতিটি অত্যন্ত পশ্চাৎপদ। সচেতন অভিভাবকেরা পারতপক্ষে এ ধারায় তাঁর সন্তানকে পড়াতে চান না। মূলত খরচ কম হওয়ায় বিশেষত গ্রামাঞ্চলের অস্বচ্ছল পরিবারের সন্তানরা ও এতিম ছেলে মেয়েরা এই মাধ্যমে পড়তে বাধ্য হয়। আবার পরকালে মুক্তির আশায় কোনো কোনো অভিভাবক তাঁর অন্তত একটি সন্তানকে মাদ্রাসায় পড়ান।
১৯৮৬ সালে দাখিল ও আলিম স্তরকে যথাক্রমে এসএসসি ও এইচএসসির সমমান দেয়া হয়। তারপর ২০০৬ সালে ফাজিল ও কামিল স্তরকে যথাক্রমে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর সমমান প্রদান করা হয়। এগুলো মাদ্রাসা শিক্ষার্থীদের সাথে একধরনের প্রতারণা এবং এটি ছিলো ভোটের রাজনীতি। কারণ শুধু সমমান দিলেই মাদ্রাসা শিক্ষার্থীরা সাধারণ শিক্ষার্থীদের মত যোগ্যতর হয়ে যায় না। মাদ্রাসা শিক্ষা সাধারণ শিক্ষা ব্যবস্থা থেকে অনেক পিছিয়ে। মাদ্রাসা শিক্ষায় মূলত পাঠ্যপুস্তক ও সিলেবাসের আধুনিকীকরণ করে ধীরে ধীরে এ মাধ্যমটিকে সাধারণ শিক্ষার সাথে একীভূত করলে এর শিক্ষার্থীরা সকল পেশার জন্য নিজেদের যোগ্যতর হিসেবে তৈরী করার সুযোগ পাবে। ঠিক তখনই সমমান দেয়াটা মাদ্রাসা শিক্ষার্থীদের কাজে আসবে। মাদ্রাসায় আধুনিক জ্ঞান বিজ্ঞান চর্চার মাধ্যমে চিন্তায় চেতনায় সমাজ গড়ার কারিগর তৈরী হবে। এবং সমাজের অভ্যন্তরে বিরাজমান সাম্প্রদায়িক সমস্যারও বিলোপ সাধন ত্বরান্বিত হবে।
দেশের বেশিরভাগ মাদ্রাসাতেই জাতীয় পতাকা উত্তোলন ও জাতীয় সংগীত গাওয়া হয় না। পাঠ্যসূচিতে জাতীয় ঐতিহ্য, সংস্কৃতি ও মুক্তিযুদ্ধের মূল্যবোধ সম্পর্কিত পড়া খুবই কম। আমাদের দেশের মাদ্রাসা শিক্ষা এখনও পুরোপুরি ধর্ম শিক্ষা নির্ভর। মাদ্রাসাগুলোর পাঠ্যপুস্তক ও সিলেবাসগুলো আধুনিক জ্ঞান–বিজ্ঞানের অনুকূল না হওয়ায় এখানকার শিক্ষার্থীরা ধর্মীয় গোঁড়ামি, কুসংস্কারাচ্ছন্নতা, কূপমণ্ডুকতা থেকে বের হতে পারে না। এবং এরাই ধর্ম নির্ভর রাজনৈতিক দল ও ব্যক্তির শক্তি যোগানদাতা হিসেবে ব্যবহৃত হয়।
এছাড়া হাজার হাজার জাল রেজিস্ট্রেশনের মাধ্যমে বোর্ড পরীক্ষা দেয়া, মুখস্থ ও নকলের ছড়াছড়ি, শিক্ষকদের বিভিন্ন অসামাজিক কর্মকাণ্ডে লিপ্ত হওয়া, ছাত্রদের শারিরীক ও যৌন নির্যাতনের মত ঘটনাগুলো মাদ্রাসা শিক্ষার ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন করছে।
কারিগরি শিক্ষা: নিগ্রহের শিকার
কারিগরি শিক্ষা অধিদফতরের হিসেবে, দেশে এখন সরকারি পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট আছে ৪৯ টি, ভোকেশনাল ইনস্টিটিউট আছে ৬৪টি। কারিগরি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র, বস্ত্র প্রকৌশল ও কৃষি ইনস্টিটিউট সহ মোট ২৫১ টি প্রতিষ্ঠান রয়েছে। এই বোর্ডে এসএসসি পরীক্ষায় এ বছর মোট ৯১ হাজার ১৭০ জন পরীক্ষা দিয়েছে।
বাংলাদেশ ও জার্মানির বিভিন্ন কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ১৬০ জন করে শিক্ষার্থীর ওপর ২০০৯ সালের জুলাই থেকে ২০১০ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত প্রায়োগিক গবেষণা চালিয়ে দেখা যায় দক্ষতা নিরুপণে বিভিন্ন পরীক্ষায় বাংলাদেশের শিক্ষার্থীরা জার্মানির শিক্ষার্থীদের প্রাপ্ত নম্বরের এক–চতুর্থাংশ পেয়েছে। গবেষণায় মুখস্থ করে মনে রাখা, বোঝা, এবং প্রয়োগ এই তিনটি ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীদের দক্ষতা যাচাই করা হয়েছে। মনে রাখার ক্ষেত্রে বাংলাদেশের শিক্ষার্থীরা ভালো করলেও পরবর্তী দুটি পর্যায়ে, অর্থাৎ বোঝা ও প্রয়োগ করার ক্ষেত্রে ভালো করতে পারেনি। পাঁচ বছরের প্রশ্নপত্র বিশ্লেষণ করে ওই গবেষণায় দেখা গেছে, বাংলাদেশে প্রশ্নপত্র প্রণয়নের ক্ষেত্রে তাত্ত্বিক বিষয়ে প্রাধান্য দেওয়া হয়। অন্যদিকে জার্মানির ছাত্রদের যাচাইয়ের ক্ষেত্রে ব্যবহারিক দিকটাই প্রাধান্য পায়।
বাংলাদেশে সবচেয়ে উপেক্ষিত শিক্ষা হচ্ছে কারিগরি শিক্ষা। এ শিক্ষায় শিক্ষিতের হার মাত্র ৩ শতাংশ। অথচ উন্নত দেশগুলোতে কারিগরি শিক্ষায় শিক্ষিতের হার ৪০ থেকে ৬০ শতাংশ। দেশের কারিগরি শিক্ষা খুবই নাজুক অবস্থায় গিয়ে পৌঁছেছে। প্রশিক্ষণ কেন্দ্রগুলোতে যে সকল বিষয়ে হাতেকলমে শিক্ষা দেয়া হচ্ছে তা একেবারেই বাস্তবতাবিবর্জিত। ওই শিক্ষা না দেশে না বিদেশে কোথাও কোনো কাজে আসছে না। ফলে কারিগরি শিক্ষার প্রতি ছাত্রছাত্রীরা আগ্রহ হারিয়ে ফেলছে।
উৎপাদনমুখী ও স্বনির্ভর অর্থনীতির জন্য দরকার দক্ষ জনশক্তি। আমাদের দুর্ভাগ্য আমাদের অর্থনীতি মোটেও উৎপাদনমুখী নয়। উৎপাদনমুখিতা না থাকায় কারিগরি শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য থাকে বিদেশে দক্ষ শ্রমিক পাঠিয়ে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করা। অথচ বিদেশ গমনেচ্ছু বিশাল একটি অংশই কিন্তু অদক্ষ শ্রমিক। এই অংশকেও সঠিকভাবে কারিগরি শিক্ষার আওতায় আনা যাচ্ছে না।
কারিগরি শিক্ষায় অন্যতম সমস্যা হচ্ছে তীব্র শিক্ষক সঙ্কট এবং নিম্নমানের শিক্ষা ব্যবস্থা। কারিগরি শিক্ষা অধিদফতরের সূত্রমতে, স্থায়ী অস্থায়ী মিলিয়ে বর্তমানে পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটগুলোতেই ৪৬ শতাংশ শিক্ষকের পদ শূন্য রয়েছে। অন্যদিকে ভোকেশনাল ইনস্টিটিউটগুলোতে শিক্ষকদের শূন্য পদ ৬৪ শতাংশ। লোকবল সংকটও চরম। তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীর পদেও ৫৬ শতাংশ খালি রয়েছে।
বিজ্ঞান শিক্ষার সমান্তরালভাবে কারিগরি শিক্ষার বিস্তার ছাড়া আধুনিক বিশ্বের সাথে প্রতিযোগিতায় আমরা টিকে থাকতে পারবো না। কিন্তু এই শিক্ষা নিয়ে এক ধরনের অবহেলা দৃশ্যমান। মেধাবীদের আকৃষ্ট করার জন্য কোনো পদক্ষেপ নেই। অভিভাবক মহলে বরং এক ধরনের নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি বিদ্যমান।
উচ্চ শিক্ষা: বিলেতি প্রভুরা যেমনটা চায়
বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) ২০১০ সালের প্রতিবেদনে দেখা যায় ৩০টি সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের মোট আসন সংখ্যা রয়েছে প্রায় ৩৫ হাজার। এছাড়া জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন বিভিন্ন বিষয়ে আসন রয়েছে সর্বমোট ৩ লাখ ৬৯ হাজার ৮৫৪টি। ইউজিসির বার্ষিক প্রতিবেদন অনুযায়ী ৫১টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে মোট আসন সংখ্যা ১ লাখ ১৪ হাজার ৫১২টি। দেশের সরকারি–বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিকেল কলেজ ও মাদ্রাসা সব মিলিয়ে উচ্চ শিক্ষায় আসন সংখ্যা ৫ লাখের কিছু বেশি। এ বছর ১০ শিক্ষা বোর্ডে এইচএসসি/সমমান পরীক্ষায় পাস করেছে ৭ লাখ ২১ হাজার ৯৭৯ জন। এ হিসেবে ২ লাখ শিক্ষার্থী শুধু আসন সংকটের কারণেই উচ্চ শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হবে।
বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের ২০০৯ সালের বার্ষিক প্রতিবেদনে বলা হয়, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মূল কাজ হলো শিক্ষা, গবেষণা, ও নতুন জ্ঞান সৃষ্টি করা এবং মানবজাতির কল্যাণে তার বিস্তার ঘটানো। কিন্তু সে কাজ এবং শিক্ষার মানোন্নয়নের ক্ষেত্রে দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো অনেকাংশে ব্যর্থ হচ্ছে। এর কারণগুলোর মধ্যে আছে গবেষণা কার্যক্রমের স্বল্পতা, ত্রুটিপূর্ণ নিয়োগ–প্রক্রিয়া, শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর অসম অনুপাত, শিক্ষকদের কম মনোযোগ, গবেষণা ও শিক্ষা আনুষঙ্গিক খাতে অল্প বরাদ্দ।
১৯৯২ সালে বাংলাদেশ সরকার General Agreement on Trade in Services (GATS)এ স্বাক্ষর করার মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় সেবাখাতসমূহকে বেসরকারি পুঁজি বিনিয়োগের ক্ষেত্র হিসেবে অবারিত করেছে। শিক্ষা ও স্বাস্থ্যে বিনিয়োগ অধিকতর লাভজনক ও নিরাপদ। মূলত উচ্চশিক্ষাকে ঘিরে এই বাণিজ্যটি চলছে। আমাদের উচ্চশিক্ষা হয়েছে মুনাফার মাধ্যম এবং ছাত্ররা এখান থেকে শিক্ষা কিনে নিতে বাধ্য হয়। আর তাই আমাদের উচ্চশিক্ষা দিনে দিনে ধনীদের কুক্ষিগত হচ্ছে এবং গরীব মেধাবীরা উচ্চশিক্ষায় প্রবেশের সুযোগ পাচ্ছে না। আমাদের দেশে শিক্ষা নিয়ে এই বাণিজ্যিকায়ন ঘটছে দুটি উপায়ে– প্রথমতঃ প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করে সরাসরি বাণিজ্য করা হচ্ছে, দ্বিতীয়তঃ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ভর্তি ফরমের মূল্য বৃদ্ধি, বেতন–ফি বৃদ্ধির মাধ্যমে ধীরে ধীরে এগুলো থেকে সরকারি ভর্তুকি কমিয়ে ছাত্র বেতন নির্ভর করে ফেলা হচ্ছে। এভাবে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর বেতন–ফির পরিমাণ ধীরে ধীরে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় সমান করা। এবং পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় তৈরী না করে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে বাণিজ্যের অবাধ সুযোগ তৈরী করা। দ্বিতীয় উপায়ে হুট করে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে প্রাইভেটাইজেশন করা সম্ভব নয়। তাতে করে ছাত্র অসন্তোষ তৈরী হবে। তাই বিভিন্ন কৌশলে ধীরে ধীরে এটি বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। যার একটি হচ্ছে বিশ্বব্যাঙ্কের পরামর্শে করা ইউজিসি’র ২০ বছর মেয়াদী কৌশলপত্র। “উচ্চ শিক্ষার ২০ বছর মেয়াদী কৌশলপত্র” বিশ্বব্যাংকের পরামর্শে ইউজিসি প্রণয়ন করে বিএনপি আমলে। বিশ্বব্যাংক এই খাতে ১৪০০ কোটি টাকা ঋণ দিয়েছে। ছাত্র অসন্তোষের আশঙ্কাকে মাথায় রেখে কৌশলপত্রে চার পর্বে উচ্চশিক্ষার ‘সংস্কার‘ বাস্তবায়নের পরামর্শ দিয়েছে মঞ্জুরি কমিশন। প্রস্তাবিত চার পর্ব হচ্ছেঃ প্রাথমিক পর্ব ২০০৬–২০০৭, স্বল্পমেয়াদী ২০০৮–২০১৩, মধ্যমেয়াদি ২০১৪–২০১৯ ও দীর্ঘমেয়াদী ২০২০–২০২৬। কি আছে কৌশলপত্রে তা আমাদের জানা দরকার:
মঞ্জুরি কমিশনের ২০ বছর মেয়াদী কৌশলপত্রে বলা হয়েছে, ‘সরকার আগামী ২০ বছরে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বরাদ্দ ৯০% থেকে কমিয়ে ৭০% এ হ্রাস করার পরিকল্পনা করতে পারে। অর্থায়নের শূন্যতা পূরণের জন্য নিজস্ব অর্থের উৎস তৈরী করা উচিত। ছাত্র ঋণের নতুন প্রকল্প প্রবর্তন করতে হবে।’ ২০০৮ থেকে ২০২৬ সাল পর্যন্ত মোট ৩টি ধাপে বেতন বৃদ্ধি করা হবে। ২০২৬ সালের মধ্যে সকল পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় পরিণত হবে বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ে। মঞ্জুরি কমিশনের কৌশলপত্রে দেশি–বিদেশী ব্যাংকগুলোর কাছ থেকে শিক্ষার্থীদের ঋণ নেয়ার পরামর্শ দেয়া হয়েছে।কৌশলপত্রে শিক্ষাকে একটি লাভজনক বিনিয়োগ হিসাবে দেখা হয়েছে। মৌলিক জ্ঞান অনুসন্ধান এবং বিজ্ঞান শিক্ষা হয়েছে উপেক্ষিত। বিজ্ঞান, কৃষি, সাহিত্য, ইতিহাস, দর্শনের মতো অপরিহার্য বিষয়গুলোকে উচ্চশিক্ষা থেকে সরিয়ে ফেলা হচ্ছে কৌশলে।
কৌশলপত্রে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে আবাসিক হল নির্মাণ না করার সুপারিশ করা হয়েছে।
কৌশলপত্রে ছাত্র রাজনীতি বন্ধের সুপারিশ করা হয়েছে। মূলত কৌশলপত্র বাস্তবায়নে যাতে কোনো ছাত্র আন্দোলন তৈরী হতে না পারে সেজন্যই এই সুপারিশ। অজুহাত হিসেবে দেখানো হয়েছে শিক্ষাঙ্গনে সন্ত্রাস, দখলদারিত্ব, লেজুড়বৃত্তি ইত্যাদি কারণকে। যদিও এটা সবারই জানা ছাত্রলীগ–ছাত্রদল–ছাত্রশিবির যারা এসব অপরাজনীতি করে তাদের এসকল ছাত্র সমস্যা নিয়ে ভাববার সময় নেই।
২০ বছর মেয়াদী কৌশলপত্র বাস্তবায়নে হাতে নেয়া হয়েছে HEQEP (Higher Education Quality Enhancement Project) প্রকল্প। বিশ্বব্যাঙ্ক এর আওতায় ১০ বছর করে ৪ কিস্তিতে সর্বমোট ৮১ মিলিয়ন মার্কিন ডলার ঋণ দিবে। বিশ্বব্যাঙ্কের অর্থায়নে আফ্রিকা ও লাতিন আমেরিকায় চলা কিছু দেশের শিক্ষা ব্যবস্থার নমুনা দেখলে আশঙ্কিত না হয়ে পারা যায় না। HEQEPএর অধীনে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে যেসকল প্রকল্প হাতে নেয়া হচ্ছে সেগুলো কতখানি আমাদের দেশের বিদ্যমান অবস্থার উপযোগী সেটি নিয়ে প্রশ্ন থেকে যায়। আবার ব্যক্তি মুনাফার উৎস হিসেবে ব্যবহৃত হওয়া বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে এই ঋণের আওতায় কোন যুক্তিতে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে সেটিও পরিস্কার নয়।
PPP (Pubic Private Partnership)এর মাধ্যমে উচ্চশিক্ষার সম্প্রসারণের কথা বলা হলেও মূলত শিক্ষা বাণিজ্যই উৎসাহিত হচ্ছে। শিক্ষাকে একটি লাভজনক পণ্যে রুপান্তর করা হচ্ছে।
উচ্চশিক্ষায় বিজ্ঞান শিক্ষার প্রতি আগ্রহ হারাচ্ছে শিক্ষার্থীরা। চাকুরি স্বল্পতাই এর মূল কারণ বলছেন বিশেষজ্ঞরা। আইনস্টাইনের মতে, যদি কাউকে একদমই আয়–রোজগারের কথা চিন্তা করতে না হয় তাহলে তার জন্য বিজ্ঞান অবশ্যই আশীর্বাদস্বরূপ। ২০১০ সালে প্রকাশিত ইউজিসির প্রতিবেদনে দেখা যায় ৩১টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত মোট ১৫ লাখ ৭২ হাজার ৪৭৪ জন শিক্ষার্থীর মধ্যে কলা ও মানবিক বিষয়ে অধ্যয়নরত শিক্ষার্থীর সংখ্যা ৫ লাখ ৩১ হাজার ২০৭ জন, সামাজিকে ২ লাখ ৩৭ হাজার ৬৯৮ জন, বিজ্ঞান, কৃষি ও কারিগরি ক্যাটাগরিতে ৩ লাখ ৩ হাজার ৫৪২ জন, বাণিজ্যে ৪ লাখ ৬২ হাজার ৫৫৪ জন, আইনে ৩১ হাজার ৮৫২ জন, এবং ডিপ্লোমা/সার্টিফিকেট কোর্সে ৫ হাজার ৬২১ জন। এসব শিক্ষার্থীর বেশিরভাগই জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন কলেজ ও ইন্সটিটিউটে অধ্যয়নরত। আবার এক্ষেত্রে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্দেশ্য সম্পূর্ণ বাণিজ্যিক। বাজারের চাহিদা অনুযায়ী ব্যবসায়িক স্বার্থে তারা বাণিজ্য বিষয়কে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে।
দেশের পাবলিক–প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে ১২ টি পাবলিক ও ৪২টি প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় রাজধানীসহ ঢাকা অঞ্চলে অবস্থিত। যা আঞ্চলিকভাবে বৈষম্যপূর্ণ ও সুষম শিক্ষা বিস্তারে অন্তরায়।
উচ্চশিক্ষায় নারীদের অংশগ্রহণ কম। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) সর্বশেষ প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়, ৩১টি সরকারি ও স্বায়ত্ত্বশাসিত বিশ্ববিদ্যালয়ে ২০০৭ সালে শিক্ষার্থী ছিলো ১৩ লাখ ৮২ হাজার ২১৬ জন। যার মধ্যে ছাত্রী ছিলো ৫ লাখ ৫২ হাজার ৯৮৮ জন (৪০ শতাংশ)।
পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়: নৈরাজ্যের প্রতীক
ঢালাও দলীয়করণ ও সরকারি হস্তক্ষেপের কারণে শিক্ষাঙ্গনে অস্থিরতা বিরাজ করছে। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর স্বায়ত্বশাসন নেই বললেই চলে। কোনো বিশ্ববিদ্যালয়েই নির্বাচিত উপাচার্য নেই। বুয়েট উপাচার্যের দলীয় বিবেচনাপ্রসূত কাজ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেট কর্তৃক পদ্মা সেতু প্রকল্পে কোটি টাকা দেয়ার সিদ্ধান্ত ইত্যাদি ঘটনা নির্লজ্জ দলীয় দাসবৃত্তির পরিচায়ক। যে দল ক্ষমতায় থাকে সে দলের সমর্থক শিক্ষকরা প্রশাসনিক কর্তৃত্ব পান। প্রশাসন ও শিক্ষকদের মধ্যে বিরোধ পরিলক্ষিত হয় প্রায় সবগুলো পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে।
পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো কেমন চলছে তা বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন বা ইউজিসি তাদের সর্বশেষ যে বার্ষিক প্রতিবেদন তৈরী করে সেটি দেখলেই বুঝা যায়। নিচে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে ইউজিসির মূল্যায়ন তুলে ধরা হলো:
কোনো পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে নির্বাচিত উপাচার্য নেই। শিক্ষক ও কর্মকর্তা–কর্মচারী নিয়োগের ক্ষেত্রেও রয়েছে বিস্তর অনিয়মের অভিযোগ। যে দলই ক্ষমতায় যাক, দেখা যায় নানাভাবে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে নিজেদের স্বার্থে নিয়ন্ত্রণে রাখতে চায়।
দলীয় রাজনীতির প্রভাবে একাডেমিক ও প্রশাসনিক কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে। “ত্রুটিপূর্ণ নিয়োগ পরীক্ষা” শিক্ষার মানের অবনতির অন্যতম কারণ। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর বর্তমান ভর্তি প্রক্রিয়া ব্যয়বহুল ও জটিল।পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন কার্যক্রমের প্রকল্পভিত্তিক কাজের হালচাল অত্যন্ত করুন। উদাহরণস্বরূপ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি প্রকল্পের উদাহরণ দেয়া যেতে পারে। শিক্ষার গুণগতমান এবং অবকাঠামোগত উন্নয়ন শীর্ষক আমব্রেলা প্রকল্পের আওতায় ২৫৫৭.৫৩ লাখ টাকা ব্যয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাব প্রকল্পের অনুকূলে ২০১০–১১ অর্থবছরের এডিপিতে ৭০০.৫৩ লাখ টাকা বরাদ্দ করা হয়েছিলো। যা দিয়ে একাডেমিক ভবন নির্মাণ, একটি লিফট ক্রয় এবং কন্টিনজেন্সি খাতে ব্যয়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়। বাস্তবে কাজের অগ্রগতি হয়েছে মাত্র ১৩ দশমিক ৭০ শতাংশ। এভাবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিটি প্রকল্পের অগ্রগতি নির্ধারিত সময়ের মধ্যে ৭ শতাংশ, ১০ শতাংশ এর বেশি এগোয়নি। সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষেত্রে ঠিক একই দৃষ্টান্ত উল্লিখিত হয়েছে।
জাতীয় ও উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় ব্যতীত ২৯টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম বর্ষের আসন সংখ্যা ডিপ্লোমা ও সার্টিফিকেটসহ ৫৬ হাজার ১৯২টি। ভর্তিকৃত শিক্ষার্থীর সংখ্যা ৫৮ হাজার ১৭০ জন। আসন সংখ্যার অতিরিক্ত ভর্তি করা হয় ১ হাজার ৯৭৮ জন। এখানে সব সময়ের জন্যই একটি স্থায়ী বিশৃঙ্খল অবস্থা বিরাজ করছে।
বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শিক্ষক–শিক্ষার্থীর আনুপাতিক হার অনুকূল হলে গুণগত মানসম্পন্ন শিক্ষা নিশ্চিত করা সম্ভব হয়। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর এ হার সন্তোষজনক নয়। এখানে জাতীয় ও উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় বাদ দিলে ২৯টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে বিগত তিন বছরের শিক্ষক শিক্ষার্থীর অনুপাত ১:০৪ থেকে ১:৫১। অপেক্ষাকৃত নতুন বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষক সঙ্কট বেশি। সবচেয়ে বেশি শিক্ষক সংকট রয়েছে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় ও বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে। তাদের শিক্ষক শিক্ষার্থীর অনুপাত ১:৫১।
দেশের কতিপয় পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে একাডেমিক সেশন আশঙ্কাজনকভাবে পিছিয়ে পড়েছে। অনাকাঙ্খিত ও অনভিপ্রেত এ সেশন জটের কারণে একদিকে শিক্ষার্থী ও তাদের অভিভাবকরা যেমন আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছেন, অন্যদিকে সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় সম্পদেরও প্রচুর অপচয় ঘটছে।
ভর্তি পরীক্ষা অত্যন্ত ব্যয়বহুল। ভর্তি পরীক্ষাগুলো কেবলমাত্র বোর্ড পরীক্ষার একটি অতি সংক্ষিপ্ত রুপ এবং এ পরীক্ষার গুণগত মান বর্তমানে প্রশ্নবিদ্ধ। এছাড়া বর্তমান পদ্ধতিতে বেশির ভাগ শিক্ষার্থীকে ৬ থেকে ১০টি ভর্তি পরীক্ষায় অবতীর্ণ হতে হয় এবং এর জন্য তারা দীর্ঘ সময়ের কোচিং সেন্টারের শরণাপন্ন থাকে। মানসিক চাপ ও একই বিষয়বস্তু নিয়ে দীর্ঘকাল অধ্যয়নরত থাকার ফলে তাদের সৃজনশীলতা বহুলাংশে হ্রাস পায়।
পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো কোনো শিক্ষক অনিয়ন্ত্রিত ও অপরিকল্পিতভাবে অন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে খণ্ডকালীন শিক্ষকতা বা প্রাইভেট কনসালটেন্সি করার কারণে নিজ নিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক কার্যক্রম অনেকাংশে ব্যাহত হচ্ছে।
বিশ্ববিদ্যালয়সমূহে গবেষণা খাতে বরাদ্দ নেই বললেই চলে। গবেষণা নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর দৃষ্টিভঙ্গি কেমন তা পরিষ্কার হয়ে যায় যখন দেখা যায় চুয়েটের উপাচার্যের ব্যক্তিগত গাড়ির জন্য বরাদ্দ দেয়া হয় ৭৬ লাখ টাকা। অথচ সেই একই বাজেটে গবেষণায় মাত্র ২০ লাখ টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়।
২০০৭ সালে ইউজিসি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়সমূহকে নিয়ন্ত্রণের জন্য অভিন্ন একটি আইনের (আমব্রেলা এক্ট) প্রস্তাবনা তৈরী করেছে যা বিশ্ববিদ্যালয়ের সায়ত্তশাসনের সাথে সাংঘর্ষিক। মঞ্জুরি কমিশন নিজেই এটি স্বীকার করেছে এই বলে যে, “নীতিবিরোধি হলেও কাজের সুবিধার্থে এ অধ্যাদেশ প্রবর্তন করা হচ্ছে।” যে বিষয়গুলো আমব্রেলা এক্টের অধীনে প্রস্তাব করা হয় সেগুলো হলো:
রাষ্ট্রপ্রধানকে আচার্য করা। এই ধারা অন্তর্ভুক্তির মাধ্যমে মূলত বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে সরকারি নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। কারণ কোনো রাষ্ট্রপতি তাঁর নিজ দলীয় সিদ্ধান্তের বাইরে যাবার সাংবিধানিক অধিকার নেই। এছাড়া একজন রাষ্ট্রপতি সবসময় যোগ্য আচার্য হবেন সেরকম ভাবনা কোনোভাবেই যুক্তিসঙ্গত নয়।
আমব্রেলা এক্টের কিছু ধারা কর্তৃক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর একাডেমিক, প্রশাসনিক ও আর্থিক বিষয়গুলোতে মঞ্জুরি কমিশনের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার প্রয়াস চালানো হয়েছে।
দলীয় বিবেচনায় উপাচার্য নিয়োগের জন্য সার্চ কমিটিকে (যাদের দ্বারা মনোনিত তিন জনের প্যানেল থেকে রাষ্ট্রপতি/আচার্য একজনকে নিয়োগ দেবেন) সরকারি দলের ইচ্ছেমতো গঠন করার চেষ্টা চালানো হয়েছে। আচার্য কর্তৃক গঠিত ৫ সদস্য বিশিষ্ট সার্চ কমিটিতে থাকবেন একজন সাবেক উপাচার্য, মঞ্জুরি কমিশনের চেয়ারম্যান, একজন সিনিয়র শিক্ষাবিদ ও দুই জন অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি। রাষ্ট্রপতি/আচার্য কর্তৃক এদের সকলেই যে দলীয় বিবেচনায় সার্চ কমিটিতে স্থান পাবেন তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
আমব্রেলা এক্টের প্রস্তাব অনুযায়ী ১৭ সদস্য বিশিষ্ট সিন্ডিকেটের ৮ জনই মনোনীত হবেন সরাসরি রাষ্ট্রপতি/আচার্য কর্তৃক। এভাবে সিন্ডিকেটকেও সরাসরি নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা চালানো হচ্ছে। এছাড়া শিক্ষকদের ও ছাত্র সংসদ নির্বাচন বন্ধ রেখে সিনেটে ছাত্রদের অংশগ্রহণের সুযোগ বন্ধ করে বেশিরভাগ বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেটকে প্রায় অকার্যকর রাখা হয়েছে।
মূলত ইউজিসি’র কৌশলপত্রের (২০০৬–২০২৬) পূর্ণ বাস্তবায়নে অর্থাৎ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর স্বায়ত্তশাসন খর্ব করে ও উচ্চশিক্ষাকে উচ্চ মূল্যের পণ্যে পরিণত করে সাধারণের নাগালের বাইরে নিয়ে যাওয়াই এই আমব্রেলা এক্টের লক্ষ্য বললে ভুল হয় না।
জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়: সর্বাঙ্গে ব্যথা ওষুধ দেবো কোথা
জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের সংকট বুঝাতে বলতে হয়, সর্বাঙ্গে ব্যথা ওষুধ দেবো কোথা? উচ্চ শিক্ষার প্রসারে ও পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের অভাবে ১৯৯২ সালে ৪৫০টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান নিয়ে যাত্রা শুরু করে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়। বর্তমানে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত কলেজ রয়েছে ২ হাজার ২১৬টি। প্রথম বর্ষে ভর্তি হতে পারে প্রায় ৩ লাখ ৭০ হাজার শিক্ষার্থী। একসাথে প্রায় ১২ লাখ শিক্ষার্থী এই বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত। এ বিশ্ববিদ্যালয় দেশের উচ্চশিক্ষার শতকরা ৮০ ভাগ দায়িত্ব পালন করে থাকে।
জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় ২০১২ সালে যাদের অনার্স ফাইনাল রেজাল্ট দিয়েছে তাদের প্রত্যেকের সনদ পত্রে লিখা হয়েছে যে তারা ২০০৯ সালে পাস করেছে!!! এই তিন বছর নষ্টের দায় কার? জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে সেশন জট একটি গুরুতর সমস্যা। এখান থেকে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর পাশ করতে একজন শিক্ষার্থীর জীবনের মূল্যবান ৭–৮টি বছর চলে যায়। ২০০৫–০৬ শিক্ষাবর্ষে ভর্তি হওয়া এক শিক্ষার্থীর পাঠ ২০১২ সালেও শেষ হয়নি। ভর্তি পরীক্ষা, ক্লাস, পরীক্ষা, ফল প্রকাশ কোনো কিছুই সময়মতো হয় না। এসবের কারণে শিক্ষা গ্রহণে শিক্ষার্থীদের আগ্রহ থাকে না। প্রচুর শিক্ষার্থী এসময় ঝড়ে যায়। শিক্ষার্থীরা চরম হতাশায় ভোগে। অনেকে বিভিন্ন পেশার সাথে যুক্ত হয়। এসময়টাতে আয়ের উদ্দেশ্যে বিভিন্ন ফটকা কারবারে জড়িয়ে পড়ে শিক্ষার্থীরা। এমএলএম, শেয়ার বাজার ইত্যাদিতে বিনিয়োগ করে। আবার অল্প বয়সেই এরা সর্বস্ব হারায়। অনেকে অসামাজিক কর্মকাণ্ডে নিজেকে জড়িয়ে ফেলে।
নানা অনিয়ম ও দূর্নীতির বেড়াজালে বন্দী জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়। প্রায় প্রতিটি উপাচার্যের বিরুদ্ধেই ছিলো দূর্নীতির হাজারো অভিযোগ। কিন্তু কোনোটিরই সুষ্ঠু তদন্ত ও বিচার হয়নি। নিয়োগে অনিয়ম, দলীয়করণ সহ চলছে চরম নৈরাজ্য। হাইকোর্টের রায়ে সর্বশেষ চারদলীয় জোট সরকারের আমলসহ পরবর্তীতে সকল নিয়োগকে অবৈধ ঘোষণা করা হয়। কিন্তু বর্তমান মহাজোট সরকার সে ঘোষণার আংশিক বাস্তবায়ন করে নিজ দলীয়দের চাকরিচ্যুত করেনি।
পরীক্ষার হলের অভাবে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় অধিভুক্ত কলেজগুলোতে ডিগ্রী, অনার্স, মাস্টার্স শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষার্থীরাও শ্রেণীকক্ষ সংকটে ভোগে। ক্লাস হয় না বললেই চলে। বছরে সব মিলিয়ে ৮০–৯০ দিন মাত্র ক্লাস হয়। এ কারণে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের প্রাইভেট পড়ার উপর নির্ভর করতে হয়।
জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনস্থ কলেজগুলোর মধ্যে সরকারি কলেজ রয়েছে মাত্র ২৫৩টি। বাকি কলেজগুলো বেসরকারি অধিভুক্ত কলেজ। কলেজগুলোতে ভর্তি, শিক্ষার্থী নিবন্ধন, কোর্স কারিকুলাম নির্ধারণ, পরীক্ষা গ্রহণ ও সনদপত্র প্রদানসহ সব কার্যক্রম এ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে পরিচালিত হয়। অথচ বেসরকারি কলেজগুলোতে শিক্ষক নিয়োগ, শিক্ষকদের বদলি, অধ্যক্ষ নিয়োগ, অবকাঠামোগত উন্নয়নসহ কোনো কিছুই এ বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়ন্ত্রণে নেই। সরকারি কলেজের শিক্ষক নিয়োগ হয় পাবলিক সার্ভিস কমিশন পরিচালিত বিসিএস পরীক্ষার মাধ্যমে। এসব শিক্ষকদের বদলি নিয়ন্ত্রণ করে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদফতর (মাউশি)। অন্যদিকে বেসরকারি কলেজসমূহে শিক্ষক নিয়োগ, অবকাঠামো নির্মাণসহ সার্বিক পরিচালনার নিরঙ্কুশ ক্ষমতা কলেজ পরিচালনা পর্ষদের। অবশ্য শিক্ষক নিয়োগ কমিটিতে একজন বিষয় বিশেষজ্ঞ (সাবজেক্ট স্পেশালিস্ট) থাকেন মাত্র। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই যার ক্ষমতা গৌণ।
বর্তমানে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত এমন কোনো কলেজ খুঁজে পাওয়া যাবে না, যেখানে শিক্ষক সংকট নেই।
জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় অধিভুক্ত সংক্রান্ত সংশোধন রেগুলেশন ২০০০–এর ৩(১) এ বলা আছে, ‘কোনো কলেজে কোনো বিষয়ে ডিগ্রি (পাস ও অনার্স) এবং স্নাতকোত্তর কোর্স থাকলে উক্ত বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের রেগুলেশন অনুযায়ী শিক্ষাগত যোগ্যতা এবং অভিজ্ঞতাসম্পন্ন ১২ জন শিক্ষক/শিক্ষিকা কর্মরত থাকতে হবে।‘ কোনো কলেজই এ নিয়মটি মানছে না। শহরের কলেজগুলোর চাইতে গ্রাম ও মফস্বলের কলেজগুলোর দশা আরো করুন। সেখানে প্রতি বিভাগে ৩–৪ জন শিক্ষক দিয়ে জোড়াতালি দিয়ে কোনোভাবে ক্লাস নেয়া হচ্ছে। এছাড়া শিক্ষকদের বেতন ভাতা নিয়ে রয়েছে অসন্তোষ।
শিক্ষার্থীদের আবাসন সঙ্কট চরম। বেশিরভাগ কলেজের আবাসন ব্যবস্থা নেই। যে কয়টা ক্যাম্পাসে আছে সেগুলো আবার বিভিন্ন ছাত্র সংগঠন কর্তৃক দখল হয়ে আছে।
এছাড়া কলেজগুলোতে গণতান্ত্রিক চর্চা অবরুদ্ধ। ছাত্র সংসদ নির্বাচন না হওয়াতে বিভিন্ন কলেজ বিভিন্ন ছাত্র সংগঠন কর্তৃক দখল হয়ে আছে। ছাত্রদের হাজারো সমস্যা থাকলেও এ সংগঠনগুলোর নেতা–কর্মীদের তাতে কোনো মাথা ব্যথা নেই। এরা মূলত নিজ সংগঠনের নাম ভাঙ্গিয়ে বিভিন্ন সুযোগ সুবিধা গ্রহণেই ব্যস্ত। বাম সংগঠনগুলো এসব ইস্যুতে আন্দোলন করতে চাইলে উল্টো তাদের বিভিন্ন হামলা–হুমকি–ভয়ভীতি প্রদর্শন করা হয়।
জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া লাখ লাখ শিক্ষার্থীর শিক্ষাজীবন ধ্বংসের মুখে। প্রতিটি সরকার এই সত্য শিকার করে এর পূনর্গঠনের কথা বললেও উল্টো নিজেরা বিভিন্ন সমস্যায় জর্জরিত করেই দায়িত্ব ছাড়েন।
প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়: ব্যবসায়িকভাবে সফল
উচ্চ শিক্ষার চাহিদা আর শিক্ষার্থীর অনুপাতে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা কম। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের এই যুক্তির ভিত্তিতে ১৯৯২ সালে সরকার জারি করেছিল প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় আইন। উচ্চ শিক্ষার চাহিদা ও পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের সংকটের বিষয়টি অত্যন্ত সঠিক। কিন্তু এর সমাধান কোনোভাবেই প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় তৈরীর মধ্যে দিয়ে সম্ভব না সেটি এখন প্রমাণিত সত্য। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনেরও এখন সেই বোধোদয় ঘটেছে বলেই মনে হয়। সর্বশেষ ইউজিসি বার্ষিক রিপোর্টে যা উল্লেখ করেছে তা থেকে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে কিছু উদ্ধৃতি নিম্নে দেয়া হলো:
ইউজিসির অনুমোদন ব্যতিরেকে নতুন কোর্স, বিভাগ, এমনকি অনুষদ চালু করা।
ব্যবসায়িক মনোবৃত্তি নিয়ে আকর্ষনীয় বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে ভর্তির জন্য প্রচারণা চালানো।
ভাড়া করা বাড়িতে পাঠদান।
আয়–ব্যয়ের হিসেব সংরক্ষিত না হওয়া।
মানসম্পন্ন শিক্ষার অভাব, যোগ্য ও অভিজ্ঞ পূর্ণকালীন ও খণ্ডকালীন শিক্ষক নিয়োগ না করে অধিকসংখ্যক সবেমাত্র পাশ করা জুনিয়র শিক্ষক নিয়োগ করা। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের মোট শিক্ষকের ৫৬ ভাগই প্রভাষক। পূর্ণকালীন শিক্ষকদের সংখ্যা খুবই কম। পূর্ণকালীন শিক্ষদের মধ্যে ৬৭ ভাগই প্রভাষক। শিক্ষক শিক্ষার্থীর অনুপাত ১:৩০ অথবা এর বেশি।
উচ্চহারে ক্রেডিট প্রতি টাকা নির্ধারণ।
গবেষণাকর্ম নেই বললেই চলে। ২০০৯ সালে ৫১টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে ২০টি বিশ্ববিদ্যালয় গবেষণা খাতে কোনো টাকাই খরচ করেনি। ২০১০ সালে ২৯টি কোনো ধরনের গবেষণাই করেনি। অথচ ‘কোয়ালিটি এডুকেশন’ বলে এরাই সবচেয়ে বেশি বিজ্ঞাপন দেয়।
একই শিক্ষক দ্বারা পাঠদান, প্রশ্নপত্র প্রণয়ন এবং উত্তর পত্রের মূল্যায়ন।
অধিক হারে নম্বর প্রদান এবং সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র–ছাত্রীদের সাথে ফলাফলে বৈষম্য।
উদ্যোক্তা কর্তৃক প্রশাসনিক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করা।
বিশ্ববিদ্যালয় অলাভজনক প্রতিষ্ঠান হওয়া স্বত্ত্বেও শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে আদায় করা অর্থ অন্যত্র বিনিয়োগ করা।
এছাড়াও আরো গুরুতর কিছু সমস্যা রয়েছে:
মালিকানার জের ধরে কিছু সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রশাসনিক স্থবিরতা বিরাজ করছে।
অনুমোদনহীন একাধিক ক্যাম্পাস চালু করা।
উপাচার্য পদ নিয়ে মালিকদের অন্তর্দ্বন্দ্ব চলছে কিছু বিশ্ববিদ্যালয়ে। নতুন ৮টি বিশ্ববিদ্যালয়ের ৬টিতে উপাচার্য নেই।
শত শত কোটি টাকার সনদ বাণিজ্য করাই কিছু বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্দেশ্য।
বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে মাদকের বিস্তার।
শিক্ষার মান বৃদ্ধিতে ও গবেষণায় বরাদ্দ না দিয়ে ক্লাসরুমের সৌন্দর্য বর্ধন, শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ ইত্যাদির পেছনেই বেশি খরচ করা।
প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় আইন’১৯৯২ এ এটিকে নন–প্রফিটেবল হিসেবে উল্লেখ করা হয়নি। তাই এ মাধ্যমে অবাধ বাণিজ্য করছে একটি দুষ্ট চক্র। নিয়মের তোয়াক্কা না করা এসব বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার নজির খুবই কম। ইউজিসির ভেতরে অনেকেই রয়েছেন যারা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর কাছ থেকে অবৈধভাবে বিভিন্ন সুবিধা নিচ্ছেন।
উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়: এখানেও পড়ালেখা হয়
ভর্তি না নেয়া, কোর্সের মেয়াদ বাড়ানো কমানো, সময়মতো পরীক্ষা–ফলাফল প্রকাশ না হওয়া, বছরের শুরুতে পাঠ্যপুস্তক সরবরাহ না করা সহ অজস্র সমস্যায় জর্জরিত উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়। আর তাই এখানে ভর্তিও কমেছে আশঙ্কাজনকভাবে।
পাঠ্য বইয়ে ইতিহাস বিকৃতির অজুহাতে ২০১০ সেশনে এসএসসি ও এইচএসসি সহ কয়েকটি মূল প্রোগ্রামে কোনো ভর্তি নেয়া হয়নি। ২০০৮ সালে (২০০৯ শিক্ষাবর্ষ) উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়া মোট শিক্ষার্থী ছিল ১ লাখ ৪৩ হাজার ৪৫ জন। ২০০৯ সালে (২০১০ শিক্ষাবর্ষ) শিক্ষার্থীর সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় দুই লাখ পাঁচ হাজার ৫৯৯। কিন্তু ২০১০ সালে (২০১১ শিক্ষাবর্ষ) ভর্তি হয় মাত্র চার হাজার ৮২১ জন শিক্ষার্থী। এক বছরে শিক্ষার্থী কমেছে প্রায় ৯৭.৬৫ শতাংশ।
আগে বিশ্ববিদ্যালয় নির্ধারিত যেকোনো স্কুলে সরাসরি ভর্তির সুযোগ থাকলেও এখন আর সেই সুযোগ নেই। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ সারা দেশে ১২টি আঞ্চলিক ও ৮০টি কো–অর্ডিনেটিং কেন্দ্র নির্মাণ করেছে। যেগুলোর মাধ্যমে ভর্তি হতে হবে। এতে প্রত্যন্ত অঞ্চলের শিক্ষার্থীদের ভর্তির আগ্রহ কমে গেছে।
২০০৯ ব্যাচের এসএসসি পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয় ২০১০ সালের ৪ জুন। ৩ মাসের মধ্যে ফল প্রকাশের নিয়ম থাকলেও এখানে প্রায় ৬ থেকে ৯ মাস সময় লাগে।
বিভিন্ন পরীক্ষাকে কেন্দ্র করে আদায় করা হচ্ছে বাড়তি ফি।
বাজেট: শুভঙ্করের ফাঁকি
২০০৮–০৯ অর্থবছরে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর জন্য মোট বরাদ্দ ছিল ৮৫৯ কোটি টাকা। এর মধ্যে শিক্ষা আনুষঙ্গিক খাতে ব্যয় ধরা হয় মাত্র ১১০ কোটি টাকা। আর প্রকৃত ব্যয় হয়েছে তার চেয়েও কম, ৯৬ কোটি ৮৭ লাখ টাকা। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর জন্য যে বরাদ্দ দেওয়া হয়, তার বেশির ভাগ ব্যয় হয় শিক্ষক ও কর্মকর্তা–কর্মচারীদের বেতন–ভাতা খাতে। ওই অর্থবছরের মোট বরাদ্দের ৭২ ভাগ ব্যয় হয়েছিলো এই খাতে। আর শিক্ষা আনুষঙ্গিক খাতে ব্যয় করা হয়েছে মাত্র ১১ ভাগ টাকা। তার উপর ২০০৭–০৮ অর্থবছরে শিক্ষার সাথে প্রযুক্তি ও ২০০৮–০৯ অর্থবছরে তার সাথে স্বাস্থ্যখাতকে যোগ করা হয়। এতে প্রকৃত অর্থে শিক্ষা বাজেট হয় আরো সংকুচিত। এটি শুভঙ্করের ফাঁকি।
১৯৭২ সালের জাতীয় বাজেটের ২১ শতাংশ বরাদ্দ হয়েছিলো শিক্ষা খাতে। পর্যায়ক্রমে তা কমে ২০১২–১৩ অর্থ বছরে দাঁড়িয়েছে ১২ শতাংশে। ২০০৫ সালে দারিদ্র বিমোচন কৌশলপত্রে শিক্ষা খাতে জাতীয় আয়ের ৫ শতাংশ বরাদ্দের লক্ষ্য মাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছিলো। এ কৌশলপত্রে ২০১০ সালের মধ্যে জাতীয় বাজেটে শিক্ষা খাতে বরাদ্দ ২৫ শতাংশে উন্নীত করার কথা বলা হয়েছিলো। অপর দিকে ইউনেস্কোর প্রস্তাব অনুযায়ী শিক্ষা খাতে জাতীয় আয়ের ৮ শতাংশ অথবা বাজেটের ২৫ শতাংশ বরাদ্দ থাকা উচিত।
অর্থনীতিবিদদের মতে, শিক্ষা খাতে বিনিয়োগ সবচেয়ে লাভজনক এবং নিরাপদ রাষ্ট্রীয় বিনিয়োগ। অর্থনীতিবিদ এডাম স্মিথ, ডেভিড রিকার্ডো এবং মার্শালের মতে, শিক্ষা এমন একটি খাত যার কাজ হলো দক্ষ জনশক্তি গড়ে তুলে পুঁজির সঞ্চালন ঘটানো। শিক্ষার অর্থনীতি নিয়ে মৌলিক গবেষণায় অর্থনীতিবদ আর্থার শুল্জ ও রবার্ট সলো দেখিয়েছেন যে, প্রাথমিক শিক্ষায় বিনিয়োগ করলে সম্পদের সুফল ফেরত আসে ৩৫ শতাংশ, মাধ্যমিক শিক্ষায় ২০ শতাংশ, এবং উচ্চ শিক্ষায় ১১ শতাংশ।
আমরা যদি না জাগি মা কেমনে সকাল হবে
আমাদের পুরো শিক্ষা ব্যবস্থা ভেঙ্গে পড়েছে। উপরোক্ত চিত্র থেকে দেখা যাচ্ছে শিক্ষায় বর্তমানে সবচেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে এর বাণিজ্যিকীকরণের। যার কারণে সাধারণের নাগালের বাইরে চলে যাচ্ছে শিক্ষা। এছাড়া ঝড়ে পড়ার হার বাড়তে থাকা, শিক্ষা পণ্যের উচ্চ মূল্য, বাজেটে শিক্ষা খাত উপেক্ষিত থাকা, গবেষণা কার্যক্রমে স্থবিরতা, আদিবাসি শিক্ষা উপেক্ষিত থাকা, অবহেলিত বিজ্ঞান শিক্ষা, দূর্নীতি, অব্যবস্থাপনা, দলীয়করণ, বাড়তি ফি আদায়, ভর্তি বাণিজ্য, শিক্ষক সংকট, শিক্ষকদের অবমূল্যায়ন, আবাসন সংকট, দেশি বিদেশি প্রেসক্রিপশনে শিক্ষাখাতকে আবদ্ধ করা, সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে সিট সঙ্কট, একের পর এক বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় অনুমোদন, পশ্চাৎপদ মাদ্রাসা শিক্ষা, ইংরেজি মাধ্যমে দেশীয় কৃষ্টি–কালচার উপেক্ষিত, সার্টিফিকেট বাণিজ্য এরকম আরো হাজারো সমস্যায় জর্জরিত আমাদের গোটা শিক্ষা ব্যবস্থা।
শিক্ষার সাথে মানুষের অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক বোধের রয়েছে নিবিড় সম্পর্ক। শিক্ষার মধ্য দিয়ে মানুষ নিজেকে আবিস্কার করতে শেখে। তার শ্রেণি চেতনার বিকাশ সাধন হয়। ফলে সে তার চারপাশের জগতকেও সচেতনভাবে পরিবর্তন করতে চায়। সে প্রভাবিত করে বাকিদের। যেটি উন্নত রাজনৈতিক সংস্কৃতির জন্ম দেয়। শাসক শ্রেণি শিক্ষার এই দিকটাকেই সবচেয়ে বেশি ভয় পায়। আর তাই যুগে যুগে শাসক শ্রেণির শিক্ষা ভাবনাও প্রায় একইরকম। লর্ডমেকলে বৃটিশ শিক্ষা ব্যবস্থার যে মূল কথা বলেছেন সেটি হচ্ছে, ‘আমরা বর্তমানে এমন একটা শ্রেণি তৈরী করব যারা কোটি কোটি ভারতীয় যাদের আমরা শাসন করি তাদের সঙ্গে আমাদের ইন্টারপ্রেটারের কাজ করবে। তারা হবে এমন একটি শ্রেণি যারা রক্ত মাংসে ও বর্ণে ভারতীয় কিন্তু মন মানসিকতায় ও বুদ্ধিমত্তায় ইংরেজ।‘ পাকিস্তানি স্বৈরশাসক আইয়ুব খান সরকারের শরীফ কমিশন রিপোর্টে শিক্ষাকে পণ্য হিসেবে উপস্থাপন করা হয় এভাবে, ‘শিক্ষা সম্পর্কে জনসাধারনের চিরাচরিত ধারণা অবশ্যই বদলাতে হবে। সস্তায় শিক্ষা লাভ করা যায় বলিয়া তাহাদের যে ভুল ধারণা রয়েছে, তা শীঘ্রই ত্যাগ করিতে হবে। যেমন দাম তেমন জিনিস এই অর্থনৈতিক সত্যকে অন্যান্য ব্যাপারে যেমন শিক্ষার ব্যাপারেও তেমনি এড়ানো দুষ্কর।‘ শিক্ষা নিয়ে এদের মনোভাবের আজো কোনো পরিবর্তন ঘটেনি। উপরন্তু দেখা গেছে শাসক শ্রেণি দিনে দিনে আরো আগ্রাসী হয়েছে। বর্তমান সরকারের আমলে প্রণীত শিক্ষানীতিতেও প্রায় একইরকম মনোভাবের প্রতিফলন ঘটেছে। শিক্ষার এসব সংকটের বিরুদ্ধে এখনই তীব্র আন্দোলন শুরু করা দরকার। যার সাথে সাথে ক্ষমতাসীন শাসক শ্রেণিরও পরিবর্তন অনিবার্য হবে। আর না হয় আমরা জাতি হিসেবে কখনোই স্বনির্ভর, আত্মমর্যাদাশীল হতে পারবো না।
তৌহিদ টিপু: সিস্টেম ইঞ্জিনিয়ার, হেলোওয়ার্ল্ড কমিউনিকেশন্স লিমিটেড।
লেখক পরিচিতি
সম্পাদক বাংলাদেশের শিক্ষা
এই লেখাটি সম্পাদক কর্তৃক প্রকাশিত। মূল লেখার পরিচিত লেখার নিচে দেওয়া হয়েছে।