জাহাঙ্গীর মোহাম্মদ আরিফ লিখেছেন করোনা ক্রান্তিকালে শিক্ষা নিয়ে
একটি বড় আকারের ডাবল খাট। সাইজ বোধকরি ৬’X৫’ হবে। আমাদের বিয়ের সময়ে বানানো। একটু বড় করে বানানো, যেন সংসারে নতুন অতিথি আসলে তাকে দুজনের মাঝখানে শোয়ানো যায়। এভাবে এই খাটে আমরা তিন জন বছরের পর বছর শুয়েছি। আমাদের পুত্র বড় হতে তার আর আমাদের ঘর যখন আলাদা হলো, তখন কী করে যেন এই বিশাল খাটটা তার ঘরে গেলো। সেই থেকে এই খাট তার ঘুমানোর জায়গা, খাওয়ার জায়গা, পড়ার জায়গা, টিভি দেখার জায়গা, ভিডিও গেমস খেলার জায়গা, অনলাইনে বন্ধুদের সাথে আড্ডা দেবার জায়গা। মাঝে মাঝে আমরা তিনজন খাটটাতে একসাথে বসে নানা বিষয়ে গল্প করি। টেলিভিশনে ফুটবল বা ক্রিকেট খেলা থাকলে বাপ-ব্যাটা মিলে এই খাটে শুয়ে বসে দেখি। ২০২০ সালের মার্চ মাসে কোভিড-১৯ তথা করোনা ক্রান্তিকাল শুরু হলে খাটটা তার ক্লাস করার জায়গাও হয়ে যায়। ত্রিশ বর্গফুট জায়গায় একজন মানুষের গোটা দুনিয়া– স্কুল, খেলার মাঠ, আড্ডার জায়গা, পড়ার টেবিল, খাবার টেবিল, বিশ্রামের বিছানা, বিনোদনের স্থান!
২০২০ সালের মার্চে করোনা ক্রান্তিকালের শুরুতে আমাদের পুত্র ছিলো এ-লেভেলের চূড়ান্ত পর্বের অর্থাৎ এ-২-এর পরীক্ষার্থী। পরীক্ষার রেজিস্ট্রেশন হয়ে গেছে, রুটিন দেয়া হয়ে গেছে। এখন শুধু কেন্দ্রের বিবরণ দেয়া, প্রবেশপত্র (স্টেটমেন্ট অব এন্ট্রি) দেয়া আর জুন মাস থেকে পরীক্ষা শুরু হওয়া বাকি। এর পরে কী হলো সেটি সারা বিশ্ব জানে। পরীক্ষার সব প্রস্তুতি সম্পন্ন হবার পরে যখন গোটা পরীক্ষাটি অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়ে যায়, বাতাসে নানা উড়ো খবর ভাসে, কিছুদিন পর পর নানা রকম সিদ্ধান্তের কথা শোনা যায়, তখন পরীক্ষার্থীর অবস্থা হয় ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত আসামীর মতো। আর তার অভিভাবকের অবস্থা হয় জেলের বাইরে প্রতীক্ষমান স্বজনদের মতো।
তুলনাটা একটু রূঢ় হয়ে গেলো হয়তো, কিন্তু ওইসব দিন যারা পার করেছেন, তারা জানেন সেসব দিন কেমন গেছে। পুত্র নানা উৎস থেকে নানা রকমের খবর শুনে মুষড়ে পড়তো। আমরা তার মুখের দিকে তাকাতে পারতাম না। একটা ভালো ব্যাপার ছিল এই যে, পিয়ারসন-এডেক্সেল তাদের সাইটে মোটামুটি কিছু খবর দিয়ে রাখতো। কিন্তু সেসব খবরের মধ্যে শেষ পর্যন্ত কোনটি টিকবে তার কোনো নিশ্চয়তা ছিল না।
যখন সিদ্ধান্ত হলো হয় পরীক্ষা না দিয়ে গ্রেড নেয়া অথবা পরবর্তী সিটিং-এ পরীক্ষা দেয়ার, তখন আমাদের পুত্র পরীক্ষা না দিয়ে গ্রেড নেবার পক্ষে মত দিলো। আমরাও তা সমর্থন করলাম দুটো কথা ভেবে। এক, গত কয়েক মাসের সিদ্ধান্তজনিত দোলাচলে পুত্রের পড়াশোনা ঠিক মতো হয়নি। আগের প্রস্তুতি গেছে, মনও ভেঙে গেছে। দুই, পরের সিটিং-এ পরীক্ষা দেয়া মানে এই দফা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সুযোগ হারানো– কমপক্ষে একটি সেশন পিছিয়ে পড়া।
কিন্তু পরীক্ষা না দিয়ে গ্রেড নেয়াতে পুত্রের অপূরণীয় ক্ষতি হয়ে গেলো। পরীক্ষা না দিয়ে গ্রেড দেবার ক্ষেত্রে ভিত্তি ছিল আগের পরীক্ষার (অ্যাডভান্সড সাবসিডিয়ারি) ফলাফল, স্কুলের মক্ টেস্ট ও ক্লাস পারফরম্যান্স। আগের পরীক্ষার ফলাফলের ব্যাপারে কিছু বলার নেই, কিন্তু বন্ধ হয়ে যাবার আগে তিনটি বিষয়ের নয়টি পেপারের মধ্যে স্কুলে মক্ হতে পেরেছিল মাত্র একটির। ক্লাস পারফরম্যান্স বলে বিশেষ কিছু ছিলো না, কারণ এ-২-এর পরীক্ষার্থীদের ক্ষেত্রে ক্লাসটেস্ট ধরনের জিনিসের চাপ কম থাকে। ফলে পিয়ারসন-এডেক্সেল যখন এসব কিছুর প্রমাণ চাইলো, তখন আমাদের পক্ষ থেকে দেবার মতো জিনিস যথেষ্ট ছিলো না। যাই হোক, যার যা কিছু আছে তাই জমা দিয়ে আমরা ইষ্টনাম জপ করতে লাগলাম।
পরীক্ষার ফলাফল যখন প্রকাশিত হলো, তখন দেখা গেলো আমাদের পুত্র তিনটি বিষয়ের মধ্যে দুটোতে খুব নিম্নমানের গ্রেড পেয়েছে। আমরা শোকে-দুঃখে হতবাক হয়ে গেলাম। যদি পুত্র পরীক্ষা দিয়ে খারাপ গ্রেড পেতো, তাহলে চ্যালেঞ্জ করার একটি বিষয় থাকতো। কিন্তু এখন আমরা কী দিয়ে চ্যালেঞ্জ করবো?
এদিকে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ভর্তির সার্কুলার দিয়ে দিয়েছে। খারাপ গ্রেডের কারণে পুত্র তার প্রথম পছন্দের বিষয়ে আবেদন করতে পারলো না– এটি আরও হৃদয়বিদারক হলো। পুত্র তিনটি বিশ্ববিদ্যালয়ে দুটি করে বিষয়ে আবেদন করলো। ভর্তি পরীক্ষার ফলাফলে দেখা গেলো সে সবগুলো বিশ্ববিদ্যালয়ে, সবগুলো বিষয়েই চান্স পেয়েছে। এতে আমাদের মনে কিছুটা শান্তি এলো।
এমন সময় স্কুল থেকে জানানো হলো সকল পরীক্ষার্থীর ফলাফল পরিবর্তিত হয়েছে। গিয়ে দেখি পরিবর্তিত ফলাফলে পুত্র যে দুটি বিষয়ে নিম্নমানের গ্রেড পেয়েছিলো, সেগুলোর গ্রেড এক ধাপ করে উন্নতি হয়েছে। এটা দেখে আমাদের মন খারাপ হয়ে গেলো। কারণ, শুরুতেই এই গ্রেডটা দিলে পুত্র বিশ্ববিদ্যালয়ে তার পছন্দের বিষয়েই আবেদন করতে পারতো। আমাদের মন খারাপ অক্ষম ক্রোধে পরিণত হলো যখন বিষয়ভিত্তিক নাম্বার পাওয়া গেলো। দেখা গেলো, পুত্র মাত্র ০.৫০% নম্বরের জন্য একটি বিষয়ে এবং ১.৬৭% নাম্বারের জন্য আরেকটি বিষয়ে এক ধাপ করে কম গ্রেড পেয়েছে।
যারা সারা দুনিয়াব্যাপী পরীক্ষা চালান, তারা কী করে সকল শিক্ষার্থীর ফলাফল ভুল করতে পারেন? ভুল যখন শোধরালো তখন কীসের ভিত্তিতে তারা একজন শিক্ষার্থীকে এমন নাম্বার দিতে পারেন যেখানে মাত্র ০.৫০% নাম্বারের জন্য একটি বিষয়ে নিম্নতর গ্রেড আসতে পারে? আমরা এই অন্যায়ের বিরুদ্ধে কার কাছে বিচার চাইবো? কী বিচার দিবো? জীবনের শুরুতে আমাদের পুত্র বিনা অপরাধে যে অন্যায়ের শিকার হলো, এবং তাতে তার যে সমূহ ক্ষতি হলো তার দায় কে নেবে?
এর জন্য করোনা অতিমারিকে দায়ী করাটা স্রেফ নিজেদের দায় এড়ানোর একটি নোংরা চেষ্টামাত্র। এখনকার দুনিয়াতে অনেক পরীক্ষা অনলাইনে নেয়া হয়। অনেক গুরুত্বপূর্ণ পরীক্ষা বহু বছর ধরে কম্পিউটার বেসড টেস্ট (সিবিটি) হয়ে গেছে। পিয়ারসন-এডেক্সেলের পক্ষে অমন কিছু করা মোটেও অসম্ভব কিছু ছিলো না, কিন্তু তা করা হয়নি। অতিমারিকালে এমন ছোট-বড় অসংখ্য অন্যায়, অবিচার, অবহেলা, অজ্ঞতার ঘটনা ঘটে গেছে। এগুলো নিয়ে কখনো তদন্ত হবে না, ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা হবে না। মাঝখান থেকে কিছু মানুষের জীবনটাই পালটে যাবে, অথবা বাকিটা জীবন এর মাশুল গুনে যেতে হবে।
যথাসময়ে অনলাইনে আমাদের পুত্রের বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাস শুরু হলো। আমি তার ঊনত্রিশ বছর আগে নিজের বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের ক্লাস শুরু হবার কথা স্মরণ করে বিষণ্ণ হয়ে পড়লাম। আজও আমাদের ব্যাচের শিক্ষার্থীরা সানন্দে সেই দিনটি উদযাপন করেন, অথচ পুত্র নিজের বিশ্ববিদ্যালয়ের আঙিনাতে পা রাখার সুযোগটি পর্যন্ত পেলো না। দিন যায়, পুত্র অনলাইনে ক্লাস করে, ক্লাস টেস্ট দেয়, অ্যাসাইনমেন্ট জমা দেয়, রিপোর্ট লেখে, প্রেজেন্টেশন দেয়, মিড টার্ম দেয়, টার্ম ফাইনাল দেয়। এভাবে এক এক করে তিনটি টার্ম শেষ হয়ে যায়। অর্থাৎ, পুত্র যদি এই টার্মে পাশ করে তাহলে বলতে হবে তার বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের এক-চতুর্থাংশ সে ঘরে বসে পার করে দিলো।
করোনা অতিমারীকালে আমাদের পুত্রের উচ্চ-মাধ্যমিক পাশ করা ও বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম বছরটিকে মোটামুটি নিজের চোখের সামনে পার হতে দেখায় কিছু বিষয় চোখে পড়েছে। প্রথমে উচ্চ-মাধ্যমিক পাশের পর্যায়ের কথা বলি। আমরা স্বীকার করতে চাই বা না চাই, বর্তমানে মাধ্যমিক বা উচ্চ-মাধ্যমিকে বোর্ডের (তা যে বোর্ডই হোক) পরীক্ষায় অংশগ্রহণের প্রস্তুতির ব্যাপারটি পুরোপুরি কোচিং সেন্টার-নির্ভর হয়ে গেছে।
অনেকের গৃহশিক্ষক থাকে বটে, তবে যাদের গৃহশিক্ষক থাকে তারাও কোচিং সেন্টারে যায়। যারা কোচিং সেন্টারে যায় না, তারা নিতান্ত আর্থিকভাবে অসমর্থ বলে যেতে পারে না। তাদের আর্থিক সক্ষমতা বাড়লে অথবা কোনো কোচিং সেন্টার যদি তাদেরকে বিনামূল্যে বা হ্রাসকৃত মূল্যে পড়ার সুযোগ দেয়, তাহলে তারাও কোচিং সেন্টারে যাবে। এর কারণ কী সেটি ভিন্ন আলোচনা, তাই এখানে সেটি নিয়ে বলতে যাবো না। করোনা অতিমারীতে কোচিং সেন্টারগুলো কার্যত বন্ধ হয়ে যাওয়ায় মাধ্যমিক ও উচ্চ-মাধ্যমিক পর্যায়ের পরীক্ষার্থীদের জন্য তাই পড়াশোনাটা কঠিন হয়ে পড়ে।
কিছু কিছু কোচিং সেন্টার অনলাইনে ক্লাস চালানোর চেষ্টা করেছে বটে; কিন্তু কারিগরি সীমাবদ্ধতার জন্য সেগুলো শিক্ষার্থীদের বিশেষ কাজে আসেনি। এ-বিষয়ে পূর্বজ্ঞান বা পূর্বাভিজ্ঞতা না থাকায়, নানা প্রকারের ও অপরীক্ষিত প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করায় কোচিং সেন্টারগুলোর অনলাইন ক্লাসরুম আসলে খুব কম কাজে এসেছে। ফলে উচ্চ-মাধ্যমিক পর্যায়ে যা যা কিছু শেখার কথা ছিলো, তার কিছু কিছু জিনিস শিক্ষার্থীদের শেখার বাইরে থেকে গেলো।
আশ্চর্যের ব্যাপার হলেও সত্যি হচ্ছে, বিরাট সংখ্যক ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে কোনো ল্যাব নেই। বিশেষ কিছু কোচিং সেন্টার আছে যারা এই ল্যাবগুলো করায়। ল্যাববিহীন স্কুলের শিক্ষার্থীরা পরীক্ষার আগের দুই-তিন মাসে ওসব জায়গায় গিয়ে ল্যাব করে নেয়। অতিমারীর কারণে এই শিক্ষার্থীরা এবার কোনো ল্যাব না করেই এ-২ পরীক্ষা পাশ করে গেলো। এই ক্ষতিটি অপূরণীয়। এসব শিক্ষার্থীর যারা স্নাতক পর্যায়ে ভৌত বিজ্ঞান, জীব বিজ্ঞান, ফলিত বিজ্ঞান, চিকিৎসা, প্রকৌশল, কৃষি ধরনের বিষয় পড়বে, তারা অনেক বিষয়ে ব্যবহারিক জ্ঞানের অভাবে অকুল পাথারে পড়বে। এই ক্ষতির পরিণতি ভয়াবহ হবে।
উচ্চ-মাধ্যমিকের ফলাফল প্রকাশের পর বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি ও ক্লাস শুরু করার জন্য আমাদের পুত্র খুব কম সময় পাওয়ায় সে অন্য কোনোকিছুতে যুক্ত হতে পারেনি। ক্লাস শুরু হবার পর দেখা গেলো খুব অল্প কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া অনলাইন ক্লাসের বিষয়টি ইউটিউবে ভিডিও দেখার মতো একটি ব্যাপার। শিক্ষক-শিক্ষার্থীর মধ্যে খুব কম ইন্টার্যাকশন হচ্ছে। শিক্ষকের পক্ষে যেমন বোঝা কঠিন হচ্ছে শিক্ষার্থীরা আদৌ বিষয়টি বুঝতে পারছে কিনা, তেমন শিক্ষার্থীদের পক্ষেও নিজেদের সমস্যাগুলো নিয়ে শিক্ষকের সাথে আলোচনার সুযোগ খুব কম হচ্ছে।
সশরীরে পাঠদানকালে পাঠের বিষয়ের বাইরের যেসব বিষয় আলোচনায় পাঠদান প্রাণবন্ত হয়, শিক্ষার্থীদের পক্ষে বোঝা সহজতর হয়, এবং পাঠবহির্ভূত অন্য বিষয় জানা যায়, অনলাইন ক্লাসে সেগুলো ঘটার সুযোগ খুব কম। কোনো কোনো শিক্ষায়তনে তাদের শিক্ষা প্রশাসনের লোকজন অনলাইনে খবরদারি করেন বলে বিব্রতকর পরিস্থিতি এড়াতে শিক্ষকগণ কেবল তালিকাভুক্ত বিষয়টিই যান্ত্রিকভাবে পড়িয়ে যান। আমি পুত্রের ক্লাস করা কিছু দিন লক্ষ করে বুঝতে পারলাম— বিষয়টি ঠিক যা হওয়া উচিত ছিলো তেমন হচ্ছে না।
এ-ব্যাপারে আমি আমার পরিচিত কিছু শিক্ষকের (বিভিন্ন পর্যায়ের ও বিভিন্ন মাধ্যমের) সাথে আলোচনা করার চেষ্টা করলাম। তাতে কয়েক ধরনের প্রতিক্রিয়া লক্ষ করলাম। প্রথম গোত্রের শিক্ষক ধরেই নিলেন অনলাইন ক্লাস করানো নিয়ে সামাজিক মাধ্যমগুলোতে যেসব নেতিবাচক আলোচনা ও কুরুচিপূর্ণ ট্রোল চালু আছে, আমি সেই দলের। অর্থাৎ, আমি তাঁকে এবং অনলাইন ক্লাস করানোকে অপমান করার জন্যই এসব প্রশ্ন করছি। ফলে আমি শুরু থেকে তাঁর পালটা প্রশ্ন, বাক্যবাণ ইত্যাদিতে আক্রান্ত হলাম। কেন আমার এসব জানা দরকার, জেনে কী লাভ হবে ইত্যাদির তোড়ে আলোচনা আর আগানো যায়নি। দ্বিতীয় গোত্রের শিক্ষক পুরোপুরি অনলাইন ক্লাস পদ্ধতির বিরোধী। তাঁর বিবেচনায় এসব তামাশা না চালিয়ে অবিলম্বে সবাইকে টিকা দিয়ে বা না দিয়ে সশরীরে ক্লাস শুরু করানো উচিত। তৃতীয় গোত্রের শিক্ষক মোটামুটি প্রেসনোটের ভাষায় কথা বলেন। তিনি বিদ্যমান ব্যবস্থায় কোন গলদই খুঁজে পেলেন না, ফলে আমার সাথে আলাপ করারও কিছু পেলেন না। চতুর্থ গোত্রের শিক্ষক আলোচনায় আগ্রহী এবং কিছু খুঁটিনাটি বিষয় নিয়ে আলোচনা করলেন। কিন্তু আমি লক্ষ করলাম তিনি যে পর্যায়ের ও যে বিষয়ের শিক্ষক, তিনি আলোচনা কেবল সেখানেই সীমাবদ্ধ রাখছেন। ফলে আমি সার্বিক চিত্রটি নিয়ে বিশেষ কিছু জানতে পারলাম না। আমি গবেষক নই, তাই যেভাবে বিষয়টি নিয়ে আগালে ফল লাভ হতো, তা করতে পারিনি। তবে মোটামুটি এটি বুঝতে পারলাম যে, শিক্ষক, শিক্ষার্থী, অভিভাবক সবাই অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছেন কবে থেকে সশরীরে ক্লাস শুরু হবে এবং তাঁরা অনলাইন ক্লাসের এই আপদের হাত থেকে রক্ষা পাবেন।
যেহেতু আমাদের পুত্র ভৌত বিজ্ঞানের একটি ফলিত বিষয়ে পড়ছে, তাই তার ক্ষেত্রে ল্যাবে কাজ করা একটি অত্যাবশকীয় ব্যাপার। অনলাইনে ল্যাব করা আর রসগোল্লার ছবি দেখার মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। বস্তুত তার বেশিরভাগ ল্যাব ক্লাস হচ্ছে না। হয়তো এই কোর্সগুলো বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ জমিয়ে রাখছেন সামনে করাবে বলে। আমার জ্ঞান বলে কোর্সঃ থিয়োরি-১০১ পড়ানোর সময়েই কোর্সঃ ল্যাব-১০২ করাতে হবে। নয়তো যখন কোর্সঃ থিয়োরি-১০৩ বা থিয়োরি-২০১ পড়ানো হবে তখন অনেক কিছুই শিক্ষার্থীর কাছে বোধগম্য হবে না। এ-সমস্যা নিয়ে সবাই সম্ভবত অপেক্ষার নীতি নিয়েছেন, কিন্তু এর ফলে শিক্ষার্থীর যে ক্ষতি হবার তা হয়ে গেল।
একটি তিক্ত সত্য হচ্ছে, অনলাইন পাঠদানের কালে যেসব অ্যাসাইনমেন্ট দেয়া হচ্ছে, রিপোর্ট লিখতে দেয়া হচ্ছে, অনেকের ক্ষেত্রে সেগুলোতে অভিভাবক বা গৃহশিক্ষকের অবদান থাকছে। কোনো কোনো সময় অনলাইন পরীক্ষা দেবার সময়ও একটু আড়াল থেকে তাদের সহযোগিতা থাকছে। এগুলো সংশ্লিষ্ট শিক্ষক যে ধরতে পারছেন না তা নয়, তবে সেটি ঠেকানোর উপায় তাঁর হাতে থাকছে না। তিনি হয়তো নকলকারী বা সাহায্যগ্রহণকারী শিক্ষার্থীকে কম নম্বর দিয়ে শাস্তি দিতেন পারেন; কিন্তু অসদুপায় অবলম্বনের ফলে শিক্ষার্থীর যে নৈতিক অবক্ষয় হলো সেটি ঠেকাতে পারেন না। অভিভাবক ও গৃহশিক্ষকের সহযোগিতা ও প্ররোচনায় শিক্ষার্থীর অসদুপায় অবলম্বনের ঘটনা সংশ্লিষ্ট সকলের নৈতিকতার মান নামিয়ে দিলো। এটি আকার ও মাত্রায় পূর্বে সংঘটিত নকলের মহোৎসবগুলোকে ছাড়িয়ে গেলো। জাতিকে এর জন্য অনেক বড় মূল্য শোধ করতে হবে।
আমি একদিন পুত্রকে তার নতুন বন্ধুবান্ধবদের ব্যাপারে জিজ্ঞাসাবাদ করলাম। জানা গেলো, বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাস থেকে তার কোনো নতুন বন্ধু হয়নি। কিছু কিছু বিষয়ে গ্রুপ বেঁধে অ্যাসাইনমেন্ট করার বা রিপোর্ট লেখার ব্যাপার থাকলেও যেহেতু তারা কেউ কাউকে কখনো সরাসরি দেখেনি, তাই তাদের মধ্যে বাড়তি কোনো হৃদ্যতা তৈরি হয়নি। বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের এক বছর পার হয়ে যাওয়ার পরেও একজনও নতুন বন্ধু তৈরি না হওয়াটা একটি চরম দুর্ভাগ্যের বিষয়। এই সমস্যাটি নিয়ে আমি কোথাও কোনো আলোচনা দেখতে পাইনি। সম্ভবত এটি নিয়ে কারো কোনো মাথাব্যথাও নেই। তাছাড়া দীর্ঘদিন ধরে নির্বান্ধব অবস্থায় থাকা একজন মানুষের মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকারক।
বছর ত্রিশেক আগে আমি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম বর্ষে পড়তাম। স্নাতক শ্রেণির প্রথম বর্ষ কেবল বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের প্রথম নয়; জীবনের আরও হাজারোটা বিষয়ের প্রথমটাও তখন হয়। সেসব হাতেখড়ি বা অভিজ্ঞতার কোনোটা মধুর, কোনোটা তিক্ত। তার কোনোটা আনন্দে ভাসিয়ে নিয়ে যায়, কোনোটা গভীর বিষাদে নিমজ্জিত করে। এর সবকিছু তখনই হয় যখন মানুষ নিয়মিত বিশ্ববিদ্যালয়ে যাওয়া শুরু করে, নতুন শ্রেণিতে ক্লাস করে, নতুন নতুন বন্ধু পায়।
আমাদের পুত্র বেশ কয়েক মাস ধরে আনুষ্ঠানিকভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী হলেও এর কোনোটিই ঠিকমতো তার ক্ষেত্রে ঘটেনি। গত ঊনিশ মাস ধরে গৃহবন্দীত্বের কালে সে অনলাইনে ক্লাস করে, পরীক্ষা দেয়, অ্যাসাইনমেন্ট করে, প্রেজেন্টেশন দেয় বটে– তবু তার কোনোকিছুই তাকে ওই অভিজ্ঞতাগুলো দেয়নি। ঊচ্চ-মাধ্যমিক পাশ করার পর বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েও সেশনজটে পড়ে আমাকে দেড় বছর বাসায় বসে থাকতে হয়েছিলো ক্লাস শুরু করার জন্য। আমি জানি, কী দুর্বিসহ ছিলো সেই দিনগুলো।
আমাদের পুত্রের ক্ষেত্রে অমনটা হয়নি, তবে যা হয়েছে তা আরও খারাপ। ঘরে বসে থাকার ওই দেড় বছরে আমি শিক্ষকতা করেছি, এই মহানগরের লাইব্রেরিগুলোতে বসে বই পড়েছি, নানা দেশের সাংস্কৃতিক কেন্দ্রগুলোতে চলচ্চিত্র দেখেছি, গান শুনেছি, শুদ্ধ উচ্চারণ আর আবৃত্তির পাঠ নিয়েছি, ফরাসি ভাষা শেখার ব্যর্থ চেষ্টা করেছি। এর কোনোটা করার সুযোগ পুত্রের নেই, কারণ তার ঘরের বাইরে বের হওয়া বারণ। কেউ কেউ বলবেন, এগুলো সবই তো ঘরে বসে করা সম্ভব। হ্যাঁ, তা যে সম্ভব সেটা কেতাবের কথা, বাস্তবতা একেবারে ভিন্ন। ঊনিশ মাস ধরে কয়েকশ বর্গফুটের বাসস্থানে বা ত্রিশ বর্গফুটের কর্মস্থলে বন্দী একজন মানুষের পক্ষে নতুন কোনোকিছুতে মনোযোগ দেয়া সম্ভব না। ক্রমাগত গান শোনা, সিনেমা দেখা, বই পড়া, খবর দেখা এগুলোর কোনো সমাধান দেয় না। এতে আমাদের পুত্রের যে ক্ষতি হলো সেটি অপূরণীয়। সেটি ভাবলে বা তার মুখের দিকে তাকালে আমার বুকটা ভেঙে যায়। আমি জানি না জীবন তাকে কখনো কোনোভাবে এই ক্ষতি সুদসহ পূরণ করবে কি না।
লেখক পরিচিতি
সম্পাদক বাংলাদেশের শিক্ষা
এই লেখাটি সম্পাদক কর্তৃক প্রকাশিত। মূল লেখার পরিচিত লেখার নিচে দেওয়া হয়েছে।