বাড়ি শিক্ষাক্রম ও পুস্তক

নতুন কারিকুলাম এবং আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা

নতুন কারিকুলাম, নতুন বই; ছবিসূত্র: বিডিনিউজ২৪
নতুন কারিকুলাম, নতুন বই; ছবিসূত্র: বিডিনিউজ২৪

আমরা সাইকেল চালানো শিখি মাঠে। তার অর্থ এই নয় যে, সাইকেল সবসময় মাঠেই চালাতে হবে। মূলত রাস্তায় সাইকেল চালানোর প্রস্তুতি আমরা নেই মাঠে। একইভাবে আমাদের পাঠ্যবই জীবনের প্রস্তুতির জন্য, শুধু পাঠ্যবই নিযে ব্যস্ত থাকার জন্য নয়। পাঠ্যবইয়ের বাইরে থেকে প্রশ্ন করা হলে সংশ্লিষ্ট সবাই একবাক্যে বলে ওঠেন যে- বইয়ের বাইরে থেকে প্রশ্ন এসেছে। অর্থাৎ সবাই ধরে নিয়েছে- বই থেকে হুবহু প্রশ্ন আসতে হবে। হ্যাঁ, ছাত্রছাত্রীদের বয়স অনুযায়ী প্রশ্ন হতে হবে, তা সে যে বিষয়েরই হোক। এই বিষয়টিও শিক্ষক তথা প্রশ্নপ্রণেতাদের ভালোভাবে জানতে হবে। ইংরেজি, গণিত ও বিজ্ঞান বিষয়গুলো বরাবরই কঠিন বলে মনে করা হয়। বিজ্ঞান পড়ার ভয়ে অনেকেই এখন বিজ্ঞান পড়া ছেড়ে দিয়েছে। এখন বিজ্ঞানের শিক্ষার্থী পাওয়া দুষ্কর, বিশেষ করে গ্রামাঞ্চলে। কারিকুলাম ঠিকমতো হচ্ছে কি? গণিতে ফিগার পরিবর্তন করে দিলে শিক্ষার্থীরা তখন আর গণিত পারে না; অর্থাৎ তাদের ভিত্তিটা ঠিকমতো গড়ে ওঠেনি। আর ইংরেজির ক্ষেত্রে পাশের হার বেড়েছে পাল্লা দিয়ে, কিন্তু বাস্তব জীবনে ইংরেজি ব্যবহার করার ক্ষেত্রে দৈন্যতা পূর্বের চেয়েও প্রকট। ইংরেজিতে শিক্ষার্থীদের দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য জাতীয় শিক্ষাক্রম এবং পাঠ্যপুস্তক বোর্ড কর্তৃপক্ষ নিরন্তর পরিশ্রম করে যাচেছ। দেশব্যাপী ওয়ার্কশপ করছে কিন্তু অবস্থার কতোটা পরিবর্তন হবে জানি না। কারণ শিক্ষক, প্রতিষ্ঠান, সমাজ, প্রশ্নপ্রণেতা, শিক্ষার বাণিজ্যিকীকরণ এবং রাজনীতিকরণ ইংরেজিতে পাশ করা এবং ইংরেজি জানার ক্ষেত্রে মারাত্মক প্রভাব ফেলে।

জুন মাসের শেষের দিকে দিনাজপুর গিয়েছিলাম দাপ্তরিক কাজে। তিনটি বেসরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয় পরিদর্শন করেছি। জানতে পারলাম ষষ্ঠ, সপ্তম এবং অষ্টম শ্রেণিতে মাসিক বেতন ২৮ টাকা এবং নবম ও দশম শ্রেণিতে ৩৮ টাকা। অন্য একটি বিদ্যালয়ে ছাত্রছাত্রীদের কাছ থেকে বছরে একবার ৫০০ টাকা নেয়া হয়, তাও সবাই দিতে পারে না। শিক্ষকরা স্কুল থেকে কিছুই পান না, শুধু সরকারি অংশই পান। দ্বিতীয়টিতে শিক্ষকরা আগে কিছু পরিমাণ ’বোনাস’ পেতেন, বর্তমানে কমিটি তা দিচ্ছে না কারণ বিদ্যালয়ের উন্নয়নকাজ চলছে। এই যখন শিক্ষকদের অবস্থা, তখন প্রাইভেট তারা কেন পড়াবেন না? ইংরেজি সংবাদপত্র নিউ এইজের ২৩ জুন তারিখে একটি রিপোর্ট দেখলাম- ঢাকার খুব কম সংখ্যক বিদ্যালয়ই সরকারের দেয়া নীতিমালা প্রাইভেট পড়ানোর ক্ষেত্রে মেনে চলে। একটি গোপন প্রতিবেদন থেকে জানা যায় যে, দেশের ৩৫০০ শিক্ষক ৩০০ বিদ্যালয়ে প্রাইভেট নামক ব্যবসা রমরমা অবস্থাতেই চালিয়ে যাচ্ছেন। আমার বিশ্বাস- এ সংখ্যা ৩০০ বা ৩৫০ নয়, তারচেয়ে অনেক বেশি হবে।

আমার সহকর্মী ড. বিশ্বজিৎ রায়ের ছেলে ঢাকার রেসিডেনসিয়াল মডেল স্কুল ও কলেজে ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়ে। সেখানকার ইংরেজি শিক্ষক তাঁর ছেলেকে প্যারাগ্রাফ লিখতে দিয়েছে ‘হাউসমেকার’। ছেলে হন্যে হয়ে খুঁজছে কোথায় পাবে প্যারাগ্রাফটি। শেষে আমার শরণাপন্ন হলো। আমি বললাম ‘হাউস ওয়াইফ’ কিংবা ‘হাউসমেকার’ একই বিষয়। আমি জিজ্ঞেস করলাম- শিক্ষক এই প্যারাগ্রাফ লেখার জন্য কোনো ধরনের সংকেত/হিন্টস দিয়েছে কিনা। বললো, না, কিছুই দেয়নি। শুধু বাসা থেকে প্যারাগ্রাফ লিখে আনতে বলেছে। এই বিষয়টির মধ্যে অনেক কিছু লুকিয়ে আছে।

প্রথমত, ইএলটি (ইংলিশ ল্যাংগুয়েজ টিচিং) এবং সিএলটি (কমিউনিকেটিভ ল্যাংগুয়েজ টিচিং)-এর যুগে ছাত্রছাত্রীরা প্যারাগ্রাফ মুখস্থ করবে না। শিক্ষক ক্লাসে আলোচনা করবেন কীভাবে কোন বিষয় লিখতে হয়। দলে, জুটিতে, চেইনড্রিলে এবং সমস্ত ছাত্রছাত্রীদের অংশগ্রহণে কীভাবে কোনো নতুন বিষয় কিংবা জানা বিষয়ে কোনো কিছু লিখতে হয়। যেমন ‘হাউসমেকার’ সম্পর্কেই বলা যায়। শিক্ষক ছাত্রছাত্রীদের জিজ্ঞেস করবেন ‘হোয়াট ইজ ইউর মাদার?’ কোনো কোনো ছাত্রছাত্রী উত্তর দিবে– ‘মাই মাদার ইজ এ টিচার’, কেউ বলবে- ‘মাই মাদার ইজ এ হাউস ওয়াইফ’। তারপর শিক্ষক বলবেন, ‘ও কে, এজ এ হাউজ ওয়াইফ, হোয়াইট ডাস ইয়োর মাদার ডু’। ছাত্রছাত্রীরা কেউ বাংলায় বলবে, কেউ ভাঙ্গাভাঙ্গা ইংরেজিতে বলবে, কেউ ভুল বলবে। শিক্ষকের কাজ হলো তাদের ভুল এবং ভাঙ্গা ইংরেজিগুলো শুদ্ধ করে বোর্ডে লিখে দেওয়া এবং ছাত্রছাত্রীদের মুখে বলানো তাদের বলার দক্ষতা বাড়ানোর জন্য এবং ইংরেজি ভীতি কাটিয়ে ওঠার জন্য। কেউ বলতে না চাইলে উৎসাহ দিয়ে বলাতে হবে। কেউ লজ্জায় বলতে না পারলে তার কাছে গিয়ে আরও দ্বিগুণ উৎসাহ দিতে হবে। কোনো সহজ বিষয় কঠিন করে বলে বাসা থেকে লিখে আনতে দেওয়া কোনো উপযুক্ত এবং আধুনিক যুগের শিক্ষকের কাজ নয়।

এখন প্রশ্ন হচ্ছে, গ্রামের স্কুলের যে বর্ণনা দিলাম সেখানকার কোনো শিক্ষক যদি এই কাজটি করতেন তাহলে আমার এত বেশি কথা বলা বা ব্যাখ্যা দেওয়ার প্রয়োজন ছিল না। বিষয়টি ঘটেছে ঢাকার একটি নামি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে। এই বিষয়গুলো ঢাকার নামীদামী প্রতিষ্ঠানগুলোর শিক্ষকদের জানার কথা। না জানার কারণ হচ্ছে নামীদামী প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদেরকে প্রতিষ্ঠান থেকে বাইরের কোনো ধরনের অনুষ্ঠানে আধুনিক যুগের সেমিনার, সিম্পোজিয়ামে শিক্ষকদের স্কুল-কলেজ থেকে আসতে দেয়া হয় না। এক ধরনের এলিনেশন সৃষ্টি করে রাখে। এসব প্রতিষ্ঠান মনে করে, আমরা বোর্ডের মধ্যে ভালো ফলাফল করছি, আমাদেরকে অন্যরা অনুসরণ করবে। আমরা টিচারদেরকে প্রশিক্ষণে পাঠাবো কেন? আসলে পৃথিবী পাল্টেছে অনেক। শিক্ষাক্ষেত্রে এবং শিক্ষাদানের ক্ষেত্রে পরিবর্তন এসেছে ব্যাপক, যা শুধু নিজের প্রতিষ্ঠানে বসে জানা যায় না। শিক্ষাদানের ক্ষেত্রে নিত্যনতুন পদ্ধতি আবিষ্কৃত হচেছ- এগুলোর সাথে আমাদের এইসব নামিদামি স্কুল-কলেজের শিক্ষকদের পরিচিতি নেই।

তৃতীয়ত, সরকারের যে নতুন নিয়ম শিক্ষকরা প্রাইভেট পড়াবে না- বিষয়টি একেবারেই মানা হচ্ছে না। উক্ত প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক হয়তো তাঁর কাছে প্রাইভেট পড়া ছাত্রছাত্রীদের মাঝে তার কপিপেস্ট করা পারাগ্রাফের নোট  বিতরণ করবেন, অন্যদের সেটি দিবেন না। অথবা, বাকিদেরকে অন্ধকারে রেখে উৎসাহিত করছেন তার কাছে আসার জন্য। এক্ষেত্রে আমার নিজের একটি অভিজ্ঞতার কথা মনে পড়ছে। রাজউক উত্তরা মডেল স্কুল ও কলেজে থাকাকালীন আমার এক সহকর্মী ষষ্ঠ শ্রেণির ছাত্রছাত্রীদের লিখতে দিয়েছেন- ‘বিএনপি গভর্নমেন্টস সাকসেস অ্যান্ড ফেইলার ইন ফোর ইয়ারস’। সপ্তম শ্রেণীর ছাত্রছাত্রীদের লিখতে দিয়েছেন- ‘আমেরিকান ইনভ্যাশন ইন ইরাক’। এখন আমার প্রশ্ন, এই বিষয়গুলো কি ষষ্ঠ এবং সপ্তম শ্রেণির জন্য উপযোগী? দ্বিতীয় প্রশ্ন হচ্ছে, ওই শিক্ষক  নিজে কি লিখতে পারবেন এ ধরনের রচনা? যদি নিজে লিখতে না পারেন তাহলে ছাত্রছাত্রীদের লিখতে দিবেন কেন? প্রাইভেট পড়ানোর জন্য নাকি মুখস্থবিদ্যাকে উৎসাহিত করার জন্য? প্রতিষ্ঠান কর্তৃপক্ষ কি এগুলো দেখেন? আমি হলফ করে বলতে পারি, ঢাকার নামিদামি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রধানরা এগুলোর তোয়াক্কা করেন না। তারা দেখেন সিলেবাস শেষ করা হয়েছে কিনা, এ প্লাস কতজন পাবে ইত্যাদি। জিপিএ-৫ পাওয়া শিক্ষার্থীদের অনেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে পারেনি গতবছর শুধু ইংরেজির কারণে। অথচ ওইসব শিক্ষার্থী ইংরেজিতে এ প্লাস পেয়ে এসেছিলো।

ঢাকার আরেকটি নামকরা বিদ্যালয় আইডিয়াল স্কুল ও কলেজ। সেখানকার এক ছাত্রকে দেখলাম প্রিপজিশন বাংলা অর্থসহ মুখস্থ করছে। জিজ্ঞেস করলাম- ওভাবে মুখস্থ করছো কেন? ছেলেটি উত্তর দিলো, স্যার পুরো বইয়ের (অ্যাডভান্সড গ্রামার) প্রিপজিশন অর্থসহ মুখস্থ করতে বলেছেন, তা না হলে ক্লাসে শাস্তি পেতে হবে। অবাক হলাম শুনে। প্রিপজিশন পড়ানোর যে কত নতুন এবং আধুনিক উপায় আছে তার সাথে খোদ ঢাকা শহরের শিক্ষকের কোনো পরিচিতি নেই! তাহলে ঢাকার বাইরের শিক্ষার্থী এবং শিক্ষকের অবস্থা কতোটা আর ভালো আমরা আশা করতে পারি?

লেখক পরিচিতি

মাছুম বিল্লাহ বাংলাদেশে ইংলিশ টিচার্স অ্যাসেসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ইট্যাব)-এর সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। তিনি পূর্বে ক্যাডেট কলেজ ও রাজউক কলেজের শিক্ষক হিসেবে কাজ করেছেন। কাজ করেছেন ব্র্যাকের শিক্ষা কর্মসূচিতে বিশেষজ্ঞ হিসেবে। তিনি ভাব বাংলাদেশের কান্ট্রি ডিরেক্টর হিসেবেও কর্মরত রয়েছেন। তিনি নিয়মিত শিক্ষাবিষয়ে নানা প্রবন্ধ লিখছেন।

কোন মন্তব্য নেই

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Exit mobile version