শিক্ষা নিয়ে আতঙ্ক, উদ্বেগ আর পরীক্ষা শেষ না করার বছর ছিল ২০১৩। শিক্ষাথীদের অপূরণীয় হয়েছে রাজনৈতিক সহিংসতার কারণে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, “এই ক্ষতি আলু-পটলের ক্ষতি দিয়ে বিবেচনা করা ঠিক হবে না। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান অনির্ধারিতভাবে বন্ধ থাকায় প্রতিদিন সাড়ে বার কোটি শিক্ষাঘণ্টা বঞ্চিত হয়ে বাঙালি জাতির নতুন প্রজন্ম মনোগতভাবে শুকিয়ে যাচেছ। এ শুষ্কতার বিরূপ প্রভাব পড়বে ভবিষ্যত জাতি গঠনে। এমটি চলতে থাকলে বাঙালি চিন্তাপ্রবণ এবং সরস জাতির বদলে হয়ে উঠবে শুষ্ক ও বিকলাঙ্গ”। জেএসসি বা অন্যান্যপাবলিক পরীক্ষাগুলোতে অশগ্রহণকারীদের সংখ্যা বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, দেশে নিয়মিত শিক্ষার্থীর সংখ্যা প্রায় সোয়া তিন কোটি। তারা তাদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে দৈনিক গড়ে চারটি শ্রেণিঘন্টা শিক্ষকদের কাছে পাঠগ্রহণ করে থাকে, যা পরিসংখ্যান থেকে বেরিয়ে এসেছে। রাশেদা কে. চৌধুরী বলেন, “শিক্ষাক্ষেত্রে যে ক্ষতি হয়েছে তা ভয়াবহ বিপর্যয়ের চেয়েও ভয়াবহ। প্রকৃতির বিপর্যয় একসময় পুষিয়ে ওঠা সম্ভব, কিন্তু শিক্ষার ক্ষতি পুষিয়ে ওঠা সম্ভব নয়। অপর্যাপ্ত শিক্ষার কারণে যে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে, তা জাতিকে প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম বহন করতে হবে”।
কোমলমতি শিক্ষার্থীরা এই উত্তাল রাজনৈতিক ডামাডোলের মধ্যে গত ৪ নভেম্বর জেএসসি পরীক্ষা শুরু করার প্রস্তুতি নিচ্ছিল। কিন্তু প্রথম দিনেই অবরোধ কর্মসূচির কারণে তা পিছিয়ে যায়। ২০ নভেম্বরের পরীক্ষা শেষ হতে আরও কয়েকদিন লেগে যায়। তাদের শারীরিক ও মানসিক যন্ত্রণার মধ্যে পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়েছে। তারপরও তারা যে অভুতপূর্ব সাফল্য দেখিয়েছে সেজন্য তারা জাতির পক্ষ থেকে ধন্যবাদ পাওয়ার উপযুক্ত। এবার রাজশাহী শিক্ষাবোর্ডের পাসের হার ও জিপিএ-৫ প্রাপ্তি অতীতের সকল রেকর্ড ভঙ্গ করেছে। এবার পাসের হার শতকরা ৯৩.৮৮ এবং জিপিএ-৫ প্রাপ্তির সংখ্যা বেড়েছে ৩ গুণেরও বেশি। গত বছর পাশের হাড় ছিল শতকরা ৮৫.০৯ ভাগ। কুমিল্লা বোর্ডের জুনিয়র সার্টিফিকেট পরীক্ষার ফলাফলে সেরা বিশ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মধ্যে শীর্ষস্থান অর্জন করেছে কুমিল্লা জিলা স্কুল। দ্বিতীয় স্থানে আছে নওয়ার ফয়জুন্নেছা সরকারী বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় ও তৃতীয় স্থানে আছে কুমিল্লা মডার্ণ হাই স্কুল। দিনাজপুর শিক্ষাবোর্ডের সেরা দশ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শীর্ষে রয়েছে রংপুর ক্যান্টনমেন্ট পাবলিক স্কুল। যশোরে বেড়েছে পাসের হার, বেড়েছ জিপিএ-৫ প্রাপ্তি ও শতভাগ পাস প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা। যশোর বোর্ডে সেরা ২০-এ খুলনার সাতটি স্কুল জায়গা করে নিয়েছে। এর মধ্যে সরকারী করোনেশন বালিকা বিদ্যালয় প্রথম, জিলা স্কুল তৃতীয় এবং মিলিটারী কলেজিয়েট স্কুল পঞ্চম স্থান দখল করেছে। বরিশাল বোর্ডে পাসের দিক থেকে গত বছরের ন্যায় এ বছর বরিশাল বোর্ড প্রথম স্থান দখল করেছে। এবারে এ বোর্ডে পাসের হার ৯৬.৬০। গত বছরের তুলনায় পাসের হার বেড়েছে ২.৮ শতাংশ। বরিশাল বোর্ডে জিপিএ-৫ প্রাপ্তির ক্ষেত্রে সেরা প্রতিষ্ঠানের মধ্যে এবারও প্রথম স্থানে রয়েছে বরিশাল সরকারী বালিকা বিদ্যালয়। চট্টগ্রাম বোর্ডে জেএসি পরীক্ষায় এবার পাসে হাড় ৮৬.১৩ শতাংশ; গতবারের তুলনায় এবার বেড়েছে ৭.৭৮শতাংশ। সিলেট বোর্ডে সেরা হয়েছে সিলেট ক্যাডেট কলেজ।
এ বছর প্রথমবারের মতো চতুর্থ বিষয়ের নম্বর যোগ হওয়ায় জিপিএ-৫ পাওয়া শিক্ষার্থীর সংখ্যা বেড়েছে। এ সংখ্যা বেড়েছে চার গুণ। মোট ১ লাখ ২৫ হাজার ২৬৫ জন শিক্ষার্থী জিপিএ-৫ পেয়েছে। এটি একটি ভালো পদক্ষেপ। চতুর্থ বিষয়ের নম্বর যদি মূল পরীক্ষায় প্রভাব না ফেলে, তাহলে শিক্ষার্থীরা বিষয়টি ভালোভাবে পড়তে চায় না এবং বিষয়টির গুরুত্ব থাকে না। কাজেই এটি একটি প্রশংসনীয় পদক্ষেপ।
চতুর্থবারের মতো নেয়া এই জেএসসি পরীক্ষায় সার্বিক পাসের হাড় ৮৯.৭১ ভাগ। গত বছর এ পাসের হার ছিল ৮৬ দশমিক ১১ ভাগ। তার আগের বছর ছিল ৮২.৬৭ ভাগ। আর ২০১০ সালে প্রথমবারের মতো নেয়া জেএসসিতে পাসের হার ছিল ৭১.৩৪ ভাগ। এবার জেডিসিতে পাশের হার ৯১.১১ ভাগ। গত বছর ছিল ৯০.৮৭ ভাগ। এর আগের বছর এই হার ছিল ৮৮.৭১ ভাগ।
এবারের রাজশাহী শিক্ষা বোর্ডের অধীনে অনুষ্ঠিত জুনিয়র সার্টিফিকেট পরীক্ষার ফলাফলে ক্যাডেট কলেজ ও রাজশাহীর নামিদামি স্কুলগুলোকে পেছনে ফেলে চমক দেখিয়েছে বগুড়া ক্যান্টনমেন্ট পাবলিক স্কুল ও কলেজ। এছাড়া এবার বোর্ডেও শীর্ষ ২০টি স্কুলের ৮টিই দখল করেছে বগুড়ার স্কুল। পাশের হার সর্বোচ্চ বলে বিবেচিত জিপিএ-৫ প্রাপ্তির সংখ্যা ব্যাপকহারে বেড়েছে। কয়েক বছর ধরে এই ফল প্রকাশকে কেন্দ্র করে সাধারণত স্কুলে স্কুলে ব্যাপক উল্লাস-উদ্দীপনার সৃষ্টি হয়। কিন্তু দেশের বিদ্যমান সহিংস ও উদ্বেগজনক রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে এ উৎসাহে ভাটা পড়ে। বিশেষ করে ঢাকার স্কুল ও মাদ্রাসাগুলোতে ফল সংগ্রহ করেই সন্তুষ্ট থাকতে হয়।
বিগত এইচএসসি পরীক্ষার ফলাফলে বিরোধী দলের হরতালের প্রভাব পড়ে। যে কারণে মোট পাসের হার কমেছিল। কিন্তু এবারও সেই একই ধরনের ঘটনার মধ্যে ফলাফল খারাপ না হয়ে বরং বেড়েছে। এ প্রশ্নের জবাবে শিক্ষামন্ত্রী বলেন, হরতালের মধ্যে বিগত পরীক্ষার ফলাফলে নেতিবাচক প্রভাব পড়ায় আমরা বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে এবার তা উত্তরণের পদক্ষেপ নিয়েছি। কিন্তু সেটি কী? সেটি কি বেশি নম্বর দিয়ে দেওয়া? না অন্য কিছু?
ফাঁস হওয়া প্রশ্নেই নেয়া হয়েছে এবারকার জেএসসি পরীক্ষা। জেএসসির ইংরেজি দ্বিতীয় পত্রের প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়েছে। ১৪ নভেম্বর সারাদেশে এ পরীক্ষা অুনষ্ঠিত হয়। চার দিন ধরে বাজারে প্রশ্নের আকারে যা পাওয়া গিয়েছিল, তার বেশিরভাগ প্রশ্নই হবহু মিলে যাওয়ার পরও শিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং শিক্ষাবোর্ডের কর্মকর্তারা তাকে নিছক ‘সাজেশন’ বলে উড়িয়ে দিয়েছেন। পরীক্ষা বাতিল করেননি। এমনিতেই পরীক্ষা ঠিকমতো নেয়া যাচ্ছিলো না, তার মধ্যে চলতি পরীক্ষা বাতিল করলে এবার হয়তো জেএসসি এবং জেডিসি পরীক্ষা আর নেয়া যেত না। সে বাস্তবতায় এটি হয়তো ঠিক ছিল, কিন্তু প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে।
অভিভাবকরা বলেছেন, গণিতসহ অন্যান্য বিষয়ের প্রশ্নও তারা পেয়েছেন। দেশের ১০টি শিক্ষাবোর্ডের ফোরাম আন্ত:শিক্ষা বোর্ড সমন্বয় সাব-কমিটির আহবায়ক ও ঢাকা শিক্ষাবোর্ডের চেয়ারম্যন অধ্যাপক তাসলিমা বেগম বলেছিলেন, ফাঁস বলে যে প্রশ্ন পাওয়া গিয়েছিল, তার ১০টির মধ্যে ৬টি মিলে গেছে। অভিজ্ঞ শিক্ষকরা সাজশন করলে এরকম মিলে যেতেই পারে। এখানে প্রশ্ন হচ্ছে, অভিজ্ঞ শিক্ষকরা সাজেশন করলে যদি ৬০ শতাংশ প্রশ্ন মিলে যায়, তাহলে কী ধরনের সৃজনশীল প্রশ্ন আমরা চালু করেছি? শিক্ষার্থীরা এবার মোট ১১টি বিষয়ের মধ্যে ৫টি বিষয়ে সৃজনশীল পদ্ধতিতে পরীক্ষা দিয়েছে। বাংলা প্রথম পত্র, বিজ্ঞান/সাধারণ বিজ্ঞান, ধর্ম শিক্ষা, বাংলাদেশ ও বিশ্বপরিচয় এবং ঐচ্ছিক বিষয়ে তারা পরীক্ষা দিয়েছে।
এবার জেএসসি পরীক্ষায় দেশসেরা হয়েছে ভিকারুননিসা নুন স্কুল ও কলেজ। গত ববছর প্রথম হয়েছিল রাজউক উত্তরা মডেল স্কুল ও কলেজ। এবার এ প্রতিষ্ঠানটি তৃতীয় স্থান দখল করেছে। দ্বিতীয় হয়েছে মতিঝিল আইডিয়াল স্কুল ও কলেজ। মোট পাঁচটি মানদণ্ডের ভিত্তিতে ১০০ পয়েন্টের মধ্যে ৯৯.১৩ পয়েন্ট পেয়ে সারা দেশে প্রথম স্থান অধিকার করেছে ভিকারুননিসা স্কুল ও কলেজ। এ পাঁচটি মানদণ্ড হচ্ছে- নিবন্ধিত প্রার্থীদের মধ্যে নিয়মিত পরীক্ষার্থীর শতকরা হার, শতকরা পাসের হার, মোট পরীক্ষার্থীর মধ্যে জিপিএ-৫ প্রাপ্তির হার, পরীক্ষাথীর সংখ্যা ও প্রতিষ্ঠানের গড় জিপিএ।
পাশের হার বিগত বছরের চেয়ে এবার ২.৯৭ শতাংশ বেড়েছে। আর জিপিএ বেড়েছে বিগত বছরের চেয়ে এক লাখ ২৫ হাজার ২৬৬ জন বেশি। এবার অনুত্তীর্ণদের দু-এক বিষয়ে অকৃতকার্য বিষয়ে পরীক্ষা নেয়ার সুযোগ থাকবে না। মন্ত্রণালয় সুত্রে বলা হয়েছে, গতবার তিন বিষয়ে অকৃতকার্যদের নবম শ্রেণীতে ভর্তির পর পরীক্ষায় অংশ নেয়ার সুযোগ দেয়া হয়েছিল। সেটি করা হয়েছিল, নতুনকরে এ ধরনের পরীক্ষা চালুর পরিপ্রেক্ষিতে। এখন থেকে তার আর কোনো সুযোগ থাকবে না। অকৃতকার্যদের নতুন করে পরীক্ষা দিতে হবে। নবম শ্রেণীতে ভর্তি এই পরীক্ষার ফলাফলে ভিত্তিতে করা হবে। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে নেয়া এটি আরেকটি প্রশংসনীয় পদক্ষেপ। আমরা গুণগত শিক্ষার কথা সবাই বলছি, অথচ কীভাবে সে মান নিশ্চিত করা হবে সে পদক্ষেপও তো নিতে হবে। এটি সে ধরনের একটি পদক্ষেপ।
জেএসসি পরীক্ষার ফলাফলের ভিত্তিতেই জুনিয়র স্কলারশিপ বা বৃত্তি প্রদান করা হবে। বর্তমানে সাত হাজার ট্যালেন্টপুলে ও ১৫ হাজার সাধারণ বৃত্তি দেয়া হয়েছে। আগামী একমাসের মধ্যে বৃত্তিপ্রাপ্তদের তালিকা প্রকাশ করা হবে। পরীক্ষার ফলাফল এবং কোটার ভিত্তিতে আগের নিয়মেই বৃত্তিপ্রাপ্তদের তালিকা চূড়ান্ত করা হরে। প্রতিটি ইউনিয়ন কিংবা ওয়ার্ডে দুজন করে ছাত্র ও ছাত্রীকে বৃত্তি দেয়া হবে। তবে এখানে শিক্ষাসংশ্লিষ্ট সবাইকে দৃষ্টি রাখতে হবে যাতে কোনো ধরনের স্বজনপ্রীতি বা দুর্নীতির আশ্রয় নেয়া না হয় বৃত্তিপ্রাপ্তদের তালিকা চূড়ান্ত করতে।
পরীক্ষার্থীদের সাফল্যের জন্য ঢাকা শিক্ষাবোর্ডের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক অধ্যাপক এস এম ওয়াহিদুজ্জামান তিনটি কারণ উল্লেখ করেছেন। তাদের মধ্যে একটি হচ্ছে পড়ালেখার প্রতি শিক্ষার্থী-অভিভাবকদের মনোযোগ বৃদ্ধি হয়েছে। শিক্ষার্থীদের পরীক্ষাভীতি হ্রাস পেয়েছে এবং সৃজনশীল পদ্ধতিতে অভ্যস্থতা বৃদ্ধি হয়েছে। তাঁর মতে, দেশে স্থিতিশীল পরিবেশ থাকলে ফল আরো ভালো হতো। তিনি যথার্থই বলেছেন। মূলত অন্যান্য কারণের মধ্যে এ তিনটি মূল কারণ যোগ হয়েছে জেএসসি এবং জেডিসি পরীক্ষার ফল ভালো হওয়ার পেছনে।
লেখক পরিচিতি
মাছুম বিল্লাহ বাংলাদেশে ইংলিশ টিচার্স অ্যাসেসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ইট্যাব)-এর সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। তিনি পূর্বে ক্যাডেট কলেজ ও রাজউক কলেজের শিক্ষক হিসেবে কাজ করেছেন। কাজ করেছেন ব্র্যাকের শিক্ষা কর্মসূচিতে বিশেষজ্ঞ হিসেবে। তিনি ভাব বাংলাদেশের কান্ট্রি ডিরেক্টর হিসেবেও কর্মরত রয়েছেন। তিনি নিয়মিত শিক্ষাবিষয়ে নানা প্রবন্ধ লিখছেন।