আবদুল্লাহ আল মামুন লিখেছেন আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণা ও শিক্ষকতা নিয়ে

ছয়

গবেষণাকর্ম নিয়ে একটি প্ৰশ্ন প্রায়ই উঠে আসে, সেটি হলো: গবেষণা কর্মের গুণগতমান না পরিমাণগতমান বেশি গুরুত্বের দাবিদার? অনেকে মনে করেন গুণগতমান, আবার অনেকে মনে করেন পরিমাণগতমান। আমি দুটোকেই সমান গুরুত্বের চোখে দেখে থাকি। আমার স্বপক্ষে কিছু যুক্তি উপস্থাপন করছি:

  • দুপুরের খাবার হিসেবে এক চামচ অতি উন্নতমানের বাসমতি চালের ভাত না এক প্লেইট মিনিকেট চালের ভাত বেশি গুরুত্বপূর্ণ? দুপুরের খাবারের জন্যে এক প্লেইট মিনিকেট চালের ভাত বেশি গুরুত্বপূর্ণ নয় কি?
  • ৩৫ থেকে ৪০ বছরের কর্মজীবনে উন্নতমানের সময়-উপযোগী পাঠদানের জন্য কয়েকবার নয়, প্রতিনিয়ত আমাদের মস্তিষ্ক শাণিত করা প্রয়োজন? আমরা সকলেই স্বীকার করতে বাধ্য যে, সময়-উপযোগী তথ্য-উপাত্ত দ্বারা যতো বেশি বার আমাদের মস্তিষ্ক শাণিত করবো, আমরা শিক্ষার্থীদের ততো বেশি উন্নতমানের পাঠদানে সমর্থ হবো।
  • কোনো গবেষকের অনেক গবেষণাকর্মের মধ্যে কোন গবেষণাকর্ম যে তাঁকে তাঁর গবেষণা ক্ষেত্রে একটি বিরাট জায়গা করে দিবে তিনি তা নিজেও জানেন না।
  • ইচ্ছে করলে কেউ বেশি প্রবন্ধের অধিকারী গবেষককে বেশি সন্তান প্রসবকারী ইতর প্রাণীর সাথে তুলনা করতে পারেন যদি তাঁর গবেষণা কর্মের মানদণ্ড (যা নিম্নে বর্ণিত হলো) শূন্যের কোঠায় থাকে।

আমাদের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের world class research করতে বা করাতে স্ব স্ব গবেষণাক্ষেত্রের জার্নালগুলোর মান (Thomson Reuters কর্তৃক নির্ণীত impact factor) এবং পৃথিবীর অন্যান্য গবেষকদের গবেষণাকর্মের তুলনায় নিজের গবেষণাকর্মের মান (তাঁর যেকোনো গবেষণাকর্মের citation সংখ্যা, মোট citation সংখ্যা, impact point, h-index ও i10-index) জানাটা অতি জরুরি

আমাদের নবীন শিক্ষক ও তাঁদের অধীনে গবেষণারত শিক্ষার্থীদের (যাঁরা world class research করতে আগ্রহী) জন্যে গবেষণা কর্মের মানদণ্ড (যেমন citation number, impact factor, impact points, h-index এবং i10-index) সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত কিছু ধারণা প্রদানের চেষ্টা করছি:

  • citation number: কোনো গবেষকের একটি গবেষণাকর্ম যতোবার অন্য গবেষণা কর্মে cited হয়েছে তাকে ওই গবেষণা কর্মের citation number বলে। একজন গবেষকের প্রতিটি গবেষণা কর্মের citation number-এর যোগফলকে ওই গবেষকের গবেষণাকর্মের total citation number বলে। total citation number নির্ণয়ে self-citations গণনায় না আনাই শ্রেয় বলে আমি মনে করি।
  • impact factor: কোনো জার্নালের ২০১৮ সনের impact factor=A/B, এখানে A হলো ২০১৭ সনে ওই জার্নালে প্রকাশিত প্রবন্ধের total citation number এবং B হলো ২০১৭ সনে ওই জার্নালে সর্বমোট প্রকাশিত প্রবন্ধের সংখ্যা।
  • impact point: “কোনো গবেষকের impact points 30” এর অর্থ হলো ওই গবেষকের সকল গবেষণাকর্ম যে ভিন্ন ভিন্ন জার্নালে প্রকাশিত হয়েছে, ওই সকল জার্নালের impact factor-এর যোগফল 30।
  • h-index: “কোনো গবেষকের h-ইনডেক্স 20” তার অর্থ হলো ওই গবেষকের সকল গবেষণা কর্মের মধ্যে কমপক্ষে ২০টি গবেষণা প্রবন্ধের প্রতিটি কমপক্ষে ২০ বার করে cited হয়েছে।
  • i10-index: “কোনো গবেষকের i10-ইনডেক্স 50” তার অর্থ হলো ওই গবেষকের সকল গবেষণাকর্মের মধ্যে কমপক্ষে ৫০টি গবেষণা প্রবন্ধের প্রতিটি কমপক্ষে ১০ বার করে cited হয়েছে।

আমি মনে মনে করি, আমাদের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের world class research করতে বা করাতে স্ব স্ব গবেষণাক্ষেত্রের জার্নালগুলোর মান (Thomson Reuters কর্তৃক নির্ণীত impact factor) এবং পৃথিবীর অন্যান্য গবেষকদের গবেষণাকর্মের তুলনায় নিজের গবেষণাকর্মের মান (তাঁর যেকোনো গবেষণাকর্মের citation সংখ্যা, মোট citation সংখ্যা, impact point, h-index ও i10-index) জানাটা অতি জরুরি। আমার মূল কথা হলো, বিশ্ববিদ্যালয়ে world class research করার পরিবেশ গড়ে তুলতে, আমাদের শিক্ষকদের আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় নামতে হবে, এবং সেই সঙ্গে আমাদের শিক্ষার্থীদেরকেও আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় নামাতে হবে।

সাত

একজন গবেষক ও শিক্ষক নিজে যেমন সার্থক, সফল ও অর্থবহ জীবনের স্বপ্ন দেখে এসেছেন, ঠিক তেমনি তাঁর শিক্ষার্থীদের তাঁর নিজের চেয়েও অনেক বড় বড় স্বপ্ন দেখাতে হবে। সেই সঙ্গে সেই বড় বড় স্বপ্ন বাস্তবায়নের পথও দেখাতে হবে। একজন গবেষক ও শিক্ষককে তাঁর গবেষণাকর্মে ও শিক্ষকতায় সর্বদা সৎ ও আন্তরিক থাকতে হবে যেহেতু তিনি সত্য ও সুন্দর সন্ধানে, সেই সঙ্গে শুদ্ধ ও আকর্ষণীয় পাঠদানে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।

আমরা বড় বড় থিসিস অথবা অনেক গবেষণামূলক প্রবন্ধ প্রকাশ করার চেষ্টা করে থাকি, কিন্তু existing literature-এ অর্ধেক বাক্য যোগ/বিয়োগ করাই যথেষ্ট আমাদের স্ব-স্ব গবেষণা ক্ষেত্রে একটি বিশাল জায়গা করে নেওয়ার জন্য। কিন্তু কোন গবেষণাকর্ম আমাদের এ অর্জন এনে দিবে, তা আমরা নিজেরাও জানি না।

আমরা বড় বড় থিসিস অথবা অনেক গবেষণামূলক প্রবন্ধ প্রকাশ করার চেষ্টা করে থাকি, কিন্তু existing literature-এ অর্ধেক বাক্য যোগ/বিয়োগ করাই যথেষ্ট আমাদের স্ব-স্ব গবেষণা ক্ষেত্রে একটি বিশাল জায়গা করে নেওয়ার জন্য। কিন্তু কোন গবেষণাকর্ম আমাদের এ অর্জন এনে দিবে, তা আমরা নিজেরাও জানি না।

আমাদের একটি কথা ভুলে গেলে চলবে না যে, মনোরম প্রাকৃতিক পরিবেশে চোখভুলানো অট্টালিকা বিশ্বমানের বিশ্ববিদ্যালয় গঠনের একমাত্র নিয়ামক নয়। বিশ্বমানের বিশ্ববিদ্যালয় গঠনের অন্যান্য জরুরি নিয়ামকগুলো হলো:

  • সময়-উপযোগী বিশ্বমানের গ্রন্থ এবং গবেষণাগার (যা সর্বদা সচল থাকবে, যেহেতু আমাদের দেশের সিংহভাগ গবেষণাগারের যন্ত্রপাতি দীর্ঘকাল/চিরকাল অচল অবস্থায় পড়ে থাকা আমাদের গবেষণার একটি বড় প্রতিবন্ধক) প্রতিষ্ঠিত করা;
  • শাণিত মস্তিষ্ক ও সময়-উপযোগী জ্ঞানের অধিকারী নবীন শিক্ষক নিয়োগ প্রদান করা (এ ব্যাপারে বিশেষজ্ঞ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য মহোদয়কে দৃঢ়ভাবে আপোষহীন থাকা একান্ত বাঞ্চণীয় বলে অন্তত আমি মনে করি);
  • নবীন শিক্ষকদের ও সময়-উপাযোগী/বিশ্বমানের গবেষণা ও পাঠদানকে যথাযথ মূল্যায়ন করে বিশ্বমানের গবেষণা ও শিক্ষার উপযুক্ত পরিবেশ তৈরি করা।

একটি বিশ্বমানের উন্নত বিশ্ববিদ্যালয় গঠনে উপাচার্যের ভূমিকা অপরিসীম। আমার ২৭ বছরের গবেষণা ও শিক্ষকতা জীবনের অভিজ্ঞতা থেকে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্যদের ভূমিকার ওপর আমার নিজেস্ব কিছু কথা শেয়ার করছি:

  • অধিকাংশ উপাচার্যই চান তাঁর নেতৃত্বে তাঁর বিশ্ববিদ্যালয়টি গড়ে উঠুক একটি বিশ্বমানের উন্নত বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে, কিন্তু অধিকাংশক্ষেত্রে তাঁর চারপাশবেষ্টিত বেশকিছু স্বার্থান্বেষী চাটুকারদের জন্যে তিনি তা করতে পারেন না।
  • এই স্বার্থান্বেষী চাটুকারদের দল যদি কোনোভাবে সুন্দর মনের একজন উপাচার্যকে অনিয়ম/দুর্নীতিতে জড়িয়ে ফেলতে পারে, তিনি চাইলেও আর তাদের দল থেকে সহজে বেরিয়ে আসতে পারেন না, যেমন সহজে পারে না ডাকাতদল থেকে বিবেক দ্বারা তাড়িত একজন ডাকাতদলের সদস্য।
  • স্বার্থান্বেষী চাটুকারদের দল থেকে বেরিয়ে আসতে ব্যর্থ একজন উপাচার্য একের পর এক অনিয়ম/দুর্নীতি করতেই থাকেন। তখন তাঁর চারপাশের ভালো মানুষদের ভালো পরামর্শও আর ভালোলাগে না। ফলে তাঁর পাশ থেকে ভালো মানুষগুলো ধীরে ধীরে বিদায় নিতে থাকেন। আমার মতে, একটি বিশ্বমানের উন্নত বিশ্ববিদ্যালয় গঠনের প্রত্যয়ে ভালো মানুষগুলি উপাচার্যর পাশ থেকে বিদায় নেয়া সমস্যার সমাধান নয়, বরং উপাচার্যের আরও কাছে থেকে স্বার্থান্বেষী (অর্থ/ক্ষমতালোভী) চাটুকারদের মুখোশ খুলে দিয়ে তাদেরকে উপাচার্যের পাশ থেকে সরিয়ে দেয়াই প্রকৃত সমাধান।

আমার স্বীকার করতে কোনো দ্বিধা নেই যে, আমার প্রিয় জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে কমপক্ষে ৮০% নবীন শিক্ষকই অত্যন্ত মেধাবী ও শিক্ষক হওয়ার যোগ্যতা রাখে। কিন্তু নিয়োগকর্তারা অতি অভিজ্ঞ আম বিক্রেতাদের (যাদের কাজ হলো প্রতি পাঁচটি আমের মধ্যে কমপক্ষে একটি করে পচা আম ঢুকিয়ে দেয়া) মতো প্রতি চার-পাঁচজন যোগ্য মেধাবী শিক্ষকের সাথে একজন করে অযোগ্য শিক্ষক বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়োগ দান করেন। একটি পচা আম নিয়ে আমার যতো না মাথাব্যথা, তার চেয়ে অনেক বেশি মাথাব্যথা এই জন্যে যে, একটি পচা আম বাকি আমগুলোকেও পচিয়ে ফেলতে পারে যেহেতু ব্যধি সংক্রামক, কিন্তু স্বাস্থ্য সংক্রামক নয়।

একটি বিশ্বমানের উন্নত বিশ্ববিদ্যালয় গঠনে নবীন শিক্ষকদের ভূমিকাও অত্যন্ত গুরুত্ত্বপূর্ণ। কারণ অধিকাংশ বিশ্ববরেণ্য বিজ্ঞানীরাই তাঁদের বড় বড় গবেষণাকর্ম তাঁদের ২৫ থেকে ৪৫ বছর বয়সেই করেছেন (যদিও অধিকাংশ ক্ষেত্রে তাঁরা স্বীকৃতি অনেক পরেই পেয়েছেন)। যেমন, Thomson তাঁর ৪১ বছর বয়সে (১৮৯৭ সনে) ইলেকট্রন আবিস্কারের জন্যে ৫৩ বছর বয়সে (১৯০৯ সনে) নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন; রাদারফোর্ড তাঁর ৩৩ বছর বয়সে (১৯০৪ সনে) মূলত এবং র‍্যাডিয়েশন আবিস্কারের জন্যে ৩৭ বছর বয়সে (১৯০৮ সনে) নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন; আইনস্টাইন তাঁর ২৬ বছর বয়সে (১৯০৫ সনে) ফটো-ইলেকট্রিক ইফেক্টের কোয়ান্টাম ব্যাখ্যার প্রদানের জন্যে ৪২ বছর বয়সে (১৯২১ সনে) নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন; বোর তাঁর ২৮ বৎসর বয়সে (১৯১৩ সনে) বোর অ্যাটম মডেল প্রদানের জন্যে ৩৭ বছর বয়সে (১৯২২ সনে) নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন ইত্যাদি।

সুজলা, সুফলা, শস্য-শ্যামলা আমাদের সোনার বাংলার মেধাবী ছেলেমেয়েরা উচ্চশিক্ষা ও গবেষণার জন্য বিদেশ গিয়ে গবেষণার উপযুক্ত সুযোগ ও পরিবেশ পেয়ে এমন ভালো ভালো কাজ করছে, তা শুধু তাদেরকেই স্বনামধন্য করছে না, ধন্য করছে আমাদের, ধন্য করছে আমাদের বাংলা জাতিকে। আমাদের এই মেধাবী ছেলেমেয়েদের অনেকেই দেশে ফিরছে, আবার অনেকে দেশে ফেরছে না। স্বদেশে নিয়োগে অনিয়ম ও অবমূল্যায়নের অভিযোগ ছাড়াও তাদের দেশে না ফেরার পিছনে অনেক যুক্তি রয়েছে। সে যুক্তিতে আমি যাচ্ছি না। দেশে ফেরার জন্যে আমার একটিই যুক্তি রয়েছে। ধরা যাক, একটি শিশুকে একদিকে ছেঁড়া কাপড় পরা তার হতদরিদ্র মা হাত বাড়িয়ে ডাকছেন, অন্যদিকে বিশ্বসুন্দরী (যেমন, ঐশ্বরিয়া রায়) হাত বাড়িয়ে ডাকছেন। শিশুটি কার কাছে যাবে এবং কেন যাবে? আমার বিশ্বাস, ছেঁড়া কাপড় পরা তার হতদরিদ্র মায়ের কাছেই যাবে। কারণ নিজের মায়ের কোলই তার সবচেয়ে প্রিয় এবং নিরাপদ জায়গা। সুজলা, সুফলা, শস্য-শ্যামলা আমাদের এই মাতৃভূমি কি মায়ের কোলের মতো আমাদের সবচেয়ে প্রিয় এবং নিরাপদ জায়গা নয়? পৃথিবীতে আছে কি এমন কোনো জায়গা যা আমাদের মাতৃভূমির চেয়েও বেশি প্রিয় এবং নিরাপদ?

আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, একজন আত্মউৎস্বর্গকৃত গবেষক ও শিক্ষক তাঁর আত্ম-উৎস্বর্গের স্বীকৃতি কোনো না কোনো এক রূপে, কোনো না কোনো একদিন অবশ্যই পাবেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণা ও শিক্ষকতা (যা আমার পেশা থেকে নেশাতে পরিণত হয়েছে) নিয়ে আমার না বলা অনেক জমাটবাঁধা কথাই আমার হৃদয়ের কথা, আমার ভালোবাসার কথা। এ-জন্যেই আমার এ লেখা, যা কোনোভাবেই কাউকে কষ্ট দেয়ার জন্য নয়। তারপরও আমার এ লেখায় কোনোভাবে কেউ কোনো কষ্ট পেয়ে থাকলে আমাকে ক্ষমা করবেন।

আরও পড়ুন: প্রথম পর্ব এখানেদ্বিতীয় পর্ব এখানে

আবদুল্লাহ আল মামুন: অধ্যাপক, পদার্থবিজ্ঞান বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা।

Sending
User Review
0 (0 votes)

লেখক সম্পর্কে

সম্পাদক বাংলাদেশের শিক্ষা

এই লেখাটি সম্পাদক কর্তৃক প্রকাশিত। মূল লেখার পরিচিত লেখার নিচে দেওয়া হয়েছে।

মন্তব্য লিখুন