সরকারি হিসেবে এখন পর্যন্ত ৩১৭টি মাধ্যমিক বিদ্যালয় রয়েছে। একই মন্ত্রণালয় এবং অধিদপ্তরাধীন হলেও অভ্যন্তরীণ শিক্ষা ব্যবস্থাপনায় বিদ্যালয়গুলোর মধ্যে বিস্তর বৈসাদৃশ্য লক্ষ্য করা যায়। বিদ্যালয়গুলোতে স্টাফিং প্যাটার্ন, শ্রেণী, শিফ্ট, লিঙ্গ এবং আরও কিছু বিষয়ের পরিপ্রেক্ষিতে পার্থক্য বিদ্যমান। তাছাড়া সুষ্ঠু তদারকি এবং নিয়ন্ত্রণের অভাবে শিক্ষকগণের আচরণগত পার্থক্যও রয়েছে। এই পার্থক্যগুলো আপাতদৃষ্টিতে খুব স্বাভাবিক মনে হলেও বিদ্যালয়ের পাঠদান কার্যক্রম ও কোমলমতি শিক্ষার্থীদের ফলাফলে বেশ প্রভাব পড়ে।

মো. জালাল উদ্দিন লিখেছেন শিক্ষা ব্যবস্থাপনা নিয়ে

সরকারি হিসেবে এখন পর্যন্ত ৩১৭টি মাধ্যমিক বিদ্যালয় রয়েছে। একই মন্ত্রণালয় এবং অধিদপ্তরাধীন হলেও অভ্যন্তরীণ শিক্ষা ব্যবস্থাপনা বিদ্যালয়গুলোর মধ্যে বিস্তর বৈসাদৃশ্য লক্ষ্য করা যায়। বিদ্যালয়গুলোতে স্টাফিং প্যাটার্ন, শ্রেণী, শিফ্ট, লিঙ্গ এবং আরও কিছু বিষয়ের পরিপ্রেক্ষিতে পার্থক্য বিদ্যমান। তাছাড়া সুষ্ঠু তদারকি এবং নিয়ন্ত্রণের অভাবে শিক্ষকগণের আচরণগত পার্থক্যও রয়েছে। এই পার্থক্যগুলো আপাতদৃষ্টিতে খুব স্বাভাবিক মনে হলেও বিদ্যালয়ের পাঠদান কার্যক্রম ও কোমলমতি শিক্ষার্থীদের ফলাফলে বেশ প্রভাব পড়ে। যতদূর সম্ভব পার্থক্যগুলো কমিয়ে আনা হলে বিদ্যালয়ের সার্বিক পরিবেশের ওপর ইতিবাচক প্রভাব পড়বে বলে আশা করা যায়।

রাজশাহী অঞ্চলের মোহনপুর সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষকসহ সহকারি শিক্ষকের পদ সংখ্যা মাত্র ৬। এই ৬ জন শিক্ষক দিয়ে স্কুলটি কীরকম বেহাল অবস্থায় আছে তা বলাই বাহুল্য। ছাত্রী মাত্র ১০ জন। ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক জনাব আবু বকর সিদ্দিক জানালেন, শিক্ষকস্বল্পতার কারণে এই বিদ্যালয়ে ছাত্রীরা ভর্তি হতে চায় না। অনেক সুযোগ-সুবিধা দিয়ে ভর্তি করলেও কিছুদিন পরেই তারা পার্শ্ববর্তী মোহনপুর সরকারি বিদ্যালয়ে চলে যায়। অধিকাংশ সরকারি স্কুলে বালক অথবা বালিকা ভর্তির রীতি প্রচলিত থাকলেও কোনো কোনো বিদ্যালয়ে কো-এডুকেশন বা সহশিক্ষা ব্যবস্থা প্রচলিত যা পার্শ্ববর্তী বালক বা বালিকা বিদ্যালয়ে নেতিবাচক প্রভাব পড়ে।

একই অবস্থা নাটোরের সিংড়া উপজেলার সিংড়া দমদমা সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে। এখানেও ছাত্রী এবং শিক্ষক সংখ্যা অপ্রতুল। শিক্ষকস্বল্পতার কারণে ছাত্রীরা পার্শ্ববর্তী একটি বেসরকারি বিদ্যালয় যেখানে সহশিক্ষা ব্যবস্থা প্রচলিত সেখানে ভর্তি হয়। শিক্ষকরাও এ ধরনের বিদ্যালয়ে থাকতে চায় না। সম্প্রতি বদলিকৃত শিক্ষক জনাব শাহজাহান রেজা জানালেন, স্কুলটিতে বর্তমানে শিক্ষক সংখ্যা ৭ এবং ছাত্রী সংখ্যা ১৫০ জনের মতো। যে কারনে তিনি হীনমন্যতায় ভুগছেন এবং বদলির চেস্টা করেছেন। বলাবাহুল্য, উপজেলা পর্যায়ের প্রতিটি বিদ্যালয়ের অবস্থা কমবেশি একই রকম। প্রতিটি বিদ্যালয়ের স্টাফিং প্যাটার্নে ভিন্নতা রয়েছে।

আশির দশকে তৎকালীন সরকার যে সমস্ত বিদ্যালয় জাতীয়করণ করেছিল সেগুলোর অধিকাংশই ৬ষ্ঠ শ্রেণী থেকে ১০ম শ্রেণী পর্যন্ত। স্বাধীনতা-পূর্ব জাতীয়করণকৃত বিদ্যালয়গুলোর কিছু কিছু ৩য়-১০ম শ্রেণীবিশিষ্ট এবং কোনো কোনোটি ১ম-১০ম শ্রেণীবিশিষ্ট। এসমস্ত সংযুক্ত প্রাথমিক বিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত শিক্ষার্থীদেরকে উচ্চ-বিদ্যালয়ের নিজস্ব সিলেবাস অনুসরণ করতে হয় বিধায় তাদের ওপর বাড়তি চাপ পড়ে।

নব্বইয়ে দশক পর্যন্তও ডাবলশিফ্টভুক্ত বিদ্যালয়ের সংখ্যা ছিল ৬২। বর্তমান সরকারের আমলে ২০১০ সালে জেলা পর্যায়ে আরো ৮০টি বিদ্যালয়ে ডাবল শিফ্ট খোলা হয়। এ সমস্ত ডাবলশিফ্টভুক্ত বিদ্যালয়েও স্টাফিং প্যাটার্নে ভিন্নতা রয়েছে। নতুনভাবে সৃষ্ট শিফটে কৃষি শিক্ষকের কোনো পদ সৃষ্টি করা হয় নি।

মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের হিসাব অনুযায়ী, ৩১৭টি বিদ্যালয়ের মধ্যে প্রধান শিক্ষক রয়েছেন মাত্র ১১৭টি বিদ্যালয়ে (বেনবেইস, ২০১১)। সহকারী প্রধান শিক্ষকের সংখ্যাও সন্তোষজনক নয়। তাই অধিকাংশ বিদ্যালয়লোতে একজন সিনিয়র সহকারী শিক্ষক প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব পালন করেন। বিভাগীয় পর্যায়ের বিদ্যালয় ছাড়া সব বিদ্যালয়েই ব্যাপক শিক্ষক সংকট রয়েছে। সুষ্ঠু শিক্ষা ব্যবস্থাপনা নিশ্চিতে এটি একটি অন্তরায়।

অধিকাংশ প্রধান শিক্ষক এবং সহকারী প্রধান শিক্ষক সাধারণত কোনো ক্লাস নেন না এবং পরীক্ষার উত্তরপত্রও মূল্যায়ন করেন না। যদিও শিক্ষক হিসেবে তাঁদের সপ্তাহে কমপক্ষে ১২টি ক্লাস নেওয়ার বিধান রয়েছে। কিছু তোষামুদি সিনিয়র শিক্ষকও সপ্তাহে ১০/১২টির বেশি ক্লাস নিতে অনাগ্রহ প্রকাশ করেন। ফলে সাধারণ শিক্ষকদের ওপর অধিকহারে ক্লাস চাপানো হয়ে থাকে। তাছাড়া প্রায় প্রতিদিন অন্তত ২/১ জন শিক্ষক অনুপস্থিত থাকেন। আর শিক্ষকস্বল্পতা তো রয়েছেই। তাই অতিরিক্ত ক্লাস নিতে শিক্ষকদের নাভিশ্বাস উঠে যায়।

প্রতিটি সরকারি বিদ্যালয়ে অভ্যরীণ পরীক্ষার সিলেবাস প্রনয়ন করেন স্ব স্ব বিষয়ের শিক্ষকগণ। বিভিন্ন বিদ্যালয়ের শিক্ষকগণ বিভিন্ন রকম সিলেবাস প্রণয়ন করেন। মন্ত্রণালয়ের সুস্পষ্ট কোনো নির্দেশ না থাকায় কিছু বিষয়ের সিলেবাস প্রণয়নে আইটেম বা বিষয়বস্তুর সংযোজনের ক্ষেত্রে কোনো কোনো শিক্ষকের স্বেচ্ছাচারিতাও পরিলক্ষিত হয়।

রীতি অনুযায়ী প্রায় সকল সরকারি বিদ্যালয়ের শিক্ষকগণকে স্ব স্ব বিষয়ের প্রশ্নপত্রও প্রণয়ন করতে হয়। এই সুযোগে কোনো কোনো অসাধু শিক্ষক তাঁর প্রাইভেট ছাত্রদের মধ্যে প্রশ্নপত্র ফাঁসের সাথেও জড়িত হয়ে পড়েন এবং বিদ্যালয় কর্তপক্ষকে বিব্রতকর অবস্থায় ফেলেন। বিশেষ করে ইংরেজি এবং গণিত বিষয়ের ক্ষেত্রে এটি মাঝে মধ্যে ঘটে থাকে।

যথাযথ কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে মনিটরিং করে এই বৈষম্যগুলো অনেকাংশেই দূর করা সম্ভব। প্রতিটি বিদ্যালয় একই স্টাফিং প্যাটার্নের আওতায় আনা উচিত। জাতীয়করণের সময় কোনো কোনো স্কুলের পদ সংখ্যা কম ছিল। সে সমস্ত স্কুলে নতুন পদ সৃষ্টি করে সমতা বিধান করা আবশ্যক। উচ্চ-বিদ্যালয়ের সাথে প্রাথমিক বিদ্যালয় সংযুক্ত করে রাখা অযৌক্তিক। এতে উচ্চ-বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের কর্মকর্তাদের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করতে গিয়ে বাড়তি ঝামেলা পোহাতে হয়।

একটি বিদ্যালয়ের সার্বিক উন্নয়ন প্রতিষ্ঠার প্রধানের ও তার শিক্ষা ব্যবস্থাপনা বিষয়টির ওপর অনেকাংশে নির্ভরশীল। ভারপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠান প্রধান দিয়ে কাজ চালানো গেলেও অনেক বিষয়েই সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগেন এবং অদক্ষতার পরিচয় দেন। তাই যথাশীঘ্র প্রধান শিক্ষকসহ বিভিন্ন বিষয়ের শিক্ষক নিয়োগ প্রদান অত্যাবশ্যক।

এনসিটিবিকে পুস্তক বিতরনের পাশাপাশি স্কুলগুলোর সাময়িক পরীক্ষার সিলেবাসও বণ্টন করা উচিত। তদনুযায়ী জেলা বা উপজেলা শিক্ষা অফিসারের মাধ্যমে স্বনামধন্য ও অভিজ্ঞ শিক্ষকদের দিয়ে প্রশ্নপত্র প্রণয়ন করানো যেতে পারে।  বলা হয়ে থাকে শিক্ষা জাতির মেরুদণ্ড। কিন্তু শিক্ষা তার চেয়েও বেশি কিছু। প্রকৃতপক্ষে তা জাতির মস্তিষ্কস্বরূপ। পরিকল্পিত শিক্ষা ব্যবস্থাই উন্নত জাতি গঠনের পূর্বশর্ত। সুতরাং একটি সর্বজনিন ও বৈষম্যবিহীন শিক্ষাব্যবস্থা সারাদেশে চালু হোক এটাই সবার কাম্য।

মো. জালাল উদ্দিন:  সহকারী শিক্ষক, নাটোর সরকারি বালক উচ্চ বিদ্যালয়, নাটোর।

Sending
User Review
0 (0 votes)

লেখক সম্পর্কে

সম্পাদক বাংলাদেশের শিক্ষা

এই লেখাটি সম্পাদক কর্তৃক প্রকাশিত। মূল লেখার পরিচিত লেখার নিচে দেওয়া হয়েছে।

মন্তব্য লিখুন