মহান শিক্ষা দিবস পালিত হয় ১৭ সেপ্টেম্বরে। শরীফ কমিশন শিক্ষানীতির বিরুদ্ধে এদেশের সচেতন ছাত্রসমাজ আন্দোলন গড়ে তুলে। এতে কয়েকজন শিক্ষার্থী প্রাণ হারান। বিভিন্ন শিক্ষক ও ছাত্রসংগঠন তাই দিনটিকে মহান শিক্ষা দিবস হিসেবে পালন করে আসছে; যদিও রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে ঘটা করে তেমন কিছু আমরা করতে দেখি না।
তবে ২০১০ সালে জাতীয় শিক্ষানীতি হওয়ার পর এর বাস্তবায়ন শুরু হয়। স্বৈরাচারী আইয়ুব সরকার তৎকালীন শিক্ষা সচিব এস এম শরিফের নেতৃত্বে শিক্ষা কমিশনটি গঠন করেছিল যা ছিল চরম বৈষম্যমূলক। সেনা শাসকগণ শিক্ষানীতি প্রণয়ন করলে যা হয়, তাই হয়েছিল এটি। এই কমিশনের অর্থ অনেকটা এরকম— টাকা যার শিক্ষা তার। আর এটি তৎকালীন ছাত্রসমাজ কোনোভাবেই মেনে নেয়নি, মেনে নেয়নি এদেশের কোনো সচেতন মানুষ।
বারুদের মতো জ্বলতে শুরু করে পুরো ছাত্রসমাজ। শরীফ কমিশন যেন আগুনে ঘি ঢেলে দেয়। কারণ এটি ছিলো শিক্ষাকে পণ্য করার একটি চক্রান্ত। শিক্ষা সকলের জন্য নয়, বরং যারা অর্থ ব্যয় করতে পারবে তাদের জন্য। শিক্ষা একটি বিশেষ শ্রেণির হাতে চলে যাওয়ার প্রস্তাব দেয়া হয়। এটিকে সাম্প্রদায়িক শিক্ষানীতি বললেও অত্যক্তি হবে না। এ বৈষম্যমূলক শিক্ষানীতির বিরুদ্ধে সদাজাগ্রত ছাত্রসসমাজ ১৭ সেপ্টেম্বর হরতাল আহবান করে এবং এর সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করে পেশাজীবী, শ্রমিক, কৃষকসহ সর্বস্তরের মানুষ।
১৯৬২ সালের শিক্ষা আন্দোলনই ধীরে ধীরে স্বাধীনতা আন্দোলনের দিকে ধাবিত হয়। সামরিক শাসক আইয়ুব খানের প্রণয়নকৃত বৈষম্যমূলক শিক্ষানীতির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের সচেতন ছাত্রসমাজ। স্বৈরশাসক আইয়ুব খান ক্ষমতা দখলের মাত্র দুই মাস পর ১৯৫৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর একটি শিক্ষা কমিশন গঠন করেন। শরীফ কমিশন নামে খ্যাত এস এম শরীফের নেতৃত্বে যেসব কমিশন ১৯৫৯ সালের ২৬ আগস্ট তাদের প্রতিবেদন পেশ করে। এতে শিক্ষাবিষয়ে যেসব প্রস্তাব ছিলো, তা প্রাকারান্তরে শিক্ষা সংকোচনের পক্ষেই গিয়েছিলো।
প্রস্তাবিত প্রতিবেদনে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষাক্ষেত্রে ছাত্র বেতন বর্ধিত করার প্রস্তাব ছিলো। ২৭ অধ্যায়ে বিভক্ত শরীফ কমিশনের ওই প্রতিবেদনে প্রাথমিক স্তর থেকে উচ্চতর স্তর পর্যন্ত সাধারণ, পেশামূলক শিক্ষা, শিক্ষক প্রসঙ্গ, শিক্ষার মাধ্যম, পাঠ্যপুস্তক, হরফ সমস্যা, প্রশাসন, অর্থবরাদ্দ, শিক্ষার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য বিষয়ে বিস্তারিত সুপারিশ উপস্থাপন করা হয়। আইয়ুব সরকার এই রিপোর্টের সুপারিশ গ্রহণ করে এবং তা ১৯৬২ সাল থেকে বাস্তবায়ন করতে শুরু করে।
১৭ সেপ্টেম্বর সকাল ৯টায় বের হয় ছাত্র-জনতার বিরাট মিছিল। মিছিলটি যখন হাইকোর্ট পার হয়ে আবদুল গণি রোডে প্রবেশ করে, তখনই অতর্কিতভাবে পুলিশ গুলিবর্ষণ শুরু করে। রাস্তায় লুটিয়ে পড়েন বাবুল, গোলাম মোস্তফা, ওয়াজিউল্লাহসহ নাম না জানা অনেক ছাত্র। রাজপথ নরকে পরিণত হয়, কিন্তু পিছু হটতে বাধ্য হয় আইয়ুব সরকার। বৈষম্যমূলক শিক্ষানীতির বাস্তবায়ন আর করতে পারেনি।
এরপর শুরু হয় গণমুখী শিক্ষানীতি প্রবর্তনের দাবিতে আন্দোলন। আর ১৭ সেপ্টেম্বর ছাত্র-জনতার গণআন্দোলনের রক্তাক্ত স্মৃতিবিজড়িত দিনটি প্রতিষ্ঠা পায় মহান শিক্ষা দিবস হিসেবে। কিন্তু জাতীয় পর্যায়ে দিনটি কি সেভাবে গুরুত্ব পাচ্ছে? সকল শিক্ষক কি দিবসটির কথা জানেন? শতকরা কতজন শিক্ষার্থী জানেন? ছাত্রসমাজের এই আত্মত্যাগ জাতি কি স্মরণ করবে না? দিনটি নিয়ে কি মিডিয়ায়ও খুব একটা আলোচনা হয়? আমাদের বুঝতে কষ্ট হয় রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে বিষয়টিকে সেভাবে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে না কেন?
শরীফ কমিশনের শিক্ষা সংকোচন নীতি কাঠামোতে শিক্ষাকে তিন স্তরে ভাগ করা হয়: প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চতর। পাঁচ বছরে প্রাথমিক, পাঁচ বছরের মাধ্যমিক, তিন বছরে উচ্চতর ডিগ্রি কোর্স এবং দুই বছরের স্নাতকোত্তর কোর্সের ব্যবস্থা থাকবে বলে প্রস্তাব করা হয়। উচ্চশিক্ষা ধনিকশ্রেণির জন্য সংরক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়েছিলো। এজন্য পাস নম্বর ধরা হয় শতকরা ৫০, দ্বিতীয় বিভাগ শতকরা ৬০ এবং প্রথম বিভাগ ৭০ নম্বর।
এই কমিশন বিশ্ববিদ্যালয়ে স্বায়ত্তশাসনের পরিবর্তে পূর্ণ সরকারি নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা, বিশ্ববিদ্যালয় কলেজে রাজনীতি নিষিদ্ধ করা, ছাত্র-শিক্ষকদের কার্যকলাপের ওপর তীক্ষ্ণ নজর রাখার প্রস্তাব করে, যা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বায়ত্তশাসনের মূলে কুঠারাঘাত করার শামিল। শিক্ষকদের কঠোর পরিশ্রম করাতে ১৫ ঘণ্টা কাজের বিধান রাখা হয়েছিলো। রিপোর্টের শেষ পর্যায়ে বর্ণমালা সংস্কারেরও প্রস্তাব ছিলো।
বিভিন্ন ছাত্রসংগঠন আইয়ুবের এই শিক্ষানীতির বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়। ঢাকা কলেজ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ বহু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে স্ব স্ব দাবির ভিত্তিতে জুলাই-আগস্ট মাসজুড়ে আন্দোলন চলতে থাকে। বর্তমান শিক্ষক নেতা অধ্যক্ষ কাজী ফারুক এ আন্দোলনের অগ্রভাগে ছিলেন। এ আন্দোলন কর্মসূচির ধারাবাহিকতায় ‘অল পার্টি স্টুডেন্ট অ্যাকশন কমিটি’ ১৭ সেপ্টেম্বর দেশব্যাপী হরতাল কর্মসূচির ডাক দেয়।
ওই দিন সকাল দশটায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে হাজার হাজার মানুষ সমাবেশে উপস্থিত হয়। সমাবেশ শেষে মিছিল বের হয়। জগন্নাথ কলেজে গুলি হয়েছে এমন গুজব শুনে মিছিল দ্রুত নবাবপুরের দিকে যাত্রা শুরু করে। কিন্তু হাইকোর্টের সামনে পুলিশ এতে বাঁধা দেয়। তবে মিছিলকারীরা সংঘাতে না গিয়ে আবদুল গণি রোডে অগ্রসর হয়। তখন পুলিশ মিছিলের পেছন থেকে লাঠিচার্জ, কাঁদানে গ্যাস ও গুলিবর্ষণ করে।
পুলিশের সাথে দ্বিতীয় দফা সংঘর্ষ বাধে ঢাকা কোর্টের সামনে। এখানেও পুলিশ-ইপিআর গুলি চালায়। এতে বাবুল, গোলাম মোস্তফা ও ওয়াজিউল্লাহ শহীদ হন, আহত হন শতাধিক এবং শত শত ছাত্রকে গ্রেফতার করা হয়। ওই দিন শুধু ঢাকা নয়, সারা দেশে মিছিলের ওপর পুলিশ হামলা চালায়। টঙ্গিতে ছাত্র-শ্রমিক মিছিলে পুলিশ গুলি চালিয়ে হত্যা করে সুন্দর আলী নামে এক শ্রমিককে।
সেই থেকেই ১৭ সেপ্টেম্বর পালিত হয়ে আসছে ছাত্রসমাজের শিক্ষার অধিকার আদায়ের লাড়াই-সংগ্রামের ঐতিহ্যের দিবস ‘মহান শিক্ষা দিবস’। বাংলাদেশ নামক ভূখণ্ডের অভ্যুদয়ের সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে জড়িয়ে আছে শিক্ষার সার্বজনীন অধিকার আদায়ের এই আন্দোলন। এই আন্দোলনের বিভিন্ন সূত্র থেকে আমরা যেটি দেখতে পাই, মোট আহতের সংখ্যা ছিলো ২৫৩। ১০৫৯ ছাত্রকে গ্রেফতার করা হয়। ১৮ সেপ্টেম্বর শিক্ষার্থীরা মৌন মিছিল বের করে। প্রতিবাদ দিবস পালনের মাধ্যমে ছাত্ররা ধর্মঘট প্রত্যাহার করে।
সেইদিন পল্টন ময়দানে ছাত্রদের জনসভা অনুষ্ঠিত হয়। ছাত্রদের আন্দোলনের উত্তপ্ত অবস্থায় ১৯৬২ সালের ২৪ সেপ্টেম্বর লাহোরে গণতান্ত্রিক ফ্রন্ট গঠিত হয় সোহরাওয়ার্দি, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, মাওলানা মওদুদি, মাহমুদ আলী, জহিরুদ্দিনের উদ্যোগে। তারপর শুরু হয় ধারাবাহিক আন্দোলন যা চূড়ান্ত লক্ষ্যে পৌঁছে যায় ’৬৯-এর গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে। এসব ঘটনা ধীরে ধীরে আমাদের স্বাধীনতা আন্দোলনের পথের দিকে ধাবিত করে। তবে, একথা সত্যি যে, ৫৮-৫৯ বছর পার হলো, কিন্তু শিক্ষার সার্বজনীন যে আকাঙ্ক্ষা তা কিন্তু পূরণ হয়নি; যদিও আমরা এগিয়েছি অনেক।
মহান ভাষা আন্দোলনসহ সকল প্রকার আন্দোলনে আমাদের ছাত্রসমাজের যে গৌরবোজ্জল ভূমিকা, সেটিকে বেশি বেশি আলোচনায় আনা প্রয়োজন। কারণ বর্তমানে যে ছাত্ররাজনীতি চলছে তা ত্যাগের নয়, ভোগের। বর্তমানের ছাত্রসমাজকে জানতে হবে স্বাধীনতাপূর্বকালে ছাত্রসমাজের যে চরম আত্মত্যাগ ও দেশপ্রেমের কথা। কিন্তু দুঃখের বিষয় হচ্ছে, মহান শিক্ষা দিবসের মতো একটি গুরুত্বপূর্ণ ও ছাত্রসমাজের গৌরবোজ্জল আত্মত্যাগের কথা যেনো আমরা ভুলতেই বসেছি। এ নিয়ে কোথাও কোনো আলোচনা নেই, নেই উচ্ছ্বাস। তারা যেজন্য আন্দোলনে করেছিলেন এবং পাকিস্তানি জান্তার বিরুদ্ধে লড়াই করে শিক্ষা সংকোচন নীতির তীব্র বিরোধিতা করেছিলেন, জীবন উৎসর্গ করেছিলেন, সেই স্বপ্ন কি আজও বাস্তবায়িত হয়েছে?
শিক্ষার লক্ষ্য মনে হচ্ছে যেন একজন কেরানি ও প্রশাসক হওয়া, যেন এসব মানেই জীবনের সব পাট চুকে যাওযা। জ্ঞানের আলোচনা নেই, সৃজনশীলতা নেই, মানবতা নেই, সহমর্মিতা নেই, জাতীয় ইতিহাস ও ঐতিহ্য জানা না জানার বালাই নেই, দেশপ্রেম নেই। একজন উচ্চশ্রেণির কেরানি হওয়ার স্বপ্নে বিভোর থাকে সব উচ্চশিক্ষিতরা। এ কেমন সমাজ আমরা নির্মাণ করেছি যে, একজন সরকারি কর্মকর্তা হওয়াটাই যেন জীবনের সবচেয়ে বড় ব্রত? ‘একটি গণমুখী শিক্ষানীতি প্রবর্তনের দাবিতে ১৯৬২ সালের ছাত্র-জনতার ব্যাপক গণআন্দোলনের রক্তাক্ত স্মৃতিবিজড়িত দিন ১৭ সেপ্টেম্বর। সেই আন্দোলনে ছাত্রসমাজের সঙ্গে সেদিনের বিক্ষোভ মিছিলে মেহনতী মানুষের অংশগ্রহণ ছিলো ৯৫ শতাংশ। স্বতঃস্ফূর্তভাবে বুড়িগঙ্গার ওপার থেকে এপার পর্যন্ত নৌকার মাঝিরা বৈঠা হাতে মিছিলে চলে এসেছেন।
চারটি বড় দাগের ঘটনা বা বিষয় বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ক্ষেত্র প্রস্তত করেছে। সেগুলো মধ্যে একটি হচ্ছে, ’৫২-এর ভাষা আন্দোলন, ’৬২-এর শিক্ষা আন্দোলন, ’৬৯-এর আন্দোলন বা গণঅভ্যুত্থান এবং ’৭০-এর সাধারণ নির্বাচন। ১৭ সেপ্টেম্বর এতো গুরুত্বপূর্ণ দিন হওয়া সত্ত্বেও দিনটি এখনও জাতীয় দিবসের স্বীকৃতি পায়নি। শিক্ষাক্ষেত্রে যুগোপযোগী পরিবর্তন আসেনি, যদিও ১৯৬২-র শিক্ষা আন্দোলন ছিলো বাঙ্গালী জাতির মুক্তির লক্ষ্যে এক মাইলফলক। দূর হয়নি, বরং আরও বেড়েছে গ্রাম ও শহরের মাঝে শিক্ষাবৈষম্য। শিক্ষাদানের ব্যাপ্তি বেড়েছে কিন্তু মান কমেছে সর্বত্র। এই মানহীন শিক্ষা নিয়ে আমাদের ভবিষ্যত প্রজন্ম বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জসমূহ কীভাবে মোকাবিলা করবে, সেটি আমাদের বাস্তব দৃষ্টিকোণ দিয়ে ভাবতে হবে। নিতে হবে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা।
লেখক পরিচিতি
মাছুম বিল্লাহ বাংলাদেশে ইংলিশ টিচার্স অ্যাসেসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ইট্যাব)-এর সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। তিনি পূর্বে ক্যাডেট কলেজ ও রাজউক কলেজের শিক্ষক হিসেবে কাজ করেছেন। কাজ করেছেন ব্র্যাকের শিক্ষা কর্মসূচিতে বিশেষজ্ঞ হিসেবে। তিনি ভাব বাংলাদেশের কান্ট্রি ডিরেক্টর হিসেবেও কর্মরত রয়েছেন। তিনি নিয়মিত শিক্ষাবিষয়ে নানা প্রবন্ধ লিখছেন।