প্রায় এক বছর হয়ে গেল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে এসেছি পিএইচডি করতে। এই এক বছরে বাংলাদেশের উচ্চশিক্ষার হালচালের সাথে, বিশেষত শ্রেণিকক্ষে পড়ালেখা নিয়ে, বিদেশের উচ্চশিক্ষার পার্থক্য বেশ ভালোমতই চোখে পড়েছে। আজ সে বিষয়েই একটু লিখতে চাচ্ছি।
দেশে বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি নিয়মিত অভিযোগ হচ্ছে, শিক্ষার্থীরা ক্লাস করে না বা শিক্ষকরা ক্লাস নেন না। এর নানাবিধ কারণ আছে। যে কারণগুলো শোনা যায়, তার মাঝে উল্লেখযোগ্য কিছু কারণ নিচে এভাবে দেওয়া যায়।
১) শিক্ষকদের শ্রেণিকক্ষে পড়ালেখা করানোর বা পড়ানোর ভালোলাগে না। ক্লাসে একই গতানুগতিক পুরনো শিট থেকে বা বইয়ের প্রতিটা লাইন পড়তে, বলতে বা লিখতে থাকেন। অনেক সময় ক্লাসে আসেনও না সময়মতো।
২) যে শিক্ষার্থী যে বিষয়ে পড়ছে, তার সে বিষয়ে চাকরি হবে না সে জানে। সবাই বিসিএস বা সেরকম চাকরির পরীক্ষার পড়াতে মগ্ন থাকে।
৩) রাত জেগে ফেসবুক থেকে, ভিডিও গেমস খেলার পর সকালে ক্লাসে আসা যায় না।
৪) টিউশনির সাথে ক্লাসের সময় সাঙ্ঘর্ষিক।
৫) রাজনীতি করে এমন সিনিয়র ভাইয়ের পিছে ঘুরে ক্লাসে যাবার সময় হয় না, ইত্যাদি।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিশ্ববিদ্যালয়ের ধরন পুরো আলাদা। গ্রাজুয়েট শিক্ষার্থীরা তো নিজ গরজেই ক্লাসে যাবে যেহেতু শিখতে এসেছে। আন্ডারগ্রাজুয়েট শিক্ষার্থীদেরও বেশ আগ্রহী দেখলাম ক্লাস করায়।
এখানে শিক্ষকরা প্রতি বছর সিলেবাস আপডেট করেন। শ্রেণিকক্ষে পড়ালেখা বিষয়ে শিক্ষক ক্লাসে আসেন একটি পরিকল্পনা করে। প্রথমেই বোর্ডে আজকের বিষয়, আগামী ক্লাসের প্রিভিউ আর আগের ক্লাসের রিভিউ লিখে শুরু করেন। দেশে ৫০ মিনিটের ক্লাসে পড়ানো হয় হয়ত মিনিট ত্রিশেক। বাকি সময় বই ঘাটাঘাটি করে কী পড়াব তা বোঝানো, রোল কল করা কিংবা শিক্ষার্থীদের সাথে গল্পগুজব করে সময় যায়। এখানে বিষয়ের বাইরে কথা হয় না। কেউ কিছু বোঝেনি, সে সেটি নিয়েই প্রশ্ন করবে। শিক্ষকও বারবার বুঝিয়ে যাবেন যতক্ষণ সে না বুঝছে।
অনেক শিক্ষক ক্লাসের সময় শেষ হবার পরে রুমে শিক্ষার্থীরা গিয়ে দেখা করার সময় দেন। তারা গিয়ে দেখা করে পড়া বুঝে নেয়। ক্লাসেই উপস্থিতি নেয়ার যে বাজে অভ্যাস, যেটি অনেক সময় নষ্ট করে আমাদের দেশে, সেটি এখানে নেই। অনেক শিক্ষক ক্লাসে শিক্ষার্থী মনোযোগী ছিল কিনা, সেটি বুঝতে ক্লাস শেষে কুইজ নেন। সেটিই উপস্থিতির হিসাব।
আর সবচেয়ে বড় কথা— শ্রেণিকক্ষে পড়ালেখা ও এর অংশ হিসেবে প্রতি সপ্তাহে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মতো বাড়ির কাজ থাকে। পুরো ছুটির দিন কাজ করেও শেষ হয় না। এখানে বাড়ির কাজের পদ্ধতি আমাদের মতো নয়, তাই শিক্ষার্থীদের অনেক বেশি মনোযোগী থাকতে হয় ক্লাস লেকচার শোনার জন্য। কারণ লেকচারেই অনেক সময় বাড়ির কাজ সমাধানের সূত্র দেয়া থাকে।
মূলত ক্লাস লেকচার অনেক গোছানো থাকে। সুতরাং শিক্ষকরা খারাপ পড়ান না। পড়ালেও ক্লাস না করলে কিছুই পারা যাবে না। তাই সেই খারাপ পড়াও বুঝতে চেষ্টা করে শিক্ষার্থীরা। আর যখন শিক্ষার্থীরা বুঝতে চেষ্টা করে, শিক্ষক তখন বাধ্য হন নতুনভাবে বিষয়টি নিজে বুঝতে, যাতে তাদের বোঝাতে পারেন। এভাবে একটি ফিডব্যাক লুপ পদ্ধতিতে পঠনপাঠন এগিয়ে চলে।
সেমিস্টারের শেষ সপ্তাহে শিক্ষক কেমন পড়ালেন সেটি গোপন ফর্মে শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে ফিডব্যাক থেকে নেয়া হয়। সেখানে খারাপ মূল্যায়ন পেলে আর কিছু না হোক, সহকর্মীদের মাঝে ছোট হতে হয় নিশ্চয়। এই রেটিং নেয় বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। শিক্ষকরা রেটিং থেকে প্রতিনিয়ত শেখেন ও শেখান।
শ্রেণিকক্ষে পড়ালেখা ও পরীক্ষা এখানে পরস্পর সম্পর্কিত কিন্তু পরীক্ষা খুব বিশাল ব্যাপার না। আগেই বলেছি বাড়ির কাজের কথা। পুরো সেমিস্টারে পড়া এমনভাবে ভাগ করা যে, চাপ একটানা পড়ে না। পরীক্ষা মানে সিলেবাস বড় এখানেও, কিন্তু নিয়মিত ক্লাস করলে আর বাড়ির কাজ করলে পড়া জমে না, ফলে সিলেবাসও বড় লাগে না। আমার গবেষণা সুপারভাইজারকে আমি বলছিলাম, আমার অক্টোবরের প্রথম সপ্তাহে মিড টার্ম। তিনি বললেন সেপ্টেম্বরের শেষ দু’দিন উইকেন্ড তখন পড়বা! দেশে তো এটি চিন্তাও করা যাবে না যে, দুই দিন পড়ে পরীক্ষা দিব। এখানে এটিই স্বাভাবিক।
ফলাফল কীভাবে প্রস্তুত হয়? শিক্ষকরা বাড়ির কাজ গ্রেডিং করেন না। সব কোর্সেই সেই শিক্ষকের শিক্ষা সহকারী/ গ্রেডার থাকে। এই সহকারীরা সাধারণত এই কোর্স আগেই করে ফেলা কোনো সিনিয়র গ্রাজুয়েট শিক্ষার্থী হন। তিনি বাড়ির কাজ গ্রেডিং করেন, ইন ক্লাস কুইজের খাতা দেখে নাম্বার দেন। কেবল সেমিস্টার ফাইনাল পরীক্ষা বা মিড টার্মের প্রশ্ন করা, খাতা দেখা, নাম্বার দেয়া ইত্যাদি কাজগুলো শিক্ষক নিজে করেন।
সুতরাং শিক্ষকরা নিজের মতো পড়ান। শিক্ষার্থীদের গ্রেড কমে যাবে কঠিন বিষয়টা পড়ালে এসব দেখার দায়িত্ব শিক্ষকের না বলেই মনে হয়। দেশে গ্রেড কম পেলে অনেক সময় অনেকে পুনর্মূল্যায়নের আবেদন করে; সেটি এখানে হয় না। কারণ গ্রেডিং, প্রশ্ন করা আর পড়ানো এখানে আলাদা বিষয় হিসেবে দেখা হয়। কোনো ব্যাক্তিক রেষারেষিতে গ্রেড কমে যাবার সম্ভাবনা থাকে না।
শিক্ষার্থীরা শ্রেণিকক্ষে পড়ালেখা নিয়ে আগ্রহী, সবাই শেখার জন্য আগ্রহী। মূলত আমেরিকান শিক্ষার্থীরা সবাই ব্যাচেলর করছে একটি ভালো চাকরি পাবে সে আশায়। ব্যাচেলর পড়তে যে খরচ, তা তাদের বাবা-মা দিচ্ছে না। তারা ইতিমধ্যে ১৮ বছর পার করেছে সুতরাং অ্যাডাল্ট। নিজে পার্টটাইম কাজ করে বা ব্যাংক থেকে মোটা অংকের লোন নিয়ে পড়া চালাচ্ছে। এই টাকা চাকরি পেয়ে শোধ করবে।
সুতরাং তাদের ভালোই গরজ আছে বিষয় বোঝার আর শেখার। চীনা বা ভারতীয় শিক্ষার্থীরাও অনেকে ফান্ডিং ছাড়া চলে এসেছে। তারা ভালো ফলাফল করে শিক্ষকের নেক নজরে পড়ার চেষ্টা করে। তাতে ওই শিক্ষকের ল্যাবে সহকারী হিসেবে ঢুকে পড়ার চেষ্টা থাকে, ও সম্ভাবনাও থাকে। এতে শিক্ষার্থীর নিজের আর্থিক চাপ কমে। তাই তারাও ক্লাস করায় আগ্রহী থাকে।
চাকরির বাজার জেনেই শিক্ষার্থীরা ডিগ্রির বিষয় ঠিক করে। যেহেতু টাকা দিয়ে পড়বে, উপযোগ আছে এমন বিষয়েই পড়ে। অপ্রচলিত ডিগ্রিতে চাকরি এই দেশেও নাই। কারো আগ্রহ বেশি হলে সে ডাবল ডিগ্রি নেবে। কিন্তু অনাগ্রহের বিষয়ে চান্স পেয়ে পড়া বা চাকরি নাই তাও পড়ি কারণ চাকরির আবেদনে ব্যাচেলর ডিগ্রি লাগবেই—এটি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে চলে না। যে ব্যাচেলর ডিগ্রি পড়বে সে জেনেই পড়বে কেন পড়ছে, কীভাবে পড়ছে, চাকরি কী বা ভবিষ্যৎ কী? ফলে দেশে যে একটি মনোযোগবিহীন শিক্ষার্থীর ঢল, সেটি এখানে নাই।
দেশে শিক্ষার্থীরা ঘণ্টার পরে ঘণ্টা ফেসবুক ব্যবহার করে বা গেম খেলে। এটি এখানে নেই। এরা আনন্দ করে, কাজ করে নির্দিষ্ট সময়ে। সারা সপ্তাহ পাগলের মতো পরিশ্রম করে সাপ্তাহিক ছুটিতে যা মন চায় করে। আর দেশে অনেক শিক্ষার্থী দেখা যায় যারা এক লাইন প্রোগ্রামিং কোড লিখতে তিনবার ফেসবুক হোমপেজ রিফ্রেশ দেয়! ওরা এখানে অনেক বহির্মুখী। আমেরিকান ফুটবলের সেই রমরমা! দিনশেষে বার কিংবা ডিস্কোতে বড় বড় লাইন। অবশ্য দেশে তো খেলার মাঠও নাই, ফেসবুক আর ভিডিও গেম ছাড়া উপায় কী?
টিউশনি এখানেও আছে কিন্তু ধরনটি একটু অন্য রকম। নোটিশ বোর্ডগুলাতো কিছু ছোট ছোট স্টিকার ঝোলে। ‘ফর এলজেব্রা কল পল’ বা ‘নিড হেল্প ইন জাভা কল আভা’ ধরনের। এই বিজ্ঞাপনের সাথে ফোন নম্বর ও ঘণ্টাপ্রতি ২০/৩০ ডলার লেখা। কেউ কোনো জায়গায় আটকে গেলে ফোন দিয়ে কথা বলে ঘণ্টাচুক্তি ঠিক করবে, লাইব্রেরিতে বসে সাহায্য নিবে। সমস্যা কেউ সরসরি গাইড বইয়ের মতো সমাধান করে দিবে না। হয়তো সমস্যাটি বুঝতে সাহায্য করবে, সমাধানের সূত্র ধরিয়ে দেবে। দেশে স্কুল-কলেজের ছাত্রছাত্রীদেরকে যেমন মুখে তুলে খাওয়ানো লাগে, সেরকমটি কেউ করে না বা কেউ চায়ও না।
আর ছাত্ররাজনীতিও দেশের মতো নয়। এখানেও ডেমোক্রেট-রিপাবলিক ছাত্রসংগঠন আছে। তারা একসাথে হয়ে সভ্যভাবে দেশের নিয়মনীতি নিয়ে আলাপ আলোচনা করে। অপছন্দনীয় নিয়মনীতির প্রতিবাদও করে প্ল্যাকার্ড নিয়ে, কিন্তু মতে না মিললে মারপিট করে না। বিশ্ববিদ্যালয় অচল করে দেয় না দিনের পর দিন। সব আন্দোলন শান্তিপূর্ণভাবে শেষ হয়।
পিএইচডি করতে আসার পর এই হলো আমার বিদেশে বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়ালেখার সংস্কৃতির পাঠ। দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ে অন্য সবকিছু গুরুত্ব পায়, পড়ালেখা ছাড়া। এমন কথাও বলতে শুনেছি যে, ক্লাসে নাকি জীবনের যা দরকার, তার মাত্র ৫% পাওয়া যায়, বাকিটা ক্লাসরুমের বাইরের পাঠ। অথচ এখানে ক্লাসরুমে পড়ালেখার গুরুত্ব সর্বোচ্চ। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ালেখার পরিবেশ না ফিরিয়ে আনলে শিক্ষার্থীরা ক্লাসে যাবে কেন? শিক্ষকরাই বা ক্লাস নেবে কেন?
বাংলাদেশের শিক্ষা ওয়েবসাইটের জন্য এই লেখাটি তৈরি করেছেন মোঃ মহসিনুর রহমান আদনান।
লেখক পরিচিতি
সম্পাদক বাংলাদেশের শিক্ষা
এই লেখাটি সম্পাদক কর্তৃক প্রকাশিত। মূল লেখার পরিচিত লেখার নিচে দেওয়া হয়েছে।